সোয়েটার

আমার একটা সোয়েটার বানানোর কথা ছিল বিপুর জন্য। এমন একটা সোয়েটার যেটা দেখলেই মনে হবে এটা শুধু বিপুর জন্যই বানানো, বিপুর ব্যক্তিত্বটাই তুলে ধরে, এবং যেটা পড়লে বোঝা যাবে এটা আমি বানিয়েছি। বিয়ের পর পর এমন একটা ইচ্ছা নিয়ে আমি ওকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে ফিতা দিয়ে প্রথমে ওর কাঁধের মাপটা নিয়েছিলাম। ইচ্ছা হয়েছিল পেছনে একটা হুডি সহ বানাবো, যেন খুব শীতে হুডিটা মাথায় দিয়ে পড়তে পারে, আলাদা করে জ্যাকেট বা টুপির প্রয়োজন না হয়। এর আগে নিজের জন্য বা অন্যদের জন্য যখন সোয়েটার বানিয়েছিলাম তখন একটা রং বেছে নিয়ে, ডিজাইন বেছে নিয়ে বানানো শুরু করে দিয়েছিলাম। সেগুলো বানানোর সময় এতো ভাবতে হয়নি। কিন্তু বিপুরটা বানানোর সময় আমার মনে হল এটা হতে হবে অন্যরকম কিছু। একটা আর্ট পিস।এর মধ্যে বিপুকে পাওয়া যাবে।

একদিন বিপুর বাসায় ফিরতে দেরি দেখে উল কাটা নিয়ে বসলাম। শুরু করলাম কাঁধের অংশটা বোনা দিয়ে। অনেকদিন পর  সোয়েটার বুনতে বেশ ভাল লাগছিল। বেশ উৎসাহও ছিল। উল কাটা দিয়ে সোয়েটার বুনতে বুনতে কখন যে রাত একটা বেজে গেল খেয়াল ছিল না। হঠাত যখন আবিষ্কার করলাম হাই তুলছি তখন ঘড়ি দেখে হুশ হল এত রাত হয়েছে। খুব দুশ্চিন্তায় স্বাভাবিক ভাবেই হাতটা মোবাইল ফোনের কাছে চলে গেল। ফোন ধরার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে বিপু ফোন ধরে ব্যস্ত হয়ে বলল, তুমি এখনো জেগে আছো? তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়, আসছি আমি। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে আবার বুনতে বুনতে চেয়ারেই পা লম্বা করে ঘুমিয়ে পরলাম। হঠাত মনে হল অনেক দুর থেকে কিসের যেন শব্দ আসছে। ধুমধাম ধুমধাম। চমকে উঠে বুঝলাম বিপু এসেছে। কিন্তু বিপুর কাছে তো একটা চাবি ছিল তাহলে এমন ধাক্কাধাক্কি কেন? উঠে দরজার কাছে যেতেই নিশ্চিত হলাম এটা বিপুই। সে খুব রেগে গেছে আমি ঘুমিয়ে গেছি বলে। ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে বলা শুরু করল একটা মানুষ এত রাত অবধি বাইরে আছে, কোনো খবর নাই, তোমার কোন চিন্তা নাই। এত নিশ্চিন্তে ঘুমাও, কিভাবে সম্ভব? তুমি তো রীতিমত মানসিক ভাবে একটা অসুস্থ মানুষ। মা বাবা কি এতো টুকু শেখায় নাই?

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। চাবি আছে ওর কাছে। একটু আগে নিজেই আমাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলল। তারপর এখন এই কথা বলছে? চাবি যে ছিল ওর কাছে আর আমি ঘুমালে যে দোষের কিছু দেখি না এটা বলার সুযোগ সে আমাকে দিল না। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। না রাগ, না হতাশা, না অভিমান। একটা অযৌক্তিক বিষয় কারো উপর চাপিয়ে দিলে যেমন লাগে তেমন একটা অসহায় বোধ।  যা একটু ঘুম পেয়েছিল আমার তাও চলে গেল। একধরনের বিভ্রান্তিকর অপরাধ বোধ থেকে কিছুই বলতে পারলাম না। বরং উল্টো জিজ্ঞেস করলাম, এখন কি ভাত দেবো? বিপু রেগে উঠে বলে, এত রাতে কেউ ভাত খায় নাকি? আমি ওকে বেডরুমে একা থাকতে দিয়ে উল কাটা নিয়ে এসে ডাইনিং টেবিলের সামনে চেয়ারে বসলাম। বুঝলাম আর ঘুম হবে না। অসহায় বোধটা আস্তে আস্তে উলের ছোটো ছোটো বুননের মধ্যে মিলিয়ে গেল। এভাবেই প্রথম দিন শুরু হয়েছিল সেই সোয়াটার বোনা।

এরপর বেশ কয়েকবার সোয়েটার নিয়ে বসার কথা মনে হলেও আমি ইচ্ছা করেই বসিনি। কারন প্রথমে যেই পরিকল্পনা নিয়ে শুরু করেছিলাম সেটা ঠিক কেমন যেন খাপছাড়া লাগছিল। অর্থাৎ একটা সৃষ্টিশীল কিছু তৈরীর জন্য যেই আগ্রহটা হয়েছিল তাতে যেন একটু ভাটা পড়েছে। তাছাড়া বিপুকে কেমন রহস্যময় লাগছিল। যেন তাকে ঠিক ধরতে পারছিলাম না। বলে একটা, করে আরেকটা। কি বলে নিজেই ভুলে যায়। যেমন, একদিন একটা শেভিং ফোম কেনে, তার দুইদিন পর আরেকটা কেনে। ভুলেই যায় দুই দিন আগেই একটা কিনেছে। বা হয়তো যেদিন ইচ্ছা হল না, অফিসেই গেল না। সারাদিন শুয়ে শুয়ে টিভি দেখল।

একদিন এসে বলল ওর সাংবাদিকতা মনে হয় ছেড়ে দিতে হবে। কারন ওর পেছনে নাকি কোনো  গোয়েন্দা বা বিদেশী এজেন্টকে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে ওর সব কাজ কর্ম পর্যবেক্ষণের জন্য। ফোন করে কে যেন হুমকিও দিয়েছে। আমি প্রথমে এটা শুনে একটু ভয় পেয়েছিলাম। আজকাল দেশে গুম খুন বেড়ে গেছে। প্রায়ই খবরের কাগজে নানান খবর আসে। যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের জন্য বিশেষ করে অনেক ঝুকিপূর্ন হয়ে গেছে জীবন। সাংবাদিকেরা নিজেরা বা তদের পরিবারের সদস্যরাও নাকি ক্ষতির হুমকি পাচ্ছেন। কাজেই বিপুর মধ্যেকার অসংলগ্নতা আসলে যে শুধু ওর ব্যক্তিগত অসংলগ্নতা তা বলা যাবে না। গোটা রাজনৈতিক পরিস্থিতিই মানুষের ভেতর নানান রকম নিরাপত্তাহীনতা বোধের জন্ম দিয়েছে। কাজেই ঠিক কিভাবে বিপুকে আমি বুঝবো তা নিয়ে আমার মনের মধ্যে ব্যপক সংশয় জোরালো হতে হতে আমাকে একেবারেই বিভ্রান্ত করে দিয়েছে। এই নিয়ে টুকটাক পড়াশোনা করতে গিয়ে জেনেছি যে সিজোফ্রেনিক প্রবণতা রয়েছে এমন মানুষদের লক্ষণের মধ্যে একটি লক্ষণ হল তারা সারাক্ষণ মনে করে কেউ তাকে সবসময় অনুসরণ করছে। সে খুব গরুত্বপূর্ন কিছু করছে, যে কারণে সে গোয়ান্দা নজরদারিতে রয়েছে। যেমন নোবেল বিজয়ী জন ন্যাশ সবসময়ই এমন এক সম্মোহনের মধ্যে থাকতেন যেন কোন ষড়যন্ত্রকারী তাকে বারবার ফোন করতো। তিনি সেই শব্দ শুনতে পেতেন। তবে আমাদের দেশের বাস্তবতায় মানুষ সিজোফ্রেনিক নাকি রজনৈতিক পরিস্থিতি তাদের সিজোফ্রেনিক করে রেখেছে সেই বিষয়ে আমাদের বিভ্রান্ত থাকাটাই নিয়তি। এর বেশি আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব না।

এর মধ্যে আমি একটা চাকরির জন্য অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছিলাম। একটা কোম্পানি থেকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পেলাম। একটা ছোটোখাটো আর্কিটেকচার কোম্পানি। ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন কো-অরডিনেশনের কাজ। ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে জানলাম মালিক আমার এক বান্ধবীর বড় ভাই। নিজের যোগ্যতা ছাড়াও এই বাড়তি পরিচয়টা দিয়ে খুব সহজেই চাকরিটা হয়ে গেল। কিন্তু গোলমাল শুরু হয়ে গেল দুই মাস পরেই। আমার ব্যক্তিত্ব, কাজের ধরন, সবার সাথে সম্পর্কের ধরন, অফিসের অন্য কলীগদের জন্য সমস্যা হয়ে উঠলো। এর মূল কারন হল আমি খুব অল্প সময়েই কাজ বুঝে নিতে শুরু করায় আমাদের বস আমার উপর দ্রুত নির্ভরশীল হয়ে উঠলেন। কিছু দরকার হলেই উনি আমাকে ডাকেন। আমাকে অন্যদের কাছ থেকে কাজ আদায়ের দায়িত্ব দেন ও তাদের কাজকর্ম তদারকির জন্য আমাকে পাঠান। কাজের নির্ধারিত সময় বিকাল ৫ টা হলে, অফিস থেকে বের হতে আমার ৬ টা বেজে যেত এবং বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক সময় ৭ টা বা ৮ টা বেজে যেত। এদিকে বিপু প্রথমে খুশিই ছিল আমার চাকরি পাওয়া নিয়ে। কিন্তু দুই মাস পর তার নিজের চাকরি চলে যাওয়ার পর সে নিজেই যখন ভেঙ্গে পড়ে তখন শুরু হয় আমার চাকরি নিয়ে তার সমস্যা। ঘরের কাজের বেশিরভাগ দায়িত্ব যদিও সব সময় আমিই করতাম, বিপু বেকার হয়ে যাওয়ায় কিছু কাজ তার করার প্রয়োজন শুরু হল। কারন আগে আমরা সপ্তাহের অফিসের দিনগুলোতে দুজনেই বাইরে থাকতাম। রাতের খাবারটা শুধু একসাথে খেতাম। চাকরি চলে যাওয়ার পর বিপু বাসায় থাকায় আমাদের আগের সেই অভ্যাসেও পরিবর্তন আসে। সকাল, দুপুর, রাত, তিনবেলাই বিপু বাসায় খায়। নতুন বেকার জীবনের সাথে মানিয়ে চলতে গিয়ে তার দ্রুত মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। খামখাই আমার উপর মেজাজ খারাপ করে।

মাঝে মাঝে অফিস থেকে ফিরতে দেরী হলে বিপু ফোনের পর ফোন করতে থাকতো। অনেক সময় কোন মিটিংয়ে থাকা অবস্থায় ফোন করলে ধরতে না পারলে ভীষণ রেগে যেত। প্রথমে আমি এর কারন কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। ভাবতাম খামাখা রাগ করে কেন। মাঝেমাঝে মনে হত সন্ধ্যা হলে রাস্তাঘাটে নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত থাকতো হয়তো। একসময় মনে হল ঠিক তাও না। কারন অফিসের সময় ফোন না ধরলেও সে রেগে যেত। একধরনের অব্যক্ত জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা তৈরি করতো। যেমন ফোন ধরি নাই কেন। কি বিশেষ কাজ ছিল। কি পরিস্থিতিতে ফোন ধরা যায় বা যায় না কেন ইত্যাদি। একদিন তো সে ফোন না পেয়ে অফিসে এসে হাজির। রিসেপশনে এসে অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। আমি তখন বসের রুমে একজন ক্লায়েনটের চুক্তিপত্র বিষয়ক একটা জটিল সমস্যা নিয়ে আলাপে ব্যাস্ত ছিলাম। যেই আধ ঘণ্টা সময় সে অপেক্ষা করছিল ততক্ষণ নাকি সে রিসেপশনে অন্তত পাঁচ বার অনুরোধ করেছে আমাকে ডেকে দিতে। পরে মিটিং অর্ধসমাপ্ত রেখে যখন বের হয়ে আসলাম ভাবলাম জরুরি কিছু বোধ হয়। কিন্তু বের হয়ে এসে বিপুকে উদভ্রান্তের মত মনে হল। সে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছে না কি কারনে সে এসেছে। আমি যখন বললাম মিটিং শেষ হতে আর ঘণ্টা খানেক লাগবে এবং সে চাইলে অপেক্ষা করতে পারে, সে খুব অবজ্ঞা করে বলল, থাকো তোমার বস আর ক্লায়েন্টের সাথে।

অকারণে সন্দেহ করা ছাড়াও বিপু আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করাও শুরু করল। একদিন বলেই বসলো, আমি নাকি খুবী অহংকারী হয়ে গেছি চাকরী শুরু হবার পর। আমি নাকি তার খেয়াল করি না। আমার নাকি ঘরের দিকে কোনো খেয়াল নেই, ঘরের সব আসবাবপত্রের উপর নাকি পুরু ময়লার স্তর। এই ময়লা জঞ্জালে বিপুর পক্ষে নাকি আর থাকা সম্ভব না। তো এসব শুনে আমি যখন বললাম যে আমার সময় হয় না। কাজ করে এতকিছু করার সময় পাই না। কাজেই এসব করতে হলে আমার চাকরি ছাড়তে হবে তখন সে এত রেগে গেল যে ডান হাত উঁচু করে আমার দিকে তেড়ে এলো মারবে বলে। হাত উঁচু করে সে যখন আমার দিকে আসছে আমি হাতটার দিকে তাকিয়েছিলাম। হাতটা ভীষণ লম্বা ও শক্তিশালী মনে হচ্ছিল। আমি ভাবছিলাম এই হাতটা আমার গায়ে এসে আঘাত করলে আমি একেবারে শেষ হয়ে যাব। হাতটা এসে আমার কাঁধ শক্ত করে ধরে আমাকে একটা ঝাঁকি দিয়ে ধাক্কা দিল। আমি পেছন দিকে পড়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার হাতটা দিয়ে আমি বিপুর ডান হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম তাই সামলে ফেললাম। কিন্তু সামলাতে গিয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। বিপু আমাকে আঘাত করেই ক্ষান্ত হয়নি। ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা সমস্ত খাবার ছুড়ে ফেলে দিল মেঝেতে। কাঁচের প্লেট বাটির সাথে সাথে চুর্ন বিচুর্ন হল আমাদের সদা নিরীহ কাচের গ্লাস গুলো, যেগুলো নীরবে আমাদের পানি পানের সঙ্গী ছিল বহুদিন ধরে।

সেদিন বিপু বাসা থেকে বের হয়ে চলে গেল। কোথায় গেল কিছু বলে গেল না। ভাঙ্গা কাঁচের টুকরা আর ফেলে দেয়া খাবার পরিষ্কার করে ক্লান্ত হলে রাতে আমি আবার উল কাটা নিয়ে বসলাম। সেদিন আমি সোয়েটারের ডান হাতটা বোনা শুরু করলাম। রাতে একটুও ঘুম এলো না। সারারাত বুনলাম। ভোর ৫ টার দিকে একটু ঘুম এলো কিন্তু ৮টায় ধরমর করে উঠে গেলাম। অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিলাম আমি অসুস্থ। তারপর এক কাপ চা খেয়ে আবার সোয়েটার বোনা শুরু করলাম।

তিনদিন পর বিপু যখন বাসায় ফিরে এলো তার চোখ মুখ বিভ্রান্ত। গালে খোঁচা খোঁচা দারি। চুল গুলো ময়লা আর উসকো খুসকো। চোখে মুখে একটা অসহায় ভাব এর মধ্যেও ফুটে উঠছিল। যেন একটা অভিমানী বালক বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল এবং পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছে। আমার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। কিন্তু পুরোপুরি খেয়াল করতে চাইছে আমার প্রতিক্রিয়া। ওর এই হঠাত ফিরে আসা আমাকে যেমন একদিক থেকে নিশ্চিন্ত করেছে অন্যদিক থেকে চিন্তিত করেছে। আমার মনে হয়েছে কোথাও কোন একটা সমস্যা হয়েছে। আমি ঠিক ধরতে পারছি না। বিপু বোধ হয় মানসিক ভাবে সুস্থ নেই। এই অসুস্থতা এমন এক অসুস্থতা যার নিরাময় আমার হাতে নেই। এমন পরিস্থিতিতে আমি বড়জোর যা করতে পারি তা হল নির্মল ভালবাসা প্রদর্শন করতে পারি। ভাল কিছু রান্না করে খাওয়াতে পারি। আগের প্রসঙ্গ একেবারে ভুলে গিয়ে অন্যকিছু নিয়ে কথা বলতে পারি। রাগ অভিমান হয় এমন কিছু পরিহার করে পরিবেশটা সহজ করতে পারি।

আমি রান্না ঘরে গিয়ে ইলিশ মাছ আর চিংড়ি মাছের প্যাকেট ফ্রিজ থেকে বের করলাম। যখন রান্না শুরু করলাম তখন টের পেলাম বিপু গোসল করতে গেছে। আমি প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে রান্না করলাম। তারপর সব গুছিয়ে টেবিলে খাবার দিয়ে গোসল করতে যাওয়ার আগে বেডরুমে উকি দিয়ে দেখি বিপু ঘুমিয়ে গেছে। একটু খারাপই লাগলো এই ভেবে যে খুদা নিয়ে ঘুমিয়ে গেল ক্লান্ত মানুষটা। অন্য সময়ের চেয়ে বেশি সময় নিয়ে আমি সেদিন গোসল করলাম। বেশ ক্লান্ত ছিলাম। সারাদিন অফিস শেষে এমনিতেই ক্লান্ত লাগে, তার উপর বিপুর এই হঠাত রাগ, হঠাট উত্তেজিত হয়ে ভাংচুর – এগুলো কিভাবে নেব, কি করবো বুঝতে না পেরে মনের ভেতর খুব চাপ অনুভব করছিলাম। গোসল করতে করতে নানান কথা ভেবে বের হয়ে ভাবলাম বিপুকে ডাকবো খেতে। তখন মনে হল ভর্তাটা বানিয়ে নেই। রান্নাঘরে যাবার সময় দেখি ডাইনিং টেবিলের সব তরকারির বাটির ঢাকনা খোলা। প্লেটে মাছের কাঁটা পড়ে রয়েছে। বাটিতে সব তরকারি শেষ। ৪ টুকরা ইলিশ আর এক বাটি চিংড়ির কিছুই অবশিষ্ট নেই। শুধু কিছু ভাত আর ডাল রয়েছে।

রান্নাঘরে গিয়ে ভর্তা বানিয়ে ডাল আর ভাত দিয়ে খেয়ে নিলাম। বিপু তখন আবার ঘুম। আসলে ঘুমাচ্ছে কিনা তাও জানি না। অতিরিক্ত ক্লান্তিতে আমার ঘুম চলে গেল। আমি আবার সোয়েটার নিয়ে বসলাম। শুরু করলাম পেট আর বুকের অংশটা।

এরপর থেকে বিপু আমার সাথে দূরত্ব বজায় রাখা শুরু করলো। একই সাথে একই বাড়িতে ঘুমালেও আমরা আলাদা ঘুমানো শুরু করেছি। বিপু নতুন করে চাকরি খুঁজছে। সারাদিন রাত কম্পিউটারের সামনে বসে থাকে। দেখতে দেখতে বিপু কয়েক মাসে প্রায় ৫ কেজি ওজন বাড়িয়ে ফেললো। আমাদের মধ্যে টুকটাক কথা হয়। খুব বেশি আলাপ হয় না। পারিবারিক অনুষ্ঠান, আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে যাওয়াও কমে গেছে। বেকার হবার কারণে বিপু কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করে। আমি নিজেও খুব একটা স্বস্তি বোধ করি না।

এদিকে অফিসে নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমার বস এক তরুণীর প্রেমে পড়েছে। নাম সামিরা। তাকে নিয়ে এদিক সেদিক বেড়াতে যায়। অফিসের অনেকেই এসব ব্যাপারে জানে না। এর কারণ ওই তরুণীর ঘন ঘন যাওয়া আসার কারন হিসাবে সবাই জানে আমি তার বান্ধবী। মেয়েটি এসে প্রথমেই আমার সাথে যোগাযোগ করে। আমার সাথে চা খায়, গল্প করে, তারপর বসের কামড়ায় যায়। আমি কখনোই বসকে এই নিয়ে প্রশ্ন করি না। উনি খুব সহজ ভাবেই বেড়াতে যাওয়ার বিষয়গুলো আমার সাথে শেয়ার করেন। যেন এটাই হওয়ার কথা।

কিন্তু একদিন বস আমাকে ডাকলেন এই বিষয়ে কথা বলতে। বললেন, সামিরা নাকি খুব উঠে পড়ে লেগেছে যে তাকে বিয়ে করতে হবে। বসের ছেলেমেয়ে আছে। সংসার আছে। এগুলো সব ছাড়তে হবে সামিরার সাথে সম্পর্ক রাখতে হলে। আমি ওনাকে কি বলবো বুঝতে পারলাম না। বুঝলাম উনি কারো সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে পারছেন না। তাই আমাকেই বলছেন। আমি তার অবস্থা দেখে কিছুই বলতে পারলাম না। একে তো জানি না বসকে কেন প্রেম করতে হবে। দ্বিতীয়ত প্রেম যখন করেছেনই এমন তো ভাবার কারন নেই যে প্রেম করলেই বিয়ে করতে হবে। আমি শুধু বসকে বললাম, স্যার আপনি যদি বিয়ে করেনও সব ছেড়েছুড়ে তারপর কি সামিরার সব ঠিক হয়ে যাবে? আপনি তার সাথে থাকতে কতটুকু প্রস্তুত? বস আমাকে বললেন, চলেন আপনাকে নিয়ে বাইরে থেকে কফি খেয়ে আসি। একটু ইতস্তত করে রাজি হয়ে গেলাম। অফিসের সময় শেষ। ৫ টা বেজে গেছে। এক ঘণ্টা বাইরে বসে কফি খাওয়াই যায়। কফির দোকান খুঁজতে গিয়ে জ্যামে আধা ঘণ্টা লেগে গেল। আমি আর-চোখে ঘড়ি দেখছি। কিন্তু বস কফি খেতে বসে ব্যখ্যা করা শুরু করলেন উনি কেন প্রেমটা করছেন। ওনার স্ত্রীর সাথে ওনার সম্পর্ক ভাল নেই। ওনার ভাষ্যমতে এর কারন তারা একে অপরকে বুঝতে পারেন না। দুইজন খুবই আলাদা ধরনের, আলাদা চিন্তার মানুষ। উনি যখন এসব বলছিলেন আমি কেমন একটু অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুনছিলাম মন দিয়ে ঠিকই, কিন্তু একই  সাথে ভাবছিলাম বিপুর কথা। বিপুও তো আমার অচেনা। বিপু যাই করে আমি তার পেছনে কারন খুঁজে বুঝতে চাই সে এমন করে কেন। মাঝে মাঝে বুঝি যে আমি তার জন্য আসলে উপযুক্ত সঙ্গী না। সে বুদ্ধিমতী সঙ্গী চায়, কিন্তু তার বুদ্ধিকেও সে হজম করতে পারে না।

সেদিন বস এত আবেগী হয়ে গিয়েছিলেন যে রাত আটটা পর্যন্ত উনি তার মনের দুখের কথা আমাকে বলেছিলেন। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৯ টা। বাসায় ফিরে সিড়ি দিয়ে উঠবো। তখন দেখি ছুটা বুয়া গেঁটের সামনে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই ছুটে এলো। বলল, আপা অনেকদিন দইরা একটা কথা কমু কমু কইরা কইতে পারি নাই। মনে কিছু লইয়েন না। আইজকা স্যার আমারে কামেরত্থন ছুটায় দিছে বেতন না দিয়াই। হেয় ফড়ায় মাস খানিক দইরা বাসায় এক মাইয়ারে লইয়া আহে। হেরে আমি দেইখ্যা হালাইছি সিরিতে। স্যারে বুইজ্জা গ্যাছে আমি দেখছি। হ্যাঁয় আমারে কয় আমি বলে ঘর ঠিক মতন মুছি না। কাইলকা খারাপ ব্যবহার করছে। কিছু কই নাই। আইজকা চুপ থাকতে পারি নাই। হেরে জবাব দিছি, আমি তো ফরিস্কার কইরাই রাইখ্যা যাই। আফনেই না একেকদিন ময়লা করেন। কে কি করে হগগলে জানে। হুইন্যা তো হ্যাঁয় রাইগ্যা আমারে মারতে আইছিল। আমি বাইর অইয়া আইছি। আমার মনে অয় হের মাথায় কুনো সমস্যা অইছে। হ্যাঁয় মাজিমইদ্দ্যে একলা একলা কি জানি বিড়বিড় করে। আফনেরে না কইলে অইতো না। হেইল্লেগা কইলাম।

আমি বুয়াকে ১০০০ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাসায় চলে গেলাম। বাসায় গিয়ে দেখি, বিপু টেবিলে বসে আগের দিনের রান্না করা খাবার খাচ্ছে। আমি কাপড় বদলে রান্না ঘরে গিয়ে দেখলাম সিঙ্কে আমাদের প্লেট ও পানির গ্লাস ছাড়াও অতিথিদের জন্য আলাদা করে রাখা পানির গ্লাস প্লেট ভেজানো। বুয়াকে বের করে দেয়ায় এসব আধোয়া হয়ে পড়ে আছে। সিংকের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। কালকে সব ধোবো ঠিক করে দীর্ঘ সময় ধরে গোসল করলাম।

আমি সেদিন রাতে আবার সোয়েটার বোনা শুরু করলাম। বিপুকে মনে হল আমার চেহারা দেখে কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি নির্বিকার ছিলাম। কেন এত নির্বিকার তা আমি জানি না। সোয়েটার বুনতে বুনতে নিজের সাথে কথোপকথনই আপাতত  শান্তির। কিন্তু সেদিন সারারাত বুনেও সোয়াটার বোনা শেষ হল না। বুঝলাম, কোনোদিন হবে কিনা তাও জানি না। তবু বুনলাম।

পরদিন আমার বস আবার আমাকে কফি খাওয়ার অফার দিলেন। আমি বললাম, স্যার কফি খেতে গেলে একটু বেশি সময় লেগে যায়। চলেন এখানেই আলাপ করি। নিজেই অফিসের রান্নাঘর থেকে দুই কাপ কফি বানিয়ে আনলাম। কেন যেন মনে হল স্যার আমার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। শুনেছি জাপানে নাকি বিবাহিত পুরুষেরা বিবাহিত নারীদের সাথে আলাপ করতে যায়, টাকা দেয় একারণে। কিন্তু সহবাস করে না। আমার মনে হচ্ছে বস কাউকে খুঁজছেন অনার সমস্যা বলার জন্য। আমি তার প্রতি কখনোই কোনো আগ্রহ দেখাইনি বলে ওনার মধ্যে আমাকে নিয়ে একটু কৌতূহল আছে সেটা আমি টের পাই। তবে নিরাপদ দূরত্বে থাকাই শ্রেয় মনে করি। বসের ব্যপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই। উনি অন্যসব পুরুষদের মতই একজন পুরুষ। ওনার জীবনের সমস্যার সাথে অন্যদের সমস্যার কোনো পার্থক্য নেই। বস খুব আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে বললেন, তুমি কিন্তু খুব সুন্দর। আগে লক্ষ করিনি। কিন্তু তুমি কখনো তোমার গল্প আমাকে করনি। আমি কিন্তু না বললেও অনেক কিছু বুঝি।

কি বোঝেন স্যার?

তুমিও আনস্ট্যাবেল আছো।

না, স্যার।

তোমার হাজব্যান্ডের সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন?

সম্পর্ক তো ভালই।

একজন অন্যজনকে বুঝতে পারো?

আমি আমার মত বুঝি।

সেটা ক্যামন?

একটু বসেন স্যার। রুম থেকে ব্যাগটা নিয়ে আসি।

ব্যাগটা এনে সেখান থেকে সোয়াটারটা বের করলাম।

এই যে দেখেন স্যার, এটা আমার হাজব্যান্ড।

মানে?

সোয়েটারটা মেলে ধরলাম। সাথে রাখা হ্যাংগার দিয়ে সোয়েটারটা কাবার্ডের উঁচু হাতলটার মধ্যে ঝুলিয়ে দিলাম।

এটা কি?

একটা সোয়েটার।

এমন অদ্ভুত আকৃতির কেন? একটা হাত এত বড়ো?

জ্বি স্যার। এই ডান হাতটা একটু বেশি আগ্রাসী। তাই অন্য হাতের চেয়ে বড়ো আর পা পর্যন্ত বিস্তৃত।

কিন্তু নীচে ওটা কি ঝুলছে?

স্যার এটা সোয়েটারের অংশ ছিল না। এটা আমার সংযোজন। এটা একটা প্যাচ খাওয়া পুরুষাঙ্গ। অন্যমনস্ক হয়ে ভুলে লম্বা বানিয়ে ফেলেছিলাম। পরে খুলে আবার নতুন করে করতে গিয়ে গিটটু লেগে গেছে। আর সেটার গতিপথে অনেকগুল সুতা বুননে আটকাচ্ছিল না। সুতাগুলি বহুগামী পুরুষের পুরুষাঙ্গের মত চারিদিকে ছড়িয়ে গিট্টু লেগে গেছে। ভাবলাম, এমনই থাকুক।

বুকের কাছে চিপা। আর পেটের কাছে এমন ঢোলা কেন?

পুরুষের পেট খুব গুরুত্বপূর্ন স্যার। গুরুত্ব বোঝাতে একটু বড়ো করা হয়েছে। বুকে সে আসলে বড়ো অসহায়। এতো অসহায় যে সংকুচিত হতে হতে পুরো শরীরের তুলনায় একটু বেশি সংকুচিত হয়ে গেছে হৃদয়। এত নিরাপত্তাহীনতা চারিদিকে!

গলার ওপর দুইটা ফিতার সাথে গোল গোল কি ঝুলছে?

হুডি বানাতে চেয়েছিলাম কান আর মাথা ঢাকার জন্য। পরে দেখি, পুরুষের চোখ গুলো সন্দেহ করতে করতে নীচের দিকে ঝুলে গেছে। ঘাড়ের উপরে ঢাকার মত কিছু আর অবশিষ্ট নেই। সন্দেহবাতিক চোখের সাথে মাথাটাও আড়াল হয়ে নেমে গেছে নীচে। ফিতা দিয়ে ঝুলানো ওই গোল অংশগুলো চোখ।

পুরুষ বলছো কেন? এটা না বিপুর জন্য?

স্যার। ওই একই কথা।

ফর্ম, স্ট্রাকচার, নান্দনিকতা নিয়ে কাজ করা আমার আর্কিটেক্ট বস অনেকক্ষণ ধরে সোয়েটারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। গভীর চিন্তিত দেখাল তাকে। আর আমি ভাবলাম উনি যদি নিজের সাথে কোনো সাদৃশ্য পেয়ে আমার ব্যক্তিত্বকে একটু ভয় পান, তাহলে এই দফা আমার প্রতি তার সদ্য জেগে ওঠা প্রেমের ভাব থেকে মুক্তি পাই। হাজার হলেও চাকরিটা এই মুহুর্তে আমার খুব দরকার। ঘনিষ্টতা বাড়ানোর প্রস্তাব পাবার আগেই একটা সিগনাল যাওয়া খুব জরুরি।

বিকৃত হলেও সোয়েটারটা কিছু তো কাজে লাগুক!

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত