ধুপশিখা

ধুপশিখা/ কাজী লাবণ্য

 

কাশফুলের মত শ্বেতশুভ্র ধোঁয়ার শিখাগুলি কিছু সোজা আবার কিছু কিছু একসাথে কুন্ডলি পাকিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে আর মন কেমন করা এক অদ্ভুত গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। চাল ভর্তি একটি ম্যালামাইনের বাটিতে কদমফুলের মতো আগরবাতি গুলি গেঁথে দিয়ে চৌকির তলায় রাখা হয়েছে। আরো বেশ কয়েকটি এমন বাটি, কয়েকটি আগরদানি বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছে। উঠোনের এক কোনায় সেই ভেজা জায়গাটায় একগুচ্ছ আগরবাতি মাটিতে গাঁথা হয়ে গন্ধ বিলিয়ে যাচ্ছে।

এই আগরবাতির গন্ধটি যেন কেমন! এই গন্ধ নাকে এলেই মিলাদ, ঈদ, কোরান খতম, বা এই ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা মৃত্যুবাড়ীর কথাই মনে হয়। সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে অনেক কিছু, সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছুই চলে গেছে চির বিলুপ্তির পথে। বহু আগে মানুষ সুগন্ধি হিসেবে আতর ব্যবহার করলেও এখন বেছে নিয়েছে আধুনিক বডি স্প্রে বা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পারফিউম। পরিবেশের জন্য এসেছে বিভিন্ন দামের বিভিন্ন নামের এয়ার ফ্রেশনার, কিন্তু পরিস্থিতি মতো আগরবাতির জায়গা আছে এক অভিন্ন।

এখন রাত কটা বাজে কে জানে! সমস্ত কোলাহল স্তব্ধ, চারিদিকে সুনসান নিরবতা, আগত শেষ মানুষটিও চলে যাবার পর পুরো পরিবেশ যেন আচমকা পালটে গেল। আচানক আমার মনে একটি অদ্ভুত ভাবনা  এলো- আচ্ছা এখন এই নিরিবিলিতে যখন দেখার বা শোনার কেউ নাই, এই ফাঁকে আব্বা কি একবার  আমাকে কিছু বলতে পারেনা! একটিবার। একটু খানি কথা! এই রহস্যময় বিশ্ব  ব্রহ্মান্ডে কত কিছুই ত ঘটে! কত অলৌকিক ঘটনার কথা শোনা যায়! যদি তাই হত আমি কাউকে বলতামনা। সত্যি সত্যি সেই অসম্ভব অলৌকিক কিছু ঘটার আশায় বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটু পা চালিয়েই আব্বার কাছে গেলাম তার পাশ ঘেষে তার চৌকিতে বসলাম, আব্বা কি কিছু বলবে আমাকে! এই নির্জন নিস্তব্ধ চরাচরে যখন কেউ  কোথাও জেগে নেই- আব্বা কি পারে না তার আলাভোলা প্রিয় কনিষ্ঠ সন্তানকে কিছু বলতে! চিরদিনের জন্য স্পর্শের একটু শেষ ভরসা দিতে!

আমি শহরের একটি বেসরকারী কলেজের অংকের মাষ্টার। অংক একটি রহস্যময় আবার লজিক্যাল ব্যাপার হলেও আমি মানুষটা লজিকের বাইরে চিন্তা ভাবনা করি। যদিও সেগুলি খুব কার্যকর কোন চিন্তা ভাবনা নয়। কিন্তু না ভেবে আমি পারিনা। আমরা ৪ ভাই আর ১ বোন। ৩ ভাই নিজেদের ব্যবসা, জমি জমা, গঞ্জের দোকান, কিছু বাসা ভাড়া দেয়া আছে সেগুলি দেখাশোনা করে। আব্বা মা, ৩ ভাই ও তাদের বৌ বাচ্চা মিলে এখনও আমাদের যৌথ পরিবার। কেবল আমি চাকুরির কারনে পরিবার নিয়ে শহরে থাকি। এই উপজেলা থেকে শহরের দূরত্ব বেশি নয়।

আব্বা ছিলেন অত্র এলাকার একজন মান্যগণ্য রাজনৈতিন ব্যক্তি। আজকালকার নৈতিক অবক্ষয়ের ঘৃণ্য রাজনীতি নয়, যখন রাজনীতি সত্যিই মানুষের কল্যাণে কাজ করত সেই তখনকার রাজনীতি। ব্যক্তি হিসেবেও তিনি ছিলেন একজন ত্যাগী, পরিশ্রমী, মিতব্যয়ী, নির্মল চরিত্রের সমুজ্জ্বল প্রতীক। তিনি সারাজীবন মানুষের কল্যানে কাজ করেছেন। আর মা! তিনিও বাবার ছায়া হয়ে নিজের মতো সংসার, সন্তান এবং আব্বার আদর্শকে মেনে নিয়ে জীবন নির্বাহ করেছেন। মা ছিলেন নিঃস্বার্থ দেশ সেবার মন্ত্রে দীক্ষিত আব্বার যথার্থ জীবন সঙ্গিনী। মা আত্মপ্রত্যয়ে ভরা ত্যাগী সাহসী একজন মানুষ, মা বিশ্বাস করেন কেবল ধন থাকলেই ধনী হয়না, যার যতটুকু আছে তা থেকে যে অকাতরে দান করতে পারে, সেই প্রকৃত ধনী। আব্বা- মা দুজনেই তাদের বিশ্বাস সন্তানদের মাঝে গ্রোথিত করার চেস্টা করেছেন। ৮০/৯০ বছরের পুরনো আব্বা মা আমাদেরকে নিজেদের আত্মিক ও জাগতিক গুণাবলির সমন্বয়ে প্রকৃত মানুষ করার চেস্টা করেছেন। কতটা আমরা হতে পেরেছি, আমি জানিনা। তবে আমি আমার মননে চেতনে ধারন করি যে এমন সবল শুদ্ধ চরিত্রের অনন্য সাধারণ বাবা মায়ের সন্তান হতে পারাটাও জীবনের এক অতুলনীয় প্রাপ্তি। তারপরও জেনারেশন গ্যাপ সম্ভবত থেকেই যায়।

খুব স্বাভাবিক নিয়মে বয়স হলেও রোগ ব্যধি বিষন্নতা বা জীবনের উপর কোন বিরূপ মনোভাবে আব্বা কখনই জরাগ্রস্থ বা ভারাক্রান্ত হননি। আব্বার সঙ্গী ছিল একটি ইয়ামাহা-১৪০ মোটর বাইক, সকল কাজে এটাই ছিল তার একমাত্র বাহন। যখন তিনি এম পি ছিলেন তখনও তিনি (রাজধানীতে যখন গেছেন সেই সময় ছাড়া) অক্লান্ত এই বাহনই ব্যবহার করেছেন। অকুতোভয় মানুষটি অন্যায়ের সাথে, ভোগ বিলাসিতার সাথে আপোষ করেননি।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজের কাজ নিজের হাতে করে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে, সন্তানদেরকে শেষ উপদেশ দিয়ে, মার কাছে বিদায় নিয়ে চিরদিনের জন্য চোখ বুজেছেন। গত দুদিন ধরেই আব্বার শরীর খারাপ ছিল, শোনামাত্রই আমি সপরিবারে ঐদিনই চলে আসি। গতদুদিন ধরে আমি আব্বার বিছানার এক কোনে চুপচাপ বসে থাকতাম, তার অসুস্থ্যতার খবর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লে, স্রোতের  মতো লোকজন   আসতে থাকে। আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব ছাড়াও আসতে থাকে আব্বার কাছ থেকে যারা উপকৃত হয়েছে, যারা আব্বাকে বিপদের বন্ধু বলে জানে তারা। গত দুদিন ধরে চলে দর্শনার্থী মানুষের ঢল। আমি আব্বার কোন কাজে আসিনা, কেবল চুপচাপ এক কোণে বসে বসে আব্বার দিকে তাকিয়ে থাকি। তিনি প্রায় সকল মানুষের মাথায় হাত বুলিয়ে মঙ্গল প্রার্থনা করেন এবং নিজের জন্য দোয়া করতে বলেন। এভাবে একের পর এক চলতেই থাকে। ডাঃ এর নির্দেশ অনুযায়ী বড় ভাইয়েরা এই মানুষের ঢল এ্যালাউ করছিলেন না, কিন্তু আব্বার প্রবল ইচ্ছায় আবার কিছু বলতেও পারছিলেন না। ডাঃ এবং ভাইদের হাজার অনুরোধ স্বত্বেও আব্বা কিছুতেই হসপিটালে যেতে রাজী হলেননা। তিনি ধীর স্থির ভাবে এক কথাতেই অনড় রইলেন, বললেন-

-আমার সময় শেষ, কোন বিষয়েই তোমরা আমায় জোর করবে না…

একইরকম ভাবে গত দুদিন যাবার পর আজ শেষ বিকেলে আব্বা বললেন তাঁর চার পুত্র আর আম্মা বাদে কেউ যেন ঘরে না থাকে। তাঁর ইচ্ছেমত ব্যবস্থা করা হলে, আব্বা প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। কবছর আগে প্রয়াত একমাত্র কন্যার জন্য নিরব থাকলেন, তারপর আম্মার ব্যাপারে বললেন কোন অবস্থাতেই আম্মার যেন কোন অসুবিধা বা অযত্ন না হয়। তারপর বললেন- তোমরা আমার জন্য দোয়া কর, কিন্তু কান্নাকাটি বা আমার জন্য বিশাল বড় কাঙ্গালি ভোজের আয়োজন করবানা। বলার সামান্য পরেই সত্যি সত্যিই আমাদের জোড়া জোড়া সজল চোখের সামনে আব্বা চলে গেলেন অতি নিরবে নিশ্চুপে বিনা ভয়ে বিনা কষ্টে… কী প্রশান্তিময় সেই প্রস্থান!

আশ্চর্য, খুব আশ্চর্য! মৃত্যু এমন! বিস্ময়কর মৃত্যু আমায় একেবারে নির্বাক করে দিল। ভাইয়েরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে, মায়ের গলা ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। মা ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়লেন আর চিরকালই শান্ত ও ছাড়া ছাড়া স্বভাবের আমি বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে রইলাম। আমার গুছানো অতি পরিচিত ভুবন যেন পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ল, আমার হতবিহবলতা কাটেনা, একদম বিশ্বাস হয়না আব্বা চলে গেলেন! আব্বা আর নেই! এখন তাকে বলা হবে ডেডবডি বা লাশ। এ কি করে সম্ভব! এই যে আব্বা আমাদের মাঝেই শুয়ে আছেন, তাঁর অবিকৃত শরীর এখনও গরম অথচ তিনি নেই। একজন মানব শিশু জন্মাবার পর তাকে মানুষ করতে চলে যায় বছরের পর বছর, মানব শিশুর মত এতো সময় নিয়ে আর কোন প্রাণীই তো বড় হয়না। সেই পরিপুর্ণ একজন মানুষ কিনা এক লহমায় শেষ! সে আর মানুষ রইলনা! হয়ে গেল কেবল দ্রুত পচনশীল এক শরীর! তখন সকলের মুখে এক কথা তাড়াতাড়ি ঢাকার ব্যবস্থা কর, ঢাকার ব্যবস্থা কর। একজন কেউ মুরব্বি এসে আব্বাকে আপাদমস্তক একটা চাদরে ঢেকে দিলেন। মুহুর্তেই চারিদিক থেকে আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, রাজনৈতিক সহযোগী, ভক্ত, সমর্থক দিয়ে বাড়ি ভরে উঠতে লাগল..

একসময় ভাইয়েরা ও ময়মুরব্বি মিলে ঠিক হলো আগামিকাল সকাল সকাল আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে জানাজা শেষে তাঁকে কবর দেয়া হবে। তিনি চলে যাবেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অন্ধকার এক সুড়ঙ্গ পথের দিকে…

একজন কেউ মারা গেলে মৃত্যু পরবর্তী বহু করনীয় দায়িত্ব কর্তব্য থাকে। আমার ৩ বড় ভাই, মামাত চাচাত ভাই আরো প্রচুর আত্মীয় স্বজন মিলে সেগুলি করতে লাগল। যেমন কাফনের কাপড়, নতুন সাবান, লোবান, আগরবাতি ইত্যাদি কিনে আনা। মাইকিং এর ব্যবস্থা করা, বাঁশ কাটা, কবর খোঁড়া, হুজুরদের খবর দেয়া, নাম ধরে ধরে প্রতিটি মানুষকে ফোন করে শোক সংবাদ দেয়া ইত্যাদি, কোন কাজই বাকি রইল না।

আব্বার গোসল দেয়া হল। তাকে উঠানের এক কোনে একটি চৌকিতে শুইয়ে রাখা হল চাদরে ঢেকে। গোসলের জায়গাটি পানি ঢেলে লেপে দেয়া হল। সেখানে ধুপ এবং আগরবাতি জ্বালানো হল। তাহলে মৃত্যু কি অশুচি ব্যাপার! যে জায়গায় কেউ মারা যায় সে জায়গাও কি অশুচি হয়ে যায়! রাত বাড়তে লাগলে ধীরে ধীরে আগত মানুষজন চলে গেলে চারপাশ সুনসান হয়ে আসে। কেবল এতিমখানা থেকে আগত কয়েকজন ছোট ছোট ছেলে ঢুলে ঢুলে পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করতে থাকে। একটু পরে তাদেরও গলার মিঠে সুর স্তিমিত হয়ে আসে।

অত্র এলাকার রীতি অনুযায়ী কেউ মারা গেলে আত্মীয় প্রতিবেশীরা খাবার দিয়ে যায়। যে কদিন কুলখানি না হয় খাবার আসা চলতেই থাকে। অনেক সময় আত্মীয় প্রতিবেশী বসে আলোচনা করে ঠিক করে নেয় কে কোন বেলা খাবার দেবে তারপরও দেখা যায় কোন বেলা একাধিক বাড়ি থেকে খাবার চলে আসে। বাড়ীর মানুষ, আগত আত্মীয় স্বজন খেয়েও অনেক খাবার বেঁচে যায়, সেগুলো গরীব মানুষদেরকে খাওয়ানো হয়। আজ রাতেও কে যেন প্রচুর খাবার এনে বাড়ীর সকলকে সামনে বসিয়ে মমতার সঙ্গে খাইয়ে দিয়েছে। উপস্থিত সকলেই খেয়েছে, যারা আব্বাকে গোসল দিয়েছে তারা, বড় হুজুর এবং তার সাথে আসা সব তালেব উল এলেমরা সকলেই খেয়ে দেয়ে যার যার ঠিকানায় চলে গেছে।

আমাকেও কে যেন ডেকে খাবার টেবিলে বসিয়ে দিয়েছিল খেয়ে নিয়েছি, মনে হয় বেশীই খেয়ে ফেলেছি, কেন যেন খুব ক্ষুধা লেগেছিল।

আগামিকালের কাজকর্মের আলোচনা সেরে সকলেই চলে গেলে, খালা চাচির সহায়তায় হাইপ্রেসার ও ডায়াবেটিসের পেসেন্ট শোকে মুহ্যমান দিশেহারা আমার মা শুয়ে পড়লেন। সবাই চলে যাবার পর কেবল আমার ৩ বড়ভাই আলোচনা করে ঠিক করলেন- ক্ষমতাসীন দলের কোন কোন এম পি, মন্ত্রীকে কুলখানিতে ডাকবেন। এও ঠিক হলো কুলখানির আয়োজন হবে দু ধরনের সাধারণ মানুষের জন্য একরকম আর ভি আইপি দের জন্য স্পেশাল। একজন ভাই বলে উঠলেন আচ্ছা সেসব আলোচনার জন্য আরো সময় আছে, এখন ঘুমানো যাক। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলেন- সাদা পাজামা পাঞ্জাবি টুপি সব ঠিকঠাক আছে না নেই কে জানে! এরই মধ্যে কেউ একজন বড়, মেজো কিংবা সেজো উঁচু গলায় আমাকেও ডাক দিলেন।

নির্জন রজনী ধীরে ধীরে কেমন যেন ভুতুড়ে হয়ে উঠতে লাগলো। বাড়ির চারপাশে লাগানো বাল্বগুলোকে ঘিরে নানা পতঙ্গ উড়তে লাগলো।

পবিত্র কোরান তেলাওয়াতকারীরা ঝিমিয়ে পড়ে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়েছে। খাবারের লোভে যে কুকুর গুলি এসেছিল তারাও এক সময় এ কোনায় সে কোনায় ঘুমিয়ে পড়েছে, কেবল ঘুমহীন আমি জেগে রান্না ঘরের পাশে ঝোপালো কামরাঙা গাছটির নিচে একটি টুলে বসে আছি। মানুষের অহেতুক কৌতুহলী প্রশ্নের হাত থেকে লুকিয়ে থাকার জন্য এই গাছের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কোন জায়গা হয়না। ছোটবেলা থেকে বাড়ির অবস্থা বুঝে কত আমি এখানে উঠে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতাম, মা জানতেন কিছু বলতেন না। পরিস্থিতি আমার অনুকূলে এলে নেমে আসতাম। মা এসে জড়িয়ে ধরে গায়ে মাথায় আটকে থাকা নাকফুলের মত কামরাঙার অপুর্ব ফুল, হলুদ পাতা, মাকড়শার ঝুল মুছে দিয়ে আদরের ঠোঁট কপালে ছুঁইয়ে বলতেন “যা বাবা খেলতে যা কিংবা পড়তে যা”। আমি চলে গেলে নিশ্চয়ই মার বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসত। আজও কয়েকবার আমার সেই পুরনো অভ্যাস মনে মনে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কিন্তু এখন আমি অদম্য ইচ্ছেকে দমন করতে শিখে গেছি।

আমি আগা গোড়াই একটু তফাতে দাঁড়িয়ে বা বসে বসে সব অবলোকন করে যাচ্ছিলাম। না ইচ্ছে করে বিশেষ কিছু দেখার জন্য নয়, আমার বৈশিষ্ট বা স্বভাবটাই এমন। অনেক কিছুতেই আমার খটকা লাগলেও আমি কাউকে কিছু বলতে পারিনা, আবার করতেও পারিনা। একদম ছোটবেলা থেকেই আমি এরকম। অনেক বড় হবার পর আমি বুঝতে পেরেছি ব্যাপারটা কিন্তু তার অনেক আগেই আব্বা বুঝতে পেরেছিলেন এবং আমাকেত নয়ই কাউকে না জানিয়ে আব্বা ডাঃ এর পরামর্শ মত নিজের বুদ্ধি বিবেচনা মত আমার সাথে প্রতিটি আচরণ করেছেন, আগলে রেখেছেন, কেউ যেন আমায় অন্যরকম কিছু মনে না করে সেজন্যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছেন। তিনি চাননি পরিবার, সমাজ বা পৃথিবী আমাকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করুক বা আলাদা ভাবে ট্রিট করুক। সে সময় এই ব্যাপারে কোনরকম জন সচেতনতা বা সুচিকিৎসা গড়ে উঠেনি, তারপরও আব্বা খুজে খুঁজে ঢাকা শহরের কোন এক ডাঃ পরামর্শ নিয়েছেন এবং অনেক খুঁজে এর উপর একটি বই কিনেছেন যদিও সেটি ইংলিশে লেখা ছিল। অংকে ভালো ছিলাম বলে কোনরকমে মাস্টার্স কমপ্লিট করতে পেরেছি, আসলে আমি কি করেছি! আব্বাই হাতে ধরে করিয়েছিলেন। আবার নিজের এক বিধবা বোনের মায়াবতী একটি মেয়ের সাথে বিয়েশাদি দিয়ে আমার জীবনটাকে স্বাভাবিক একটা গতি এনে দিয়েছেন। অনেক বড় হবার পর আব্বার সংগ্রহের প্রচুর বইয়ের মাঝে সেই বইটি পেয়েছিলাম সেটি পড়তে গিয়েই আমি বুঝে যাই আমার ব্যাপারটা। অবশ্য আমি নিশ্চিত জানিনা আমার সমস্যা সেটাই ছিল কিনা। হতে পারে আমার সমস্যা অন্যরকম। সেখানে অনেক লেখায় লাল কালিতে আন্ডারলাইন করা ছিল, পাশে আব্বার নিজের হাতের কিছু নোটও ছিল। বইটিতে লেখা ছিল-

“অটিজম কোন সাধারণ রোগ নয়। এটি শিশুদের একটি মনোবিকাশগত জটিলতা যার ফলে সাধারণ ৩টি সমস্যা দেখা দেয়। যেগুলি হচ্ছে-

প্রথমতঃ মৌখিক কিংবা অন্য কোন প্রকার যোগাযোগ সমস্যা।

দ্বিতীয়তঃ সামাজিক বিকাশগত সমস্যা।

তৃতীয়তঃ খুব সীমাবদ্ধ ও গন্ডিবদ্ধ জীবন যাপন ও চিন্তা ভাবনা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ। এ ছাড়া অতি চাঞ্চল্য, জেদি, বা আক্রমণাত্মক আচরণ, অহেতুক ভয়ভীতি, খিঁচুনি ইত্যাদি থাকতে পারে।

১৯৪৩ সালে জন হপকিন্স হাসপাতালে ডাঃ লিও কান্নের এবং প্রায় একই সময়ে জার্মান বিজ্ঞানী ডাঃ হ্যান্স এস্পারজার রোগটি সম্বদ্ধে বিস্তারিত জনসমক্ষে উপস্থাপণ করেন। তার আগে রোগটি থাকলেও এ সম্বদ্ধে তেমন কোন ধারনা ছিলনা। অটিস্টিক শিশুরা সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করতে এবং সঠিক আচরণ করতে ব্যর্থ হয়। তাকে নির্দিষ্ট সামাজিক পরিস্থিতিতে প্রত্যাশিত আচরণের শিক্ষা দিতে হয় নিয়মিত। এদের সংবেদী ক্ষমতা অনেক সময় ভালো থাকে না। উৎসব বা জনসম্মুখে যেখানে শত শত মানুষ কথা বলে লাউড স্পিকার বাজে জোড় শব্দে এসব তার কাছে দুর্বিসহ হতে পারে, কেননা সে হয়ত অতি শ্রবনসংবেদি। এরা অনেক সময় কথার আক্ষরিক অর্থই বোঝে, অন্য অর্থ থাকলেও তা ধরতে পারে না। অটিস্টিক শিশুর সঙ্গে বাগধারা, প্রবচন, প্রহসন, দ্ব্যর্থবোধক শব্দ ব্যবহার না করে সরাসরি সহজ ভাষায় কথা বলা ভালো”

টুলে বসে বসেই আমি দেখলাম- আব্বাকে গোসল দেবার পর পর্দাঘেরা জায়গা থেকে কেউ একজন উচ্চস্বরে বলে উঠল- গা মোছার তোয়ালে বা গামছা কই?

এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল, আব্বার চার পুত্রবধূ বারান্দায় জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে রইল-

বাড়ির পুরনো আম্মার সহকারী মেয়েটি এক দৌড়ে আব্বার ঘরের দরজায় তারে ঝুলানো বহুল ব্যবহিত প্রায় ক্ষয়ে আসা গামছাখানি এনে গোসলকারির হাতে দিল- ধরা গলায় বলল-

-এইটা নানার গামছা।

আমার বিস্ময় কাটেনা- এ বাড়ির ড্রয়ার, আলমিরা, সুটকেস, খুললে কত শত নতুন তোয়ালে গামছা রয়েছে, কেউ একটা নতুন তোয়ালে এনে দিল না!

গোসল শেষে আবার হাক ডাক লাশ ঢেকে রাখতে হবে পরিষ্কার কাপড় কই!

কারো কোন সাড়া শব্দ নেই!

একটু পর মা নিজেই ঘর থেকে বহু পুরনো একটি কাশ্মিরী শাল এনে দিল, বলল-

-এটি পরিষ্কার।

আমি জানি ওটি ধোয়া পরিষ্কার। আব্বা প্রতি শীতে এই চাদর গায়ে দিতেন এবং শীত শেষে মা সেটি ধুয়ে ইস্ত্রি করে ন্যাপথলিন দিয়ে তুলে রাখতেন। সেটি বড় ট্রাংকের ভেতর শুয়ে শুয়ে পরের শীতের জন্য অপেক্ষা করত। আমার যতদুর মনে পরে আমার বোধ হবার পর থেকেই আব্বার গায়ে এই চাদর দেখে এসেছি যা এখন আর নিজস্ব বর্ণে নেই।

মনে হল- বাড়ীতে কত নতুন চাদর, বেডকভার আরো কত কিছু আছে কেউ একজন ছুটে গিয়ে নিয়ে এসে বলল না এটা দিয়ে আব্বাকে ঢেকে রাখ।

এই তবে জীবন! আব্বা এত কিছু করলেন সারা জীবন, এত সংগ্রাম করলেন দুনিয়ার মানুষের জন্য, পরিবারের জন্য, এত কৃচ্ছসাধন, এত লড়াই! এ্যাবনরমাল এক সন্তানকে কিভাবে জগত সংসারে স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠা দিলেন! এত কিছু তবে কার জন্য! যা রেখে গেলেন তাই বা কার জন্য! হায় নশ্বর জীবন!

আমি জানিনা। আমি আসলেই কিছু জানিনা। বিবমিষায় আমার অন্তর যেন নিমতিতা হয়ে গেল। আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেল!

আচ্ছা রাত এখন কত? আমার হাতে ঘড়ি নেই। বাড়ির সব দরোজাই বন্ধ, কেবল মায়ের দরোজা একটু ফাঁক, সিডেটিভ ঘুমের ঘোরেই মা মৃদু গোঙানোর শব্দ করছেন, এছাড়া আর কোথাও কোন শব্দ নেই।

সাদা কাফনে মুড়ে একটা খালি চৌকিতে আব্বা শুয়ে আছেন। সেই বিবর্ণ চাদরে আপাদমস্তক ঢাকা। হুজুর এবং বড় ভাইয়েরা মিলে অতি দ্রুত বাঁশ পুঁতে উপরে ছাউনি দিয়ে একটি সাময়িক চালা তৈরি করেছে এর নিচেই আব্বাকে রাখা হয়েছে। প্রায় ৯০ বছর এই গ্রহের পথপ্রান্তরে হেঁটে হেঁটে আমার ক্লান্ত আব্বা অবশেষে কাল চলে যাবেন অজানা এক ঠিকানায়।

আমি কি ক্লান্ত! আমি কি শোকাহত! আমি কি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করছি! না সেসব কিচ্ছু নয়। কেবল এক সীমাহীন হাহাকার আমায় গিলতে লাগল, আমার জলহীন, নিদ্রাহীন চোখ কেমন যেন জ্বালা করতে লাগল…

রাতের চরিত্র দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভোর হতে আর বাকি নেই, সকাল হলেই সবাই মিলে আব্বাকে নিয়ে যাবে কবরে। আমি উঠে আস্তে আস্তে পুরো বাড়িটা হাঁটলাম, এল শেপের বারান্দা ঘুরে সব ঘরের দরোজায় একটু করে থামলাম। পৃথিবী গহীন ঘুমে নিমগ্ন। পুরো বাড়ি পরিক্রমা শেষে আমি আব্বার পাশে এসে দাড়ালাম। একবার চৌকির নিচে উঁকি দিলাম। ভেতরের অনুভুতি ব্যক্ত করার মত বিচক্ষনতা আমার নেই, আর দশজন মানুষের মত বুদ্ধিমান বা চৌকশ আমি নই, আমার ভেতরে কোথায় যেন দুমড়ে মুচড়ে আমাকে লণ্ডভণ্ড করতে লাগল, আমার সমস্ত পৃথিবী চারপাশ থেকে ছোট হয়ে আসতে লাগল, আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল, মাথার ভেতরে এক কালো ঘুর্ণি পাগলের মত ঘুড়তে লাগল। বাড়িটা চারপাশ থেকে ছোট হয়ে আসছে। কোথায় গিয়ে আমি আমার অন্তরাত্মায় উপচে উঠা সব দুর্বিসহ যন্ত্রণা বের করে দিতে পারি! আমি আর পারলামনা- আমি আস্তে করে চৌকিতে উঠে আব্বার পাশে সেই বিবর্ণ চাদরের অর্ধেক মুড়ি দিয়ে সটান শুয়ে পড়লাম।

আগরবাতির সুগন্ধি ধোঁয়া ফুরফুর উড়তে লাগল আর মরা মাছের চোখের মত আকাশের চাঁদটা নির্বিকার তাকিয়ে রইল।

 

 

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত