দরজা খুলে যাকে দেখলাম, তাকে দেখে এক ঝটকায় আমি বহু বছর পিছিয়ে গেলাম; যেন তার বর্ষাতি থেকে টুপটাপ ঝরে পরছে, বৃষ্টির ফোঁটা নয়, পুরাতন সব স্মৃতি!
(১)
ছুটির দিন। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। শোয়ার ঘরের কোণায় জানালার পাশে রাখা ইজি চেয়ারটাতে আধশোয়া হয়ে আছি আমি আর আমার কানে বেজে চলেছে তুহিন ভাইয়ের দরাজ গলায় ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়, ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা সেই কি ভোলা যায়!’ বাইরে বৃষ্টির অবিরাম রিমঝিম ছন্দের সাথে ভেতরের এই সাউন্ড বক্সে বেজে চলা গান, গানের সুর, মিউজিক- সব কিছু মিলেমিশে তৈরি হচ্ছিল যেন এক মহাজাগতিক আবহ, ভেতর আর বাহির যেখানে একাকার, আর সেই মহাজাগতিক পরম আবেশে আমি যেন ক্রমশ নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফানা হয়ে যাচ্ছিলাম মহাবিশ্বের প্রতিটি অণু পরমাণু ইলেকট্রন প্রোটন নিউট্রন এবং ঈশ্বর কণায়। আর ঠিক তখনই হল ছন্দপতন। ঘরের কলিংবেল বেজে উঠল। ছুটির দিনগুলোতে আমি একা থাকতে পছন্দ করি। তাই বাজার করার ছেলেটা আর কাজের বুয়াটিকে আসতে বারণ করে দিই এইসব দিনে৷ বিয়ে করিনি, তাই বউ বাচ্চার কোন ঝুট ঝামেলাও নেই। একেবারেই নিজের মত করে কাটাই আমি ছুটির দিনগুলো। অনলাইনে অর্ডার করে খাবার আনিয়ে নিই, কিংবা ফ্রিজে আগের কোন খাবার থাকলে তা গরম করে খাই। আর এইসব দিনে বাসায় কেউ কলিং বেল বাজালে আমি চরম বিরক্ত হই। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি৷ তবে আজকে দরজা খুলে যাকে দেখলাম, তাকে দেখে আমি বিরক্ত হলাম না, স্মৃতিকাতর হলাম!
(২)
রমিজ৷ আমার ভার্সিটির বন্ধু। ভার্সিটিতে আমরা এক সাথে একই হলের একই রুমে ছিলাম। যদিও দুজনের বিভাগ ছিল আলাদা। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, আর সে দর্শনে। হলের গেস্টরুমের বড় ভাইদের নির্দেশনা অনুসারে আমরা দুজন একই সাথে উঠেছিলাম হলের গণরুমগুলোর একটিতে, আর একই সাথে বছর খানেক পরে গণরুমের গণ্ডি পেরিয়ে আমরা থিতু হয়েছিলাম তিনশ এগার নাম্বার রুমে এবং ভার্সিটির শেষ দিন পর্যন্ত আমরা সেই রুমেই ছিলাম। তারপর পড়াশোনা শেষ করে বন্ধুরা সব একেকজন একেক দিকে চলে গেলাম৷ প্রথমে রমিজ সহ আরো কয়েক জনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ থাকলেও জীবনের নানাবিধ চোদনে আস্তে আস্তে তা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে, আর আমি নিজেকে বন্দী করে ফেলি নিজেরই তৈরি করা এক চরম আত্মকেন্দ্রিকতার চার দেয়ালের মধ্যে। হয়তো তারাও তা-ই করেছিল। কেননা যোগাযোগহীনতার এই প্রক্রিয়াটা একপাক্ষিক ভাবে সম্পন্ন হয়নি, বরং সকলের সমান অংশগ্রহণ তাতে নিশ্চিত হয়েছিল। আর তাই আজ বহুকাল পরে রমিজকে আমার দরজার সামনে দেখে আমি খানিক অবাকও হলাম!
(৩)
সাউন্ড বক্সে বেজে চলেছে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ আর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমার পুরানো বন্ধু রমিজ, যাকে দেখে আমার মনে একের পর এক ভেসে উঠছে পুরানো সব স্মৃতি- কি চমৎকার কাকতাল, তাই না! দরজার পাশের হুকে বর্ষাতিটা ঝুলিয়ে রেখে জুতা খুলে রমিজ সোফায় এসে বসল। তাকে বেশ বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছিল। আমি তার মুখোমুখি বসে বললাম-
“কিরে, কেমন আছিস? এতদিন পর হঠাৎ কি মনে করে?
-“আমি ভাল নেই, বন্ধু। বেঁচে থাকার কোন প্রেরণাই আমি খুঁজে পাচ্ছি না, কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে চাই। আমি বাঁচতে চাই, বন্ধু।”
-“একটু খুলে বলতো কি হয়েছে।”
-“তুই তো জানিস বন্ধু, বেঁচে থাকার জন্য আমার একটা থ্রিলের দরকার হয়। সেই থ্রিলের সন্ধান পেতে আমি বহু কিছু করে দেখেছি। কোনটাতেই আমার মন বেশিদিন টিকেনি। শেষমেশ আমি বেঁচে থাকার যথার্থ থ্রিলের সন্ধান পাই সেই রাতে, যে রাতে আমরা রুমের বেলকনিতে বসে প্রথম থ্রি কার্ড খেলেছিলাম। যে অনির্বচনীয় আনন্দ সেই রাতে জুয়া খেলে আমি পেয়েছিলাম, পরবর্তীতে সেটাই হয়ে উঠেছিল আমার জীবনে বেঁচে থাকার একমাত্র পাথেয়, তৈরি করে দিয়েছিল আমার গতিপথ। তারপর থেকে আমি বহু কিছু করেছি, বহু দেশ ঘুরেছি, কিন্তু একদিনের জন্যও ছাড়িনি জুয়া খেলা। নানান সময়ে নানান জায়গায় নানান কিছু নিয়ে বাজি ধরেছি আমি। কিন্তু খেলতে খেলতে, বাজি ধরতে ধরতে এখন এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে বন্ধু, যে এই বাজি ধরাতেও আমি আর কোন থ্রিল পাচ্ছিনা৷ যারা নেশা করে, তারা যেমন নেশার মাত্রা বাড়াতে বাড়াতে এক সময় বিশেষ ধরনের সাপের ছোবল খেয়ে নেশা করে, আর সেই নেশাও এক সময় তাদের কাছে ফিকে হয়ে যায়, আমারও হয়েছে ঠিক তাই। আমি বাঁচতে চাই, বন্ধু। আমাকে বাঁচা, প্লিজ!”
রমিজের কথা শুনে আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। ভাবছিলাম, আমার কি করার আছে৷ আর তখনই আমার মাথায় পুরো পরিকল্পনাটা তৈরি হল, যেন ঐশী কোন সত্তার প্রভাবে৷ আমি তাকে বললাম,
“কাল একবার আসতে পারবি? আমি সব রেডি করে রাখব।”
রমিজ হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে উঠে চলে গেল।
(৪)
পরের দিন৷ তাও ছুটির। রমিজ বসে আছে সোফায়, আমার মুখোমুখি। আর আমাদের দুজনের মাঝখানে যে টেবিল তাতে দুটো কাচের গ্লাসে একই রঙের ড্রিঙ্ক। আর আমার হাতে দুটো কাচের শিশিতে একই রঙের তরল। শিশি দুটো রমিজকে দেখিয়ে আমি বললাম,
-“জীবনে তে বহু বাজি ধরলি বন্ধু, নিজের জীবনকে কখনো বাজি ধরেছিস কি?”
-“না বন্ধু। জীবন বাজি রাখার কথা বিভিন্ন জায়গায় পড়েছি, শুনেছি, কিন্তু আক্ষরিক অর্থে জীবন বাজি রাখার কথা কোনদিন তো মাথাতেই আসেনি!”
-“তাহলে এক কাজ কর, বন্ধু। একবার নিজের জীবনকে বাজি রেখে দেখ। একেবারে আক্ষরিক অর্থেই। হয়তো, এতেই তুই খুঁজে পাবি তোর কাঙ্ক্ষিত সেই থ্রিল, তোর বেঁচে থাকার প্রেরণা! আর সেই আয়োজনই আজ তোর জন্য আমি করে রেখেছি। মাই ফ্রেন্ড! তুই কি তোর জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত?”
-“কেমন সেটা!”
আমি দেখলাম রমিজের চোখ উত্তেজনায় চকচক করছে। আমি বললাম,
-“আমার হাতে যে দুটো শিশি দেখছিস, তার মধ্যে যে তরল, তা দেখতে একই রকম হলেও, এর একটি একেবারেই সাধারণ তরল, তবে অন্যটিতে আছে বিষ, যা খাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে বিষের প্রতিক্রিয়ায় তোর মৃত্যু হবে৷ এখন তোর সামনে রাখা দুটো গ্লাসের ড্রিঙ্কের মধ্যে এই দুটো শিশির তরল আমি মিশিয়ে দিচ্ছি।”
এই বলে আমি দুটো শিশি আলাদা আলাদা ভাবে দুটো গ্লাসে ঢেলে মিশিয়ে দিলাম। তারপর আবার শুরু করলাম,
“এখন তোকে যেকোন একটা গ্লাস বেছে নিতে হবে৷ মনে রাখিস, একটা খেলে তোর কিছুই হবেনা, আরেকটা খেলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই মৃত্যু। অথচ, জীবন আর মৃত্যুর এখানে একই রঙ। দেখে বুঝার উপায় নেই কোনটা জীবন, আর কোনটা মৃত্যু! আর এখানেই তোকে জুয়াটা খেলতে হবে বন্ধু, যেখানে বাজি রাখতে হবে তোর নিজের জীবন। চয়েজ ইজ ইয়োরস। তুই কি রাজি?”
রমিজ জুলজুল করে গ্লাস দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে। আমার কথা শেষ হলে সে যেন কতকটা মন্ত্রমোহিত স্বরে, যেন বা বহু যুগের ওপার হতে বলে উঠল,
“আমি রাজি৷”
এই বলে রমিজ হাত বাড়াতে গেল গ্লাসের দিকে।
“ধীরে বন্ধু, ধীরে। একটা ফর্মালিটি আছে, সেটা সেরে নিই আগে।” আমি বললাম।
রমিজ হাত গুটিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসু নেত্রে আমার দিকে তাকাল। আমি তখন দেরাজ খুলে বের করে আনলাম সেই স্বীকারোক্তিটা, যা আমি আমার এক উকিল বন্ধুকে দিয়ে তৈরি করিয়েছিলাম গতকাল, রমিজ চলে যাওয়ার পর। যেখানে লেখা আছে এই ধরনের কোন জুয়া খেলতে গিয়ে রমিজের মৃত্যু হলে তার জন্য কোন ভাবেই আমি দায়ী থাকব না৷ সে সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় এই বাজি ধরছে। কাগজটি আমি রমিজের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,
“পড়ে দেখ, আর সই করে দে৷ অবশ্য যদি তোর কোন আপত্তি না থাকে, তো।”
রমিজ একবার চোখ বুলিয়েই কাগজটিতে সই করে দিল।
“নাউ ইয়্যু আর কমপ্লিটলি প্রিপেয়ার্ড টু প্লে দা গেইম। লেটস বিগিন।” নাটকীয় সুরে বললাম আমি৷
আর তারপর রমিজ কয়েক বার দুটো গ্লাসের উপর হাত ঘুরিয়ে অবশেষে তার বাম দিকের গ্লাসটাই তুলে নিল আর একবারেই গিলে নিল সবটুকু তরল।
*
রমিজ মারা যায়নি৷ আসলে পুরোটাই ছিল একটা সাইকোলজিক্যাল গেইম৷ দুটো তরলই ছিল সাধারণ, কোনটাতেই বিষ ছিল না৷ আর তাই রমিজের মারা যাওয়ারও কোন প্রশ্ন আসেনা। আমি তো তাকে কেবল একটু নির্দোষ আনন্দ দিতে চেয়েছিলাম। আর তাই নাটকটা জমিয়ে তুলেছিলাম৷ অবশ্য এতে রমিজের কাঙ্ক্ষিত থ্রিলের কোন অভাবই হয়নি। সে তা পুরোদমেই পেয়েছে। কেননা, সে তো আর সত্যটা জানেনা। আর তাই আমার জন্য যেটা নাটক, রমিজের জন্য তা হয়ে উঠেছিল এক জীবন মরণ খেলা। সেই খেলায় নিজের জীবনকে বাজি ধরে সে পেয়েছে বেঁচে থাকার এক নতুন থ্রিল। আমি জানি, এখন থেকে এই থ্রিল সে বার বার পেতে চাইবে, তাই ফিরে ফিরে আসবে আমার কাছে। আর এভাবে প্রতিবার বেঁচে যেতে যেতে এই খেলাটিও তার কাছে এক সময় ক্লান্তিকর, একঘেঁয়ে হয়ে উঠবে। তখন সত্যি সত্যিই একদিন তাকে আমার মেরে ফেলতে হবে। আর সেই মৃত্যুর মধ্য দিয়েই সে লাভ করবে এক নব জীবন; হয়তো, হয়তো না।