সোনিয়ার বিয়ে হয় আঠারো বছর বয়সে। ঠিক এইচ এস সি পরীক্ষার পর৷ ক্লাসের সবথেকে সুন্দরী মেয়েদের একজন ছিল সে৷ যার সাথে বিয়ে হয়, সেই ভদ্রলোক একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। শিক্ষিত, মার্জিত এবং বেশ রুচিশীল মানুষ৷ কারো সাথে কোনোদিন অন্যায় কিংবা খারাপ ব্যবহার করেন না৷ সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছেই তিনি সম্মানের পাত্র। শুধু সোনিয়ার কাছে তিনি খারাপ, চরম খারাপ। এর পিছনে একটা কারণ আছে।
বত্রিশ বছর বয়সে তিনি যখন বিয়ে করেন, তখন তার জমজমাট ব্যবসা। সোনিয়ার বাবাও ছোটখাটো একজন ব্যবসায়ী। মেয়ের বিয়ে দিতে তাই একটুও দেরী করেন নি। সোনিয়া যখন প্রথম প্রথম শ্বশুরবাড়ি যায়, বয়সের অনেক ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও স্বামীর আদর যত্নে বেশ ভালো সময় কাটে তার৷ বুঝতেই পারেনা সময় কিভাবে চলে যাচ্ছে। সোনিয়ার স্বামীও পুরো জীবন-যৌবন ব্যবসায় ব্যয় করে এরকম একটা সুন্দরী মেয়েকে বউ হিসেবে পেয়ে বেজায় খুশি। ভালোই চলছিল সংসার।
বিয়ের বছর চারেক পরের ঘটনা। সোনিয়ার বাচ্চার বয়স আড়াই বছর৷ স্বামীর এতবড় ব্যবসা, বাড়ি-ঘর আর বিলাসীতার মধ্যে বাস করতে করতে নিজের পড়াশুনা, ক্যারিয়ার সব ভুলে গেছে সে৷ এডমিশানও নেয় নি কোথাও। ভেবেছিলো জীবন এভাবেই কেটে যাবে। কিন্তু সোনিয়ার স্বামীর আচরণে দিন দিন পরিবর্তন ঘটতে থাকে। সোনিয়া একটু এক্সট্রোভার্ট স্বভাবের ছিল৷ স্কুল কলেজ সে বন্ধু বান্ধব নিয়ে হৈ-হুল্লোর করেই কাটিয়েছে। বিয়ের পর স্বামী নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকলেও একটা সময় এসে লোকটার ব্যস্ততা তাকে পীড়া দিতে শুরু করে।
সোনিয়া তার স্কুলের বন্ধুদের সাথে কথা বলা শুরু করে। যেই ছেলেটা তাকে নিয়মিত ডিস্টার্ব করতো সেই ছেলেটার সাথেও সে নিজের সুখ-দুঃখ শেয়ার করতে থাকে৷ ওর স্বামী যখন বাসায় ফেরে, তখন রাত এগার-বারোটা। ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে নামাজ পড়ে ঘুম। এর বাইরে একটা কথাও নেই তার৷ শুধু “সোনিয়া খেয়েছো?”, “বাচ্চা কান্নাকাটি করেনাই তো?”, ” মা ওষুধ খাইছে?” এরকম কিছু কথা মুখস্থের মত আউড়িয়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন।
একদিন, দুইদিন, তিনিদিন না, টানা মাসের পর মাস এভাবে চলতে থাকে৷ সোনিয়া একদিন রাগ করে ঘুমানোর আগে কান্নাকাটি শুরু করে৷ স্বামীকে জিজ্ঞেস করে, আপনি আমার সাথে এরকম কেন করছেন? রোবটের মত কেন হয়ে গেলেন?
কেন? তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে? আমি তো তোমার আর বাচ্চার জন্যই এত পরিশ্রম করি৷ সুখে থাকতে তোমাকে ভূতে কিলায়? তোমার কিসের অভাব? গত চার বছরে তোমার কোনো আবদার আমি অপূর্ণ রেখেছি?
এক দমে কথাগুলো বলে সোনিয়ার স্বামী। সোনিয়াও মাথা নীচু করে বসে থাকে। আসলেই তার কোনো চাওয়া অপূর্ণ নেই। যখন যা চায় তাই সে পায়। শুধু সেই শুরুর মত স্বামীর অফুরন্ত সময় আর পায়না। না চাইতেই যে ভালোবাসা, কেয়ার সে পেত, সেটা আজ চেয়েও পাচ্ছেনা এটা সোনিয়া মানতে পারেনা। স্বামীকে সে বোঝানোর চেষ্টা করে নানাভাবে। কিন্তু কিছুতেই কাজ হয় না। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে সোনিয়া।
বিয়ের আগে অনেক চঞ্চল থাকলেও বিয়ের পর স্বামী সংসার নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সোনিয়া বন্ধু-বান্ধবীদেরকে প্রায় ভুলেই বসেছিল। কিন্তু স্বামীর অবহেলা তাকে আবার সোস্যাল মিডিয়ার দিকে ধাবিত করে। ফেইসবুক, হোয়াটস এপে সে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে ফ্রেন্ডদের সাথে। স্বামীকে না জানিয়ে বাইরে ঘুরতেও শুরু করে। মনে অপরাধবোধ থাকলেও চার দেয়ালের বন্দীত্ব তাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে ভেবে সে ঘরে থাকতে পারেনা৷ স্বামীর সাথে প্রতারণা করছে ভেবে একা একা কাঁদে, আবার তার পরিবর্তিত আচরণ সে মেনেও নিতে পারেনা।
একদিন সোনিয়া মুখ ফুটে বলে ফেলে, আপনি যে আমার সাথে এরকম করতেছেন, আমি কিন্তু পালিয়ে যাবো, প্রেম করবো, তখন কি করবেন?
তুমি পারলে যেয়ে দেখো৷ এত সুখ কোথায় পাবা তুমি? আত্মবিশ্বাসের সাথে লোকটা জবাব দেয়। তার ধারণা সোনিয়ার সাহস নেই তার আনুগত্য ভাঙার, পাশাপাশি যাবারও আর জায়গা নেই।
একটা সময় এসে সোনিয়ার স্বামী বুঝতে পারে তার স্ত্রী তাকে না জানিয়েই বাইরে যায়। বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা দেয়৷ তারপর সোনিয়ার মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া হয়। তার বান্ধবীদের সাথেও কথা বলা বন্ধ করে দেয়া হয়। সোনিয়া শুধু রান্নাবান্না, একটা বাচ্চা, আর বেডরুম এই জগত নিয়ে পড়ে থাকে৷ এভাবে চলতে চলতে সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
বিয়ের সময় সোনিয়ার স্বামী জানতো মেয়েটা একটু চঞ্চল। কিন্তু সৌন্দর্যে দিশেহারা হয়ে সে বলেই ফেলেছিল বিয়ে করলে সে সোনিয়াকেই করবে। ধীরে ধীরে তাকে ভালবেসে চেঞ্জ করবে, মনের মত করে গড়বে। কিন্তু বিয়ের পর লোকটা সেই ধৈর্য্য দেখাতে পারেনি৷ প্রথমদিকে বেশ ভাল সময় কাটলেও সময় যত গড়িয়েছে, কম্প্রোমাইজ আর ধৈর্যের পরিবর্তে রেস্ট্রিকশানের মাত্রা বেড়েছে দিন দিন। সোনিয়া যাই করতে গেছে, বুঝিয়ে-শুনিয়ে না বলে ধমক আর মারধরের মাধ্যমে সেসব থামাতে চেয়েছে তার স্বামী।
সোনিয়া বুকফাটা আর্তনাদ করে বুঝানোর চেষ্টা করেছে সে এত তাড়াতাড়ি সবকিছু মানতে পারতেছে না, পারবেনা। কিন্তু লোকটা নাছোড়বান্দা। তার একজন গুরু আছে, এবং নিজের কিছু চিন্তাভাবনা আছে। এর বাইরে সে কিছুই ফলো করে না। তবে একটা ব্যাপারে সে বেশ খুশি। সোনিয়ার সৌন্দর্য তার দারুণ প্রিয়। এই একটা বিষয়ে সে স্ত্রীকে নিয়ে গর্ববোধ করে। কিন্তু সোনিয়ার ক্রমাগত বেপরোয়া হয়ে যাওয়াটা সে পাত্তাই দেয় না কিংবা কল্পনাও করতে পারেনা যে সোনিয়া তাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে।
একদিন সোনিয়া বলেই বসে, আপনি আমাকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছেন। অনেক ভালোও বেসেছেন। কিন্তু এখন যে আচরণ করতেছেন এটা আমি বেশীদিন নিতে পারবো না। হয় মারা যাবো নাহয় পাগল হয়ে কোথাও হারিয়ে যাবো।
একথা শুনে সোনিয়ার স্বামী হাসতে থাকে। বলে, তোমাদের মেয়েদের এই এক সমস্যা। সব আবদার পূরণ হলেও অভাব তোমাদের ফুরায় না। আর কি চাও এক জীবনে? সবই তো দিলাম।
সোনিয়া আবারো চুপ। কোনো উত্তর খুঁজে পায়না। বাইশ বছরের একটা মেয়ে বাচ্চাটাকে বুকে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। মোবাইল ফোন, টিভি বিহীন বাসায় একা একা বই পড়ে। সেটাও আর ভালো লাগেনা। সারাদিন কেঁদেও রাতে যখন স্বামী বাসায় আসে, সোনিয়া ভাবে এই বুঝি একটু গল্প করার লোক পাওয়া গেল। কিন্তু তার পোড়া কপাল। রোবটের মত সব কাজ শেষ করে নাক ডেকে ঘুমাতে থাকে তার স্বামী।
আরো বছর চারেক পরের ঘটনা। সোনিয়ার স্বামী একটা ফ্রি কন্সাল্টেন্সি ফার্ম করেছে। এখানে যুবকদের বিয়ে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বিয়ের আগে কোন কোন ব্যাপারগুলো ভালো করে খেয়াল করতে হবে, বিয়ের পর কিভাবে স্ত্রীকে ভালো রাখতে হবে, শত ব্যস্ততার ভীড়েও স্ত্রীর জন্য কিছুটা সময় স্পেশালভাবে বরাদ্দ রাখতে হবে এই বিষয়ে তার বক্তব্যে হাজারো সংসার সুন্দর হয়, ভাঙন থেকে বেঁচে যায়। কয়েকদিন পর পরই তার কাছে মেইল আসে, ভাইয়া আপনার সেশনটা করার পরে আমাদের পরিবারে বেশ পরিবর্তন এসেছে। দুজনেই এখন কম্প্রোমাইজ করে চলা শিখেছি।
এসব মেসেজ পড়ে আর সোনিয়ার স্বামী কাঁদে। আজ চার বছর হলো সোনিয়া তার সাথে নেই। বাচ্চাটাকে মায়ের বাড়ি রেখে সোনিয়া কোথায় চলে গেছে কাউকে বলেনি। শুধু ডায়েরীটা তার বালিশের নীচে রেখে গেছে। প্রতিটা দিনের ঘটনা সেখানে সুন্দর করে লিখা। শুরুর দিকে স্বামীর প্রশংসায় ভরপুর আর শেষের দিকে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। ডায়েরীর সর্বপ্রথম লিখা- “জগতে আমার চেয়ে সুখের কেউ নেই। এত সুন্দর স্বামী, এত সুন্দর পরিবার কজনের ভাগ্যে জোটে কে জানে? মনে হয় জান্নাতে এসেছি।”
ডায়েরীর শেষ পাতায় লিখা- “আমি হয়তো নরকে যাচ্ছি। কিন্তু প্রতিনিয়িত নরকযন্ত্রণা ভোগ করা থেকে মুক্তি পাবো, এই আনন্দ নিয়ে চলে যাচ্ছি। ভালো থাকুক নরকের স্রষ্টা।”
ডায়েরীর এই কথাগুলো সোনিয়ার স্বামীকে ভীষনভাবে নাড়া দিয়েছিল। সে ডায়েরী পড়তে পড়তে ভীষণ কেঁদেছে। সবভাবে সোনিয়াকে খুঁজেছে। খুঁজতে খুঁজতে প্রায় পাগল হবার দশা। তবুও কোথাও পায়নি তাকে৷ অবশেষে সোনিয়ার ডায়েরীর লিখাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সে প্রচুর বই-পুস্তক পড়া শুরু করে। নোট করে সবকিছু। তার একটা সময় গিয়ে মনে হয়, সমাজে তার মত অনেক মানুষ আছে যারা নিজেদের খেয়াল-খুশিকেই সব মনে করে। তার সঙ্গীটাও যে একজন রক্তমাংসের মানুষ, শুধু দামী পোষাক, আসবাব আর খাবারের বাইরেও যে মানুষটার অন্তরের কিছু খোরাক থাকতে পারে এটা অনেক পুরুষই এখনো বোঝেনা। এই উপলব্ধি থেকেই সোনিয়ার স্বামী মানুষকে মোটিভেশান দেয়া শুরু করে। ভালো ফল পেয়ে এখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সবাইকে মোটিভেশান দিয়ে বেড়ায়৷ এভাবে অনেক পরিবার সে ভাঙার হাত থেকে রক্ষা করে। এক সোনিয়া হয়তো হারিয়ে গেছে অন্ধকারে, তবুও সেই হারানোর ফলস্বরূপ আজ হাজারো সোনিয়ার সংসার টিকে যাচ্ছে, বেঁচে যাচ্ছে তারা নরকযন্ত্রণা কিংবা ভাঙনের হাত থেকে!
জগতে আমরা যত সুন্দর আর হাসিখুশি কাপলই দেখি না কেন, এর আড়ালে থাকে দুজন মানুষের পরস্পরের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ এবং কম্প্রোমাইজের হাজারো গল্প। পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ আর কম্প্রোমাইজ ছাড়া একটা সম্পর্ক কখনোই সুখের কিংবা স্থায়ী হয় না।