এক প্রবল বৃষ্টি রাতের গল্প ছিল ‘রাতভর বৃষ্টি’। সেই রাতের নরনারী, সেই রাতের দম্পতি, সেই রাতের পরিবার, প্রতিবেশীরা দীর্ঘ দিন, দীর্ঘ রাত ধরে আমার মাথায় বিস্তার করে।
‘বিস্তার’ ব্যাপারটার স্বভাব বড় ভয়ংকর। শান্তি দেয় না কাউকে এক মুহূর্ত। পিলপিল পায়ে মাথাটা ক্রমাগত খেতে থাকবে। মগজেই বাসা বানাবে আবার মগজ খাবে।
এমন হলে অবশ্য আমি তোমার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি। তুমি হাসছ নাকি মুখ বাঁকা করে আছ ঠিক পরিষ্কার বোঝা যায় না ছবিতে। কল্পনায় তোমার আঙুল গুলোও দেখি। সেই আঙুল গুলো দেখি সত্য তবে ছুঁতে পাই না। তোমার মনটাও মাঝে মাঝে মেঘের মতো ভাসা ভাসা দেখা যায়। কিন্তু পরিস্কার বোঝা যায় না। অস্ফুট অনুচ্চস্বরে তুমি যা বলে যাও তা আসলে তুমি বলো না। তোমার গভীরেই রাখো। আর আমি কেমন চিৎকার করি তাতো তুমি দেখো এবং শোনো। মাঝে মাঝে তাল মেলাবে বলে এগিয়ে আসো। অথচ আমাদের এক পায়ের সাথে আরেক পা মেলে না কিছুতেই। কী ভীষণ অসহায় লাগে। আমরা তালহারা হই।
শান্তি একটা তবুও থাকে মনে মনে আমরা কেউ কাউকে হারাই না।
হারাই না বলেই সহজে ডাকি না। তুমিও না, আমিও না।
এই বাদল জলের রাতে তুমি শুকনো আবির মাখিয়ে শব্দের চিত্র জাল সম্পূর্ণ করছ। রক্তের মতো লাল ক্ষরণ আমাদের হৃদয়ে। সহৃদয় বলেই হয়তো লাল থেকে নীল হয়ে ওঠে। ফাগ হয়ে যায় বেদন। এইসব আমার কল্পনা।
বাস্তবতা ভীষণ কঠিন। হেড অফিস ঢাকায় হলেও সুনামগঞ্জে শাখা অফিসে তোমাকে মাসে একবার যেতেই হয়। সব সময় যাও। দুই বা তিন দিন থাকতে হয়।যেবার সাত দিন থাকতে হলো তোমাকে বিদেশি ক্লায়েন্টদের মিট করার জন্য সেবার তোমার অফিস এ্যাসিস্ট্যান্টও গিয়েছিল। তখন মনের খুঁতখুঁতানি কাটছিল না কিছুতে । সম্পূর্ণ সাতটা দিন আমি ভেতরে ভেতরে দাপিয়েছি। বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই অবশ্য। আমি এমনই। আমার ব্যবসা, বুটিক সব সামলাচ্ছি। আর ভেতরে ভেতরে তোমার জন্য মরে যাচ্ছি। তোমাকে আঁচড়াচ্ছি, কামড়াচ্ছি। আমি কী সত্যিই সেই অধিকার রাখি?
দম বন্ধ হয়ে আসছে পনেরো ঘন্টা ধরে তোমার সাথে যোগাযোগ নেই। একটা সিঙ্গেল টেক্সটও না।
মোবাইলে চেষ্টা করে যাচ্ছি, ওরাও সুইচ অফ বলে যাচ্ছে।
ফোন হাতে নিয়ে একেকটা দৃশ্য দেখি। স্ক্রল করি আর দেখি। সুনামগঞ্জ পাহাড়ি বৃষ্টির ঢলে যেন ভেসে যাচ্ছে। কী ভীষণ পানির তোড়। সোজা ভাবে কেউ হাঁটতে পারছে না। পানি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, মানুষ বাড়িঘর, গাছপালা, পশু। আমার সমস্ত শরীর হীম হয়ে আসে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। চোখ সরিয়ে নেই। কিন্তু মন মানে না। আবার দেখি। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সব বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন হয়েছ তুমিও।
রাত বারোটা বেজে গেছে। সতেরো তারিখ বদলে আঠারো তারিখ হলো। তবু্ও কথা হলো না। অনেক দিনই হয়তো সরাসরি কথা হয় না। তখন তো এমন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে না। আজকাল অল্পতেই নার্ভস ব্রেক ডাউন হচ্ছে। বিছানার পাশে বেলি ফুলের ছোট্ট বাটিটা শুভ্র নির্মল দৃষ্টি নিয়ে আমাকে দেখছে। ফুল গুলো না থাকলে হয়তো নিশ্বাস নেয়াও কঠিন হতো। ফুলের ঘ্রাণের থেকেও তুমি বেশি দখল করে আছো আমাকে।
তোমার অফিসে গিয়ে কতদিনই দেখেছি, কফি বানাচ্ছ আর ডিকটেশান দিচ্ছ তুমি! তোমার সুন্দরী স্মার্ট এ্যাসিস্ট্যান্ট টপাটপ ল্যাপটপে টুকে নেয়। তোমার হাতের কফি অসাধারণ হয়। কফি তৈরি হলে প্রথম কাপ আমার হাতে তুলে দেয়া অভ্যাস তোমার। আমি মেয়েটার দিকে তাকাই খুব সাবধানে। যেন আমার দৃষ্টিতে ধরা না পড়ে ওর ডিপ কাট ব্লাউজে সামনে পেছনে বুক পিঠ অনেক উদোম দেখে আমার চোখ বিরক্ত। কিন্তু মেয়েরা সম্ভবত মেয়েদের দৃষ্টি ভালো বোঝে। বুঝুক, তার বোঝাই উচিত। সেদিনও মেয়েটি তোমার রুম থেকে বের হবার মিষ্টি করে হেসে বিদায় নিতে ভুলল না। যা দেখলে কারো রাগ থাকে না। তবুও পারিনি সামাল দিতে, বোকার মতো ঝেঁঝে উঠে বললাম, এই মেয়ে অফিসে কাজ করতে আসে না শরীর দেখাতে আসে?
তুমি শুধু চোখ পিটপিট করে চাপা গলায় বললে, রিল্যাক্স সোনা।
ওই সাতদিনের ট্যুরে অবশ্য মেয়েটার বয়ফ্রেন্ডও গিয়েছিল- আগে জানাওনি। আমাকে জ্বালানোর উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে একেকটা বদমায়শি করো তুমি। অথচ আগে বলে দিলে কী হতো! নিরব জ্বালাতন করার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে তোমার।
ঘড়ি দেখি। তোমার ফোন বন্ধ গত সতেরো ঘন্টা পঞ্চাশ মিনিট। জানি সুনামগঞ্জে কারেন্ট নেই। আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানার পরও কেন মিটিং ক্যন্সেল করলে না! অবশ্য স্মরণকালের এমন ভয়াবহ ঢলের আগমন বার্তা কোথাও প্রচার হয়নি। মেঘালয় ভেঙ্গে মেঘ নেমেছে। দুর্বার গতিতে ওদের সাথে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের ছোটো দেশের ছোট্ট একটা অংশ। মানুষের নির্মম আহাজারি কিছুতেই শান্তি দিচ্ছে না। চোখের সামনে অদৃশ্য পর্দায় কেবল একের পর দৃশ্য চলে আসছে। তুমি ঠিক আছো তো?
তোমার অফিস দোতলা, তিনতলা মিলিয়ে। নিচতলায় কয়েকটা স্টেশনারি দোকান আর গ্যারেজ। যতবার সুনামগঞ্জ গিয়েছ ভিডিও কলে কথা বলার জন্য ইনসিস্ট করো। এবার অডিও কলও করলে না। আমি করব, করি, ভাবতে ভাবতে সময় বয়ে গেলো।
সারাদিন আমারও ছোটাছুটি করতে হয়েছে। আর পাঁচ দিন পর পদ্মা সেতুর উদ্বোধন। হঠাৎ করে আমার এক বন্ধু, তুমি চেনো রাকা, ওর বর সাংসদ। সেই রাকাদের একটা গ্রুপ একই রকম আটটা শাড়ি নেবে বলে ধরল। তারা সেতু উদ্বোধন অনুষ্ঠানে পরবে। গোপন সূত্রে প্রধানমন্ত্রীর শাড়ির রঙটা তারা জেনে গেছে। অফ হোয়াইট জমিনে লাল সবুজ কাজ। তাই ওই রঙের শাড়িই তাদের চাই। পাঁচটা রেডি করলাম। বাকি তিনটার যোগাড় যন্ত্র করতে গিয়ে তোমাকে ফোন দেয়া হয়ে উঠলো না। তুমিওতো কী ভীষণ ব্যস্ত থাকো ওখানে গিয়ে। কারখানা, অফিস, ক্লায়েন্ট, শ্রমিক সব নিয়ে তুমি আমাকেই ভুলে যাও হয়তো। আর আমিও বা কিভাবে ভুলে যাই তোমার একটা সংসার আছে।
সর্বনাশা বান সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঘুমের ওষুধ না খেলে আরো সমস্যায় পড়তে হবে। এমনিতেই হাত পা আঙুল সব ঠান্ডা হয়ে আসছে।
মনে মনে বিড়বিড় করি — প্লিজ যেভাবে পারো একটা খবর জানাও। অন্যকারো মারফত তোমার খবর নেবো না, তোমারই নিষেধ।
ফোনের ভাইব্রেশনের কারণে চমকে ধড়ফড় করে উঠে বসতে গেলাম। বুকের উপর থেকে গল্পের বইটি সরে পড়ে যায়। দস্তয়ভস্কির ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট, পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছি, পড়ে গেলো মেঝেতে। রাত কত হলো! সময় দেখে নেই। বেশি না। দুইটা পাঁচ।
হাতের মধ্যে ফোনটা কাঁপছে ঝিনঝিন করে। আননোন নাম্বার। অথচ ভীষণ ভাবে তোমার ফোন আশা করেছিলাম। হঠাৎ কেমন একটা ভয়ের শীতল পরশ নেমে গেলো মাথা থেকে পা পর্যন্ত। কোনো খারাপ খবরের আশংকায় কাঁপা কাঁপা গলায় হ্যালো বললাম।
ওপাশ থেকে মিষ্টি রিনরিনে কন্ঠে একটা মেয়ে প্রশ্ন করলো,
— আপনি কী ছন্দা বলছিলেন?
— জী।
— ম্যাডাম রাশেদুল ইসলাম নামে আপনার আত্মীয় আজ বিকেলে সিলেট এয়ারপোর্ট রোডে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন…..
তবে আশার সংবাদ….
তার অনুরোধে…. আপনাকে ফোন…
আপনার পক্ষে কী….. সম্ভব ….
মিষ্টি গলার ডিউটি রত মেয়েটির কথা গুলো সব যেন প্লাবনের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে।