ভাতের গন্ধ

তাসফিয়ারা তিন বোন। সে মেজ। সহজ সরল বোকা টাইপ। সারাক্ষণ কী নিয়ে যেন উদাস হয়ে থাকে। ভরা মজলিশে ফস করে এমন একটা কথা বলে ওঠে সবাই হো হো করে হাসতে থাকে এমন টাইপ। প্রতিবেশিরা বিশেষ করে পাশের বাসার খালাম্মারা তাসফিয়ার মাকে সারাক্ষণ উপদেশ দিতে থাকেন এই নিয়ে “আপনার মেয়ের যে কবে বুদ্ধিসুদ্ধি হবে?” আরো নানা উপদেশ চলে। এখনই সব শেখান, নইলে বড় হলে কেমনে একা চলবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাসফিয়ার সামনেই এই কথাগুলো তারা মাকে বলতে থাকেন। তাসফিয়া মনে মনে ভাবে, সে কবে বোকামি করলো আর ভুল কথা বললো? সে কেবল পাশের বাসার খালাম্মার নোংরা ইঙ্গিতপূর্ণ কথার প্রতিবাদ করেছে মাত্র! প্রতিবাদ করলে বুঝি সে বোকা?

তাসফিয়ার অন্য দুইবোন ওর থেকে একদম আলাদা। সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে থাকে। কে কি বললো, কানপড়া দিয়ে গেল মাকে এগুলো নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। বড়বোন রাশনা পড়াশোনায় বেশি ভালো। শিক্ষকরা সারাক্ষণ ওকে নিয়ে প্রশংসা করেন। তারা ধরেই নিয়েছেন, রাশনা বড় হলে ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার কিছু একটা হবেই। সবচেয়ে ছোটবোন রুমানা। সবে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। পড়শোনায় এভারেজের চেয়ে ভালো। সবার ছোট বলে ওর জন্য সব ছাড়।

 

তাসফিয়ার মা দেখতে অসম্ভব সুন্দর। তিন কন্যার পরেও বোঝার উপায় নেই এমন তার রূপ। মাত্র ষোল বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল রূপের কারণে। সহজ সরল চাহিদাশূণ্য মানুষ। যে যা বলে তাই বিশ্বাস করে। স্বামীর কথার ওপর কথা বলার সাহস নেই। তাসফিয়া মায়ের স্বভাবের বেশিরভাগটাই পেয়েছে। মায়ের সাথে তার পার্থক্য শুধু সে ফস করে উচিৎ কথা বলে দেয়, মা ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হলেও মুখ ফুটে কিছু বলে না। সেরকম হলে স্বামীর মুখের ওপরই তার সারাক্ষণ কথা বলতে পারার কথা ছিল। একটা ছন্নছাড়া অপদার্থ লোকের সাথে তার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু বলার সাধ্য কই? তাসফিয়ার বড়বোন ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনায় ভালো বলে বাবামায়ের ভরসার জায়গা। ওর দিকে তাই সবার মনোযোগ। ছোটটাও আদরে-আহলাদে থাকে সবার। একমাত্র তাসফিয়াই কারো কাজে লাগে না, মনোযোগ পায় না। উপরন্তু বোকা বোকা কথা বলে হাসির খোরাক হয়।

 

তাসফিয়ার বাবা সবে অবসরে গেছেন। ছোট একটা পদে চাকরি করতেন। তারওপর ছিল কিনা সরকারি চাকুরি। এখনকার মতো সরকারি চাকরি লোভনীয় ছিল না তখন। বেসিহাবি বলে তিনদিনেই বেতনের টাকা হাপিস। উপরি আয় কি জিনিস তাও বুঝতেন না। চূড়ান্ত ছন্নছাড়া হলে যা হয় তিনি তাই। সময়ের আগেই ঘুষটুষ দিয়ে অবসর নিয়েছেন। আশেপাশে যারা যারা শুনেছে তার এভাবে অবসর নেয়ার কথা সবাই হায় হায় করেছেন। সবার একটা কথা, “ভাই কী ভুল করেছেন কয়দিন পরেই বুঝবেন। ফ্রি রেশন, বাসা, পেনশন সবতো হারালেন এখন। মেয়েরাও সব সেভাবে বড় হয়নি। স্কুল পার করেনি কেউই। সামনে পড়ার খরচসহ সব খরচ আরো কত বাড়বে সে হিসেবও করেননি।” বাবা উল্টা সবাইকে ধমকে দিয়ে বলছিলেন, “এভাবে কেরানির জীবন কয়দিন কাটাবো, বেতনে মাস কুলায় না। এবার করবো স্বাধীন ব্যবসা।” তাসফিয়ার মা বোকাসোকা হলেও ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছিলেন।  কারণ বিয়ের পর থেকে স্বামীকে দেখছেন বেহিসাবি, লাইনছাড়া অপদার্থ। তিনি পাঁচ টাকা যে গতিতে খরচ করেন, পাঁচ হাজার টাকাও সে গতিতে খরচ করেন। কীভাবে সংসারের বাজেট করতে হয় এই জীবনে শিখেননি। আর শিখবেন বলে মনে হয় না। মাসের প্রথম তিনদিন যেতে না যেতে বেতন টাকা শেষ। তারপর থেকে শুরু হতো ধারকর্জ। তাসফিয়াদের চেনাজানা-অচেনা, আত্মীয়-অনাত্মীয় এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যার থেকে অন্তত একবার হলেও ধার নেন নি। রাস্তায় যদি কারো সাথে দেখা হয় আর জিজ্ঞেস করেন বাবা কেমন আছেন, ওরা তখন বুঝে যায় ঘটনা কোনদিকে যাচ্ছে। বাসায় এসে মাকে বললেই মা বলতেন, দেখ তোর বাপ টাকা ধার করে বসে আছেন। পারেতো ঐ এক কাজ!

তাসফিয়ার এসব নিয়ে সারাক্ষণ একটা অস্বস্তি অশান্তি কাজ করতে থাকে। কিন্তু সে তার বোনদের সাথে কখনো এসব নিয়ে আলাপ করতে পারে না। ওর বোনরা খুব নির্বিকার। ওরা মনে করে এসব বাবার মাথাব্যাথা, ওরা ওদের খাওয়া পরা পেলেই হলো। তাসফিয়ার মা যে চিন্তা করে এটা সে বুঝতে পারে, কিন্তু মায়ের সাথেও তার এসব নিয়ে কথা বলতে সংকোচ, আড়ষ্টতা কাজ করে।

বাবা চাকরি ছাড়ার পর অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। অবসরের টাকা, পেনশনের টাকা সব ফুরাতে ফুরাতে তলানীতে গিয়ে ঠেকে। ব্যবসা করবে বলে এর পেছনে টাকা ঢালে, ওর পেছনে টাকা ঢালে। বাসায় নতুন নতুন লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যায়। বাবা ব্যাগ ভর্তি বাজার আনেন। মায়ের রান্না ব্যস্ততা বেড়ে যায়। নিরবে রান্না করে যান। তাসফিয়া আড়াল থেকে দেখে মায়ের চোখে দুশ্চিন্তা। মুখটা উদাস। খাবার টেবিলে নতুন নতুন ব্যবসার আলাপ সার। কোনকিছু আর দাঁড়ায় না।

 

বোনদের দেখে তাসফিয়ার হিংসাই হয়। খালি ভাবে, এত ইমোশনাল আর বোকা না হলে আজকে বোনদের মতো নিশ্চিন্ত থাকতে পারতো। বড়বোন বুয়েটে চান্স পেয়ে ক্লাস শুরু করে দিয়েছে। তাসফিয়া  কলেজে উঠেছে যদিও তার মন নেই পড়াশোনায় আগের মতো। কলেজের বেতন আটকে থাকে। জরিমানাসহ কয়েকমাসের বেতন একসাথে দেয় বাবা। ক্লাসটিচার ক্লাস শেষে যাদের বেতন বকেয়া তাদের বাবাদের অফিস রুমে দেখা করতে বলেন। সবার সামনে নিজের নাম শুনতে একদিকে শুনতে লজ্জা লাগতো আবার কয়মাস আটকে থাকবে এই ভেবে পড়াশোনায় কিছুতে মন বসাতে পারতো না। আগে বাবা যখন বাবা চাকরি করতেন তখনও দুঃচিন্তা ছিল। তখনও এইভাবেই চলতো। জরিমানাসহ কয়েক মাসের বেতন দিলেন, আবার মাসের পর মাস বাকি পড়ে যেত।

বাবা ব্যবসা ব্যবসা করে চাকরি ছাড়লো। এরমধ্যে দুই বছর কেটে গেছে। কোন ব্যবসা আদতে দাঁড়ালো না। বাবা সারাদিন বাইরে বাইরে থাকেন। কোথায় যান, কী করেন ওরা জানতে পারে না। মায়ের কপালে চিন্তার রেখা তাসফিয়ার নজর এড়ায় না। যে যা ভবিষ্যতবাণী দিয়েছিল তা একটু একটু করে ফলতে শুরু করেছে। তবু বাবা ভীষণ গোয়ার আর বদমেজাজি। হারতে কিছুতেই রাজি না বাড়ির লোকের কাছে। মা রাতে শুয়ে একদিন ছোট ছোট করে জানতে চান, “কই তোমার ব্যবসার কী হলো?” তাসফিয়া কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে বাবা উত্তরে কী বলছেন? বাবা মাকে ধমক দেন, “সব এত সোজা নাকি? তুমি ঘরে থেকে কেমনে বুঝবা? সকালে ঘুম থেকে উঠাইয়া দিও, এক লোকের সাথে দেখা করতে যাব।” তারপর আলাপ থেমে যায়। তাসফিয়ার উচ্চমাধ্যমিক চলছে তখন। সে পড়ায় মনোযো না দিয়ে বাবার ব্যবসা নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকে। একে একে পরীক্ষা শেষ হয়, রেজাল্ট হয়। সেই রেজাল্ট নিয়েও বাবা তাকে ভৎসনা করে। অথচ এত বছরে কখনো ঠিক করে খোঁজও নেননি তিনি। কেমন চলছে তার পড়াশোনা, কোন সাবজেক্টে বিশেষ খেয়াল বা মাস্টার লাগবে কিনা? রাশনার সেময়ে সব কিছুতে পাই টু পাই খরব ঠিকই বাবা রাখতেন।

 

তাসফিয়াদের বাসা ভাড়া বাকি পড়েছে কয়েক মাসের। এর আগে অনিয়মিত দিচ্ছিলেন। এবার একমাসের ভাড়া দেওয়ারই উপায় নাই। বাড়িওয়ালা ধৈর্য ধরে অনেকদিন অপেক্ষা করেছেন। বাবাকে ধরলে জিজ্ঞেস করেন, অমুক তারিখে দিবেন। পরে দেখা যায় সেই নির্দিষ্ট দিনে তিনি বাসায়ই ফিরছেন না। এমন চোর-পুলিশ খেলা বাবার সাথে বাড়িওয়ালার চলতে থাকে বেশকিছু দিন। বাড়িওয়ালা মাকে ডেকে বলেন, আপনি আর আপনার সন্তানরা সবাই এত ভালো-ভদ্র দেখে আমি কিছু বলতে পারি না। কিন্তু এভাবে আর কতদিন। আপনারা বাসা ছেড়ে দিন। টাকা দেওয়া লাগবে না। তাছাড়া যতবেশি দিন থাকবেন ততবেশি ভাড়া জমা পড়বে। আর আপনাদের বাসায় জিনিসপত্র রেখে যে দিব, সেগুলা বিক্রি করে কয় টাকাই পাব। ভাই আসলে বলে দিয়েন টাকা দিতে হবে না, বাসাটা খালি করে দেন। মা লজ্জায় এতটুকু হয়ে যান।

এদিকে বাসায় একেকদিন একেক পাওয়াদার আসতে থাকে। মাছওয়ালা, সব্জিওয়ালা, চায়ের দোকানদার, যাদের থেকে ধার নিয়েছিলেন তারা। বেল বাজলেই তাসফিয়ারা বুঝতে পারে নিশ্চয়ই কোন পাওনাদার। এর বাইরে আর কারো সাথে তাদের তেমন আর যোগাযোগ নেই। যখন অবস্থা ভালো ছিল আত্মীয়-অনাত্ময়রা আসতো আর মায়ের হাতের মজার মজার রান্না খেত। দিন যে পড়ে গেছে এই খবর এতদিনে তারাও জেনে গেছে। খোঁজ নিতে গেলে উল্টা সাহায্য দিতে হবে এটা পাগলেও বোঝে।

কয়েকদিন পর পর লুকিয়ে গভীর রাতে বাবা বাড়ি আসেন। জানলা দিয়ে চুপি চুপি ডাকেন। মা তখন দরজা খুলে দেয়। হাত খালি থাকে বেশিরভাগ সময় । কোন বাজার নেই। খাওয়া দাওয়ার অবস্থা খুবই করুণ। অনেক দিন ধরে এমন চলছে। মা যেদিন বলতেন, বাসায় কিছুই নেই, হয়তো কিছু আটা অবশিষ্ট আছে সেদিন থেকে বাবা হাওয়া। কোন খোঁজ আর থাকতো না। মাকে তাও কখনো এসব নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় না। মায়ের অসীম ধৈর্য দেখে আর অবাক হয়। বাবার মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলো কি সুন্দর সব বিশ্বাস করে অথবা মেনে নেয়। আর তার টুকটাক সেলাই করে কামানো টাকা দিয়ে একটু ভাত আর ডালের যোগান দেন মা। রাতে খেতে খেতে বাবার ব্যবসার গল্প আগের মতই চলে যেদিন বাসায় ফেরেন। ভাতের যোগান কি দিয়ে হচ্ছে তা নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই উল্টা সকালে যাওয়ার সময় মা থেকে জোড় করে ১০০/২০০ যা টাকা পান নিয়ে যান। মা একদিন বাবাকে যাওয়ার সময় বললেন, আর কোন উপায় নেই, কোথাও কোন টাকা নেই। একমুঠ চালও ঘরে নাই। বাবা কিছু না বলে বেরিয়ে যান।

রাত বাড়তে থাকে বাবার কোন দেখা নেই। দুপুরটা কোনমতে চালিয়ে নিয়েছিলেন ৪জনা। কিন্তু রাতের আর ব্যবস্থা নেই। মা বুঝতে পারেন কী হতে পারে আজও। পাশের বাসায় তাসফিয়াকে পাঠান কিছু চাল ধার আনার জন্য। আগেও এনেছিলেন আবার ফেরত দিয়েছিলেন। এতদিনে তারাও বুঝে গিয়েছিল। ভালোমন্দ কিছু রান্না করলে ওদের বাসায় পাঠাতেন। সেই মাছ কিংবা মাংস অমৃতের মতো লাগতো! তিনবেলা শাক নইলে এংকর ডাল খেতে খেতে ওদের পেটে চড়া পড়ে গিয়েছিল। সেদিন রাতে বাবা সত্যি সত্যি ফেরেন না। পরপর কয়েকদিন চলতে এমন চলতে থাকে। হঠাৎ একদিন বাবা ফেরেন বেশ রাতে। হাতে কেজি দুই চাল আর আলু। মা ভাত চড়ান। আলু সিদ্ধ দেন। মোটা চাল অনেক দিন ধরেই সবাই মিলে খাচ্ছিল। স্বাদও কারো অজানা নয়। কিন্তু আজকের ভাতটা কেমন জানি! কোনটা ভাত বেশি সিদ্ধ, কোনটা কোনটা আঠালো, কোনট ছোট, কোনটা বড়। মোটকথা, কারো সাথে কারো মিল নেই। আর সেকি বিকট গন্ধ! তাসফিয়া মাকে ভাতের কথা জিজ্ঞেস করলে মা বলেন, শুনেছি ভিক্ষার চাল বাজারে বেশ সস্তায় বিক্রি হয়।

 

 

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত