দারিদ্র্য

‘সুবহানাল্লাহ্!’
_____সমস্বরে বলল সবাই। মাওলানা সাহেবের যেন তাতে মন ভরল না। তিনি উল্লসিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন পরপরই— ‘গলায় কি জোর নাই, মিয়ারা? আল্লাহপাক এত্ত বড় পুরস্কার রাখছেন আমাদের জন্য, আর আমরা তাঁর তারিফ করতে গেলেই মিঁউমিঁউ চিঁউচিঁউ! গলা ফাটাইয়া কন— সুবহানাল্লাহ্!’
_____ধর্মপ্রাণ শ্রোতাদের ‘সুবহানাল্লাহ’ চিৎকারে তারপরেই গমগম করে উঠল এলাকার বাতাস, কেঁপে উঠল মাথার উপরকার শামিয়ানা, অনুরণন তুলে ছড়িয়ে গেল আওয়াজ দূর থেকে আরো দূরে।
_____বেহেস্তি হুরের বর্ণনা শেষ করে মাওলানা সাহেব তারপর এগোলেন অন্য প্রসঙ্গে। কিন্তু তাঁর সামনে বসা শ্রোতারা কি এগোতে পারল একই সাথে? এমন লোভনীয় পুরস্কারের ভাবনা থেকে সহজে কেই বা সরে যেতে পারে?
_____যেমন পারে নি মজিদ শেখ। মনে মনে, গোপনে গোপনে সে হিসেব কষে চলল— কী নরম বুক! তাও কি দুই-চারটা? বাহাত্তর দুগুণে এ-ক-শ চু-য়া-ল্লি-শ-টা! তাও সে কী বুক— ঝুলমুলে, থলথলে না; সবসময় উঁচু আর টানটান হয়ে থাকবে নাকি সেসব বুক! গায়ে নাকি এমন মিহি পোশাক থাকবে যে, তার ভেতর দিয়ে সা-দা ধবধবে বুকগুলো পুরোদমে দেখা যাবে! শুধু কি বুক? দেখা যাবে বাহাত্তরটা হুরের মাজা, পেট, পাছা— স-ব! আর সেসব হুরের সে কী চেহারা হবে— কোনো হুর দুনিয়ার দিকে একবার তার চোখ দিয়ে তাকালে নাকি দুনিয়ায় আর অন্ধকার নামবে না! রাতগুলোও নাকি দিনের মতোই আলোয় আলোয় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে! একেকজন বেহেস্তির জন্য সেই হুর কি একটা-দুটো? বা-হা-ত্ত-র-টা! তার কেউ বুড়িধুড়ি না, সব্বাই নাকি ষোলো বছরের ছুকরি! বান্দার জন্য আল্লাহপাকের কত রহমত! আল্লাহপাক কী মহান!
_____গোপনে হিসেব কষে চললেও হিসেবশেষে প্রকাশ্যেই মজিদ শেখ বলে উঠল গলা ফাটিয়ে— ‘সুবহানাল্লাহ্!’
_____তখন সুবহানাল্লাহ অথবা আলহামদুলিল্লাহ কিংবা নাউজুবিল্লাহের সময় নয়। ওগুলো বিশেষ পুরস্কার কিংবা ভয়ানক পাপের সম্পর্কে বক্তৃতাকালে বলতে হয়। মাওলানা সাহেবের চলমান বক্তৃতা সাধারণ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের ইহলৌকিক উপকারিতা সম্পর্কে বক্তৃতা দিচ্ছেন তিনি। সবাই নিশ্চুপে নিমগ্ন সেদিকে। তার ভেতর কেউ যদি চিৎকার করে ওঠে হঠাৎ, তখন তার দিকে অন্যান্যের চোখ, মন না যাওয়াটাই অনিয়ম।
_____অনেকগুলো মন মাওলানা সাহেবের বক্তৃতা থেকে সরে এল তৎক্ষণাৎ। অনেক জোড়া চোখ ঘুরে গিয়ে দেখল তখন— বছর ষাট-বাষট্টির চামড়ায় মোড়া শ্মশ্রূমণ্ডিত একটা মুখ; শুষ্ক, ক্ষুধাক্লিষ্ট যেন, অথচ কী ভীষণ আনন্দে উদ্বেল; উল্লাসে চোখ দুটো তার কী প্রচণ্ড চকচকে! তার সে ‘সুবহানাল্লাহ’র মানে কারো কাছে স্পষ্ট হোক বা না হোক— ওয়াজ মাহফিল অঞ্চলের আলোর প্রাচুর্যে তখন একদম স্পষ্ট লোকটার মুখাবয়ব।
।। ২ ।।
দুপুরের বেলা রান্না হয় নি।
_____রাহেলা বেগম আর মজিদ শেখের সংসারটার বয়স বছর চল্লিশেক হয়ে এলেও অভাবটা আর ঘুচল না। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। অথবা, পান্তা যদি বা চারটা থাকে, তো নুনের কৌটো ডুগডুগি। মরিচ-পেঁয়াজের ডালা ফকফকা। কখনো বা চাল থাকে না, কখনো তরিতরকারি। কখনো বা সবকিছুর পাত্রই চৈত্রের বিরান মাঠ। প্রায়কার মতো তাই চাল-তরকারি ছিল না কিছুই— কীভাবে রান্না হবে?
_____কিন্তু দিনশেষে আজ বাজার-সদাই করে এনে রাহেলা বেগমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মানুষটা সেই যে মসজিদমুখো গেল— তার আর কোনো খোঁজ আছে? খবর আছে? মাগরীবের নামায শেষ হয়েছে কি এখনকার কথা? এশার নামাযও তো শেষ হয়ে গেছে সেই কখন! তাহলে মানুষটা কই গেল? কেউ ওয়াজ মাহফিল-টাহফিলে ধরে নিয়ে গেল না তো? এইভাবে যায় তো প্রায়দিনই। আর রাহেলা বেগমের সেসব দিন ভাত বেড়ে অর্ধেক রাত পর্যন্ত না খেয়ে বসে থাকতে হয়। রাহেলা বেগমের কথা তখন মাথায় থাকে না তার। তা না থাকুক— নিজের কথা তো মাথায় রাখবে। নিজের কথা তো ভাববে কিছু। ভাবে না।
_____তা সে ওয়াজ মাহফিলে যাবে— যাক। যাবে না কেন? সেখানে নামায-রোজার কথা হয়, নবী-রাসুলের কথা হয়, পীর-আউলিয়ার কথা হয়, আরো কত কত কথা হয় ধর্মের— যাবে তো নিশ্চয়ই। তা সে যাক, রাহেলা বেগম তো নিষেধ করে না। তাই বলে না খেয়ে না দেয়ে দৌড়োতে হবে? সেই সাতসকালে চারটা পান্তাভাত পেটে পুরে বেরিয়েছে, আর এই যে এতটা রাত হল এখন…! ওয়াজ মাহফিলের নাম শুনলে মানুষটার খিদেটিদেও যেন হাওয়া হয়ে যায়!
_____কিন্তু অমন কোনোকিছুতে খিদে হাওয়া হয় না রাহেলা বেগমের। মজিদ শেখের পেটে তো সকালে চারটা পড়েছে, রাহেলা বেগমের পেটে কিছুই পড়ে নি। রাতের ভাত যা কয়টা ছিল হাড়ির তলায়— সকালের বেলা মানুষটাকে না খাইয়ে দিলে কি মানুষটা সারাদিন বাইরে বাইরে কাজ করতে পারত?
_____যাহোক, রাহেলা বেগমের খিদেটা আজ চাগাড় দিয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে যেন পেটের ভেতর খিদেটা শেয়াল-কুকুর হয়ে গেছে। উল্টেপাল্টে, ছিঁড়েছুটে, খুবলেখাবলে যেন ভেতরের নাড়ি-ভুড়ি, গিলা-কলিজা সব খেতে শুরু করেছে।
_____এখন কী করবে রাহেলা বেগম? নিজে একা খেয়ে নেবে? কিন্তু তা কি এই বছর চল্লিশের সংসার জীবনে একদিনের জন্যও করেছে সে? সারাদিন খেটেখুটে এসেও যে মানুষটা এখনো কিচ্ছু খায় নি, অভুক্ত পেটেই বেরিয়েছে, তাকে না খাইয়ে কিছু মুখে তোলা যায়?
_____করুক, আরেকটু কষ্ট করুক রাহেলা বেগম। মানুষটা আসুক, তাকে খাইয়ে দিয়েই তারপর খাবে। আর কতই বা দেরি করবে? রাত তো কম হল না।
দূরে কোথায় একটা কুকুর ডেকে চলেছে অনবরত। ঘরের পেছনের কাঁঠালগাছের ডালে কী একটা পাখিও ডেকে উঠল নাম না-জানা। চারপাশের বাড়িঘরের সব আলো নিভে গেছে, ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে সব শব্দ। বেশ আগেই যাবতীয় কাজ সেরে ঘুমিয়ে গেছে সবাই। কেবল ভাত-তরকারির গামলা-বাটি ঢাকা দিয়ে বিনিদ্র চোখ বাইরে ফেলে ঘরের চৌকাঠের উপর বসে আছে ক্ষুধাযন্ত্রণায় কাতর বছর পঞ্চাশ-বায়ান্নর একটা মুখ— রাহেলা বেগম।
গভীর থেকে আরও গভীরে ডুবে যাচ্ছে রাতের শরীর। মজিদ শেখ এখনো ফেরে নি। হায় আল্লাহ, মানুষটা আর কখন ফিরবে?
_______________
৩ মে ২০২০

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত