বেলা শেষে

 

আগুনের পরশমনি
ছোঁয়াতে চাই প্রাণে,
ক্লান্ত আমি খুঁজে তারে
পাই না কোনোখানে।

মাত্র সন্ধে হয়েছে।রাস্তার সোডিয়াম বাতিগুলো লাল লাল চোখ করে নীচের মানুষগুলোকে দেখছে,কিন্তু মানুষগুলোর সেটা খেয়াল করবার সময় কই ! কাজ শেষে সবাই বাড়িতে ফিরতে ব্যস্ত।
তাদেরই একজন শফিক সাহেব;অফিস শেষে কলেজ ভার্সিটির তাগড়া তাগড়া ছেলেপেলেদের সাথে এক রকম যুদ্ধ করে একটা লোকাল বাসে উঠে পড়েন,এবং খুবই আশ্চর্যজনকভাবে পেছনের দিকে একটা সিটও পেয়ে যান।সিটে বসতে বসতে শফিক সাহেব একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।অফিস টাইমে যানবাহনের সমস্যা নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় একটা চিঠি পাঠাতে হবে।পরক্ষণেই ভাবেন কী লাভ চিঠি পাঠিয়ে ? এই দেশে সবাই তার মত পত্রিকা অফিসে চিঠি পাঠাতে পারে, কিন্তু সমস্যার সমাধান করতে কেউ এগিয়ে আসে না। পত্রিকা অফিসে চিঠি পাঠিয়েই সবাই ভাবে, বিরাট কাজ করা হয়েছে, নিজেকে দেশের একজন সুনাগরিক হিসেবে জাহির করা গিয়েছে !
এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে একটু যেন ঝিমুনি চলে আসে শফিক সাহেবের। জানালার পাশে বসার কারনে বাতাসের ঝাপটা এসে ঝিমুনিটাকে আরো গাঢ় করে দেয়। সেই গাঢ় ঝিমুনির মাঝে শফিক সাহেব একটা স্বপ্নও দেখে ফেলেন !
স্বপ্নে দেখেন- তিনি তাঁর নাতিকে নিয়ে বাগানে হাঁটাহাঁটি করছেন। তারপর হঠাৎ করেই নাতির হাতে কীভাবে যেন একটা বল চলে আসে। তাঁরা কিছুক্ষণ সেই বলটা দিয়ে খেলা করেন। বলে তৃতীয়বার লাথি মারার পর চতুর্থবার যেই মারতে যাবেন, তখনই সেটা উধাও হয়ে গিয়ে তার জায়গায় একটা নদী চলে আসে ! নদীর পার ধরে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর চোখে পড়ে একটা পটকা মাছ মরে পড়ে আছে। সেটাকে যেই তুলতে যাবেন, অমনি তার সামনে আরেকটা দেখতে পান। সেটাকে তুলতে নিতেই আরেকটা ! আর তখনই তিনি বুঝে ফেলেন, তিনি স্বপ্ন দেখছেন ! এটা তাঁর একটা অদ্ভুত গুণ; স্বপ্নের মাঝেই তিনি বলে দিতে পারেন – এটা স্বপ্ন !এবং তখন স্বপ্নে যার সাথে দেখা হয়, তাকেই বলেন, ‘ জানেন, এই যে এখন আমি আপনার সাথে কথা বলছি, এটা একটা স্বপ্ন !’ আরও মজার ব্যাপার, তিনি ইচ্ছে করলেই স্বপ্ন থেকে বাস্তবে বের হয়ে আসতে পারেন।
বাস বেগম রোকেয়া সরণীর সিগনালে ওসে থামে। শফিক সাহেব স্বপ্ন থেকে বের হয়ে এসে মন খারাপ করে রাস্তার দৃশ্য দেখতে থাকেন। মন খারাপের কারণ, নাতি। স্বপ্নে নাতিটাকে দেখে মন খারাপ হয়ে গিয়েছে। প্রায় এক বছর হলো নাতিটাকে দেখেন না। এক বছর আগে কোনও কারণ ছাড়াই ছেলেটা বৌকে নিয়ে আলাদা বাসা ভাড়া করে। কিংবা কে জানে, কারণ হয়তো একটা আছে, কিন্তু শফিক সাহেবের মত আদিকালের সরল মস্তিষ্কের মানুষগুলো সেই কারণ ধরতে পারেন না।
শফিক সাহেবের ছেলে শফিক সাহেবকে পছন্দ করে না- এটা তিনি বোঝেন, কিন্তু ঠিক কী কারণে পছন্দ করে না, সেটা তিনি ধরতে পারেন না। কলেজে ওঠার পর থেকে ছেলে তাঁর সাথে কথা বলে না, অতি জরুরি কোনও কথা থাকলে মা’কে দিয়ে বলায়। তিনি নিজে যদি যেচে পড়ে কোনও কিছু জিজ্ঞেস করেন, তবে ভ্রূজোড়া কুঁচকে তার মাঝে পৃথিবীর সমস্ত বিরক্তি নিয়ে এসে উত্তর দেয়। অথচ তিনি তাঁর সমস্ত সঞ্চয় দুই ছেলে মেয়ের পেছনে ব্যয় করেছেন। তাদেরকে পড়ালেখা শিখিয়ে শিক্ষিত করেছেন। যৌতুক বিরোধী সমাজে মেয়েকে কালার টিভি, ফ্রিজ এবং যাবতীয় ফার্নিচারের বিনিময়ে বিয়ে দিয়েছেন। এগুলো নাকি যৌতুকের পর্যায়ে পড়ে না ! তার উপর তাঁর মেয়ে যে অপরাধ করেছে, তাতে তো বলা চলে তিনি কমের উপর দিয়ে পার পেয়ে গিয়েছেন। অপরাধটা কী জানতে ইচ্ছে করছে ? তাঁর মেয়ে এই পৃথিবীতে আগমন করেছে ময়লা চামড়া নিয়ে !
ছেলের মুখপাত্র হিসেবে শফিক সাহেবের স্ত্রী যেদিন বললেন, ‘লাখ দশেক টাকা হলে ছেলের একটা ভাল মানের সরকারী চাকরী হওয়ার সুযোগ আছে, উপরিও ভাল,’ সেদিন তেত্রিশ বছরের সরকারী চাকরী জীবনে দুর্নীতি করার অফুরন্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতিযুক্ত এক কাপ চাও স্পর্শ না করা এই শফিক সাহেব ছেলের সুখের কথা বিবেচনা করে তাঁর শেষ সম্বল গ্রামের বাড়ির ভিটে সমেত সকল আবাদি জমি বেচে দিয়ে সেখানকার হিসেব নিকেশ শেষ করে দেন। তারপরও ছেলে তাকে পছন্দ করে না কেন, সেটা তাঁর কাছে বোধগম্য নয়। তবে কি সরকারী চাকরী জীবনের তেত্রিশটা বছর ঘুষ খাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা গ্রহন করেননি, সেটাই ছেলের অপছন্দের কারণ ? নাকি সরকারী চাকরী শেষে এই বুড়ো বয়সে একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরী নিয়েছেন, সেটা ? প্রথম কারণটাই কেন যেন বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয় শফিক সাহেবের।
বাস মিরপুর ১০ নাম্বারে এসে থামতেই অনেক লোক নেমে পড়ে। অবশিষ্ট যে ক’জন আছে, তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গা এলিয়ে বসেছে। হেলপার শেষ মুহূর্তে কিছু অতিরিক্ত লাভের আশায় ‘ওই এগার, বারো, পল্লবী; এগার, বারো পল্লবী,’ বলে সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। তার প্রতি মায়া দেখিয়েই কিনা কে জানে, একজন ষাট পঁয়ষট্টি বছর বয়সি ভগ্ন স্বাস্হ্যের বৃদ্ধ লোক বাসে উঠলেন।শফিক সাহেবের পাশে বসা বাইশ তেইশ বছর বয়সী ছেলেটা সদ্য বাসে বাসে ওঠা বৃদ্ধকে দেখে এক লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, এবং বৃদ্ধ লোকটার কাছে গিয়ে বাসের সবাইকে চমকে দিয়ে ঝপ করে তাঁর পা ছুঁয়ে ছালাম করে ফেলে ! তারপর কিছু একটা বলতেই বৃদ্ধ লোকটার হকচকানো ভাব কিছুটা কমে আসে। ছেলেটা পরম যত্নে বৃদ্ধকে ধরে এনে তার সিটে বসিয়ে দেয়, এবং আশে পাশে বহু সিট ফাঁকা সত্ত্বেও সে বৃদ্ধের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথমে শফিক সাহেবের কাছে পুরো বিষয়টা কেমন জটিল মনে হলেও বৃদ্ধ এবং ছেলেটার কথা কানে যেতেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যায়।
‘তুমি তাহলে আদর্শ পল্লী স্কুলের ছাত্র ছিলে ?’ ছেলেটাকে বলেন বৃদ্ধ।
‘জী স্যার।’
‘তো এখন কোথায় আছো ? সে কী, বসছো না কেন তুমি ! পাশের সিট তো খালি-ই আছে। বসো বসো।’
‘না না, ঠিক আছে,’ বলে দাঁড়িয়েই থাকে ছেলেটা।
‘ সে কী কথা, এতগুলো সিট খালি থাকতে তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে !’
‘না না, আমার কোনও অসুবিধে নেই। আপনি স্যার এখানে কার কাছে এসেছেন ?’ বলে প্রসঙ্গটা বদলে দেয় ছেলেটা।
‘আমার ছোট ছেলের বাসা এগারো নাম্বার, তার বাসাতে বেড়াতে এসেছি।’
শিক্ষক ছাত্রের কথার মাঝখানে হেলপার এসে উপস্থিত।
‘চাচা, ভাড়াডা ?’ সাথে সাথেই ছেলেটা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে মানিব্যাগ থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে হেলপারের হাতে গুঁজে দেয়। বৃদ্ধ তা দেখে হা হা করে ওঠেন।
‘করো কী ! আমার কাছে ভাড়া আছে তো।’ কথাটা বলতে বলতেই বাস এগারো নাম্বার এসে পড়ে।
‘আসেন স্যার, আপনাকে নামিয়ে দেই,’ বলে শ্রদ্ধা এবং মমতা মেশানো হাতটা বৃদ্ধের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
‘না ঠিক আছে, আমি পারবো। তুমি কোথায় নামবে ?’
‘বারো নাম্বার,’ বলে বৃদ্ধের পেছনে পেছনে গিয়ে অতি যত্নের সাথে নামিয়ে দিয়ে এসে আগের জায়গায় বসে ছেলেটা।
পুরো ঘটনাটা শফিক সাহেবের মনে এক ধরনের আবেগ তৈরি করে। শ্রদ্ধাবোধ জিনিসটা তা হলে পৃথিবী থেকে এখনও উঠে যায়নি। আজকালকার ছেলেপেলেরাও তাদের স্কুল জীবনের শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করে- ভাবতেই এতক্ষনের মন খারাপ করা ভাবটা দূর হয়ে যায় শফিক সাহেবের।
‘খুব প্রিয় টিচার বুঝি তোমার ?’ আচমকাই প্রশ্নটা করে বসেন শফিক সাহেব।আসলে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছিল ছেলেটার সাথে শফিক সাহেবের।
‘জী ? জী।’
‘কোন সাবজেক্ট পড়াতেন তোমাদের ?’
‘জী ? উনি তো আমাদের কেরানি স্যার ছিলেন।’
কথাটা শুনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে যান শফিক সাহেব। সামান্য একজন কেরানি স্যারের প্রতি এত শ্রদ্ধা ! থমকানো ভাবটা কাটিয়ে উঠে শফিক সাহেব ছেলেটাকে বলেন – ‘বাবা, আমি কি তোমার মাথায় হাত রেখে একটু আশীর্বাদ করতে পারি ?’
ছেলেটা কিছু না বুঝে শফিক সাহেবের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। শফিক সাহেবের চোখ দুটো জলে টলমল করে ! কী কারণে শফিক সাহেব নিজেও জানেন না।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত