নীলাঞ্জনা

 

নীলা আপাদের বাড়িটা ছিল আমাদের বাড়ির ঠিক দুটো বাড়ি পরেই।

নড়াইল শহরে ঢুকে চৌরাস্তা পেরিয়ে গার্লস স্কুলের গা ঘেঁষে যে ইট বিছানো পথ ধরে মহিষখোলা যেতে হয় ওখানে খানিকটা পথ হাঁটলেই চিত্রাকে দেখা যায় সুচিত্রা সেনের মতো গ্রীবা বাঁকিয়ে থাকা চিরযৌবনা রূপে। তার গা বেয়ে ক্বচিৎ দুএকটা ছোট নৌকা যায় বটে কিন্তু তারা সংখ্যায় খানিক বাদে বাদে চিত্রার বুকে ডুব দেয়া শুশুকের মতো নয়। যাদের দেখে আমি ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম। আমার সহপাঠীরা হাসতো। বলতো, তুই আসলে একটা ভীতুর ডিম। তা তারা ভুল কিছু বলতো না। ভীতুর ডিমই তো। নইলে যাকে দেখলে আমার ভিতরটা বাড়ি খেত,স্নায়ুগুলো কেমন দুর্বল হয়ে অবশ করা ভাল লাগায় ছেয়ে যেত ; তার সামনে গিয়ে কোনদিন সে কথা বলা হয়নি। বলা হয়নি নিজের মনে বিড়বিড় করে হাজার বার বলা কথাটি। …নীলা আপা তোমায় ভালবাসি। তোমাকে না পেলে আমি বাঁচতে পারবো না। কখনো যে সে চেস্টা আমি করিনি তাও নয়। খুব একচোট আয়নার সামনে রিহার্সেল করে ,চুলটুল আঁচড়ে পরিপাটি হয়ে তারপর নীলা আপাদের বাসায় গেছি। নীলা আপাকে দেখি তিনি দরজার মুখে বসে তার সেলাই মেশিনটা দিয়ে একমনে জামা বানিয়ে যাচ্ছেন। তার মুখ-কপাল ভরে গেছে বিন্দু বিন্দু ঘামে। কোঁকড়া চুলগুলো ঈষৎ এলোমেলো। খানিক বাদে কপালের সব ঘাম ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ঝেটিয়ে টপাস টপাস করে ফেলে আবার সেলাইয়ে মনোযোগী হলেন। আহা কী অপরূপ দৃশ্য! নীলা আপার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম আমার কাছে কি মোহময় হয়ে ধরা দেয়। আমি আর তাকে কিছু বলতে পারিনা।তিনি সেলাইয়ে চোখ রেখে আমায় প্রশ্ন করেন-‘কি রে সদল ? কি চাস ?

ভ্যাবাচেকা খেয়ে আমি উত্তর হাতড়াতে থাকি। শেষে মিনমিনে গলায় বলি –‘বাগচী বাড়ির বাগানে দারুণ দারুণ ফুলের গাছ দেখে এলাম! এনে দেবো তোমায় ক’টা ?

সাদা সাদা দোলনচাঁপা ,গোলাপী রঙের টাইম ফুল,দুপুরী ফুল লাল লাল-আরো কত কী ।‘

‘তাই নাকি রে ! আচ্ছা দিস তবেক্ষণ। এখন আমাকে বাজার থেকে সুতোর গুটি এনে দে তো দেখি।’

খুশিতে আমার মন নেচে ওঠে।নীলা আপা আমায় দরকারে পাঠাচ্ছে। মানে আমি নীলা আপার কাছে গুরুত্ব রাখি। নইলে এত লোক থাকতে কি আর আমায় বলতেন । খা খা দুপুরে রোদের গুষ্টি কিলিয়ে আমি চৌরাস্তায় ছুটে যাই। মহিষখোলা থেকে কিছু কম দূর নয়, তবু এ তল্লাটে আর দোকানপাট কই বুনো পাড়ার কাছে মুদি দোকানটি ছাড়া। তা সেখানে কি আর সুই-সুতো নিয়ে বসে আছে কেউ। এইভাবে আমি হাত আরানির কাজ করে দিতে দিতে নীলা আপার অপরিহার্য হ্যান্ডস হয়ে উঠলাম। একদিন এক শুভ্র সকালে নীলা আপা তার সব থেকে মুল্যবান জিনিসটি আমার হাতে তুলে দিলেন।

সেদিন ছিল শুক্রবার। আমার স্কুল নাই। কাকডাকা ভোরে উঠে আমি বাগচীবাড়ির পাঁচিল টপকে ফুল গাছের চারা চুরি করতে গেছি নীলা আপাকে দেব বলে। আমার এই একমাত্র চুরি বিদ্যার কল্যানে নীলা আপা তাদের বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গাটায় একটা বাগান করতে পেরেছে। একে একে সব ফুলের গাছ দিয়ে ভরে উঠেছে বাগান। পাতাবাহার ও আছে। ডাল ছিড়ে এনে আমি বোতলের পানিতে ভরে রাখতাম। তারপর শেকড় গজালে নীলা আপার হাতে দিয়ে আসতাম। মাটি থেকে উপড়ানো গাঁদা ফুলের চারায় লেপ্টে থাকা ভয়ংকর দেখতে একটা কালো কুচকুচে লোমখাড়া শুয়োপোকা দেখে গাছের চারাটি প্রথমে ছুড়ে মারি, এরপর সাহস নিয়ে একটা কাঠির সাহায্যে ওটিকে গাছ ছাড়া করি। নীলা আপার জন্য আমি সব করতে পারি। নীলা আপা ,আমার নীলাঞ্জনা। না তার নীল চোখ নেই। আর সে নচিকেতার নীলাঞ্জনা ও নয়। শেখ ইসতিয়াকের নীলাঞ্জনা। মানে আমি ওই গান টি গাইতাম আর কি। কারণে অকারণে। বারে বারে। ‘নীলাঞ্জনা ওই নীল নীল চোখে চেয়ে দেখোনা। তোমার ওই দুটি চোখে আমি হারিয়ে গেছি। আমি বোঝাতেতো কিছু পারিনা।’ আমার ডেঁপো বন্ধুরা অবশ্যি নীলা আপাকে আমার মা বলতো। শুধু তার বয়স আমার থেকে মাত্র দু তিন বছর বড় বলে। এইটুকু অপরাধে আমি তাকে ভালবাসতে পারবো না সেই সংকীর্ণতা আমার মনে তখনো ছিল না ,এমন কি এখনো নেই। সেই দিন মানে যেই দিন তিনি তার অমূল্য জিনিশটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন , এটি যেন আমি পাড়ার বড়ভাই বলে খ্যাত জগলুল ভাইকে দিয়ে আসি লুকিয়ে। সেইদিন পুরো ব্যাপার না বুঝেও যা বুঝেছিলাম তাতে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতে করতে হেটেছিলাম, ‘একদিন তিন-চারটি সন্তানসহ যদি নীলা আপা স্বামী পরিত্যক্তা হয় তবে সেইদিন সে হবে আমার। হবেই আমার।’ আমি তাকে তখন ছাড়বো না। আজ তোমায় আমি গচ্ছিত রাখলাম গো নীলা আপা। ওই গুন্ডা বাউন্ডূলে জগলুলের কাছে। তুমি ভাল থেকো শুধু। আমার এই প্রথম প্রেমের প্রথম ছ্যাঁক খাওয়াকে বন্ধুরা উদযাপন করেছিল অট্রহাসির হৈ হুল্লোড়ে। ওরা ভেবেছিল আমি বেশ জব্দ হয়েছি। আর আমার এই ভীমরতি দূর হওয়া যেন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ওরা ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। ওরা জানে না কি তীব্র ক্ষীপ্র ভালবাসায় আমি আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিয়েছিলাম নীলা আপাকে আমার নিজের সঙ্গে।

আজো এই আটত্রিশ বছর বয়সে ঘুরেফিরে ল্যাপটপের কিবোর্ডে আঙ্গুল ঘুরিয়ে আমি কেবল তাকেই খুঁজে যাই। আমার নীলাঞ্জনাকে। কোথায় সেই মিষ্টি মায়াবিনী মুখখানি। কোথায় সেই মোদির চোখ দুটি। এ শহর আমাকে তার ব্যস্ততার জালে ফেলে কিছু পয়সার মালিক করেছে বটে, বউ খুজতে গেলে নীলা আপার মিষ্টি মুখটির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে আজো ওই বস্তটির মালিক আমি হতে পারিনি। আর নীলা আপা! হয়ত জগলুল ভাইয়ের ঘরণী হয়ে দু’ চারটে সন্তানকে স্কুলে আনা –নেয়া করে। হয়ত এটাই হবে। কারন নড়াইল ছেড়েছি সেই স্কুল পাসের পরেই। কারো সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ নেই। আচ্ছা এমন যদি হয় আমার সেই কৈশোরের স্বপ্নের মতো। নীলা আপার হয়ত বখাটে জগলুল ভাইয়ের ঘরটি করা হয়নি। ভেঙ্গে গেছে বাউন্ডূলের সঙ্গে ঘর করার সাধ। সঙ্গে দুটো কি তিনটে অসহায় বাচ্চা। এতগুলো বাচ্চাসহ স্বামী পরিত্যক্তাকে গ্রহণ করে কোন শালায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে –এমন হলে আল্লাহর অশেষ দয়ায় আমার একটা চান্স থেকেই যায়। এভাবে আবারো সেই স্বপ্নের চারাগাছে পানি দিতে দিতে জুকারবার্গ এর দুনিয়ায় আমি পেয়ে যাই আমার নীলাঞ্জনাকে। হ্যা নীলা আপাইতো। প্রোফাইল পিকচারে যদিও তার নিজের ছবি নেই। এক গুচ্ছ দোলন চাপা।

ফটোতে অনেক ছবি পার হয়েও তাকে আর দেখা যায়না। অবশেষে দু’ তিনটি পুরনো ছবিতে তাকে আবিস্কার করা যায়। তার পরিচিতিতে বৈবাহিক সম্পর্কের জায়গাটিতে অবিবাহিত দেখে আমার পুরোনো প্রেম শতভাগ জলে ওঠে স্বমহিমায়। চ্যাট বক্সের কল্যাণে অতি অল্প দিনের মাঝেই , হয়ত টাকাপয়সার মালিক হয়ে আমার মুখচোরা ভীতু স্বভাব কে জয় করতে পেরেছি বলেই যে কথাটি বহু বছর আগে বলতে সাহস করিনি সে কথাটি বলেই ফেললাম একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে। তার বিয়ে হয়নি। তার বিয়ে হয়না – এই সহজ সত্যিটা বারদুয়েক বলার পর ও আমি কারণ জানার প্রয়োজন মনে করিনি। অতঃপর তিনি মানে সে আমায় নিমন্ত্রণ করলো। সে ঢাকাতেই থাকে। একটি প্রথম সারির পত্রিকা অফিসের মাধ্যমে কি একটা এনজিওভিত্তিক কাজ সে করে আমি বুঝে উঠতে পারিনি। সেই পত্রিকা অফিসের নাম তার মুখে বার বার উঠে আসছিলো কেন তাও আমি বুঝিনি। অবশেষে তার বাড়ির দরজা যখন সে খুলেছিলো তখন বুঝেছিলাম। চমকে ছলকে উঠেছিলাম তাকে দেখে। এত বছর যে মিষ্টি মায়াবিনীকে পুষে এসেছি হৃদ মাজারে সে তো এ নয়। জগলুল তার স্বভাবের ক্ষতচিহ্ন নীলা আপার মুখে এঁটে দিয়ে গেছে। এইজন্য ই নীলা আপা ইনবক্সে আমার কথার জবাবে দেখা করার কথা বার বার বলছিলেন। তার নাকি আপত্তি নেই কিন্তু আমি যেন তার সঙ্গে দেখা করার পর সিদ্ধান্ত নেই। না আমি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি কয়েক মাইক্রো সেকেন্ডেই। নীলা আপার ঝলসানো মুখটা ,অ্যাসিডে ঝুলে যাওয়া ,ফেপে যাওয়া বিকৃত ঠোঁটটা দেখেই হয়তো। আমি ফেরেশতা নই। আমি মানুষ। আমি সৌন্দর্যের পূজারী পুরুষ। নীলা আপার রান্না করা খাবারগুলো আর আমার খাওয়া হয়নি।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত