ওলাবিবি

হোসনে আরার নানীজান সন্ধ্যা লাগতে লাগতে ঘুমিয়ে পড়েন। কোন ভোরে ওঠেন মুন্নুজান। তিনি ঘুম থেকে ওঠার পর মুয়াজ্জিনের আযান শুরু হয়। অত ভোরে না উঠলে বিশ জনের খাবার একা সকাল সাতটার মধ্যে রেডি করতে পারেন না। এই বাড়িতে যখন প্রথম বউ হয়ে এসেছেন তখন শ্বশুর শ্বাশুড়ি ছাড়া বাকি সব একেবারে গেদা বাচ্চা। তখন মুন্নুজানের বয়স ছিল মাত্র নয়, আর তার স্বামীর সতের। দুই দেবর, চার ননদ সব একসাথে থাকেন। কেউ যায় স্কুলে কেউ আরো ছোট। আস্তে আস্তে ননদদের বিয়ে হয়ে অন্য বাড়িতে চলে যায়। দেবররাও একে একে বিয়ে করে বউ ঘরে আনে। মুন্নুজানের এতদিন মনে হতো ননদ-দেবরদের বিয়ে হলে মনে হয় সংসারের ভার কমবে। নতুন বউরা এসে একে একে হাল ধরবে। আর তার নিজেরও কিছুটা ফুসরত হবে। এক এক করে নয় জন ছেলেমেয়ে এখন তার। বড় দুইমেয়ের বিয়ের পরও তার নিজের আরো দুই ছেলেমেয়ে হয়। কিন্তু যেমন ভেবেছিলেন তেমন হয়নি। সব মুখ তার তাকিয়ে বসে থাকে-রান্ধো-বাড়ো, গরুর বিচালি দাও, দুধ দোয়াও, ঘাটা থেকে ঘাস কেটে আন, মুরগির আধার দাও। একটার পর একটা চলতে থাকে। সবকিছুর মধ্যেও সময় মতো খাবার তুলে দিতে হয় সবাইকে। মাঝে মধ্যে মাথা তালগোল পাকিয়ে যায়। মুন্নুজানের স্বামী করিম ভূঁইয়া। স্ত্রীকে অসম্ভব ভালোবাসেন। তিনবেলা খেতে খেতে সুখ-দুঃখের আলাপ করেন। দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে স্ত্রীর অমানুষিক পরিশ্রম দেখেন। তার মনে গভীর মায়া আর কষ্ট জমে একটু একটু। বিয়ে পর থেকে স্ত্রীর এই রুটিন দেখে আসছেন। বিকাল গড়ানোর আগে কখনো মুন্নুজান নিজের মুখে ভাত তুলতে পারেন না।

বড়মেয়ের ঘরে বড়মেয়ে হোসনে আরা আজ নানাবাড়িতে বেড়াতে এসেছে। নানীবাড়ি আসা মানে নানীজানের আঁচল ধরে ধরে থাকা। যদিও সে এখন ১৬ বছরের যুবতী। হোসনে আরার নানাজানের ফজরের আযানের সাথে সাথে ওঠার অভ্যাস। উঠে নামাজ পড়ে সোজা বাড়ির পাশে ক্ষেতে যাওয়া লাগে তার। তারপর সূর্য উঠলে আর পেটের খিদাটা জমলে বাড়িতে ফিরে পানিভাত খেতে খেতে শুরু হয় ফসলের আলাপ। করিম ভূঁইয়া স্ত্রীকে সবসময় আপনি বলে সম্বোধন করেন। প্রথম প্রথম মুন্নুজান কাছে কেমন বিদিক বিদিক ঠেকতো এই ‘আপনি’ বলাটা। এখন এত বছরে অভ্যাস হয়ে গেছে। পানিভাত খেতে খেতে করিম ভুঁইয়া বলতে থাকেন মুন্নুজানকে, বুঝলেন এবার আমের এত বোল আসছে, এবার যে কী ঝড় হয় কে জানে? কয়দিন পরে ধান কাটা লাগবে। তার আগে না ধান সব ঝরে যায়? মুন্নুজানের মনেও চিন্তা আসে এই কথায়। তবু স্বামীকে ধমকের সুরে বলেন, আপনের খালি কুচিন্তা। বৈশাখ মাসে ঝড় আসবে না কি শীতকালে আসবে? করিম ভূঁইয়া আর কিছু না বলে খাওয়া শেষ করে ওঠেন। আসার সময় দেখে এসেছেন মরিচ ক্ষেত শুকিয়ে আছে। রোদ তাতার আগে পানি দিতে হবে। তড়িঘড়ি গামছাটা কাঁধে নিয়ে  সোজা হাঁটা দেন।

হোসনে আরা কলেজে ছুটি চলছে। ছুটির পরদিনই নানীবাড়ি এসে হাজির। সেই ছোটবেলা থেকে যে স্কুল ছুটি হলে নানীবাড়ি আসতো সেটা এখনো রয়ে গেছে। মুন্নুজানও নাতনি আসলে খুব খুশি হন। দুইজনে মিলে রাজ্যের আলাপ করে। বাড়ির অন্যরা দেখে বলতে থাকে,’ দেখ, মনে হয় যেন দুই বান্ধবী আর কী!’ হোসনে আরাও বলে, ‘বান্ধবী নাতো কী? আমার বান্ধবীর মতো এমন রূপবতী বান্ধবী তোমাদের আছে? এইজন্যই তো তোমরা এমন হিংসা।’

হোসনে আরা এই বাড়িতে যতবেশি দিন থাকে তত নানীর সুখ- আরাম দুইটাই হয়। দুটিতে মিলে সারাদিনের সব কাজ যেমন গল্প করতে করতে শেষ হয় আবার সন্ধ্যাবেলা মনখুলে দিন দুনিয়ার হাজার আলাপ করা যায়। মুন্নুজানের এই খাটুনি কতটা, সেটা যখন বুঝতে পারে হোসনে আরা তখন খুব রাগও হয়। আরো যে দুইনানী (নানার ছোট দুই ভাইয়ের বউ) আছে তারা কিছু করে না। এমনকি হাঁস-মুরগীগুলোকে আধারও দেয় না। চাচাতো নানী দুইজন আছে খালি সুন্দর সুন্দর শাড়ি পরা নিয়ে। আর একবার গোসল করতে ঘাটে গেলে দুইঘন্টায়ও শেষ হয় না। সারাগ্রামের যত আলাপ আছে সব বলে, সব শুনে তারপর নিজেরাও দুইচার কথা বাড়িয়ে লাগিয়ে তবে শান্তি ও সমাপ্তি। কার মেয়ে খাটো,  কার মেয়ে বেশি লম্বা, নিজের মেয়ে বেশি সুন্দর না মিজি বাড়ির মেয়ে…এই ই আলাপ। ওদের ধারণা ওদের ঘরেই শুধু পরীর মতো সুন্দর মেয়েগুলো জন্মেছে। বাকিদের ঘরে সব কালি পেত্নী। এদের কারোই এই জীবনে বিয়ে হবে না। আর তাদেরগুলো সাবালক হওয়ার আগেই রাজপুত্ররা উঠানে এসে লাইন ধরবে।

বেশির ভাগ সন্ধ্যায় মুন্নুজান কিছু খান না। বিকাল বিকাল রান্না করে সব খাবার ঢেকে ঘুমাতে চলে আসেন। আজও তাই।  হোসনে আরাকে নিজ হাতে খাইয়ে ঘুমাতে এসেছেন। হোসনে আরা ছোটবেলায় যেমন নানীর পাশে গা লাগিয়ে বসে নানা গল্প শুনতো এখনও তাই অভ্যাস। আর সন্ধ্যাবেলা ঘুমানোর আগে যখন মিহি সুরে কোরান পড়তেন হোসনে আরা কান লাগিয়ে কোলে মুখ গুজে শুনতো। কোরান পড়া শেষ হলে নানীজান নানান গল্প করতেন। যেদিন গল্প বেশি জমে যেত সেদিন পুরাই কেলেংকারী। সকাল উঠতে উঠতে বেলা উঠে যেত। একদিন মুন্নুজান শুরু করলেন ওলবিবির গল্প। হোসনে আরা অবাক হয়ে নানীজানের মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, নানীজান ওলাবিবির কথাতো আগে কখনো বল নাই। এই বাড়িতে আসতেও দেখি নাই। উনি আবার কে? নানীজান বলতে থাকেন, ওলবিবি মানুষ না। মানুষের রূপ ধরে রাতের বেলা সাদা শাড়ি পরে বের হন। যেই যেই বাড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যান সেই বাড়ির মানুষ মরে সাফ হয়ে যায়। ‘ আমাদের ছোট বেলায় ওলাবিবি আসছে শুনলে সবাই ভয়ে অস্থির হয়ে যেত, মনে করতো আজ রাতে যার বাড়ির ওপর দিয়ে যাবে কাল সে বাড়ির কেউ আর বেঁচে থাকবে না।

ঘুমানোর আগে মুন্নুজানের রোজ অজু করে পিতলের যে অজুর বদনা আছে সেটা পানি ভরে নিয়ে ঘুরে ঢুকেন। আগে পুকুর থেকে এইকাজগুলো সেরে নিতেন। এখন উঠানেই কল বসানো। পুকুর পাড়ে রাত করে আর যান না। সব সেরে বিছানায় পিঠ লাগাতে লাগাতে রাত আটটা বেজে যায়। মাঝরাতে উঠে তাহাজ্জুত পড়েন রোজ।

নাতনিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যান মুন্নুজান। হঠাৎ চারদিকের তাণ্ডবে মুন্নুজানের ঘুম ভেংগে যায়। অন্যদিনের চাইতে আজকের বাতাসটা বেশি পাগলা মনে হয়। বুকের ভেতর একটা অজানা আশংকা কাজ করে। তড়িঘড়ি উঠে অজুর বদনা নিয়ে অজু সেরে নেন। মিহি সুরে কোরান পড়তে শুরু করেন। সকালে ঝড়ের কথা ভেবে বুক কাঁপছিল।  যদিও স্বামীকে বুঝতে দেন নি কিন্তু এখন নিজেই বেশ ভয় পাচ্ছেন। বিদ্যুৎ একটা দমকা বাতাস দিতে না দিতে ফুরুত। এই হলো পল্লী বিদ্যুতের অবস্থা! সোলার লাইটের আলো তেমন জোরালো না। হোসনে আরা ততক্ষণে নানীজানকে পাশে না পেয়ে উঠে বসেছে। চোখ কচলে ঠাওর করতে পারে মুন্নুজানকে দূরে। ভয়ে জড়সড় হয়ে হোসনে আরা যেন নানীজানের পাশে না মনে হয় পেটের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। কয়মাস ধরে সে শুনেছে করোনাভাইরাসের কথা। সারাবিশ্বে হাজার মানুষ মরছে রোজ। মুন্নুজানও শুনেছেন সেকথা। একহাত দিয়ে কোরান শরীফ আর অন্য হাতদিয়ে হোসনে আরার মুখটা কোলের মধ্যে চেপে রেখেছেন আর জোরে জোরে দুলে দুলে কোরান পড়ছেন সুর করে। সামনে খোলা দরজা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। আজ ঝড়-বৃষ্টিতে জোনাক পোকাও দেখা যাচ্ছে না। মুন্নজান কোরান পড়ছেন আর মাঝেমধ্যে উঠানের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন চারদিক। হঠাৎ অন্ধকার উঠানে দেখেন, ওলাবিবি সাদাশাড়ি পরে তাদের উঠানে হেঁটে বেড়াচ্ছে। ওলাবিবির গল্পই এতদিন শুনে এসেছেন, নিজে দেখেননি। এ কোন ভাইরাস! চোখ ডলছেন বারবার…

১৬ এপ্রিল/২০২০

 

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত