সহযাত্রা

 

 

                                                                                                           

ছোট গল্প

 

সহযাত্রা

রেদওয়ান খান

 

কয়েকদিন ধরেই আকাশের অবস্থা ভালো নয়। থমথমে। এই রোদ। এই বৃষ্টি। গাছের ডালে পাখপাখালির ভয়ার্ত শব্দ-রোনাজার টের পাওয়া যায়। লোকেরা বলে পশু-পাখিরা সর্বনাশের আগাম খবর পায়।থেকে থেকে দমকা বাতাস দ্রুত উড়ে এস আবার দূরে মিলিয়ে যায়। তারপর গুমোট হয়ে থাকে দুনিয়াটা। এসবই বানের লক্ষণ। মায়াতন্নেছার মন হু হু করে। বুকের ভেতর রাজ্যের শূন্যতা খলবল করে ওঠে।

মায়াতন্নেছা তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অন্তরের ভেতর অনেক আশা করেছিল,গত শীতেই, ঘরখানি ঠিকঠাক করবে। হয়নি। গোলপাতার ছাউনি, গমের খড় আর পাটকাঠি-গোবর-মাটির প্রলেপ দিয়ে তৈরি বেড়া,কিছুই ঠিক নাই। ভিটির মাটিও ক্ষ’য়ে গেছে।জায়গায় জায়গায় মাটির গর্ত।বান যদি এসেই যায়,তো ভিটেমাটি টেকানো কঠিন হয়ে পড়বে।

ওর স্বামী সোহরাব মিয়া। সপ্তাহখানেক হয় কাজের খোঁজে গ্রামছাড়া। দিনমজুর। লোকটা কবে ফিরবে তার খবর নাই। এদিকে চার বছরের মেয়ে সুবর্ণা আর পেটের ভেতরের বাচ্চাটা নিয়ে দিন তো আর কাটে না মায়াতনের। বাড়ির অপর যে ক’ঘর, তাদেরও পুরুষ মানুসগুলো কাজের ধান্ধায় ঘরছাড়া। মেয়েলোকগুলোর বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে তাই আউল-বাউল অবস্থা।

মায়াতনের শাশুড়ি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত।অচল বৃদ্ধা ঘরে না-ফেরা ছেলোর জন্য বিলাপ করে সারাদিন। সেই বিলাপে মায়াতনের বুকের ভেতরটা বানের পানিতে ভরে যায়।বুড়ির বিলাপে উথলে-ওঠা বান বাড়ির আদিগন্তে গতিশীল আর শব্দময় হতে থাকে।

শেষ পর্য্ন্ত বান আসে,ডাকাতিয়া নদীর পানিতে সোন্দরদিয়া গ্রামখানি হু হু করে তলিয়ে যায়। যেন দরিয়া। প্রথম দুদিন রাতের জোয়ারে উঠানে পানি ওঠে। এর পরের রাতেই যায় ঘর ভেসে। প্রায় কিছুই রক্ষা করতে পারে না মায়াতন। একা আর কতোটা পারবে?

বন্যার তোড়ে ঘর-বাড়ি ভেসে যেতে দেখে মায়াতন দিশেহারা। বাপের বাড়ি যেতে পারতো। উপায় নেই।সেখানেও পানি। অথচ স্বামী কী এমন কাম করে, ধারেকাছে নাই।ঘরে অচল শ্বাশুড়ি। নিরুপায় মায়াতন শাশুড়ি,মেয়ে সুবর্ণা আর নিজের দ্বৈত শরীরখানি টেনে হিঁচড়ে অদূরের হিন্দুদের কালীমন্দিরে উঠেছে। সোন্দরদিয়া গ্রামে,মায়াতনদের এ পাড়ায় একমাত্র কালীমন্দিরের মেঝটুকু বন্যার পানির উপর বুক চিতিয়ে আছে। তার চূড়া যেন ধাবমান পানির উপর এক অদৃশ্য আশা। মায়াতনের পক্ষে কালীমন্দির ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর ছিল না।

তার পেটের ভেতরও একটা রাক্ষস বানের পানির মতো নিঃশব্দে বাড়ছে।

 

মুখুজ্জ্যেদের বাড়িটি মায়াতনদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। এ বাড়ির পূর্ব-পুরুষরা এককালে বনেদি ছিল। এখন সেই বনেদিপনা নেই, জৌলুসও নেই। তাদের বনেদিপনার শেষ তিলক,এই পলেস্তারা-খসা জীর্ণ কালীমন্দির। মন্দিরের শ্যাওলাধরা কার্নিশে বেড়ে উঠেছে বট-অশ্বত্থ গাছ। শিকড়-বাকড় ঝুলে লকলক করছে এদিক-সেদিক। মন্দিরের সামনে মজা একটা দীঘি। সেটা এখন তেড়ে-আসা বানের পানিতে বিলীন।মুখুজ্জ্যেরা সেই কবেই ইন্ডিয়া চলে গেছে। তখনও মায়াতন সোন্দরদিয়া গ্রামে বউ হয়ে আসে নি।

এখন গাঁয়ে যারা আছে তারা ক্ষীয়মাণ। মাছ ধরে। লোকে বলে দাস। জেলে। কালীমন্দিরে আশ্রয় নিয়েছে এমনি দুটি জেলে পরিবার। এরা ডাকাতিয়ায় মাছ ধরে। বয়স্ক সুকুমার,তার স্ত্রী বিলন্তবালা। জোয়ান মর্দ তেলকুচকুচে গোবিন্দ,তার স্ত্রী রঙমালা আর তাদের বছর সাতেকের পুত্র গৌতম। মায়াতনের প্রতিবেশী নূরজাহানও তার কিশোর ছেলে জয়নাল আর ছোট্ট দুই মেয়ে রুনু-ঝুনুকে নিয়ে মন্দিরে এসে উঠেছে। ঘরবাড়ি ফেলে এরা দূরে যেতে চায় নি। সংসার বড়ই মায়ার। ভিটে যেন জাদু জানে।

 

আছরের আজানের সামান্য পর,চারদিক ভাসিয়ে পানি হঠাৎ রাক্ষস হয়ে ওঠে।ফলে মায়াতন দিশেহারা।চার বছরের মেয়ে সুবর্ণা ভয় পেয়ে কাঁদতে থাকে। এদিকে অচল শাশুড়ি। তার উপর নিজের পেটখানি পাথরের মতো ভারি। জরুরি কিছু হাঁড়িপাতিল, কাঁথা, তেলচিটিচিটে বালিশ,আঁচলের গেরোতে কয়টা ময়লা দুই টাকার নোট, বড় হাঁড়িতে দুই-তিন কেজির মতো চাল, বাদামী রঙের ঔষধের শিশিতে দু’আঙ্গুল পরিমাণ তেল, ইঁদুরের দাঁত-বসানো সবুজ হুইল সাবানের ক্ষয়ে-যাওয়া টুকরো,দুটো নারকেল-মালার একটাতে মুগডাল, আরেকটাতে ক’খানা থুবড়ানো শক্ত-ঠান্ডা চিতই পিঠা।

 

একটা পুরাতন ছাপা কাপড়ে পেঁচিয়ে মায়াতন ময়লা জীর্ণ জামাকাপড়গুলো রক্ষা করার চেষ্টা করেছে।অবস্থা খারাপ দেখে দুইজোড়া হাঁস আর একটিমাত্র ডিম-পাড়া মুরগি আগেই বেচে দিয়েছিল।

আছরের ওয়াক্তের পর,চারদিক অন্ধকার। তেড়ে আসা বানের পানি ধানের জমি, উঠোন কিছুই বাদ রাখে না। পা-রাখার একটুও শুকনো জমি নেই। আকাশটাও ভয়ানক কালো হয়ে গুড়ুম গুড়ুম শব্দে চারদিক কাঁপিয়ে তুলেছিল। কিভাবে যে মায়াতন তার শাশুড়ি আর ছোট্ট সুবর্ণার হাত ধরে এসে কালীমন্দিরে উঠছিল-সে এক কাহিনী।

 

বৃদ্ধ সুকুমার দাস তার পরিবার নিয়ে আগেই উঠেছিল। একই সঙ্গে গোবিন্দের পরিবারও। তারপর একে একে অন্যরা। সবারই চোখে-মুখে সব হারানোর শোক।

প্রথমে সুকুমারের স্ত্রী বিলন্তবালা মায়াতনদের মন্দিরে ওঠায় কপাল কুঁচকে খচখচ্ করেছিল। কালীমন্দিরে তাদের যুগযুগান্তের অধিকার !  তবে সুকুমার, মায়াতনের বিপর্য্স্ত অবস্থা দেখে বললো, ‘মা গো, ভয় পাইয়ো না। পেত্যেক বছরই ত বানের জল আমাগর কপাল ভাসাইয়া লইয়া যায়।ঠাকুরের নাম লও হক্কলে’। এই বলে বৃদ্ধ চোখ-উল্টানো দাঁতে কামড় দেয়া লাল জিহ্বা বের করা কালীদেবীর উদ্দেশে দুই হাত কপালে ঠেকায়, ‘রক্ষা করো মা।’

সমস্যা একটা নয়। সমস্যা রান্নার, প্রশ্রাব-পায়খানারও।শরীর বাঁচিয়ে দিনের বেলা প্রশ্রাব-পায়খানা করা শরম ও আতঙ্কজনক হয়ে উঠেছে। পুরুষরা তবু ইচ্ছে করলে কলার ভেলায় চড়ে দূরে গিয়ে কাজটা সারতে পারে। কিন্তু মেয়েমানুষগুলো কোথায় যাবে?

গোবিন্দের বউ রঙমালা জোয়ান। মাটির চুলাটা রক্ষা করতে পেরেছিল। সেটাও এখন ভিজে উঠছে। সেই চুলায় চারটি পরিবার লাইন ধরে চাল ফোটায়। এখন চালও শেষ।সবারই।

রাতে মায়াতনের ঘুম আসে না। ক্ষিধে। বাসি কটি চিতইপিঠা ভাগ করে ভেয়েছিল শাশুড়ি আর মেয়েটার সঙ্গে।রঙমালা ধোঁয়ায় চোখ ভিজিয়ে না-ভাত,না-চাল জাতীয় একটা কিছু নামগোত্রহীন খাদ্য রেঁধেছে।তার থেকে মায়াতনকে বাটিতে একটু তুলে দিয়ে বলে,‘খাও বইন।’

হিন্দু মানুষের হাতের রান্না খেতে চায় না মায়াতনের শাশুড়ি। বুড়ি ইনিয়ে বিনিয়ে বিলাপ করছে আর কালী মূর্তিটার ভেতর আজরাইলের অস্পষ্ট ভয়-জাগানিয়া অবয়ব কল্পনা করে শিউরে উঠছে।কালীর দুই সহচর ডাকিনী-যোগিনীরাও মায়তনের শাশুড়িকে ভয় দেখায়।তাছাড়া নবী ইব্রাহিমের ক্বাবা শরীফের মূর্তি ভাঙ্গার কিসসাও বুকের ভেতর উথলে ওঠে।

 

মায়াতন এর আগে কালীকে কখনো এতোটা কাছ থেকে দেখে নি। তারও সামান্য ভয় হয়। ঘুম আসে না।   মনে হয় কালীদেবী সারাক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে আছেএসায়ামীর কথা মনে পড়ে। কাম-কাইজের খোঁজে মানুষটা হাসাইল বাজারে গেছে। সপ্তাহে তিন-চার দিন কাম পায়।যেদিন পায় না, সেদিন আর বাড়ি ফেরে না। মানুষটা কোথায় কিভাবে আছে কে জানে। আক্কেল যদি থাকত মানুষটার। সাত দিন গেল। মায়াতনের শরীরের এই অবস্থা। এদিকে বাড়ি-ঘর সব সমুদ্দুরের নিচে। মায়াতন দু’চোখে কূল-কিনারা দেখতে পায় না।

কিশোর জয়নালের মা নূরজাহান মন্দিরের ভাঙ্গা জানালাটার নিচে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ঠাঁই পেয়েছে। বৃষ্টির ছিটায় সব ভিজে যায়। ছেলে আর দুই মেয়ে নিয়ে বেচারী বড়ই মুছিবতে পড়েছে। তার স্বামী নাই। মারা গেছে। সে বাড়ি-বাড়ি টুকটাক কাজ করে বেঁচে আছে। এখন মরণ ছাড়া গতি নাই।

 

বাঁশের চোঙার মধ্যে কিছু পাট সেঁটে দিয়ে অতি সামান্য কোরোসিনে কুপিবাতি জ্বালিয়েছে সুকুমার বুড়োর গিন্নি বিলন্তবালা। সেই বাতি এখন বিপন্ন কালীমন্দিরে টিমটিমে আশীর্বাদ হয়ে জ্বলছে।

সুকুমার দাস বউয়ের সঙ্গে পুটপাট কথা বলছেন ‘বেবাক দিকে খালি জল আর জল,চুলা বন্ধ।খাওন বন্ধ। অহন কি উপায়? আমি ত আঁন্ধার দেখতাছি।’

বিলন্তবালা স্বামীর দীর্ঘশ্বাসটি নিজের ভেতর টেনে নিয়ে তারপর বুক চিরে বের করে দেয়। বলে, হুনছি, কাইল পরদানমন্তী হেলিকপ্টেরে কইরা আইতাছে। আমরা ত কোনো কিচ্ছুই সাহ্য পাইলাম না।

এমন সময় রাতের আঁধারকে ভেঙ্গে দিয়ে ভয়ার্ত বিলাপ ভেসে আসে দূর থেকে এময়ে কন্ঠের সেই বিলাপে শোকে নিথর হয়ে পড়ে চরাচর।

গোবিন্দের জোয়ান বউটি,রঙমালা, ছেলেকে বুকে নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। সে বলে,‘ও কাকী মা,হুনছেন নি,কালাচাঁনের মাইয়্যাডা, পুবালি, ঘরের মাচারতন জলে পইড়া মইরা গেছে’।

‘হুনছি রে মা, আহা রে, বউডার কাঁন্দনে বুকটা কেমুন মোচড়াইয়া ওডে’– বলে বিলন্তবালা।

‘ও কাকী, অহন লাশ কি করব? ’রঙমালা তার ছেলে গৌতমকে আঁকড়ে ধরে। অজানা আশঙ্কায় তার ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে ওঠে। সে মনে মনে ভক্তি করে কালীদেবীর উদ্দেশে কপালে হাত ঠেকায়।

বুড়া সুকুমার দাস অঘুমে হাঁপিয়ে ওঠে। গলার তলা থেকে একটা কফের দলা ঝাঁকুনি দেয়ার পর,সে বলে,‘গোবিন্দ পাগল অইছে। এই রাইতে মাছ ধরতে গ্যাছে।মাছ পাইব কই ? বানের মইধ্যে মাছে মাছের নিশানা আছে নি ?’

কারো সাড়া না পেয়ে মুখে চলে আসা বুকতলার একদলা কফ ফেলে আবার বলতে থাকে, ‘ইলেকশন আইলে হগলতে কত্ত দরদি অইয়্যা ভোট চায়। আমাগ দুখে-সুখে সাথি অইব কয়। এহন বানে আমাগর থাহনের জাগা ডুবছে, বউ-ঝি’গো রাঁন্দনের চুলা ডুবছে। একজন নেতাও ঢাহাত্তন নাইম্যা আহে না। আমাগ এমপিডা একটা আস্তা চোর। হেয় নাহি বিদেশ ঘুরতে গ্যাছে, কোন বিলাত গ্যাছে বদমাশডা কে কইব?’

সুকুমারের ছেলে,ছেলের বউ, নাতি দুটি চলে গেছে কলাগাছিয়া। বউয়ের বাপের বাড়ি। বেড়িবাঁধের ভিতর বলে করাগাছিয়া এখনও বন্যায় ডোবে নাই। তবে দুইদিন ধরে যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে সেখানেও বন্যা হবে। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যেতে পারে।

কাক ডাকার আগে,ভোরের অন্ধকারে একে একে সবাই মন্দিরের ভাঙ্গা, জলটুবটুব সিঁড়িতে বসে প্রশ্রাব-পায়খানার কাজ সারে। উপায় নাই, বিলন্তবালা মা কালীর প্রায় চোখের সামনে নোংরা কাজটি করতে গিয়ে শিউরে ওঠে।

সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনা ঘটায় মায়াতনের শাশুড়ি। সূর্য ওঠার বেশ খানিকটা পর, সে কালী মূর্তির পায়ের কাছেই কাপড় নষ্ট করে ফেলে। এমতাবস্থায় দুর্গন্ধে কালীমূর্তির জিহ্বাটা যেন মুখ থেকে হঠাৎ আরো খানিকটা ঝুলে পড়ে। দেবীর পায়ের নিচে, বিপদগ্রস্ত মহাদেবের নীল শরীরেও মলের ছিটা ছিঁড়িৎ করে ছড়িয়েছে বুড়ি।

বুড়ির কু-কান্ডে রাগে গজগজ করতে থাকে দুর্গন্ধ-তাড়িত সকলেই।‘রাম রাম’ ‘দুগ্গা দুগ্গা’ করে ওঠে বিলন্তবালা। রঙমালাও নাকে কাপড় গুজে দেয়। সুকুমার দাস পুনরায় একদলা কফ ফেলে। নিরুপায় মায়াতন নিজের ভারি শরীরটা টেনে টেনে শাশুড়ির কাপড় পরিস্কার করে। আার নিজের ‍দুর্ভাগ্যে চোখের পানি মোছে; নিজেকে বদদোয়া দেয়।

দুপুরের দিকে দুই যুবক আসে একটা ছোট নৌকায় চড়ে।কাপড়-চোপড়ে ফিটফাট। এদের হাতে কাগজপত্র, কালো রেক্সিনের ব্যাগ। কালীমন্দিরে আশ্রিতরা এদের দেখে খানিকটা আশা পায়। আচম্বিতে আশান্বিত মানুষগুলো মন্দিরের বাইরের সিঁড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।আসলে এরা এ ক’দিনে অনেকটা হিংস্র হয়ে উঠেছে। ক্ষুধা ও কর্মহীনতায় মুষড়েও পড়েছে।

যুবকদ্বয় নৌকায় দাঁড়িয়েই মন্দিরের ভেতর উঁকি-ঝুঁকি দেয়। কিছু বলে না।

মায়াতনের শাশুড়ি নড়তে পারে না। যুকবদ্বয়ের আগমনের কথা শুনে কান্নাজড়িত কন্ঠে অনুযোগ করে ‘বাবারা আল্রা আছে মাথার উপরে। আমরা কিছুই সাহ্য পাই নাই। নাম লেইখ্যা নিয়া যান..ও বউ নামডা লেখাও।’

সুকুমার দাস খুবই বিরক্ত। সে যুবকদের বলে, ‘আমরা ‘লিলিপ’ চাই না। গাঙ্গে মাছ ধরার জাল ফেলার উপায় চাই।’

এতক্ষণ মাথায় কাপড় টেনে সিঁদুর ঢেকে রেখেছিল বিলন্তবালা। সে ঘোমটার ভেতর থেকে মায়াতনের শাশুড়ির পূর্বোক্ত অনুযোগ টেনে এনে বলে ‘নাম লেইখ্যা কি অইব? রাইতে সাপ-খোপ আসে, ডরে ঘুম আসে না চোক্ষে,তার উপর পেটে দানাপানি নাই।’

যুবকেরা বিধবা নূরজাহানের দিকে কিছুক্ষণ পলকহীন চেয়ে থাকে। এত নূরজাহান এবং তার কিশোর পুত্র অস্বস্তি বোধ করে। এসময় যুকবদের একজন নীরবতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করে, ‘এরা আশ্রয়কেন্দ্রে যায় নি ? সেখানে গেলে রিলিপ পাওয়া সোজা।’

রঙমালার স্বামী গোবিন্দ অঘোরে ঘুমাচ্ছিল। সে রাতে সাত-আটটা বাইলা মাছ পেয়েছিল। যুবকদ্বয়ের প্রশ্নে এতোক্ষণে ঝিমানোর ঘোর থেকে উঠে এসে বলে, ‘এ্যাতো দূরে আচ্চয়কেন্দে কিভাবে যাই, ভাই। সঙ্গে মাইয়া মানুষ, পোলাপান, হান্ডিপাতিল, হাঁস-মুরগি-ছাগল। বড়ই খারাপ অবস্থায় আছি। কিছু চাইল থাকলে দিয়া যান ভাই।

যুবকেরা গোবিন্দের কথায় কর্ণপাত করে না। এরা শেষবারের মতো নূরজাহানের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে নৌকা ভাসিয়ে দেয়। তারপর দ্রুত ঢেউতোলা পানির দিগন্তে মিলিয়ে যায়।

লোকে বলে মরার উপর খাঁড়ার ঘা। বিপদ যখন আসে তন চৌদিক ভেঙে আসে। মায়াতনের ব্যথা উঠেছে। সে সকালে শাশুড়ির নষ্ট কাপড় মন্দিরের সামনের পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করেছে। সুবর্ণাকে ডেকে ডেকে হয়রান হয়েছে। মেয়ে ঘুম থেকে জাগে না। রঙমালাকে মায়াতর বলে বিইন আমারে কয়ডা চাইল ফুটাইয়্যা দিও।

রঙমালা প্রথমে বিরক্ত গলেও সেটা বাইরে প্রকাশ করে না। শত হলেও বিপদে পড়েই এখানে এসেছে। রঙমালার বুকের ভেতরটা কী এক অজানা কারণে করুণায় আদ্র হয়ে ওঠে। সে বলে, আইচ্ছা, তুমি চিন্তা কইরো না।

মায়াতনের অবস্থা দেখেও তার শাশুড়ির করার কিছুই থাকে না। নিজেকে তার একটা ভয়ানক বোঝা বলে মনে হয়।‘আল্লা মরণ দেয় না। বানের পানিতে কত লোকে ভাইস্যা যাইতাছে,তাও আমারে আজরাইল চোক্কে দ্যোখে না।’ এভাবে জরা ও জড়ত্বে পাওয়া বুড়ি আত্ম-অভিশাপ রচনার হেতু বর্ণনা করে চুপ হয়ে যায়।

বৃদ্ধা এ ক’দিনে কালীমূর্তিটাকে মোটামুটি মেনে নিয়েছেন। যার যার ধর্ম তার তার কাছে। এই বোধ থেকে কিছুটা ভরসা পেয়ে বার কয়েক কালী দেবীর মুখের দিকে চেয়ে ক্ষীণস্বরে, হাতের ইশারায় বিলন্তবালাকে ডেকে অনুনয় করে,‘বউয়ের ত আর সময় নাই। বাচ্চা অইব। বজ্জাত পোলা পেডে ধরছিলাম-কই গ্যাছে খপর নাই। এই বিপদের সময় আমি অহন কার কাছে যাই।’

বুড়ির অনুনয়ের আগেই সবাই যার যার সাধ্যমতো এগিয়ে আসে। বিলন্তবালা, রঙমালা, নূরজাহান।

দুই যুবক নূরজাহানের দিকে লোভী চোখে তাকিয়ে চলে যাবার পর সে ভেতরে ভেতরে শঙ্কা ও শীত অনুভব করছে। এতক্ষণে করার মতো কিছু পেয়ে সে যেন মুক্তি পেয়েছে।

সবাই মিলে একটা পুরাতন ছেঁড়া কাপড় টানিয়ে ব্যথায় কাতরানো মায়াতনকে আড়াল করার ব্যবস্থা করে। সন্তান প্রসব বিষয়ে এরা অভিজ্ঞ। বুঝতে পারে মায়াতনের সময় কম।

বিকেল থেকেই বৃষ্টি নেমেছে মুষলধারে। মন্দিরে আশ্রিত পুরুষ মানুষগুলোর কারোরই বাইরে বার হওয়ার উপায় থাকে না। সুকুমার বুড়ো তার পুরাতন হুক্কাটায় একছিলিম তামাক নিয়ে ফুঁ দিতে দিতে মন্দিরের এক কোণের দিকে বসে অস্ফুটে স্বগতোক্তি করে ‘ভগমান আর সময় পাইলা না।’

তাঁকে ঘিরে বসে গোবিন্দ আর নূরজাহানের ছেলে কিশোর জয়নাল। তারা লজ্জা পাচ্ছে।মায়াতনের গোঙ্গানিতে জয়নালের ভেতর একটা ভয়ার্ত অনুভূতি বয়ে যেতে থাকে। বুঝি বা জন্মের ইতিবৃত্ত জয়নালের কাছে স্পষ্ট হতে থাকে। গোবিন্দ’র চোখে মুখে মৃদু কৌতুক। সে তো জয়নালের মতো অনভিজ্ঞ নয়।

বাইরে তুমুল বৃষ্টি। বন্যার জল বাড়বে-হুক্কায় টান দিয়ে গম্ভীরভাবে ভাবে সুকুমার দাস। ভাবনা ছাড়া তার আর কিছু নাই। এসময় মন্দিরের দেয়ালে ঝুলে থাকা বটের শিকড়গুলো ভৌতিকভাবে নড়ে ওঠে।সেদিকে যার যার মতো করে তাকিয়ে থেকে এক ধরনের শূন্যতার জগৎ নির্মাণ করে সুকুমার বুড়ো,জোয়ান গোবিন্দ,কিশোর জয়নাল।

এসময় মায়াতনের কোঁকানি-গোঙানি চিৎকারে পরিণত হয়।তার শাশুড়ি ভাঙা-অক্ষম গলায় বউকে শাসন করে,‘ও বউ এ্যাতো চিল্লাও ক্যাঁ?পুরুষ লোকেরা আছে না? শরমের মাথা খাইছো ? আল্লাকে ডাহো।’

বৃষ্টির অবিরল রিমঝিম মাদকতা,মাকে ঘিরে থাকা লোক ও মায়াতনের ভয়ার্ত চিৎকারে-মায়ের মৃত্যু হচ্ছে ভেবে কান্না জুড়েছে সুবর্ণা-যদিও মৃত্যু কি-এটা তার কাছে স্পষ্ট নয়। জয়নালের দু’বোন রুনু-ঝুনু, গোবিন্দের ছেলে গৌতমও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বর্ষার রাত্রি,ঝড়ো বাতাস আর অচেনা কালীদেবীর মূর্তির সমুখে তাদের সবকিছুই এলামেলো, রহস্যময়।

দীর্ঘ স্থায়ী বানের পানিতে কালীমন্দিরের প্রাচীন মেঝে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে উঠেছে। এখন সাত-আসমান ভেঙে বৃষ্টি পড়ার কারণে ভাঙা জানালা দিয়ে পানির ছিটা এসে দেবীকে সিক্ত করে দিচ্ছে।

বাঁশের চোঙায় প্রায় ভেজা পাট সেঁটে সন্ধ্যাবাতি জ্বলায় রঙমালা। বৃষ্টির ছিটায় বাতি কেঁপে ওঠে। সেই আলোয় মন্দিরের ভেতর আলো-আঁধারির খেলা চলে। কালীদেবীর জিহ্বার রক্ত-ঙ ঝিলকিয়ে উঠছে।তার বুকের ওপর নরমুন্ডের মালাটা নড়েচড়ে ওঠে যেন।

এমন সময়,রাত খানিক নির্জন গাঢ় হওয়ার কারণে, টাঙানো ছেঁড়া কাপড়ের আড়ালে,প্রায় দেবীর পায়ের তলায়,মায়াতন শেষতম গোঙানি দিয়ে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করে। তার এই সাফল্যে বিলন্তবালার মুখখানি উজ্জ্বলতর হয়ে একটা বিভা ছড়ায়। কারণ, এতক্ষণ ধাইয়ের কাজটি তাকেই করতে হয়েছে। ফলে তার পুরাতন শাঁখা-সমৃদ্ধ হাত গরম রক্তে ভিজে যায়।

মায়াতনের অচল শাশুড়ি নবজাতকের কান্না শুনে সামান্য নড়ে ওঠে। এ সময় বিলন্তবালার উদ্দেশে বলে,ও বউ কি অইছে ?

নাতি অইছে গো চাচি।

‘শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আহাঃ রে…আমার আহাম্মক পুতে কই পইড়া রইছে। অহন আযান দিব কেডা ?– বৃদ্ধা পুনরায় বিলাপ শুরু করে দেয়।

বৃদ্ধার বিলাপকে সহসা সচকিত করে উলুধ্বনি করে ওঠে রঙমালা। এতে মায়াতনের শাশুড়ি বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেলেও মন্দিরবাসী সকলেই খুশি হয়। সুতরাং দেরী না করে রঙমালাকে অনুসরণ করে উলুধ্বনিতে কন্ঠ মিলায় বিলন্তবালা।

এদিকে নূরজাহানের আদেশে নবজাতকের কানে আযান দিতে হয় থতমত-খাওয়া জয়নালকে।এই তার জীবনের প্রথম আযান। কালীদেবীর মন্দিরে বানভাসির আশ্রয়, মানব শিশু জন্মের ইতিবৃত্ত অনুভব করার মতো,এই আকস্মিক আযানও তার জন্য এক বিস্ময়কর নতুন অভিজ্ঞতা। শিশুটির কানে আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণার পর,জয়নাল স্তব্ধ-বিমূঢ় হয়ে থাকে কিছুক্ষণ।

উৎসাহী রঙমালা শিশুটিকে গোসল দেয়ার জন্য ভগ্ন চুলায় পানি গরম করার চেষ্টা করে। তার আগুন জ্বালানোর কঠোর সংগ্রাম ও তৎজনিত ধোঁয়ায় মন্দিরঘর ঝাপসা হয়ে যায়।

শেষ পর্য্নত ভূমিষ্ঠ শিশুটিকে কুসুম-গরম পানিতে গোসল করায় বিলন্তবালা। এতে সে ওঁয়াঁও করে কেঁদে উঠে আপন অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে। কালীদেবীর চোখ দুটিও যেন বিস্ফারিত হয়ে মানবজন্মের এই চিৎকার অনুভব করে খুশি হয়ে ওঠে।

শিশুটিকে এক টুকরা ময়লা কাঁথায় জড়িয়ে বিলন্তবালা বলে ‘ও বুইড়া,কান্দো ক্যা…বানের জলের ভিতর দিয়া যাইবা কই!..আমার লগেই থাকতে অইব…হাহাহা।’

বাইরে তখনও বৃষ্টি। রাত কত হয়েছে কে জানে। বানের জল দীর্ঘ্স্থায়ী হবে- মনে মনে এরকমই আশঙ্কা করে সুকুমার দাস। বিলন্তবালা যে মায়াতনের বাচ্চা নিয়ে মজা-তামাশা করছে সেদিকে খেয়াল নেই বুড়োর।

এ সময় রাত্রির ঘন অন্ধকারের ভেতর থেকে মন্দিরের ভাঙা জানালা দিয়ে একটা দমকা বাতাস ঢোকে। রঙমালার জ্বালানো কুপিবাতির আলোটা কালীদেবীর জিহ্বায় আছড়ে পড়ে রহস্যময় এক দ্যুতি ছড়াতে থাকে।

                                                                                                    সমাপ্ত

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত