ইক্যুয়াল টু মানে সমান সমান

মাহতাব হোসেন অতিমাত্রায় ব্যাস্ত। এত বড় ওয়েডিং সেন্টারের এ  মাথা থেকে ও মাথা তিনি যেন একরকম দৌঁড়াচ্ছেন । তিনি একা  নন, আশেপাশে তার অফিসের অধঃস্তন দুজন কর্মকর্তাকেও দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে  মাহতাব হোসেন গলা চড়িয়ে কথাও বলে উঠছেন। তিনি  একই সাথে উচ্ছ্বাসিত এবং টেনসড। হয়তো একজন ভিভিআইপি গেষ্টের গাড়ী এসে হাজির হয়েছে গেটে কিন্তু তিনি দেখলেন গেটের সামনে কোন একটা জটলা-একটু ভারী কন্ঠে  তার এসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ারকে বলে উঠছেন – এই যে রাহাত, কি ব্যাপার- ওদিকে কেউ নেই নাকি?

সাথে সাথে রাহাত আবার তার অধিনস্ত কোন এক সাব এসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ারের দিকে ছুটে গিয়ে নিলো এক হাত চোটপাট । এভাবে অফিসের আদলেই এখানেও পানি নিচের দিকে গড়াচ্ছে। তারপরও সবকিছু একদম পরিকল্পনা মাফিক চলছে বলেই দৃশ্যমান হচ্ছে। মাহতাব সাহেব প্রচন্ড শীতাতপ এই পরিবেশও স্যুট আর জামার ভেতেরে ঘামের ছোঁয়া টের পাচ্ছেন এবং টের পাচ্ছেন ভেতরে ভেতরে এক ধরনের পরিপূর্ণতার আনন্দও।

তাদের ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে বড় কর্তার ছেলের বিয়ে বলে কথা। কাজের যেমন শেষ নেই, ভুল ত্রুটিরও সুযোগ নেই। মাহতাব হোসেন বড় স্যারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা। অফিসের বড় বড় প্রোজেক্টের মতই এই বিয়ের অনুষ্ঠানটিও একটি উচ্চ মার্গীয় প্রোজেক্ট মনে করেন মাহতাব হোসেন এবং মাহতাব হোসেন যেন  এই  বিয়ে প্রোজেক্টের অলিখিত পিডি (প্রোজেক্ট ডিরেক্টর)। বড় স্যারও মাহতাব হোসেনের ডিরেকসনে মুগ্ধ হয়ে একদম নিশ্চিন্ত মনে ভিভিআইপিদের ওয়েলকাম জানাতেই পুরো ব্যস্ত ।

মাহতাব হোসেন একা শুধু নন, তার স্ত্রীও পাত্রীর স্টেজ ঘিরে স্বঘোষিত নেত্রী ও ডিরেক্টর পদ অলংকার করে রেখেছেন। সেখানে তার কথা মতই সব হচ্ছে আর বড় স্যারের স্ত্রীকে একটু পর পর গিয়ে বলছে আপা আপনি কোন চিন্তা করবেন না, আমি সব ম্যানেজ করছি…

 

মাহতাব হোসেন আর তার স্ত্রী বড় কর্তার ছেলের বিয়ে একদম যথাযথ সম্পন্ন করার স্বেচ্ছা দায়িত্ব পালন করছিলেন। সবই ঠিকঠাক ছিলো । এক চেয়ে অধিক পরিমাণ তৈল তার স্যারের জন্য আর কি হতে পারে ! তারোপর তার অফিসের অধিনস্তদের সবার  পক্ষ থেকে দশ লক্ষ টাকা নগদ উপহার দেয়ার ব্যবস্থার পাশাপাশি স্যারের পুত্রবধূর জন্য নগদ তিন ভরি  স্বর্ন  দিয়ে গলার একটি নেকলেস উপহার দিয়েছেন মাহতাব হোসেন। স্যারের ছেলের জন্য বিদেশ থেকে আনা মন্টব্ল্যাংক ঘড়িও দিয়েছেন। সে জানে তার উপহার ও পরিশ্রমের ধারের কাছেও আর কোন কলিগ পৌঁছাতে পারবে না।  তার মত অন্যান্যা নির্বাহী কর্মকর্তাগণ মনে মনে তার এই চটপট মাতব্বরিতে একটু মনঃক্ষুন্ন হচ্ছিলো বটে কিন্তু তারা জানে বড় স্যার এই সেবার সুযোগ শুধু মাহাতাব হোসেনকেই দেবেন। তাই তারা এ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত না হয়ে বরং স্যারের পাশে দাঁড়িয়ে ভিভিআইপি অতিথিদের চেহারা দেখাতে পেরে ও হাতে হাত মিলিয়েই চমৎকারভাবে খুশি থাকছে ।

অথচ মাহতাব হোসেনের ক্লান্ত হাসিখুশি মুখটা চুপসে একদম শুকনো বেগুনের মত হয়ে গেলো যখন জানলেন তারই স্কুল আর কলেজমেট  আফজাল বারি উপহার হিসাবে নিয়ে এসেছে একটি ব্রান্ড নিউ বিএমডাব্লিউ সেদান কার । শুধু কি তাই যে গাড়ী থেকে স্ব পরিরবারে নামলো আফজাল সেই গাড়িটিও বিএমডাব্লিউয়ের এসইউভি। সে ভিভিআইপি না হলেও ঐ গাড়ীর থেকে নেমে আর উপহারের বিশালতায় সেও ভিভিআইপি ট্রিটমেন্টিই যেন পাচ্ছে। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে  মাহতাব হোসেনের আনন্দের ঘাম এখন গায়ে জ্বালা ধরাতে শুরু করেছে। তার পা আর ঐ দিকে এক বিন্দুও যেতে চাচ্ছে না। কেমন যেন আফজালের চোখের থেকে নিজেকে ‍লুকিয়ে চলেছেন তিনি।

এই আফজাল বারি তার সাথে স্কুলে পড়তো ক্লাস সিক্স থেকে। মফস্বল শহরের সেই স্কুলে দুজনেই ভালো ছাত্র ছিলেন। প্রত্যেক পরীক্ষায় হয় মাহতাব কিংবা আফজালের একজন প্রথম হতো আর অন্যজন দ্বিতীয়। এসএসসি পরীক্ষার পর রেজাল্টের সময় গিয়ে দেখা গেলো আফজাল পাঁচ নম্বর বেশি পেয়েছে। মাহতাবের বাবা ছিলেন সরকারী কলেজের শিক্ষক আর আফজালের বাবা টুকটাক ঠিকাদারী ব্যবসা করত। মাহতাবের বাবা খুব বকেছিলেন, বলেছিলেন – শিক্ষকের ছেলে হয়ে ঠিকাদারের ছেলের কাছে হেরে গেলি?

সেই লজ্জা  ঘোচাতে মাহতাব হোসেন এসএসসিতে পড়ার গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন; আফজাল অবশ্য কেমন জানি ছন্নছাড়া হতে শুরু করেছিলো। মাহতাবের তাতে  আরও খুশি। হঠাৎ এইচ এসসি পরীক্ষার আগে আফজালের বাবা এক দূর্ঘটনায় মারা গেলেন। আফজালও কলেজে আসা বন্ধ করে দিলো। মাহতাব একবার জিজ্ঞেস করেছিলো কারণ কি? আফজাল বলেনি এবং তারপর আর কখনও তাদের দেখাও হয়নি। আফজাল সেবার পরীক্ষা দেয়নি। প্রতিপক্ষ ছাড়া  ফাঁকা মাঠের গোলে মাহতাব কখনও সন্তুষ্ট হয়নি। মাহতাব খোঁজ নিয়েছিলো আফজালের। সে ঢাকায় চলে গেছে। শুনছে বাবার সাথে তার মামার পার্টনারশীপে  একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি  ছিলো। সেটায় সে এখন গভীর মনোনিবেশে করেছে।  মাহতাব ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার সময়ও মফস্বলে প্রথম দুবছর খোঁজখবর নিয়েছিলো। আফজাল পরীক্ষা দিয়েছে এমন কোন খোঁজ সে পায় নাই। তারপর আর কিছু জানা হয়নি। ঢাকায় কখনও তাদের আগে দেখাও হয়নি। হঠাৎ এই মাত্র বছর খানেক আগ তার বসের এক পার্টিতে তারা মুখোমুখি হয়ে পড়েন। মাহতাব স্পষ্ট চিনতে পারছিলেন । আফজাল একটুও বদলায় নি। সেই হালকা গড়ন লম্বা ছেলেটাই যেন এখনও আছে। যদিও মাহতাবের সেই কলেজের চেহারা এখন মোটেও নেই। চুল কমে গেছে। শরীরে মেদের বাসা। আফজাল হাসতে হাসতে হাত মিলিয়ে বলেছিলেন – স্যার কেমন আছেন?  চিনতে পারছেন? আমরা  কিন্তু একসাথে পড়তাম। আপনার কলেজের  ড্রপআউট  সহপাঠি।

মাহতাব হোসেন অভিজ্ঞ চাকুরে, তারোপর আফজাল বারি যে কোম্পানীর মালিক সেটাকে তার বস নিজে এনলিস্টেড করিয়েছেন। এতদিন ধরে ঐ কোম্পানীকে কাজ দিচ্ছে সে, কিন্তু একবারও আফজাল নাম দেখে মনে কোন পুরাতন সহপাঠীর কথা উদিতই হয়নি। কি আশ্চর্য !  কেনোই বা হবে? তবুও মাহতাব হোসেন দ্রুত সহজ করে নিলেন পরিবেশ। বসের কানে কাছে পৌঁছায় সে জন্য জোরেই বললেন,

–আফজাল, তোকে চিনবো না কেনো? তা তুই তো আমার কথা জানতিস, তুই কেনো বললিনা একবারও …

– না, আমি সামান্য কন্ট্রাকটর আর তুমি অফিসের নির্বাহী প্রধান। তোমার একটা সম্মান আছে না, সেখানে যদি ..

– ছিঃ তুই আমার কতদিনের ক্লাশ মেট আফটার ওল।

–  সেটাও তো একটা প্রোবলেম বন্ধু …লোকে তোর দিকে আঙ্গুল তুলবে, বলবে বন্ধু বলে কাজ দিচ্ছে বারবার , বড় বড় কাজ দিচ্ছে …

স্যার শুনতে পেয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। এক গাল হেসে বললেন, আরে! একি কান্ড। আগে বলবে না কেউ আমাকে। আফজাল সাহেব এটা কিন্ত অন্যায় হয়েছে। আপনিতো বলতে পারতেন… যাক ভালেই হলো মাহতাবকে এখন থেকে আর রিকয়েস্ট করতে হবে না আফজাল সাহেবকে কাজ পাইয়ে দিতে …হো হো হো…হা হা হা….

আফজাল সেদিন তার ছাই চাপা কষ্টটা আরও টের পেয়েছিলো অধিক। এসএসসিতে তার রেজাল্ট মাহতাবের চেয়ে একটু হলেও তো ভালো হয়ছিলো। এইচ এস সি দিলেও তাই হতো বলেই তার বিশ্বাস। কিন্তু কপালের ফের! …আজ সেই মাহতাব ওত বড় অফিসার। আর সে সেই অফিসের কাজে করে দেয় কেবল। সেই কাজ পেতে আবার মাহতাবকেও মোটা অংকের উপঢৌকন দিতে হয়। এই দুঃখ বোধ তাকে তিলে তিলে কুড়ে খায়।

 

অফিসের সবচেয়ে বড় কর্মকর্তার ছেলের বিয়েতে গেটে যতেই ভিআইপি হালে ঢুকুক না কেনো তাকে তো খাবার টেবিলে বসতে হয় সেই আলাদাই। সবার মুখে কেবল কন্ট্রাকটর সাহেব কি দিচ্ছেন – কবে দিচ্ছেন- এই ভাব শুধু। এরও একটা মজা আছে বাট সম্মান নাই। অথচ মাহতাবের সম্মান এখানে জয়জয়কার। বড় স্যার মাহতাবককে ডেকে বললেন, তোমার লোকজনকে বলো কন্ট্রাকটর সাহেবদের যাতে কোন আপ্যায়নে ত্রুটি না হয়? আল্টমেটলি তারা আছে বলেই আমাদের এত জৌলুশ…হা হা হা। তারেপর আফজাল সাহেব তো তোমার বাল্য বন্ধু … হো হো হো..

জ্বি স্যার! জ্বি স্যার! বলতে বলতে  আফজালের সাথে হাত মেলাতে এগিয়ে যায় মাহতাব হোসেন। বলে- দারুণ হয়েছে গাড়ীটা। তোর চয়েজ আছে। তারপর রাহাত কে ডেকে বলে দেয়  আ্যাপয়নের যেন কোনো ত্রুটি না হয়। এটুকু বলেই বসের সাথে সেও ভিভিআিইপি টেবিলের দিকে পা বাড়ায়। আফজাল পেছন থেকে ডেকে কানে কানে বলে, তোর মেয়েরে বিয়েতে একই গাড়ী নিবি নাকি? বিয়ের আগে ঐ বিলটা এপ্রুফ করে দিস মনে করে কিন্তু…

মাহতার মাথা নেড়ে যেন হ্যা সূচক কিছু বলে দ্রুত প্রস্থান করলো। আফজাল বারি  একটু কষ্ট পায়  ..এত আয়োজন সব তার আর তার মত অন্য কন্ট্রাকটারদের টাকার বদৌলতেই। অথচ…

আর মাহতাব ভাবে …শালা কইয়ের তেলে কই ভাজছে আবার কি ভাব !

সেই বিয়ের পর মাস ছয় কেটে গেছে। মাহতাবের বড় মেয়ের বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে ।

হঠাৎ একদিন দুপুর বেলা মাহতাব হোসেন বসে আছেন দুদকের অফিসে। অফিস নয় ঠিক ইন্ট্রগেশন রুমের সামনে অপেক্ষা কক্ষে। একটু পরেই সেখানে আনা হলো আরও দুজন লোককে। দুজনেই দুই কন্ট্রাকটর কোম্পানীর প্রধান। একজন তারমধ্যে আফজাল বারি। মুহূর্তে চোখচুখি হলো, তীব্র চাহুনি দুজনের- কোন কথা হলো না। কিন্তু চোখে যেন একই ভাষা উভয়ের, যে ভাষা বলতে চাইছেঃ

      তুই কি আমার সাথে বিট্রে করবি? প্রমাণ দিয়ে দিবি এদেরকে? অস্বীকার করলে এদের কিন্তু প্রমাণ করতে করতে জনম কেটে যাবে আর তার মধ্যে উপরওয়ালারা একটা কিছু করবেই, সিস্টেম চালাতে এই সময় অন্ততঃ আমাদের দুজনকে লাগবে, তাই নিজেদের বোঝাপড়াটা না হয় আমরা পরেই করে নেবো। আমরাতো দুজনেই জিতেছি, এবং হেরেছি দুজনেই, ঠিক …সমান সমান।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত