নিখোঁজ

 

আসর নামাজের আজানে মোয়াজ্জিন যখন সুরেলা কণ্ঠে ‘হাইয়া আলাস সালাহ…’ বলে দীর্ঘ একটি টান দিলেন ঠিক তখন বাজার মসজিদের ইমাম মাওলানা আবু দারদা মাহমুদ হাসানের কানে দূর থেকে মৌমাছির গুঞ্জনের মতো একটা শব্দ ভেসে এলো। মাওলানা সাহেব অজু করছেন। অজুর মাঝখানে যেসব দোয়া পাঠ করতে হয়, পাঠ করছেন। এর মধ্যেই আজানের বাক্য শুনে তিনি তারও জবাব দিচ্ছেন।

মোয়াজ্জিনের কণ্ঠে ‘হাইয়া আলাস সালাহ’ শেষ হওয়ার পর মাওলানা সাহেবের উচ্চারিত জবাব পুরোটা শেষ হলো না। অর্ধেক হতে হতে তিনি টের পেলেন, মৃদু গুঞ্জনটা আরো স্পষ্ট হয়ে মসজিদের দিকে এগিয়ে আসছে। মনোযোগটা সেদিকে গড়িয়ে যাওয়ায় জবাবের অর্ধেক অংশ জোরে উচ্চারণ করলেও বাকী অর্ধেকের লয়টা নেমে এলো, শেষ হতে সময় লাগল। মুহূর্তেই তিনি আবার অজুর শুদ্ধতায় নজর দিলেন। আজানের বাক্যগুলোর দিকে নিমগ্ন হলেন। ধীরে-সুস্থে তার অজু শেষ হলো। পশ্চিমাকাশের পানে তাকিয়ে কালিমা শাহাদাৎ উচ্চারণ করে একটু দাঁড়ালেন।

অজুর পর এই সময়টা তার মন অন্য রকম এক আভায় ছেয়ে থাকে। কিছুটা হালকা বোধ করেন। স্রষ্ঠার প্রতি আরো বেশি অনুগত, নিজেকে আরো বেশি পাপী এবং স্রষ্টার ক্ষমা লাভে আরো বেশি আশান্বিত হয়ে ওঠার মিশ্র বোধ তার ভেতরে একই সাথে একটি কান্না এবং আনন্দের অনুরণন তৈরি করে। ঝর্ণার ধারার মতো তা প্রবাহিত হতে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। বিশ্বচরাচর যেন স্নিগ্ধ আলোয় ভাসতে দেখেন তিনি। তাঁর সেই অনুভব আসলে বোঝানোর মতো না।
পার্থিব মায়া, মোহ, লোভ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একান্তই স্রষ্টার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টায়, মাথাটা নত করে মাওলানা সাহেব মসজিদে পা রাখেন। তুলোর মতো নরম পায়ে গিয়ে বসেন মিব্বারের সামনে। ইমামতি করার আগে নিবিষ্ট মনে সুন্নত নামাজ আদায় করেন। হাতে সময় থাকলে তসবিহ তাহলিল করেন। অন্য দিকে মন যেন কিছুতেই ছুটে না যায়, তার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেন না। ফরজ নামাজের আগে কারো সাথে কথা বলেন না। কেউ কোনো প্রশ্ন করলে, খুব প্রাসঙ্গিক না হলে জবাব দেন না। ইশারায় বুঝিয়ে দেন, নামাজ শেষে তিনি প্রশ্নকারীর কৌতূহল মেটানোর চেষ্টা করবেন।

ভেজা হাত-পায়ের পানি কিছুটা শুকানোর পরে মাওলানা সাহেব সুন্নত নামাজের জন্য দাঁড়ালেন। ভেতরে মুসুল্লির সংখ্যা তখনো অল্প, ধীরে ধীরে বাড়ছে। বাইরে অজুখানার সবগুলো কল ছেড়ে দিয়ে একসাথে অনেকে অজু করায় ভেসে আসছে পানি পতনের তীব্র ছড়ছড় শব্দ। মুসুল্লিরা কেউ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন, কেউ নামাজরত। এর মধ্যেই পেছন থেকে একজন লোক এসে মাওলানা সাহেবের পাশে থামলেন। কেউ তাকে চিনতে পারল না। ক্লান্ত এবং পরিপাটি পোশাকের লোকটির দিকে তাকিয়ে মাওলানা সাহেব বুঝতে পারলেন লোকটি তাঁর কাছেই এসেছেন। তিনি কে, কেন এসেছেন মাওলানা সাহেব জানেন না। লোকটি কোনো কথা না বলে পাশেই বসে পড়লেন। চোখের ভাষায় একটি বার্তা আদান প্রদান হয়ে গেলো—হুজুর, আপনি আগে নামাজ শেষ করুন।

ফরজ নামাজের আগে মিনিট পাঁচেক সময় পাওয়া গেল। এই সময়েও লোকটি তাঁর সাথে কোনো কথা বললেন না। মাওলানা সাহেবও আগ্রহ দেখালেন না। কিছুক্ষণ দোয়াদরুদ পাঠ করে জামাতের সময় হলে নিজেই মুসুল্লিদের কাতার সোজা করতে বললেন। যথারীতি নামাজ পড়ালেন। আসরের নামাজে সালাম ফিরিয়ে রাসুল (সঃ) মুসুল্লিদের দিকে ঘুরে বসতেন। মাওলানা সাহেব সেই সুন্নত অনুসরণ করে ঘুরে বসলেন এবং অনুচ্চস্বরে সংক্ষিপ্ত মোনাজাত করলেন।

বাজার মসজিদের মুসুল্লিরা নামাজ শেষে কেউ বসে থাকে না। কিন্তু আজ একজন লোকও কাতার ছেড়ে উঠল না। মসজিদ থেকে বের হলো না। সবারই চোখেমুখে উৎসুক্য। মাওলানা সাহেব মোনাজাত শেষ করে তাঁর সামনে বসে থাকা অচেনা লোকটির দিকে তাকালেন। লোকটি বললেন—হুজুর, আমরা আপনার নিখোঁজ সন্তানের সন্ধান নিয়ে এসেছি। আপনি আমাদের সাথে দ্রুত বাড়ি চলুন।

মাওলানা সাহেব সামনে তাকালেন। মুহূর্তের মধ্যেই মসজিদের জানালা দিয়ে উত্তর এবং দক্ষিণেও তাঁর চোখ গেল। দেখলেন—বিশেষ বাহিনীর লোকজন চারদিক ঘিরে আছে। তাঁর বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ শব্দ তৈরি হলো। অজানা আশঙ্কায় চোখে-মুখে ভাঁজ পড়ল। সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রেখে তিনি উঠে দাঁড়ালেন।

প্রায় এক বছর আগে তাঁর ছেলে, মাঝির ডাঙ্গা কওমী মাদ্রাসার ছাত্র, লুবান আরিফ ইবনে মাহমুদ হাসান নিখোঁজ হয়েছে। ছেলের খোঁজে তিনি কত জায়গায় গেছেন। যেই মাদ্রাসায় লুবান লেখাপড়া করত সেই মাদ্রাসার মেঝ হুজুরের সাথে ছিল লুবানের ভালো সম্পর্ক। মাদ্রাসা থেকেই তাঁর ছেলে নিখোঁজ হলো। অথচ, মেঝ হুজুর, বড় হুজুর, ছোট হুজুর কেউ-ই সঠিক কিছু বলতে পারলেন না। মাওলানা সাহেব আলাদা আলাদা করে শিক্ষকদের সাথে কথা বললেন। ছাত্রদের সাথে কথা বললেন। কারো কাছেই তিনি সন্তোষজনক উত্তর পেলেন না। পরস্পরের কথার মধ্যে বহু ফাঁকফোকর এবং অমিল খুঁজে পেয়ে তিনি থানায় সাধারণ ডায়েরি করলেন। আত্মীয়-স্বজন যে যেখানে আছে, যেখানে ছেলে যেতে পারে, যেখানে যেতে পারে না, সব জায়গায় খোঁজ নিলেন। লুবানের সন্ধান পাওয়া গেল না।

মাওলানা আবু দারদা মাহমুদ হাসান পুত্র শোকে বিমর্ষ হলেন। তাঁর স্ত্রী রাবেয়া বসরী অন্তুপুর থেকে মাঝে মাঝেই বিলাপ করে উঠতে লাগলেন। কিছু দিন তাদের নাওয়া-খাওয়া হারাম হয়ে গেল। পুত্রের নিখোঁজ বা নিরুদ্দেশ হওয়ার কোনো কারণ তাঁরা কোনোভাবেই মেলাতে পারলেন না।

লুবান তাঁদের দ্বিত্বীয় সন্তান। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। লুবানের ছোট দুই ভাইয়ের একজন বাড়ির কাছের মক্তবে আরবি অক্ষরের প্রাথমিক পাঠ নিচ্ছে। তাকেও মাদ্রাসায় ভর্তির প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। একদম ছোটটা এখনো মাতৃস্তন্য ছাড়া হয় নি। আগামী রজব মাসে তার দুই বৎসর পূর্ণ হবে। লুবানের শূন্যতা এতোই বড় হয়ে উঠল, মাওলানা সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী বাকি তিন সন্তানের মাঝখানেও কুয়াশার আড়াল দেখতে লাগলেন। যেন লুবান ছিল বৃক্ষের গুড়ি। সে নেই মানে গাছটাও নেই। গুড়িটা কেউ কেটে নিয়ে গেছে। গাছের বাকি ডালপালা ম্রিয়মান পাতাসহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এদিক সেদিক।

মাওলানা সাহেব দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। তাঁর সামনে পেছনে অচেনা সেই লোকসহ সরকারের বিশেষ বাহিনির কয়েকজন সদস্য। তারও পেছনে মুসুল্লিদের একটি অংশ এবং বাজারের দোকানিদের লম্বা স্রোত। দ্রুত পায়ে হেঁটেও তিনি সবার সাথে তাল রাখতে পারছেন না। তাঁর কষ্ট হচ্ছে।

বাড়ির উঠানে পা দিয়ে তিনি চমকে উঠলেন। তাঁর নিখোঁজ সন্তান বাড়ি ফিরেছে। হারিয়ে যাওয়া লুবান এতদিন পরে তাঁকে দেখেও আব্বা বলে বুকে ঝাপিয়ে পড়ল না। বাবার দিকে একবার তাকিয়েও দেখল না। তার দুচোখ বন্ধ, দেহ স্থির। সে শুয়ে আছে, উঠানের মাঝখানে একটি কফিনের ভেতরে।

মাওলানা আবু দারদা মাহমুদ হাসান মুহূর্তেই পাথর হয়ে গেলেন। একটু আগে তাঁর বুক ঢিপঢিপ করছিল, তাও বন্ধ হয়ে গেল। কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে লুবানের মুখের দিকে তাকালেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অন্তপুরবাসিনী রাবেয়া ছুটে এসে আলুথালু বসনে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। একটা চিৎকার দিয়েই সন্তানের কফিনের ওপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন রাবেয়া। কে, তারা কোনো বেগানা পুরুষ কি নারী—রাবেয়াকে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেলো, মাওলানা সাহেব ওসবের কিছুই খেয়াল করলেন না। তিনি লুবানের মুখটার দিকেই পলকহীন তাকিয়ে রইলেন। পরনের কাফন ভেদ করে ছোপ ছোপ রক্ত তাঁর চোখ এড়াল না। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাদা পোষাকধারী সেই লোকটির দিকে তাকালেন।

কোনো রকম আবেগের ভেতর দিয়ে না গিয়ে লোকটি বললেন—মাওলানা সাহেব, আপনার ছেলে লুবান আরিফ ইবনে মাহমুদ হাসান একটি উগ্রপন্থী গ্রুপের হয়ে কাজ করত। আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পরে আপনি থানায় একটা সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। ছেলের জন্য সম্ভ্যাব্য সব জায়গায় খোঁজ খবর করেছিলেন তাও অজানা নয়।

বাকরুদ্ধ মাওলানা কী বলবেন, বুঝতে না পেরে আরো স্থির হয়ে গেলেন।

লোকটি বললেন—এই গ্রুপের সবাই প্রথমে নিজের পরিচয় আড়াল করে ফেলে। আপনার ছেলের নামও বদলে ফেলা হয়েছিল। তার নাম ছিল তিনটি। কখনো আবু ওসামা আল নাহিয়ান, কখনো জিহাদি ওসামা, কখনো আপারেশন নাহিয়ান নামে কাজ করত সে। সে ছিল বোমা এবং বিস্ফোরক তৈরিতে দক্ষ। তার কাজ ছিল গ্রুপের অস্ত্র, বিস্ফোরক মজুদ এবং বহন করা।

এর পরে মাওলানা আবু দারদা মাহমুদ হাসান নিজের ছেলের সম্পর্কে যা শুনলেন তা বিশ্বাস হতে চাইল না কিছুতেই। লুবান আসলে নিখোঁজ হয় নি। সে পালিয়ে গিয়েছিল স্বেচ্ছায়। নিজের ইচ্ছে থেকেই সে এই গ্রুপে গিয়ে ভিড়েছে। তাদের মতের বাইরে যারা আছে তাদের সবাইকে তারা মনে করে কাফের। সরকার, প্রশাসন, আইন-আদালত হলো তাগুদ। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা হলো কুফরি। তারা মনে করে রাষ্ট্র তাগুদের দখলে আছে। এখন এই তাগুদের অনুসারী সবাইকে হত্যা করতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে আঘাত করতে হবে। এভাবেই দেশ সমাজ, পৃথিবী থেকে তারা কুফরি দূর করতে চায়। এটাই তাদের জিহাদ। তারা একটার পর একটা হত্যা করছে। কখনো ভিন্ন ধর্মের লোক, কখনো নিজ ধর্মেরই ভিন্ন মতাবলম্বী, বাউল, ফকির, খানকার খাদেম, কখনো বিদেশি। কিছুদিন আগে রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁয় তারা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হামলাটি চালায়। দেশি বিদেশি অনেক লোকজনকে জিম্মি এবং হত্যা করে। সেই ঘটনায় সরাসরি হামলাকারীরা পরে বিশেষ অভিযানে নিহত হলেও লুবান বাইরে থাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। চার দিন আগে তাদের সন্ধান পাওয়া যায় ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকায় এক পুরোনো বাড়িতে। অভিযান শুরু হলে কেউ কেউ ধরা পড়ে। কিন্তু লুবান ধরা না দিয়ে আত্মঘাতী হয়। নিজের কাছে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সে আত্মহত্যা করে।

মাওলানা সাহেবের বিশ্বাস হয় না। তিনি কফিনের দিকে তাকান। ছেলের মৃত-ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা মোচড়াতে থাকে। জীবনে কোনো দিন ছেলেকে একটা ফুলের টোকা দেন নি তিনি। ছেলেও কখনো অবাধ্য হয় নি তাঁর। মাথা তুলে যে ছেলে তাকাত না কারো দিকে সে কীভাবে এতো ভয়ঙ্কর হতে পারে! যে কখনো একা সন্ধ্যার পরে বাইরে যেতে সাহস পেত না, সে কীভাবে বোমা বানায়, অস্ত্র চালায়, মানুষ খুন করে? মাওলানা সাহেবের হিসাব মেলে না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন সম্পর্কে তাঁর কানেও কম কথা ভেসে আসে নি। শুধু তিনি না, ভেসে আসা সেসব কথা ডালপালা ছড়িয়ে অনেকের মনেই একটি অবিশ্বাসের জাল তৈরি করে রেখেছে।

মাওলানা সাহেব হঠাৎ সাহসে ভর করে ঘুরে দাঁড়ালেন। লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত ও দৃঢ় গলায় বললেন—আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি না। আপনারাই আমার নিরীহ ছেলেকে ধরে নিয়ে আটকে রেখেছিলেন। আপনারাই তাকে খুন করেছেন। এখন একটা গল্প সাজিয়ে আমার নিস্পাপ ছেলের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের পাপ ঢাকতে চাইছেন।

লোকটি বললেন—‘মাওলানা সাহেব, সত্যি মিথ্যা যাচাইয়ের অনেক পথ আপনার জন্য খোলা আছে। যথেষ্ট সময় চলে গেছে। আপনি ছেলের দাফনের ব্যবস্থা করুন। আমরা কখনো নিজের থেকে কারো লাশ পৌঁছে দেই না। কিন্তু আমাদের এই রহস্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছুতে হবে। রেস্তোরাঁয় দেশি বিদেশি লোকজন হত্যার পর পরিস্থিতি কী হয়েছে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। সামান্য কয়েকজন লোক দেশটাকে ডুবিয়ে দেবে। অল্প বয়সী ছেলেদের মাথায় জিহাদের নামে উন্মাদনা ছড়িয়ে বিপথে নিয়ে যাবে, আর আমরা বসে বসে দেখব, তা হবে না। আমরা এই রহস্যের পেছনে ছুটছি বলেই আপনার সন্তানের লাশ নিজেরাই নিয়ে এসেছি। তার দাফনের পরে আপনার সাথে আমরা কথা বলব। এর পেছনে কারা আছে, কত দূর সেই হাত আমরা তা বের করব।’

মাওলানা আবু দারদা মাহমুদ হাসান আবার ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। সমস্ত দেহ কাফনে ঢাকা। শরীরের সবটুকু ক্ষতবিক্ষত হলেও মুখটাতে তার যেন কোনো ছাপই লাগে নি। মনে হচ্ছে সে ঘুমিয়ে আছে, ডাকলেই উঠে বসবে। তিনি ছেলের দিকে আরো একটু ঝুঁকে মুখটা স্পর্শ করলেন। ছোট্ট বেলায় লুবানের শখ ছিল বাবার পিঠে বসে ঘোড়া ঘোড়া খেলা। ছেলের আবদার রাখতে তিনি হাঁটু ভেঙে ঘোড়া সাজতেন। ছেলে পিঠে উঠে বসত। সবগুলো দাঁত বের করে সে খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ত। মাওলানা সাহেবের মনে হচ্ছে তাঁর ছেলেটা ঘুম থেকে জেগে এখনই বলবে—আব্বা, আপনি ঘোড়া হন। আমি ঘোড়ার পিঠে উঠব। আব্বা, আপনি আমাকে নিয়ে সারা উঠানে আজ একটা চক্কর দেবেন?

মাওলানা সাহেবের বুকের ভেতরে ব্যাখ্যার অতীত এক শূন্যতা তৈরি হয়। এতদিন ছেলে নিখোঁজ ছিল, তিনি আশায় ছিলেন—লুবান একদিন ফিরে আসবে। আজ তিনি জানেন, ছেলে ফিরবে না। আর কোনো দিন ফিরবে না। তুমুল ভাঙনে পিতৃহৃদয়ের দুই তীর খসে খসে পড়তে থাকে। চোখে জলের ধারা নেমে আসে। তিনি ছেলেকে আরো একবার স্পর্শ করতে চান। কপালে গালে চুমু খেতে ইচ্ছে করে। ছেলেকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে রাখতে ইচ্ছে করে। তাঁর লুবান, আদরের লুবান, ঘুমের ভেতরেও যে বাবার বুকটা খুঁজে বেড়াত। বাবার বুকটা না পেলে যার ঘুম আসত না। সেই বুক শূন্য করে দিয়ে কোথায় চলে যাচ্ছে সে? মাওলানা সাহেব ছেলেকে শেষ স্পর্শ করার সুযোগ পেলেন না। তার আগেই কফিনের মুখ বন্ধ হয়ে গেল।

কফিন নিয়ে লাশবাহী গাড়িটা ধীরে ধীরে গোরস্তানের দিকে চলতে শুরু করে। অগুণতি মানুষের সাথে তিনিও হাঁটতে থাকেন। বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসা কান্নার শব্দ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। তখনই মাওলানা সাহেব তাঁর ছেলের নিখোঁজ হওয়ার কয়েকমাস আগের ঘটনাগুলো মেলাতে শুরু করেন।

নিখোঁজ হওয়ার ছয় মাস আগে থেকে চুপচাপ লুবান আরো বেশি চুপচাপ হয়ে যায়। কেউ কিছু জিজ্ঞেস না করলে উত্তর দেয় না। কিছু দিন পরে বাবার কাছে সে একটা মোবাইল ফোনের বায়না করে। ছেলে কখনো কিছু আবদার করে না বলে তিনি অনিচ্ছা সত্বেও লুবানের পছন্দের মোবাইলটা কিনে দেন। তার পর থেকে বেশিরভাগ সময়ে ছেলেকে তিনি মোবাইল ফোনে ওয়াজ নসিহত শুনতে দেখতেন। ঘর থেকে সে বের হতে চাইত না। যেন জগতের সবকিছু থেকে সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

আচমকা এক ঝড় বয়ে যায় মাওলানা সাহেবের মনের ভেতর। তাঁর মনে হয় তিনি ভুল করেছেন। ছেলের সেই বদলে যাওয়ার সময়টা তিনি খেয়াল করেন নি। মোবাইল ফোনে ছেলে কী করত, কী ওয়াজ শুনত, কার ওয়াজ শুনত তাও লক্ষ্য করেন নি। ছেলেকে তিনি অনেক বইপত্র পড়তে দেখেছেন। মাদ্রাসার বই সিলেবাস মনে করে তিনি সেগুলোও কখনো দেখতে চান নি। যে বা যারাই তাঁর ছেলেকে বিভ্রান্ত করুক, মিথ্যে জিহাদের মোহে ভাসিয়ে ভুল পথে নিয়ে যাক, তাঁর মনে হতে থাকে এর দায় তাঁরও। তাঁর মনটা বিষিয়ে ওঠে।

গোরস্তানের মাঠে জানাজার জন্য সবাই দাঁড়িয়ে আছে। এতদিন কতজনের জানাজা পড়িয়েছেন মাওলানা আবু দারদা মাহমুদ হাসান। আজ তিনি নিজের ছেলের লাশ সামনে নিয়ে দাঁড়ালেন। হঠাৎ কী মনে হলো তাঁর। তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন। জানাজার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা লোকেজনের দিকে তাকিয়ে বললেন—ধর্মের নাম দিয়ে মানুষ খুন করা জিহাদ না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যাবে না। রাসুল (সঃ) ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি করায় অতীতে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। নিরীহ মানুষকে হত্যা করা কঠোর অপরাধ। সমাজে অশান্তি সৃষ্টিকারী মানবতার শত্রু, ধর্মের শত্রু। দেশের ক্ষতির নাম জিহাদ না। নিজের জীবন নিজেই শেষ করার নাম জিহাদ না। আত্মহত্যা করা যাবে না, আত্মঘাতী হওয়া যাবে না। পরকালে এর জন্য নির্ধারিত রয়েছে কঠোর আযাব।

মাওলানা সাহেব কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠলেন। তাঁর দুচোখ আগুনের মতো রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। জানাজা না পড়িয়ে তিনি লাশের সামনে থেকে ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগলেন। জানাজার অপেক্ষায় থাকা মানুষের ভেতরে তখন শোরগোল শুরু হলো। তিনি সেদিকে কান দিলেন না। মাগরিবের নামাজের সময় হয়ে আসছে। মাওলানা আবু দারদা মাহমুদ হাসান বড় বড় পা ফেলে মসজিদের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।

 

[email protected]

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত