ঘটনাটা নাকি ঘটেছে রাত সাড়ে দশটায়। মিতুকে ফোনে খবরটা জানিয়েছে ওর এক সহকর্মী। খবর পেয়ে ওরা রাতেই গিয়েছিল। কিন্তু অত রাতে মিতুর পক্ষে সম্ভব ছিল না ওদের সঙ্গে যাওয়া। তাই ও সকালের আলো ফুটতেই বেরিয়ে পড়েছে। বাড়িটা চিনতে খুব একটা সমস্যা হলো না। যদিও মূল রাস্তা থেকে এগারো নম্বর গলিটা খুঁজে পেতে একটু সময় লেগেছিল। রিকশা থামিয়ে দু’একজনকে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিল। লোকজনের আসা যাওয়া দেখেও আন্দাজ করে নেওয়া যায় এটাই সেই বাড়ি। উপরন্ত বাসার সামনে বেশ কয়েকটি গাড়ি দেখে নিশ্চিত হওয়া গেল। তবু খানিকটা দ্বিধা নিয়েই সদর দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল মিতু। মনে তখনও ক্ষীন আশা, খবরটা যদি ভুল হয়! পৃথিবীর সব খবর সত্যি হতে হবে কেন! সত্য সব সময় প্রত্যাশিত হলেও কখনো কখনো ভুলটাও যে এত কাঙ্ক্ষিত হতে পারে, আজকের আগে এমন করে ওর মনে হয়নি কখনো। গেটে দারোয়ান ছিল না। ও সহজেই গেট দিয়ে ঢুকে গেল এবং ঢুকেই ওর পা দুটো যেন থেমে গেল। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হলো না! খবরটা যে মিথ্যে ছিল না এটা বুঝতেও সময় লাগলো না। সামনে রাখা কফিনটাই বলে দিল সব। নাকে এসে লাগলো কর্পূর- আগরবাতির গন্ধ। মৃতবাড়ির অতি পরিচিত এই গন্ধটা মানুষকে ভীষণ দৃর্বল করে দেয়। কেবলই মনে হয় আমারও বুঝি সময় হয়ে এলো। মিতুর মাথাটা হঠাৎ কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। কেমন জানি অনুভূতি শূন্য। কফিনের খুব কাছে কেউ ছিল না। অল্প দূরে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে কয়েকজন নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে কথা বলছে। মিতু কফিনটার কাছে বসে পড়ল। নিজের ভার বইবার শক্তি ওর আর অবশিষ্ট ছিল না। বরং কফিনটা হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরে সে নিজের পতন ঠেকালো। নিরুচ্চারে নিজেকেই প্রশ্ন করল, কফিনের ভেতরের এই সাদা কাপড়ে মোড়া মানুষটা কি সত্যিই আরিফ? হাসি- খুশি, উচ্ছ্বল মানুষটা এমন স্থির হয়ে পড়ে আছে! মাথা ভর্তি একরাশ রেশমি চুল। চুলগুলো প্রায়ই কপালে চলে আসত। মিতু হাত বাড়িয়ে সরিয়ে দিত। আর কী ফর্সা ওর গায়ের রঙ। রিকশায় করে রোদে ঘুরলে আরিফের মুখটা লাল হয়ে যেত। মিতু দেখে হাসতে হাসতে বলত, তুমি দেখছি মেয়েদের মতো লজ্জায় লাল হয়ে গেছ। শুনে হাসত আরিফও। ওর হাত দুটোও কি নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে? যে হাতে ও নিঃশব্দে আলপনা আঁকত মিতুর শরীরের ক্যানভাসে! ভীষণ অন্য রকম ছিল ছেলেটা। সব সময় হাসি- খুশি আর প্রাণবন্ত থাকলেও কথা বলতো কম। শুনতো বেশি। রিকশায় ওরা দু’জন যখন ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকত, মিতুই কথা বলতো। আরিফ শুনতো আর হাসতো। কত গল্প যে মিতু ওর সঙ্গে করতো! ও নিরব শ্রোতা হওয়ায় মিতু মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে যাচাই করে দেখত সত্যিই সে শুনছে কি না। যখন জানতে চাইতো, বলো তো আমি কী বলছি? আরিফ ঠিক বলে দিত। আজ কি আরিফ শুনতে পাচ্ছে না ওর নিরব কান্না! কেন আরিফ একবারও হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা টেনে নিচ্ছে না নিজের হাতের ভেতর! এত অভিমান! কেন এভাবে না বলে চলে যেতে হবে?
কেউ একজন এগিয়ে এসে মৃদুস্বরে জানতে চাইলো, আপনি কি মুখ দেখতে চান?
মিতু চমকে উঠে দ্রুত মাথা নাড়ল, না! না! পরে দেখব। তারপর বলল, উনি কয়তলায় থাকতেন?
দোতলায় চলে যান! লোকটি বলল।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই বসার ঘর চোখে পড়ল। দুই পাশের সোফায় দু’জন ঘুমিয়ে আছে। একটাতে একটি শিশু। অন্যটাতে একজন বয়স্ক মানুষ। বসে কথা বলছে কয়েকজন। কয়েকজন এ ঘর ও ঘর ছোটাছুটি করছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে না, কার সঙ্গে কথা বলবে। এক লোক হাঁক দিয়ে বলল, আমার পাঞ্জাবিটা দাও। আর রাস্তায় খাওয়ার জন্য কী নিচ্ছ? একটু বেশি করে নিও। লোক কিন্তু অনেক যাচ্ছে। তখন পাশের ঘর থেকে মাঝবয়সী এক মহিলা বেরিয়ে এলেন। মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, তুমি কে মা? কাউকে খুঁজছো ? জ্বি, আমি আরিফের বউয়ের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই! মিতু বলল। সে কি আর স্বাভাবিক অবস্থায় আছে! সারারাত চিৎকার কইরা কানছে। এখন থম মাইরা বইসা আছে। মনে হয় পাথর হইয়া গেছে মেয়েটা। আহারে! সেদিন মাত্র বিয়ে হইলো। এরই মইধ্যে সব শ্যাষ! আল্লাহ জানে মেয়েটার এখন কী হইব! আর ছেলেটাতো দুধের বাচ্চা। বলতে বলতে মহিলা চোখে আঁচল চাপা দিলেন। চোখ মুছে একটা ঘর দেখিয়ে বললেন, ঐ ঘরে যাও। তারপর সে পাঞ্জাবি চাওয়া লোকটার কথার জবাব দিলেন, ভূণা খিচুড়ি আর মাংস রান্না করে নিয়েছি। অত দূরের পথ। সবার তো খিদা লাগবে। ওদের কথা শুনতে শুনতেই পাশের ঘরে ঢুকলো মিতু। থমথমে মুখে বিছানার ওপর বসে আছে এক নারী। খাটের মাথার পাশের দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে। চোখ খোলা। কিন্তু সে চোখে যেন প্রান নাই। মাছের চোখের মতো নিষ্প্রাণ! গাঢ় সবুজ রঙের সালোয়ার কামিজ পরনে। কোলে জড়ো হয়ে আছে ওড়নাটা। কেউ বলে না দিলেও মিতু বুঝতে পারলো সেই- ই আরিফের স্ত্রী। তাকে ঘিরে কয়েকজন বসে আছে। তারা নিচুস্বরে কথা বলছিল। পাশে একটা বাচ্চা ঘুমাচ্ছে। মিতু মনে মনে ভাবল, ওটাই মনে হয় আরিফের ছেলে। কী নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে শিশুটি। ও তো জানেও না কী দুর্যোগ নেমে এসেছে ওর জীবনে। বাচ্চাটা দেখতেও কী সুন্দর হয়েছে। ঠিক যেন দেবশিশু। মিতুর ভীষণ ইচ্ছে করছিল ছুটে গিয়ে বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে নিতে। হঠাৎ মনে পড়ল ওর সেই না হওয়া মেয়েটার কথা। আরিফ যার নাম রেখেছিল মায়া। সেদিন অফিস শেষে মিতু অপেক্ষা করছিল আরিফের জন্য। আরিফ ওকে দেখে জানতে চেয়েছিল,
কী ব্যাপার? কী হয়েছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
মিতু রিকশায় উঠতে উঠতে বলল, আমাদের মনে হয় একবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
আরিফ বলল, কেন? তোমার কি শরীর খারাপ?
আমার খুব টেনশন হচ্ছে। যদি কিছু হয়ে যায়! পিরিয়ডের ডেট পার হয়ে গেছে।
আরিফ ওর কথা হেসে উড়িয়ে দিল, ধুর! কিচ্ছু হবে না। তুমি কেমন করে এত নিশ্চিত হচ্ছো? মিতু অভিমানের সুরে জানতে চাইলো।
আমি জানি! আরিফের সেই একই জবাব।
মিতুও কিছুক্ষণের জন্য যেন সমাজ- সংসার সব ভুলে নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়ে বলল, আচ্ছা ধরো আমাদের একটা বাচ্চা হবে। সেটা কী হবে, ছেলে না মেয়ে?
আরিফ অকপটে বলল, মেয়ে।
কেন? ছেলেও তো হতে পারে! মিতুর গলায় আবারও অভিমানের বাষ্প জমে।
আমার মনে হয় না ছেলে হবে। মেয়েই! আরিফের জোরালো মত।
এবার অনেকটা হারমানা স্বরে মিতু বলল, মেয়ে হলে ওর নাম কী রাখবে?
একটু ভেবে আরিফ বলেছিল, মায়া!
বাহ! কী সুন্দর নাম! আমাদের ভালবাসা থেকে জন্ম হবে মায়ার।
আরিফের সদ্য বিধবা হওয়া বউয়ের অদূরে দাঁড়িয়ে নামহীন এক সম্পর্কের না হওয়া মেয়েকে নিয়ে সেই গল্পটা মিতু একা একাই বিড়বিড় করে। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে, আচ্ছা যদি সত্যিই ওদের বাচ্চাটার জন্ম হতো তাহলে এই মানুষগুলো কি ওর জন্যও এমন আফসোস করত? কিন্তু কেউ কি জানতো ওর পরিচয়? একজন মহিলা ওকে দেখিয়ে অন্যদের কী যেন বলল। হয়তো ওর পরিচয় জানতে চাচ্ছেন। মিতু একবার ভাবলো এগিয়ে গিয়ে বলবে, আমি আরিফের সঙ্গে এক অফিসে কাজ করি। কিন্তু বলা হলো না। তখনই ভেসে এলো অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। সেই সঙ্গে শুরু হলো কান্নার রোল। বাসায় ঢোকার মুখে দেখা হওয়া সেই মহিলা এসে তাড়া দিলেন কাউকে উদ্দেশ্য করে, ও মনা! বউমা আর বাবুর জিনিস পত্র গুছিয়েনে। অ্যাম্বুলেন্স চইলা আসছে। এখন তো যাইতে হবে। আহারে ছেলেটার মায়ের না জানি কী অবস্থা! আমরা মামী হইয়াই মাইনা নিতে পারতাছি না! মা হইয়া কেমন কইরা সইব এমন জুয়ান ছেলের শোক! বলতে বলতে তিনি আবারও কাঁদতে লাগলেন। এবার আরিফের বউও চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। মিতু কাউকে কিছু না বলে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। নিচে এখন মানুষের প্রচন্ড ভিড়। সবাই ব্যস্ত হয়ে ওপর নিচ করছে। বার বার গাড়ি থামার শব্দ হচ্ছে। নতুন কেউ আসছে আর থেমে যাওয়া কান্না আবার নতুন করে শুরু হচ্ছে। আবার থেমে যাচ্ছে। এভাবেই চলছে। কফিনটা ঘিরে রেখেছে কয়েকজন। কেউ এসে শেষ বারের মতো দেখে নিচ্ছে প্রিয় স্বজনের মুখ। সবাই আফসোস করছে, ইস! কী এমন বয়স ছেলেটার! এই বয়সেই হার্ট অ্যাটাক! আহারে! বাচ্চাটা বাবার কোনো স্মৃতিই মনে করতে পারবে না! আহারে বউটার কী হবে! সংসার কেমন করে চলবে! একজন আবার জানতে চাইলো, ওর অফিসের লোকজন আইছিল? তারা কি টাকা পয়সা কিছু দিবে না! দিলে সেটা কে কতটা পাবে, সেটা নিয়েও চললো মৃদু আলোচনা। লাশ নেওয়া হবে গ্রামের বাড়িতে। সেখানে আরিফের বাবা- মা থাকেন। কফিন অ্যাম্বুলেন্সে তোলার আগে সবাই আর একবার দেখে নিচ্ছে। সঙ্গে আরো দুটো মাইক্রোবাস যাচ্ছে। যারা সঙ্গে যাবে তারা গিয়ে গাড়িতে উঠছে। এরই মধ্যে শুরু হলো বৃষ্টি। মিতু আনমনে এগিয়ে যাচ্ছিল কফিনটার দিকে। ওর একবার মনে হলো শেষ বারের মতো আরিফের মুখটা দেখি। কিন্তু পা যেন সরছে না। হঠাৎই ওর না হওয়া মেয়েটার জন্য খুব কষ্ট হতে লাগলো। চোখ ভীষণ জ্বালা করছে। ও কি তাহলে কাঁদবে। নাহ! আর দাঁড়ানো যাবে না এখানে! ভাবতে ভাবতেই ও গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। কেউ কেউ অবাক হয়ে দেখলো বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একটা মেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণে মিতুও স্বস্তি পেল। এতগুলো উৎসুক চোখের সামনে খুব বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। তার চেয়ে বেরিয়ে যাওয়া স্বস্তিকর। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই ও রাস্তায় একা হাঁটতে লাগলো। ওর দুই চোখে তখন অঝোর কান্না। আর বৃষ্টি পরম যত্নে ধুয়ে দিচ্ছে ওর চোখের জল।