১
কবর খুঁড়তে খুঁড়তে এক নিঃশ্বাসে গেয়ে যাচ্ছে রজব আলী।
‘এই মাটি তোমার হবে ঘর, বাকি সবই হবে পর
মিছা হবে বাহারি এই রঙের ই আসর’।
পাশে দাড়িয়ে আছে ছফা। গানের সাথে খুব কম মানুষের রক্তের সম্পর্ক হয়। রজব সেই কম মানুষদের একজন। রজবের দশ বছরের ছেলে রশিদ মাটি সরাচ্ছে। কবর খোঁড়ার সময় রজবের বাবা রুস্তমও গানটা গাইতো। বংশ পরপম্পরায় গানটা শিখে ওরা। রজবের বাবা এই গান শিখেছিলো তার বাবা হাতেম আলীর থেকে। কবর খোঁড়া রজবদের মূল পেশা না। গৃহস্থের জমিতে ধান চাষ করে ওরা। পুলিয়া বড়বাড়ির গোরস্থানে লাশ দাফনের প্রয়োজন হলে ওদের ঘরের প্রধান কর্তার ডাক পরে।
গোঁর খোদকদের কাছে সব কবর এক রকমের। সমাজের কাছে সব মানুষ সমান না। আজকে একজন বিশিষ্ট মানুষের কবর খুঁড়ছে রজব। পুলিয়ার গন মানুষের নেতা হাফেজ মাস্টারের কবর।
– ‘রজব ভাই, আর কতক্ষণ’? বিরক্তিকর সুরে বললো ছফা।
-‘ঘন্টাখানেক লাগবো’,গান থামিয়ে বললো রজব।
-‘জলদি করেন, সময় নাই’।
-‘বড় ভালা মানুষ আছিলো মাস্টার সাব। আমার পোলাডারে স্কুলে ভর্তি কইরা দিছে’।রজবের কথা শুনে ছফার বুকটা হুহু করে উঠলো। এমন ঘটনা এ গ্রামে নতুন না। স্কুলে পড়ার সময় ছফার বাবা মারা যায়। ওর পড়াশুনা বন্ধ হওয়ার দশা হয়েছিলো। হাফেজ মাস্টার ওকে বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেয়। কলেজে পড়ার সময় রাজনীতিতে জড়িয়ে পরে ছফা। এখন সে ইউনিয়ন ছাত্রসমাজের সভাপতি। মাস্টারের সবচেয়ে কাছের সাগরেদ ছিলো সে।
জীবনের অবিচ্ছেদ্য কোন অংশ হারিয়ে ফেললে সম্ভবত ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় নেয় প্রকৃতি। পুলিয়ার মানুষ সেরকম একটা কিছুই হারিয়েছে। গোটা এলাকায় এক অদ্ভুত শুন্যতা বিরাজ করছে। সবার সুখ-দুখের সঙ্গী ছিলো মাস্টার। দলের বাইরেও কদর ছিল তাঁর। এলাকার রাজনীতি এখন পরিচ্ছন্ন। এর পিছনে মাস্টারের অবদান আছে। দল যখন ক্ষমতায় আসলো, সব ভুলে ঐক্যের ডাক দিলেন। বিরোধীদের বলতেন, ‘অপজিশনের আসল কাজ হলো সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করা। এটাই গণতন্ত্রের সাথে রাজার শাসনের ফারাক’।
ছাত্র সমাজের মাসিক সভায় মাস্টার বক্তৃতা দিতো। তার মুখে একটা কথা প্রায়ই শুনা যেত, ‘ভাবলে খুব কষ্ট হয়। রক্ত দিয়ে গড়া দেশটার আজকে এই দশা। আমার একটাই স্বপ্ন, একদিন তোমরা সুশিক্ষিত হবা। এই ঘুনে ধরা দেশটাকে বদলে দিবা’। সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতো। শুনতে বাধ্য হতো। মাস্টারের কণ্ঠে আগুন ছিলো। অন্তরে অগাধ বিশ্বাস না থাকলে কেও অমন করে কথা বলতে পারে না।
গোরস্থানের পাশেই জানাজার মাঠ। লাশ মাঠে এসে পৌঁছেছে। মাস্টারকে শেষবার দেখতে মানুষের ঢল নেমেছে। পাঞ্জাবি পরিহিত দীর্ঘদেহী রমজান শেখও আছে সেখানে। ওকে দেখে কানাঘুষা করছে লোকজন। গতকাল পর্যন্ত এই রমজানই ছিলো মাস্টারের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। রমজানের পাশে ঘুরঘুর করছে মোবারক। মোবারকের ভালো নাম মোবারক মুন্সি। পুলিয়া বাজারে সবাই ওকে শেখের চামচা ডাকে।
রমজান পাথর দিল ইনসান। তার ছোট ছেলেটা যখন পুকুরে ডুবে মরলো তখনো তার চোখে পানি দেখেনি কেও। অথচ আজ অনবরত কেঁদে চলেছে সে। ‘চাচা অখন আমাগো একমাত্র মুরুব্বি আপনে। আপনে এমনে ভাইঙ্গা পরলে, আমরা কার কাছে যামু’? ময়না পাখির মতো একই কথা একটু পরপর বলে উঠছে চামচা মোবারক। ৭১ এ চামচা মোবারককে সাথে নিয়ে পাক বাহিনীর সাথে ঘুরতো রমজান। তখন শেখ বাড়িতে পাকিস্তানি পতাকা উড়তো। যুদ্ধের পর পাক আর্মির সাথে উধাও হয়েছিলো রমজান আর তার পতাকা।
ঝড়ের ঝাপটা বড় গাছের বেশী লাগে। নেতাদের বেলায় কথাটা সত্যি না। রাজাকারির দায়ে জুতার মালা গলায় দিয়ে সারা গ্রাম ঘুরানো হয়েছিলো চামচা মোবারককে।
পরিস্থিত শান্ত হওয়ার পর রমজান নিরাপদে ফিরে আসে।
– ‘আমি কি নিজের লাইগা কিছু করছি? গেরামের জান-মাল বাচাইতে সব করছি’, জোর গলায় বলতো রমজান। প্রবাদমতে, মিথ্যাকে জোর দিয়ে বললে সেটা সত্য হয় না। রমজান প্রবাদটিকে বহুবার ভুল প্রমাণিত করেছে।
দুনিয়াতে কতো অসম্ভব ব্যাপারই ঘটে। যার নেতৃত্বে গ্রামের মানুষ ঘরছাড়া হলো। পাঁচ বছরের মাথায় সে পুলিয়ার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠলো। আগের দল ছেড়ে জনতা পার্টিতে ঢুকে পরলো। টাকায় বাঘের চোখ পাওয়া যায় কিনা রমজান জানে না। তবে কেন্দ্রীয় নেতা আজিম মির্জার সমর্থন যে পাওয়া যায়। সেটা সে কোনভাবে জানতো। নগদ বারো হাজার টাকায় মির্জাকে বশে আনে সে। হাফেজ মাস্টাররা শুরুতে প্রতিবাদ করলেও শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় নির্দেশ মেনে নিতে হয়েছে।
বড়লোকের বড় বড় কুকীর্তি অর্থ আর ক্ষমতার দাপটের নিচে তলিয়ে যায়। সময়ের খেলায়, পরগাছা রমজান একসময় দলের বড় গাছদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলে দেয়।
হাফেজ মাস্টারের জানাজায়, কেও রমজানের শোক পালনে বিঘ্ন ঘটায়নি। বাধ্য হয়েই রমজান কান্না থামালো। ইমাম সাহেব রমজানকে অনুরোধ করেছেন, মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে।
আসলে, সব প্রস্তুতি আগেই করা ছিল। ইমাম সাহেব মাঠে আসা মাত্র চামচা মোবারক কানে কানে বলেছিলো, জানাজার আগে চাচা কথা বলবেন’। মসজিদেও রমজান প্রায় বক্তৃতা দেয়। আগে ওর দীর্ঘ বক্তৃতায় মানুষ বিরক্ত হতো। এখন সবার অভ্যাস হয়ে গেছে। দুই জনের চাকরি যাওয়ার পর এখন ওর কথায় মাথা দুলিয়ে সায় জানানো ইমামদেরও দায়িত্বে পরিণত হয়েছে।
—–
মূলত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই যতো ঝামেলা।
হাফেজ মাস্টার যেখানে প্রার্থী। দলের কেও দ্বিমত করবে ভাবা যায়না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মনোনয়ন চেয়ে বসে রমজান। বিরোধের শুরু সেখান থেকে।
ইউনিয়ানের রাজনীতির ভাগ্য নির্ধারণ হয় দলের উপজেলা অফিসে। উভয় পক্ষ সেখানে গেলো।
-‘পরিবারে ভুল বুঝাবুঝি থাকবে, সেটা নিয়া বসে থাকলে কি চলবে? গম্ভীর মুখে বললেন দলের উপজেলা সভাপতি লোকমানুল হক। সামনের মাসে দলীয় সভা। তখন মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হবে। এই বিষয়ে আর কিছু যেন শুনতে না হয়’। -এ কথা বলে বৈঠক শেষ করেন তিনি।
সততা ও সুনামের সাথে বিশ বছর পার্টির রাজনীতি করেছেন হাফেজ মাস্টার। সব সময় কর্মীদের পাশে ছায়া হয়ে থেকেছেন। একারনে দলের বেশীরভাগ কর্মী মাস্টারের পক্ষে। যত দিন যেতে লাগলো আস্তে আস্তে সবকিছু কেমন যেন বদলে গেলো। রমজান শেখের পক্ষে একে একে সবাই চলে গেলো। মাস্টার হয়ে গেলো বিদ্রোহী প্রার্থীর মতো।
রাজনীতির এক নির্দয় নিয়ম। কেও বিদ্রোহী প্রার্থীর সাথে নিজেকে জড়াতে চায় না। তাদেরকে বিরোধী পক্ষের লোকদের চেয়েও খারাপ চোখে দেখা হয়। পার্টি অফিসের চূড়ান্ত মিটিংএ প্রায় সবাই রমজান শেখকে মনোনয়ন দেয়ার পক্ষে মত দিলো।
সামনে উপজেলা ছাত্র সমাজের কমিটি ঘোষণা হবে। ইউনিয়নের ছাত্র নেতা ছফার, উপজেলায় একটা ভালো পদের বড্ড দরকার। এরকম সময়ে দলের সবার বিপক্ষে অবস্থান নেয়া বিরাট বোকামি। বাধ্য হয়ে মাস্টারের প্রিয় সাগরেদ ছফা ও রমজানের পক্ষে রায় দেয়!
-‘সবই তো দেখলেন। আপনে সম্মানি মানুষ আপনেরে আমার কিছুই বলার নাই মাস্টার সাব’। লোকমানুল হক হাফেজ মাস্টারকে বললো। লজ্জায়, অপমানে হাফেজ মাস্টারের মুখ লাল হয়ে উঠলো। সেখানে আর বেশীক্ষণ থাকেন নি তিনি। এরপর আর কখনো বাজারে দেখা যায়নি মাস্টারকে।
—–
২
দাফন শেষ। বাড়ি ফিরেছে ছফা। স্থির থাকতে পারছে না ও। হারানো প্রিয়জনের সৃতি মানুষকে ভাবায়। মাস্টারের সাথে কতো সৃতি ওর। অথচ ঘুরিফিরে শুধু শেষ দেখার কথা মনে উঁকি দিচ্ছে। ওকে গ্রাস করে ফেলছে মাস্টারের শেষ কথাগুলো।
.
চৌরাস্তায় আড্ডা দেয় ছফা।
তিন দিন আগে রাস্তার ধারে মাস্টার ওকে হাত তুলে ডাক দেয়। ছফা বুঝলো, মাস্টার ওর সাথে একা কথা বলবেন। উপজেলা অফিসের ঘটনার পর নিজেকে একঘরে করে ফেলেন মাস্টার। সেদিনের পর ছফার সাথে মাস্টারের আর দেখা হয়নি। আদতে, রমজানের পক্ষে ভোট দেয়ায় ছফা নিজ থেকে দেখা করার সাহস হারিয়েছে।
সেদিন চৌরাস্তার আড্ডা ছেড়ে মাস্টারের কাছে যেতে মন চাচ্ছিলো না। পা একদম চলছিলো না। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা মাস্টারের অভ্যাস। মাস্টারের সামনে যেতেই, মাস্টার হাঁটতে লাগলেন। ও মাষ্টারের সঙ্গে হাঁটা শুরু করলো।
.
– ‘জুলিয়াস সিজারের গল্পটা তোর মনে আছে’? মাস্টার ছফার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন।
কর্মী সভায় এ গল্প বলেন মাস্টার। জুলিয়াস সিজারকে যখন হত্যার ষড়যন্ত্র হয়, সে বন্ধু ব্রুটাসের উপর ভরসা করেছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রুটাসই পেছন থেকে ছুঁড়ি মেরে সিজারকে হত্যা করে। ছফা গল্পটা ভুলে নি। জবাব দেয়ার সাহস পেলো না। মাটির দিকে চেয়ে হাঁটতে লাগলো। বেশ থমথমে একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
-‘আমার হাত পা বাঁধা চাচা, আপনে তো ভালো কইরা ই জানেন পার্টির অবস্থা’ নিরবতা ভেঙ্গে কাঁপা গলায় বললো ছফা।
-‘আইচ্ছা আমরা কি শুধু নিজের জন্য রাজনীতি করি রে? মাস্টারের কথাটা ছফা বুঝলো না তবুও মাটির দিকে তাকিয়ে শুনে যেতে লাগলো।
– ‘বসতভিটা ছাড়া কি আছে আমার? কতো সমস্যা এই গ্রামের। কতো স্বপ্ন ছিল গ্রামটারে নিয়া’। একদমে মাস্টার বললেন।
হাঁটছে ওরা। আকাশে ক্রমশ মেঘ জমছে।
-‘রমজান শেখরে দলে ঢুকতে দিলেন ক্যান’? পাল্টা প্রশ্ন করলো ছফা।
প্রখর রাজনৈতিক জ্ঞান মাস্টারের। ছফার প্রশ্ন শুনে একটা ছোটখাট বক্তৃতা শুনিয়ে দিলেন।
‘দেখ। ভালা-খারাপ দুইটাই থাকবে রাজনীতিতে। আগেও এমন ছিলো। রাজনীতি হলো ক্ষমতার খেলা। একটা দল তখনই সফল যখন ক্ষমতা দলের ভালো অংশের হাতে থাকে। বদের হাতে ক্ষমতা গেলে। সব তছনছ হয়ে যায়। কারণ ঐ রাক্ষস শুধু ক্ষমতা দেখে দায়িত্ব দেখে না। শোন, মানুষের ভালো বা খারাপ করতে চাইলে রাজনীতির থেকে বড় হাতিয়ার নাই। এ জন্য ভালো মানুষদের ঐক্য দরকার। যাতে ক্ষমতা বেহাতে না যায়। ক্ষমতা কার হাতে আছে, সেই দিকে তাকালেই তুই একটা দল,সমাজ বা দেশের ভালো খারাপ বিচার করতে পারবি’।
-‘বুঝলাম চাচা। তবে আমার মনে হয় এখন আর শেখরে থামানো যাইব না। অনেক দূর চলে গেছে সে’।
-‘যুদ্ধের সময় পাঞ্জাবিরা ওর সাথে ছিল। তবুও সে জিততে পারে নাই। কিন্তু এইবার রমজান পারছে। কেন জানস? ঐ যে বললাম, ঐক্য। ৭১ এক জাদুকরি সময় ছিলো। সবার ভালোর জন্য আগুনে ঝাঁপ দেয়ার বিশ্বাস ছিলো আমাদের। মনের বিশ্বাস এখনো ওরকমই আছে। তবুও পারলাম না। কাছের মানুষরাই ছুঁড়ি মেরে দিলো, জুলিয়াস সিজারের মতো’। কথাটা বলে ছফার চোখের দিকে তাকালো মাস্টার।
এক অদ্ভুত অপরাধবোধ গ্রাস করতে লাগলো ছফাকে। ওর গলা ভারী হয়ে এলো
প্রসঙ্গ বদলে বললো, ‘চাচা। অনেক তো হইছে। আর কতো? এইবার একটু জিরান’
ছফার কথা শুনে মাস্টারের চোখ ঝাপসা হয়ে উঠলো। হঠাৎ তার চোখ বেয়ে পানি পরতে লাগলো। মাস্টার বুদ্ধিমান মানুষ। কায়দা করে লুকিয়ে ফেললেন।
চোখ মুছে ধরা গলায় বললো, ‘বালুর অত্যাচারে বৈশাখে রাস্তায় বেরুনো যায় না রে’।
নিজেকে আরেকটু সামলে নিলো মাস্টার।
বললো, -কি জানি বললি? জিরামু? হুম! তুই ঠিকই ধরেছিস। একলা আর কতো লড়া যায়! এবার ভাবতেছি অবসর ই নিমু’।
চোখের সামনে যেন একটা প্রকাণ্ড বটগাছ নুইয়ে পরছে। এমন দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলো না ছফা।
-‘আপ্নের লাইগা কিছু করতে পারলাম না চাচা। আমারে অভিশাপ দিয়েন না।’ অত্যন্ত লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো সে।
এ কথা শুনে মাস্টারের মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে উঠলো। এসময় গোটা অঞ্চল অন্ধকারে ঢেকে গেছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগলো। আকাশের দিকে তাকালেন হাফেজ মাস্টার
– ‘সত্য বড়ই নিষ্ঠুর। সময় মতন ঠিক এই রকম আসমানের বজ্র হয়ে ঠোকর দেয়। একদিন ঠিকই আঁধার থেকে সত্যের আলো এমন ঝলক মারবে। পারবি তো নিজেরে সামলাইতে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাস্টার বললো।
একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলো ছফা। এমন সময় বৃষ্টি পরতে শুরু করলো।
– ‘বাড়ি যা রে বাপ, তুফান আসতেছে’। এই বলে মাস্টার নিজের বাড়ির দিকে দ্রুত বেগে চলতে লাগলেন। অচিরেই প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো। ছফা সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
প্রতিবারের মতোই সত্য বলেছে মাস্টার। চিরস্থায়ী অবসর নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু মাস্টারের শেষ কথায় সেই আগুনের তেজ পাওয়া যায় নি।
ঠিক দুই দিন পর। গতকাল মাঝরাতে ছাত্র সমাজের সেক্রেটারি একরামের ডাকে ঘুম ভাঙে ছফার। -‘ভাই কিছু হুনছেন, মাস্টার চাচা নাকি ইশট্রোক করছে’? একরামের সাথে মাস্টারের বাড়িতে ছুটে যায় সে। ততক্ষণে সব শেষ। হাসিমুখে ঘুমিয়ে আছে মাস্টার। অদ্ভুত সুন্দর লাগছিলো দেখতে। ছফা বেশীক্ষণ তাকাতে পারেনি। এই বুঝি মাস্টার চোখ খুলবে। ঐ চোখের দিকে তাকানোর সাহস ওর নেই।
মাস্টারের থেকে নিজেকে দূরে রাখতে সারাদিন গোরস্থানে কাটিয়েছে। আগেও কবরে নেমেছে ছফা কিন্তু মাস্টারের কবরে নামতে পারেনি। মনে হচ্ছিল লাশটার ভার অনেক। কাঁধে নিলেই বুঝি ঘাড় ভেঙ্গে পরবে।
৩
(১৫ বছর পর)
সময় খুব সহজেই শুন্যতাকে গ্রাস করে ফেলে। কেটে গেছে পনেরটি বৈশাখ। গোরস্থানের ডানপিটে ঘাসের নিচে মাস্টারের কবরটা হারিয়ে গেছে। অনেক কিছুই বদলে গেছে। সবচেয়ে বেশী বদলেছে পুলিয়ার রাজনীতি। রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নাই। ছফা এখন মরহুম হাফেজ মাষ্টারের রাজনৈতিক শত্রু রমজান শেখের ডানহাত।
আজ সকাল থেকেই খুব অস্বস্তি বোধ করছে ছফা। ইউনিয়ন জনতা পার্টির সাধারণ সম্পাদক সে। আগামীকাল নির্বাচনের চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা হবে। নামমাত্র ঘোষণা শুধু। ছফা ই যে একমাত্র প্রার্থী।
গত পনের বছরে, পুলিয়ার রাজনীতিতে রমজানের যে উত্থান ঘটেছে। তার সবই ছফার মেহনতের ফল। রমজানের মস্তিষ্ক ব্যবসায় মত্ত। যার সবচেয়ে বড় পুঁজি রাজনৈতিক ক্ষমতা। চেয়ারম্যান হওয়ার পর রমজানের ব্যবসা তরতর করে বেড়েছে। কিন্তু রাজনীতিতে এর প্রভাব পরেনি। ছফা প্রভাব পরতে দেয় নি।
সকালে বাজারে রাফির সাথে দেখা হলো ছফার। দেখলেই সালাম দিয়ে মৃদু হাসি দেয় ছেলেটা। ওকে খুব ভালো লাগে ছফার। ওর মাঝে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে ছফা। টিউশনি করে পড়ার খরচ চালায় আবার দলের কাজেও খুব মনযোগী। আজকে রাফির মুখ মলিন। ওকে কাছে ডাকলো।
-কি রে মন খারাপ? ছফা জিজ্ঞেস করলো।
– আজকের মিটিঙে রঞ্জু শেখ দলের নমিনেশান চাইছে? বিমর্ষ কণ্ঠে বললো রাফি।
ছফা নির্বাচনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তত। ঠিক এই মুহূর্তে এমন কথা শুনতে সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। লজ্জা আরা হতাশার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে চুপসে গেলো ছফা।
নমিনেশান এর দাবীদার এর নাম রঞ্জু শেখ। সে রমজান শেখের বড় ছেলে। যুবক বয়সে পড়াশুনা করতে বিলেত চলে যায়। রঞ্জুর রাজনৈতিক জ্ঞান শুন্য। দুবছর হলো বিলেত থেকে ফিরেছে রঞ্জু। ডিগ্রির পাশাপাশি একটা বদ অভ্যাস ও সঙ্গে নিয়ে এসেছে। নেশা করে সে।
-‘এখন কি করবেন চাচা’? রাফির প্রশ্ন শুনে ছফার ধ্যান ভাঙ্গলো।
-‘আইচ্ছা মিটিঙে রমজান চাচা আছিলো? ছফা পাল্টা প্রশ্ন করলো।
-‘হু আছিলো, উনি ডাইরেক নিজের ছেলের পক্ষ নেন নাই। তবে উনি খারাপ কিছু বলেন নাই, উনার ছেলেটা জ্ঞানী। তার মতে, এ যুগে জ্ঞানী লোকের ক্ষমতায় আসা দরকার। চাচা মনে কষ্ট নিয়েন না। তয় আমার মনে হয় পরেরবার আপনার উচিৎ হইবো রঞ্জু ভাইরে জায়গা দেয়া। লোকটার মন খুব ভালা, ওইদিন আমাগো ক্লাবের ছেলেদের ২ হাজার টাকা হাতখরচ দিছে, টাকা পয়সা লাগলে ওনারে জানাইতে কইছে। দলের পোলাপাইনতো ওনার ভক্ত হয়া গেছে’।
এ যেন ক্ষরার মাঝে ভূকম্পন! রাফির কথায় বেশ আঘাত পেলো ছফা। আনমনে ভাবতে লাগলো সে। রাজনীতিতে আজকের অবস্থানে আসতে ওর বিশ বছর লেগেছে। সুখে দুখে দলের পাশে থেকেছে সবসময়। দল যাকে চেয়েছে তার সমর্থন করে গেছে। নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী লেখাপড়া করতে পারেনি। যেটুকু পড়েছে তা দিয়ে কোনদিন কোন চাকরির চেষ্টা করে নি।
রমজানের ছেলে কম করে ছফার আট বছরের ছোট। কলেজে উঠার পরও ছেলে রঞ্জুকে রাজনীতিতে ঘেঁষতে দেয়নি রমজান। অথচ এই রমজানই স্কুলের ছাত্রদের জন্য রাজনীতি বাধ্যতামূলক করেছে। ছফার ক্লাস এইট পড়ুয়া ছেলেটাও এখন পড়া লেখার চেয়ে, পুলিয়া হাই স্কুলের রাজনীতি নিয়ে বেশী ব্যাস্ত। ছাত্র হিসেবেও যে খুব একটা মেধা ছিল রঞ্জুর, তা না। বাবার টাকায় বিদেশে পড়েছে।
ছফা অভাবকে খুব কাছ থেকে দেখেছে তবুও কখনো টাকার সামনে নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়নি কোনদিন। রাফির কথাটা শুনে, আজকে মনে হচ্ছে। রাজনীতিতে ওর এতো বছরের কষ্ট আর ত্যাগ রঞ্জুর দুই হাজার টাকার কাছে কতো সহজেই হেরে গেলো।
রঞ্জুকে নিয়ে রাফির মনোভাব ছফাকে আঘাত করেছে। কিন্তু চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়ার আশা একটুও ছাড়েনি সে। ও ভালো করেই জানে, রাজনীতি এক কঠিন খেলা। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়।
ও জানে, এখনো কিচ্ছু শেষ হয়নি। সবার সমর্থন পেলে রঞ্জুকে আটকাতে ওর খুব একটা বেগ পেতে হবে না।
৪
পার্টির প্রার্থী কে হবে তা নিয়ে যথারীতি উপজেলার পার্টি অফিসে সভা বসলো। রমজান শেখ ছফাকে ওয়াদা করেছিলো ওকে দলীয় নমিনেশান দিবে। সভায় কারো পক্ষ নিলো না রমজান। পুলিয়ার রাজনীতিতে ছফার জয়জয়কার। সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় ছফার পক্ষেই গেলো। শেষ পর্যন্ত সবাই সেই রায় মেনে নিলো। স্বয়ং রমজান শেখ হাসিমুখে ছফাকে পার্টির মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা করলো। সবভুলে গিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করলো কর্মীরা।
সবকিছু প্রবল উৎসাহে চলছিলো। হঠাৎ বিপত্তি! দুসপ্তাহ বাদে এক রাতে ছফার উপর অতর্কিত হামলা!
সেদিন একাই বাড়ি ফিরছিলো ছফা। ঝোপের আড়াল থেকে উঠে আসে হামলাকারীরা। কাওকে চিনার উপায় নেই। মুখ চাদরে ঢাকা। ধারালো ছুঁড়ির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পরলো ছফা। একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ ছফার পতনের আনন্দে ঝিলিক মারছে। চোখজোড়া বড্ড চেনা লাগছে। হুশ ফিরে পেলো ছফা। এ যে শেখের চামচা, মোবারক!
ছফার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। ক্রমশ মাটিতে লুটে পরলো সে। দূরে বাতি জ্বলছে। বাতির আলোয়, পুলিয়া পাঠাগারের ভাঙা বোর্ডটা দেখতে পাচ্ছে ধুলায় লুটিয়ে থাকা রক্তাক্ত ছফা। উজ্জ্বলতায় জ্বলছে বোর্ডে অঙ্কিত পাঠাগারের নাম। হাফেজ মাস্টার সৃতি পাঠাগার। আস্তে আস্তে সেই আলো অনুজ্জ্বল হয়ে আসছে।
মৃত্যু পথযাত্রীর মধ্যে এক রকম অস্বাভাবিকত্ব থাকে। হয়তো তারা অলৌকিককে অবলোকন করতে পারে। হয়তো ছফার আহত অবচেতন মনের কল্পনা।
নিভু চোখে ছফা দেখলো, আঁধার থেকে একটা ছায়া মূর্তি ওর দিকে এগিয়ে আসছে।
সফেদ কাপড় পরিহিত। অন্ধকারে মুখটা বুঝা যাচ্ছে না। ঝাপসা মুখটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগলো। অবশেষে স্পষ্টভাবে উন্মোচিত হলো। এ যে ওর রাজনৈতিক গুরু মরহুম হাফেজ মাস্টার!
ছফার মনে হলো, আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে হাফেজ মাস্টার তার চিরচেনা অগ্নিকণ্ঠে বলছেন,
‘বলছিলাম না? একদিন ঠিকই সত্য বজ্র হয়ে ঠোকর মারবে। তোর অবসরের সময় হইছে। এখন চল আমার লগে, তুফান আসতেছে।’
ভয়, অনুশোচনা আর অবিশ্বাসের এক মিশ্র অনুভুতি ঘিরে ধরলো ছফাকে। নিজেকে সামলাতে পারলো না সে। নিস্তেজ হয়ে জ্ঞান হারালো।
পরিশিষ্টঃ
পুলিয়ার কৃতিসন্তান শরিয়ত হোসেন ছফা ১৯৯৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি দিবাগত রাতে দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো উনচল্লিশ বছর। এলাকায় ৩ দিনের শোক ঘোষনা করেছে পুলিয়া জনতা পার্টি। রমজান শেখের সৌজন্যে এলাকাজুড়ে কালো শোক ব্যানার শোভা পাচ্ছে।
রমজান শেখ ছফার শোকে শয্যাশায়ী, নাকি অন্দরে বসে আসন্ন জানাজার জন্য বক্তৃতা প্রস্তুত করছেন, তা জানা যায়নি। রমজানকে সান্ত্বনা দেয়ার মহান দায়িত্ব যথারীতি কাঁধে নিয়েছে চামচা মোবারক।
নিজেকে ছফার ছোট ভাই পরিচয় দিয়ে ছফা হত্যার বিচার চেয়ে মানব বন্ধন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে পুলিয়া জনতা পার্টির নতুন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী রঞ্জু শেখ।
গোটা এলাকায় এক অদ্ভুত শুন্যতা বিরাজ করছে।
———
৫ই জানুয়ারি,১৯৯৮ সন। সময়ঃ সকাল দশটা।
স্থানঃ পুলিয়া বড়বাড়ির গোরস্থান।
কবর খুঁড়তে খুঁড়তে এক নিঃশ্বাসে গেয়ে যাচ্ছে রশিদ আলী।
‘এই মাটি তোমার হবে ঘর, বাকি সবই হবে পর
মিছা হবে বাহারি এই রঙের ই আসর’।
রশিদের ছয় বছরের ছেলে রহিম মাটি সরাচ্ছে। কবর খোঁড়ার সময় রশিদের বাবা রজব আলীও গানটা গাইতো।
বিষণ্ণ মনে পাশে দাড়িয়ে আছে, ছফার প্রিয় সাগরেদ রাফি।
——————————————————————-
ঢাকা, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭