রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ,তেল বা চালের দাম বৃদ্ধি কিংবা সাম্প্রতিক নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা ছাপিয়ে আমাদের বাসায় এই মুহূর্তে সবচেয়ে ‘হট টপিক’ হচ্ছে-
কাজের বুয়া চলে গেছে।
জি, ঠিক শুনছেন!আর শুনে ইতোমধ্যেই যারা এক-দু’বার আঁতকে উঠলেন তাঁরা আরও কয়েকবার আঁতকে উঠবেন যখন শুনবেন এই বুয়া চলে যাওয়ার ঘটনায় আমাকেই দায়ী করা হচ্ছে,করছে আমার গিন্নি! মাত্রই বাঁকা চোখে দুষ্টুহাসি ছুঁড়ে দেওয়াদের বলে রাখি বুয়া চলে যাওয়ার সাথে আমার সংশ্লিষ্টতা কিন্তু ‘ওরকম’ কিছু না।
কী রকম?বলছি শুনুন।
গতকালের ঘটনা। আমি ছিলাম অফিসে। বিকালের দিকে গিন্নি আমাদের পাঁচ বছরের মেয়ে,মৌনিকে অল্প সময়ের জন্য কাজের বুয়ার কাছে রেখে নিচে গিয়েছিল দোকানে,প্রয়োজনীয় কিছু আনতে।
দোকান থেকে ফিরে গিন্নি শুনল যে বুয়া বলছে, ‘খালাম্মা,কাইল থাইকা আর আইতাম না, আমারে এত বড় অববাদ (অপবাদ)!’
অপবাদ? কিসের অপবাদ?
আমি বাসায় ছিলাম না তখন।আর গিন্নি তো দোকানেই ছিল।তবে অপবাদটা দিল কে?
গতরাতে অফিস থেকে ফেরার পর থেকে গিন্নির কাছ থেকে শত চেষ্টা করেও আসল ঘটনা বের করতে পারলাম না। বুয়া নেই-এমনি তার মেজাজ খারাপ। তাকে বেশি না ঘাটিয়ে অগত্যা মেয়ে,মৌনিকে নিয়ে আড়ালের ঘটনা উদ্ধার করতে বসলাম ।
নিশ্চিত ছিলাম মেয়ের কাছ থেকে মূল ঘটনা উদ্ধার করা যাবেই।নাম তার ‘মৌনি’ হলেও সে শতভাগ রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা’র প্রথম লাইন ‘আমার পাঁচ বছর বয়সের ছোটো মেয়ে মিনি এক দণ্ড কথা না কহিয়া থাকিতে পারে না– টাইপের।
চুপি চুপি স্টাডিরুমে ডেকে নিয়ে মৌনিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিরে বুড়ি,ঘটনা কি?’
মৌনি– আর বাবা,বোলো না ঘটনা..
আমি- আমি কি বলব? বলবি তো তুই!
মৌনি- তাহলে মনোযোগ দিয়ে শুনো।ঘটনা হয়েছে কি..
আমি- কি কি? তাড়াতাড়ি বল..(অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিলাম)
মৌনি- আহা! আস্তে বাবা,শোনো…হয়েছে কি, আম্মু আমাকে রেখে নিচে গেছে। আমাকে বলেছে বুয়া পেঁয়াজ,রসুন বাটছে।ওখানে কিচেনে চুপ করে ছোট্ট টুলটা নিয়ে বসে থাকতে। আমি চুপচাপ লক্ষী মেয়ের মত টুলে বসে আছি।এই তো।
এই তো!এ ঘটনার জন্য বুয়া চলে যাবে?
অবাক হয়ে তাকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম,
‘তাহলে তুই বলছিস বুয়ার সামনে বসেছিলি তাই বুয়া চলে গেছে!’
মৌনি- ‘না।বুয়া তখন পেঁয়াজ-রসুন বাটছিল আমি বুয়াকে বলেছি যে বুয়া ঠিকমতো কাজ করো ।আমি কিন্তু সব দেখছি, পাহারা দিচ্ছি।আর তুমি কিন্তু কোন পেঁয়াজ-রসুন চুরি করবে না।’
বিস্ময়ে আমার চোখ কপালে উঠল।মাই গড!সে কী সর্বনাশ করেছে তা কি সে বুঝেছে!
বুয়ারা যদি মাসে দশ দিনও না আসে তবুও আমাদের দেশের ’আন্তর্জাতিক নিয়মে’ তাদের কিছু বলা যায় না।হাসি মুখে বলতে হয়, ‘না ঠিকই আছে, তোমার তো বিরাট বিপদ-আসতে পারার কথা না।এমন সমস্যা হলে মাঝে মাঝে তুমি এসো না!’
ক্ষণিকের বিস্ময় কাটিয়ে মেয়েকে বললাম, ‘কিন্তু বুড়ি! তুই বুয়া খালাকে পেঁয়াজ, রসুন চুরির কথা কেন বললি? তোকে এটা কে শিখিয়েছে?খালা তো কষ্ট পেয়ে চলে গেছে!
মৌনি– কেন? তুমি!
কি!আমি! আমি? হে ধরণী! দ্বিখন্ডিত হও-পানি উঠুক,মাছ ধরি!
মৌনি এদিকে একমনে বলেই চলেছে, ‘তুমিই তো পড়ার সময় আমাকে বলো-
‘বুড়ি,ঠিক মতো পড়।আমি কিন্তু পাহারা দিচ্ছি।পড়া চুরি করবি না,সব দেখছি!”
মেয়ে বলে কি !পড়া চুরি আর পেঁয়াজ- রসুন চুরি এক হলো? বাচ্চা-কাচ্চা আসলেই ভয়ংকর!এদের তো কিছু বলাই দেখি দায়!
ডিনার সেরে মেয়েকে ওর রুমে ঘুম পাড়িয়ে শুতে এলাম।শোয়ার সময় গিন্নিকে বললাম,
‘মৌনি বুয়াকে যেভাবে কথাটা বলেছে আসলে মন খারাপ করার মতোই। অন্তত চোর বলাটা উচিত হয়নি! ‘
গিন্নী আমার উপর প্রায় লাফিয়ে পড়ল।
‘উচিত হয়নি মানে! তুমি কি উচিত কথা বলো সব সময়? কতবার বলেছি বাচ্চাদের সাথে তোমার টিচিং-এর ফিলোসফি মার্কা কথা বলবে না। সহজ সরলভাবে কথা বলবে।মনে নেই তোমার ফিলোসফিমার্কা সানডে-মানডে শেখানোর জন্য একবার আমাদের মৌনির স্কুলে ডাক পড়ল!’
সর্বনাশ! ঘটনা তো এখন অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে দেখি।এ তো সাক্ষাৎ ভাংচুরের সাথে মার্ডার কেস!মনে মনে প্রমাদ গুনলাম আর এক বছর আগে ফিরে গেলাম।
বছরখানেক আগে স্কুলে মৌনির ইংলিশ টিচার ওকে ‘সাতদিনের’ নাম ইংরেজিতে বলতে বলেছিলেন।
মৌনি বলেছিল,’কোনটা বলব,মিস? আমারটা না আব্বুরটা?
টিচার নাকি থ’ হয়ে বলেছেন: ‘মানে?দুইটাই বল দেখি।’
মৌনি নাকি বলেছে,
‘মিস,আমারটা হলো- স্যাটারডে , সানডে, মানডে , টুইসডে, ওয়েডনেসডে, থার্সডে, ফ্রাইডে। আর আব্বুরটা হলো ৬ দিন-Fry-Days (স্যাটারডে , সানডে, মানডে , টুইসডে, ওয়েডনেসডে, থার্সডে, ফ্রাইডে)। এসব দিনে নাকি আব্বুকে অফিসে ভাজা হয়….. হি হি হি…. আর একদিন হল- ফ্রাইডে (Friday) ।এদিন আব্বু বাসায় থাকে,ছুটি।
মেয়েকে সাত দিনের নাম শিখাতে গিয়ে একদিন এমন কথা বলেছিলাম বটে তবে সেটা দুষ্টুমি করে।এটার পরিণতি এত দূর গড়াবে সেদিনও বুঝতে পারিনি।শিশুরা যারপরনাই সংবেদনশীল!খুব খেয়াল করে…
ধুর!খেয়াল করে আর কি হবে?কাজের বুয়া তো চলে গেছে!
রাতে ‘বুয়া নেই-বাসার কি হবে-কিভাবে সব সামলানো যায়-গিন্নি/মেয়ে কি করবে’ ইত্যাদি সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। সকালে আচমকা কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাঙল।উফ।কোন মরার…
চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলে দেখি, পাশের বাসার ভাবি দাঁড়িয়ে।উনি একা না,পুরান-দোমড়ানো শাড়ি পড়া মধ্যবয়সী এক গোবেচারা টাইপ নারীও আছে।
ভাবি হাসিমুখে সালাম দিয়ে বললেন,’কেমন আছেন,ভাই ?
(বলতে চাইলাম,’কেমন আর থাকব ভাবি! আমার ফিলোসফির জোরে বাসা থেকে বুয়া চলে গেছে। ভাংচুরের সাথে মার্ডার কেসে আছি!আমার থাকা আর না থাকা !)
কিন্তু বলা হলো না। প্রতিবেশি ভাবিই বলে চল্লেন,‘ভাবি কই? উনি বলছিল,আপনাদের কাজের মানুষটা চলে গেছে।আমাদের এলাকার (উত্তরবঙ্গের) এই মহিলা কাজ খুঁজছিল।তাই নিয়ে এলাম। কথা বলে দেখতে পারেন।’
আমার চোখ-মুখ চকচক করে উঠল। নিমিষেই রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা মাথায় এলো :
“ রুদ্র, তোমার দারুণ দীপ্তি
এসেছে দুয়ার ভেদিয়া;
বক্ষে বেজেছে বিদ্যুৎবাণ
স্বপ্নের জাল ছেদিয়া ”
এ যেন দুয়ার ভেদ করে বিদ্যুতের মতো ‘স্বপ্নের বুয়া’ চলে এলো। এজন্যই ভাবিদের আমার এত ভালো লাগে!
আরে নাহ! কি বলে ফেললাম এসব!আপনারা হয়ত ভাববেন, ইয়াল্লা,না!…ওসব কিছু না!কি যা তা বলছি…আসলে বুয়া চলে গেলে মাথা এমনই হয়,ভাই!
দেখতে দেখতে দিন সাতেক চলে গেল কিভাবে টের পেলাম না।হামিদা,মানে সেই প্রতিবেশি ভাবির ঠিক করে দেওয়া বুয়া আমাদের বাসায় কাজ করছে। দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ুক কিংবা আমার দাম কমুক বুয়াটা ভালোই কাজ করছে। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সে-তবে প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই।কীভাবে? বলছি।
অফিস থেকে ফিরে গত সন্ধ্যায় দেখি হামিদা বাথরুমে কাপড়-চোপড় ভেজাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে পরনের শার্ট আর প্যান্টটা চেঞ্জ করে তাকে ধুতে দিলাম। একটু পর দেখি হামিদা আমার হাতঘড়িটা নিয়ে এসে বলছে, ‘ভাইয়া,এডা প্যান্টের পকেটে পাইসি।সাবুন দিয়া ধুইয়া দিছি।’
হতবাক হয়ে গেলাম!ঘড়িটা থেকে তখনও টপটপ করে পানি মাটিতে পড়ছে।এ কী দেখছি! হঠাৎ কি মনে হলো জানিনা। একপ্রকার ছোঁ মেরে তার হাত থেকে ঘড়িটা নিয়ে বারান্দায় চলে এলাম। অন্যান্য কাপড়ের পাশে ক্লিপ দিয়ে ঝুলিয়ে শুকাতে দিয়ে এলাম হাতঘড়িটাকে। ধুয়েই যখন ফেলেছে… কিচ্ছু বলার দরকার নেই তাকে। যদি চলে যায়? তারচে ঘড়িটা দড়িতে মেলে দিতে দোষ কি?
আজকে সারাদিন অনেকে হোয়াটসঅ্যাপ, ইনবক্সে, মেসেজে হাতঘড়িটার কি অবস্থা খোঁজ-খবর নিয়েছেন। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। সকল বিপদ-আপদ কাটিয়ে সৃষ্টিকর্তার কৃপায় ঘড়িটা ঠিকঠাক মতোই চলছে,চলছে সময়ও।
বলে রাখি,সময় ঠিকঠাক মত চলে ধোয়া ঘড়ির কারণে নয়,কাজের বুয়ার কারণে। আমার অবস্থায় পড়লে একমত হতে পারেন,না পড়লে না-ও পারেন।