সিকদার হোসেন কি চাকরিটা ছেড়ে দেবেন? না, এভাবে চলে না। হাতে কলমে যাদের সাংবাদিকতা শিখিয়েছেন তারাই আজ মাথার উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে। হারুন ছেলেটা; লম্বা লিকলিকে, পেছনে মুচড়ে যাওয়া শার্ট, স্যান্ডেল পরে প্রথম যেদিন এসেছিল একটা ফিচার নিয়ে, কী যত্নসহকারে হাতে ধরে ধরে শব্দ, বাক্যগুলো ঠিক করে ছাপিয়েছিলেন তিনি। সেই ছেলেটাই আজ আরও চার পাঁচজনকে নিয়ে অফিসে আলাদা একটা গ্রুপ তৈরি করে একপ্রকার তাকে কোনঠাসা করে রেখেছে।
আর সম্পাদক মহোদয়, সিকদার হোসেনেরই বন্ধুবর, সব দেখেও না দেখার ভান করে আছেন। অথচ সম্পূর্ণ নতুন একটা পত্রিকা এগারো বছরে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা হয়ে ওঠার পেছনে জীবন যৌবনের পুরোটাই তীব্র আবেগ, শ্রম, ভালোবাসায় উৎসর্গ দিয়েছেন তিনি। আজ তারই প্রতিদান পাচ্ছেন।
নিজেকে মাঝে মাঝে মনে হয় বুড়ো ঘোড়া। খাটতে খাটতে সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেললে, তেজহীন ঘোড়াকে রেখে আসা হয় কসাইখানায়। চক্ষুলজ্জার কারনে সম্পাদক অবশ্য ততটা অমানবিক না হলেও, একপ্রকার নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে তাকে। সহযোগী সম্পাদক বানিয়ে বেতন ভাতা ঠিকই দিচ্ছেন, কিন্তু ফিচার বা কলাম লেখা, সম্পাদনা ও অন্যান্য দায়িত্ব অন্যদের হাতে। তার লেখাও ছাপা হয় না ছাপা পত্রিকায়। মাঝে মাঝে অনলাইনে আসে। চোখের সামনে দিয়ে লেখা যায়, ছুঁতে পারেন না। হাত নিশপিশ করে একটা বাক্য, একটা শব্দ ঠিক করে দিতে। না পারার বেদনা কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।
এরকম চাপা একটা যন্ত্রণা নিয়ে সিকদার হোসেনের মতো লোক চাকরি চালিয়ে যেতে পারেন না। সবাই জানে পত্রিকার বড় দায়িত্ব আছেন তিনি।সত্যিকার অর্থে তিনি কোন দায়িত্বেই নেই। এরকম গুমোট-দমবন্ধ পরিবেশের টানাপোড়েনে শেষ পর্যন্ত চাকরিটা তিনি ছেড়ে দিলেন।
০২
চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি লেখালেখিতে মন দিয়েছে ন সিকদার হোসেন। চল্লিশ বছরের লেখালেখির জীবনে গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ মিলিয়ে বই লিখেছেন বিশটির মত। অারও অনেক লিখতে পারতেন। পত্রিকার কাজের চাপে লেখা হয়ে ওঠেনি। নিরবিচ্ছিন্ন অবসরে এখন লিখতে শুরু করেছেন নতুন একটি বই। পত্রিকায় বেশিরভাগ সময় কেটেছে ফিচার বিভাগে। ফিচার নিয়ে নানান অভিজ্ঞতা সহজ ভাষায় লিখছেন নতুন লিখিয়েদের জন্য। প্রকাশকও পেয়ে গেছেন।
পুরোনো পত্রিকা ঘেঁটে নিজের পুরোনো লেখা বের করা, বিভিন্ন বইপত্র ঘাঁটা, রেফারেন্স জোগাড় করা, মাঝে মাঝে লাইব্রেরিতে যাওয়া, নতুন বেই কেনা- চাকুরি ছাড়ার পর এভাবেই নতুন ব্যস্ততায় দুই মাস কেটে গেল চোখের পলকে। বই লেখার কাজও মোটামুটি শেষ পর্যায়ে।
একদিন সকালে পত্রিকা পড়তে পড়তে হঠাৎ একটা বিষয় খেয়াল করলেন সিকদার হোসেন। চাকরি ছেড়েছেন বারবার দুই মাস এগারো দিন। মনের ক্যালেন্ডারে দাগ দেওয়া আছে। অথচ, প্রতিদিনই ছেড়ে আসা পত্রিকার অফিস থেকে তার নামে আগে যে এক কপি পত্রিকা ফ্রী বাসায় আসতো, এখনও আসছে। দীর্ঘদিন পত্রিকায় কাজ করেছেন তিনি। অফিসের নিয়মকানুন বেশ ভালোভাবেই জানেন। পত্রিকায় চাকরি ছাড়ার পরের মাসের প্রথম দিন থেকেই তার নামে ইসুকৃত ফ্রী পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে পত্রিকা আসছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোন ভুল নয় তো?
এসব কী ভাবছেন তিনি। যতসব আজগুবি চিন্তা। পৃথিবী কী এতোটাই নষ্ট হয়ে গেছে! মানুষ কী এতোটাই নিচে নেমে গেছে! দীর্ঘদিন যে পত্রিকায় কাজ করেছেন, চাকরি ছাড়ার পর তারা বুঝি সামন্য ফ্রী পত্রিকাটিও বন্ধ করে দেবে! এতোটা অকৃতজ্ঞ মানুষ এখনও হয়নি। সম্পাদকের সঙ্গে এখনও ফোনে কথা হয় তার। পত্রিকার অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। সম্পর্ক এতো সহজেই নষ্ট হওয়ার নয়। অফিসের রাজনীতি আলাদা বিষয়। মাঝে মাঝে এরকম হীন চিন্তা যেন মাথায় কেন আসে। নিজেকে নিজের কাছে ছোট মনে হয়।
০৩
ফিচার নিয়ে লেখা বইটা বেশ বিক্রি হচ্ছে অনলাইন। প্রি অর্ডার বইয়ে অটোগ্রাফ দিতে যেতে হয়েছিল প্রকাশনীর অফিসে। কয়েকটা বইও এনেছেন সঙ্গে করে। বিশেষ কিছু লোককে দেবেন। ফেরার পথে পত্রিকার অফিসের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মনে পড়ল সম্পাদকের কথা। অবশ্যই তাকে একটা বই দিতে হবে। গাড়ি থেকে নেমে সোজা চলে গেলেন সম্পাদকের টেবিলে। বই দিলেন, গল্পগুজব করলেন, চা খেলেন। অনেকদিন পর সবার সঙ্গে দেখে হওয়ার পর একটা বিষয় খেয়াল করলেন, চাকুরীর সময় যে একটা চাপা মনস্তাত্ত্বিক উত্তেজনা কাজ করতো অফিসে সেটা এখন নেই। সব কিছু ঝরঝরে, স্বাভাবিক। সম্পাদকের টেবিল থেকে উঠে, তিনি গেলেন সার্কুলার বিভাগের প্রধান আকমল চৌধুরীর কাছে। একটা ধন্যবাদ না দিলে চরম অকৃতজ্ঞতা হবে। বিষয়টা খুলে বলতেই, চৌধুরী বিব্রত বোধ করলেন। বললেন, ‘সিকদার ভাই, আপনার মনে হয় কোথাও ভুল হচ্ছে।’
অবাক হলেন সিকদার হোসেন। ভুলে হবে কেন। পত্রিকা যে বাসায় নিয়মিত যাচ্ছে এটা তো মিথ্যা নয়।
চৌধুরী বললেন, ‘আপনি চাকুরি ছাড়ার পরদিন থেকেই আপনার নামে ইস্যুকৃত ফ্রী পত্রিকাটি মিটিংয়ের সিদ্ধান্তেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’
স্তব্দ হয়ে বসে রইলেন সিকদার হোসেন।তাহলে তার নামে প্রতিদিন সকালে পত্রিকা আসে কোথ্থেকে? যদি হকার দিয়ে যেতো, তাহলে মাস শেষে সে পত্রিকার টাকার জন্য আসতো। হতভম্ব হয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। এতো অকৃতজ্ঞ মানুষ। এতো নিচু। সামন্য দশ টাকার পত্রিকাও মিটিং ডেকে বন্ধ করে দিতে হয়। কী এমন ক্ষতি করেছিলেন তিনি ওদের।
বাসায় ফিরলেন না তিনি। হাঁটতে হাঁটতে খুঁজতে লাগলেন কে বা কারা তার নামে বাসায় পত্রিকা পাঠায়। হকারকে ধরলেই সব কথা জানা যাবে। একে ওকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, ইসমাইল নামে এক হকার পত্রিকা দেয় তার বাসার লাইনে। যেন এক আবিষ্কারের নেশায় মেতে উঠেছেন তিনি। যেন এক গোপন রহস্যের গোপন দ্বার খুলতে চলছেন কিছুক্ষণ পর। খুঁজতে খুঁজতে ইসমাইলকে দেখা মিলল গলির মুখে চায়ের দেকানে। কাছে এসে ক্ষাণিকটা উত্তেজিত গলায় সিকদার হোসেন বললেন,’আমার বাসায় কি তুমি পত্রিকা দাও?’
ইতস্তত হয়ে ইসমাইল বলল,’জ্বী স্যার।’
‘তিন মাস ধরে পত্রিকা দিচ্ছ ভালো কথা, বিল নিতে আসো না কেন? তোমার জন্য যতসব উটকো ঝামেলায় জড়ালাম।’
হাত থেকে চায়ের কাপটা নামিয়ে হতচকিত হয়ে ইসমাইল বলল,’কী বলেন স্যার, আপনার থেকে বিল নেবো কেন? আপার কত লেখা পড়েছি পত্রিকায়। হূমায়ুন ফরিদী মারা যাওয়ার পর যে লেখাটা লিখেছিলেন, ওটা পরে তো আমি টানা তিনদিন কেঁদেছি। ওই তিন দিন আমি পত্রিকাও বিক্রি করিনি। ঘরে বসে বসে বারবার পড়েছি আর কেঁদেছি।’ ইসমাইল বলে চলছে,’কয়েক মাস আগে অফিস থেকে ফোন করে বলল, আপনার নামে ফ্রী পত্রিকাটি বন্ধ। কেন বন্ধ সেটা অবশ্য বলেনি। ওনারা বন্ধ করে দিলে কী হবে স্যার, আমি তো বন্ধ করতে পারি না। আপনাকে প্রতিদিন একটা পত্রিকা দিতে পারলে আমার শান্তি। এটার জন্য টাকা দিলে আমার অপমান হবে স্যার।’
মুর্ছিতের মতো দাঁড়িয়ে আছেন সিকদার হোসেন। তার লেখালেখি, সাংবাদিকতার জীবনে এরকম ঘটনার মুখে এই প্রথম পড়ছেন।