দ্বিপ্রহর

জৈষ্ঠ্যের এক ভ্যাঁপসা গরম রাতে বউ পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে রমিজ উদ্দিন বাইরে হাওয়া খেতে বেরোলেন৷ ঘণ্টা দুই পর ফেরত এসে দেখলেন তার বছর পাঁচেকের ছেলে আতঙ্কিত চোখে মাটিতে পড়ে থাকা নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। রমিজ উদ্দিন কিছুটা নেশায় ছিলেন, তৎক্ষনাৎ তার মদের নেশা কেটে গেলো৷ স্ত্রীকে পিটিয়ে তিনি এখানেই ফেলে গিয়েছিলেন। পিটুনি কী বেশি হয়ে গেলো? অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে, টুম্পা কী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে নাকি, এখনও উঠছে না!

রাত পেরিয়ে দিন এলো, একুশ বছর বয়সী গৃহিণী টুম্পা বাণু আর মেঝে ছেড়ে উঠতে পারলো না। রমিজ উদ্দিন মদ্যপ হলেও মানুষ হিসেবে সকলের পছন্দের, জনাকয়েক লোককে নিয়ে বউকে মাটি চাপা দিয়ে ফেলে ছেলেকে নিয়ে শহর ছেড়ে চট্টগ্রাম চলে এলেন তিনি৷ তার জীবনের তেমন কোনও পরিবর্তন হলো না। আগে চালাতেন ভ্যান, চট্টগ্রামে চালাতে শুরু করলেন রিকশা। ষোলশহরের টিনের খোপের মতো একটা একটা রুমের বাসা ভাড়া করে তিনি ছেলেকে নিয়ে থাকতে শুরু করলেন। তার নেশা করবার গতিপ্রকৃতিতেও বিশেষ পরিবর্তন দেখা গেলো না। খানিকটা কমলো, তবে সেটা না কমারই সামিল৷

রমিজ উদ্দিনের ছেলে জগলুল উদ্দিনের জীবনের অবশ্য অসামান্য পরিবর্তন ঘটলো৷ আপাতদৃষ্টিতে সেই পরিবর্তন হয়তো চোখে পড়বে না, কিন্তু সামান্য মনোযোগ দিলেই জগলুলের মানসিক অসামঞ্জস্যের রূপটি চোখে উৎকট হয়ে ভেসে উঠবার কথা। সদা মদ্যপ রমিজ উদ্দিনের চোখে ছেলের এই পরিবর্তন ধরা পড়াটা যুক্তিসংগত ছিলো না, এবং তিনি তা ধরতে পারলেনও না৷ ছেলে তার ক্রমশ দূর থেকে দূরে হারিয়ে যেতে শুরু করলো৷ দীর্ঘ ছয়মাস পরে রমিজ উদ্দিন খানিকটা টের পেলেন, তার ছেলেটার আচার আচরণে একটু অসামঞ্জস্যতা এসেছে৷ তার ছেলে তো কখনও এমন ছিলো না! হাসিখুশি, সদা চঞ্চল জগলুল আজকাল এমন স্থবির হয়ে গেছে কী কারণে!

পুরো দুদিন লাগিয়ে রমিজ উদ্দিন মনে মনে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করলেন। মায়ের ওভাবে মৃত্যু যে ছেলেটার ছোট্ট মনের অঙ্গনে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে গেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ষোল শহরে ততোদিনে তার বেশ কিছু বন্ধুস্থানীয় মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো। এর মাঝে একজন হলো ইমাম মিয়া। ইমাম মিয়া বয়সে রমিজ উদ্দিনের থেকে বয়স পনেরো বড়, ধার্মিক বিশ্বাসী মানুষ। রমিজ উদ্দিনের মতো যুবা পুরুষ স্ত্রী ছাড়া চললে যে জেনা করবেই করবে, এই ব্যাপারে তার পূর্ণ আস্থা ছিলো। নতুন বন্ধু রমিজের জাহান্নামে বিচরণ কী করে ঠেকানো যায় তা নিয়ে চিন্তা করে নিজের বার্ধক্যের অখণ্ড অবসরের বেশ অনেক অংশ তিনি রোজ কাটিয়ে দিতেন। তাই রমিজ উদ্দিন যখন ছেলের ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে বন্ধুস্থানীয় মানুষদের সঙ্গে আলাপ করতে গেলেন তখন ইমাম মিয়া ভাবলেন এই তো সুযোগ।

ইমাম মিয়া সুযোগের সদ ব্যবহার করলেন৷ রমিজ উদ্দিন সেদিন রাতে নেশা করে বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলেন, ইমাম মিয়া জ্ঞানী মানুষ, ভালো একটা উপায় বাতলেছে। মা মরা ছেলের মায়ের চাইতে বেশি আর কী-ই বা প্রয়োজন হতে পারে!

মাস খানেক কেটে গেলো। রমিজ উদ্দিনের জন্য পাত্রী খোজা শুরু হয়েছে। জগলুল উদ্দিনকে তাতে তেমন উদ্দীপ্ত হতে দেখা গেলো না। সে নিজের মতোই থেমে রইলো। এতো নীরবে ওর জীবন চলতে থাকলো যে সময়ে সময়ে মাঝে মাঝে ওকে বোবা-বধিরও মনে হতো। মায়ের মৃত্যু ওর জীবনকে বাস্তবিক অর্থেই এক বিন্দুতে থামিয়ে দিয়েছিলো। ও থেমে ছিলো সেই অন্ধকার দমবন্ধ রাতের প্রথম প্রহরেই, মায়ের শরীরের একটু দূরে, মাথাটা হাঁটুর ওপর রেখে স্ফীত চোখে মায়ের শরীরটার দিকে তাকিয়ে।

*

আষাঢ় মাসে রমিজ উদ্দিনের বিয়ে ভাগ্য খুলল। এক মেয়ের সঙ্গে তার ব্যাটে বলে মিলে গেলো। মেয়েটি অতিশয় গরীব ঘরের, বয়স বিশ, তালাক প্রাপ্ত। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো মেয়েটি বাঁজা, সন্তান হইয়ে জগলুল উদ্দিনের সুখ উজাড় করবার মতো পরিস্থিতি মেয়েটি কখনওই তৈরি করতে পারবে না। রমিজ যে ছেলের জন্য এতো ভাবেন, এটা সেই প্রথম আসেপাশের মানুষজন টের পেলো।

রমিজ উদ্দিনের সুনাম আরও খানিকটা বেড়ে গেলো।্র

শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় অল্প কিছু লোক নিয়ে পাঞ্জাবী, লুঙ্গি পড়ে রমিজ বিয়ে করতে গেলেন। জগলুল উদ্দিনও দেড়শ টাকার নতুন পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বাপের পেছন পেছন পুতুলের মতো গেলো। মানুষ তাকে পুতুলের মতোই দেখলো, কয়েক মুহূর্ত দেখে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।

রমিজ উদ্দিন, ইমাম মিয়ার মুখে তৃপ্তির হাসি ফোটালেন। তিন কবুল বলে বিয়ে সেরে ফেললেন। সকলে দু টাকায় বিক্রি হওয়া বাসি লাড্ডু মুখে দিয়ে আনন্দ ফুর্তি করতে শুরু করলো। শুধু যাদের ঘিরে এই সমস্ত আয়োজন, সেই নববিবাহিতা কন্যা আর রমিজ উদ্দিনের উদ্ভ্রান্ত সন্তান নিজেদের অন্ধকার, নিস্তব্ধ মনের আঙিনাতে চুপ করে বসে নিজেদের কোলের দিকে তাকিয়ে রইলো। আনন্দ কিংবা বেদনা, কোনও অনুভূতিই তাদের মনে অনুভূত হলো না।

নতুন বউয়ের নাম শাপলা বাণু৷ দেখতে তেমন সুন্দরী নয়, মুখটা ব্রণে ভরা, চুল গুলো শুষ্ক৷ রোজ এদিক ওদিক চেয়ে তেল দেয়ার পরেও চুলের এই অবস্থার কোনও অদল বদল হয় নি।

শাপলা বাণু খাটো মানুষ। এতো খাটো যে আর আধফুট খাটো হলে তাকে বামুনের কাতারে ফেলা যেতো। সন্তান জন্মদানের পর নারীদের দেহে কিছুটা ওজন আসে, শাপলা মানুষ বাঁজা মেয়ে হয়েও ঠিক তেমনই দেখতে। মোদ্দা কথা হচ্ছে শাপলা বাণুর শরীরটায় সুন্দরের ছিটেফোঁটাও নেই, তা হোক মানুষের চোখে কিংবা নিজের চোখে। নিজের অপ্রাপ্তি নিয়ে এক সময় হয়তো আফসোস ছিলো শাপলা বাণুর, কিন্তু জীবনের যাতাকলে সেই আফসোস এখন ফিকে হয়ে গেছে।

শাপলা বাণু এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

প্রথমবার যখন বিয়ে হলো ভাইয়েরা তখন হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলো শাপলা বাণুর। যদিও কী করে সেই বিয়েতে তাকে কন্যা হিসেবে পছন্দ করা হয়েছিলো সেটা এখনও রহস্য! কিন্তু বিয়ের দুবছরের মাথাতেই যখন বন্ধ্যা সার্টিফিকেট নিয়ে শাপলা ফেরত এলো, তখন দীর্ঘশ্বাস ভর্তি বিরক্তি ফেলা ছাড়া আর কোনও উপায় দেখলো না তার ভাইয়েরা নিজেদের চোখের সামনে।

সৃষ্টিকর্তা এক আষাড় মাসে তাদের উপায় করে দিলেন। শাপলার বড় ভাইয়ের মামা শ্বশুর একটা সম্বন্ধ নিয়ে এলো। শ্রাবণ মাসের এক সন্ধ্যায় রমিজ উদ্দিন নামের এক রিকশাওয়ালা শাপলাকে বিয়ে করে নিজের এক রুমের ভাড়া ঘরে এনে জায়গা দিলো।

এই যে জায়গা হলো, এই অসামান্য দানের জন্য শাপলা বাণু নিজের নতুন স্বামীর প্রতি মনে মনে অসম্ভব কৃতজ্ঞ হয়ে রইলো। খুশি অবশ্য সে খুব একটা হতে পারলো না। তার আগে স্বামীর বয়সটা বেশ কম ছিলো, তাকে আদরেও রাখতো শুরুর একটা বছরে বেশ। কিন্তু বাচ্চা যখন হলো না তখন স্বামীর মতি পরিবর্তন হতে শুরু করলো৷ তাকে দোষ দেয়া যায় না, এতো বাহ্যিক দোষের পরেও যে তাকে সে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলো এই-ই তো অনেক!

নতুন ঘরে স্বামীর সঙ্গে সখ্যতা বাণুর তেমন একটা হলো না। স্বামী রমিজ উদ্দিন রোজ রাতে মদ গিলে বাড়ি ফেরেন। প্রায় রোজ রাতেই তাদের মিলন হয়। মাসিকের সময়টায় বলে কয়ে থামাতে হয়৷ মাঝে মাঝে দমবন্ধ করা ব্যথা হলেও শাপলা বাণুর বলতে ভয় হয়, তাকে যদি আর তিনি না ছোঁয়, সেকথা ভেবে। রমিজ উদ্দিন ভয়ের সুযোগ নিয়ে বিরতিহীন ভাবে নিজের স্ত্রীর শরীরকে সুখ দেবার চেষ্টা করেন। নিজের কুৎসিত, যুবতী স্ত্রীকে সুখ বিলোচ্ছেন, এরকম ভেবে মনে মনে কিছুটা মানসিক প্রশান্তিও অনুভব করেন তিনি।

নতুন বউকে যেই কাজে আনা হয়েছিলো সেই কাজে উন্নয়নের বাতাসও আস্তেধীরে লাগতে শুরু করে। শাপলা বাণুর অসংখ্য স্বপ্ন অপূর্ণ হয়ে থাকলেও বাচ্চা কাচ্চা হওয়ানোর কোনও স্বপ্ন কখনও, কোনওকালে ছিলো না। কিন্তু গত বিয়েতে যখন শুনলো সে বাজা মেয়ে তখন আকস্মিকভাবেই তার চিন্তাধারায় পরিবর্তন এলো। হুট করেই একটা বাচ্চার জন্য তার মন বেজায় হা-হুতাশ করতে শুরু করে দিলো। যেখানে যে বয়সী বাচ্চাই দেখুক তার সবাইকেই পছন্দ হয়ে যেতে শুরু করলো। বুকের দীর্ঘশ্বাস গোপন রেখে ভাইদের সন্তানদের সে গভীর মমত্ববোধের সঙ্গে পালতে শুরু করেছিলো। বিয়ের পর সে নিজের জন্য একান্ত একটি সন্তান পেলো। জগলুল উদ্দিনের জন্য দীর্ঘদিন পর বাস্তবিক অর্থেই সৃষ্টিকর্তা একজন অপূর্ণ মা খুঁজে দিলেন। দীর্ঘদিন পরে মাতৃস্নেহ পেয়ে জগলুল উদ্দিনের মনের শক্ত খোলসটায় খানিকটা যেন চিড় ধরতে শুরু করলো, এবং সেই চিড় দিনকে দিন শুধু বড়ই হলো। জগলুলের চিড় যতো বড় হলো ততই শাপলা বাণুর অপূর্ণ মাতৃমন পূর্ণ হলো। সৃষ্টিকর্তা তাদের দুজনকে দেখে মুচকি হাসলেন।

সময় কেটে গেলো৷ জগলুল বেশ অনেকটা বড় হয়ে গেলো। শাপলার খুব ইচ্ছে ছেলেকে সে স্কুলে পড়াবে। স্বামীকে তার খুব একটা বলতে হলো না, বোঝা গেলো মনে মনে রমিজেরও একই ইচ্ছে ছিলো৷

কোনও এক বছরের জানুয়ারি মাসে জগলুল উদ্দিন একটা সরকারি স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়ে গেলো। ষোলশহর স্টেশনটা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র৷ হরহামেশাই এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা বসে বসে আড্ডা দেয়। এর মাঝে এক দল ছেলে মেয়ে মাঝে মধ্যে স্লেড, অক্ষর বই এসব নিয়ে এসে স্টেশন মাস্টারের ঘরের পাশের খালি জায়গাটায় প্লাস্টিক বিছিয়ে আসেপাশের শিশুদের পড়িয়ে যায়। সপ্তাহান্তে একবার আসে ওরা। জগলুল উদ্দিন এই স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপটির কাছ থেকে অক্ষর জ্ঞানসহ বেশ কিছু কবিতাও শিখেছিলো। দেখা গেলো, ওর স্মৃতিশক্তি খুবই তীক্ষ্ম৷ যা কয়েকবার দেখে তা খুব বেতাল না হলে আর সহজে ভুলে না৷

সরকারি স্কুলে যেকোনও পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা জগলুলের জন্য আসলাম ভাইয়ের দোকান থেকে বান চুরি করে খাওয়ার মতো বিষয় হয়ে গেলো৷

এদিকে শাপলা বাণু আপাত নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাতে থাকলো৷ রমিজ উদ্দিন আগের স্ত্রী টুমপা বাণুকে পেটাতেন কারণ সে কথা শুনতে চাইতো না, শাপলা বাণুর ক্ষেত্রে সে বালাই নেই, পেটানোর তাই প্রশ্নই আসে না। রমিজ উদ্দিন ইদানীং এই ভেবে ইষৎ তৃপ্তও হন যে তিনি অকারণে কোনওদিন কারও গায়ে হাত তোলেন নি।

যতই দিন এগুলো, দেখা গেলো ভালো ফলাফল জগলুলের জন্য ছেলের হাতের মোয়ার মতো বিষয়। বাবা-মা, শিক্ষক, সহপাঠী সকলেই খুশি। জগলুল দুরন্ত ছেলে, বন্ধু বান্ধবদেরও ওর ওপর নিরাশ হবার কোনও অবকাশ ছিলো না। ষোলো শহর স্টেশনের প্রতিটি লোকাল মুখ ওকে দেখে হাসতো৷

কিন্তু তবুও এক রাতে জগলুল হারিয়ে গেলো। এমনভাবে হারালো যেনো সেখানে ছোট্ট জগলুলের কখনও কোনও অস্তিত্বই ছিলো না। কিন্তু এটি অদূর ভবিষ্যতের আলাপ, বর্তমান শেষ করেই সেখানে যাই৷

বর্তমানের দুরন্ত জগলুল নিজের মাকে ভালোবাসতো। প্রতিদিন নিয়ম করে মা ওর কপালে চুমু না খেলে ওর পড়তে বসা হতো না। শাপলা বাণু ছেলের সঙ্গে এই আহ্লাদটা করতে যেয়ে নিজেই আহ্লাদে আটখানা হয়ে যেতো। তার এতো ভালো লাগতো, নামাজে বসে রোজ রাতে সে ছেলের সফলতা কামনা করে চোখ ভেজাতো। হয়তো সে ভাবতো, জীবনের তার যত অপূর্ণতা তার সব এই ছেলেটির ভেতর দিয়ে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

বাপের সাথে অবশ্য জগলুল অতটা ঘনিষ্ঠ ছিলো না। বাপের জন্য ছোট্ট জগলুলের মনের বড় একটা অংশ এক অজানা অনুভূতিতে ছেঁয়ে ছিলো। জগলুল সেই অনূভুতির স্বরূপ না চিনলেও যেকোনও অভিজ্ঞ মানুষ ওর মনে ঢু মারলে বলতে পারতো, জগলুল মনে মনে বাপকে ঘৃণা করে। জমিয়ে রাখা একঘর অনূভূতির পুরোটাই ঘৃণায় বিষাক্ত! এই অনুভূতির জন্ম হয়েছিলো যেদিন শাপলা বাণুর উষ্ণ মাতৃস্নেহে জগলুলের মনের শক্ত, শীতল বরফ পিণ্ডটা গলতে শুরু করেছিলো সেদিন। যতোই বরফ গলেছে, ততোই বাপের প্রতি মনের ঘৃণাবোধ ওর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।

একটা সময়ে এসে মনে মনে বাপকে জগলুল অস্বীকার করলো৷ না বুঝেই করলো। বাবা ওর জন্য হয়ে গেলো অচেনা, বহুদূরের কোনও মানুষ যে রোজ রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে, ফিরে ঘরে পার্টিশন হিসেবে ব্যবহার করা দড়িতে ঝোলানো কাথাটাকে টেনে দিয়ে মায়ের উপর চড়ে বসে। জগলুলের বয়স কম, এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে ইতোমধ্যেই নারী পুরুষের কাম উত্তেজক ভিডিও দেখে ফেললেও নিজের মা-বাবার স্বাভাবিক যৌন জীবনকে মেনে নিতে ওর অস্বস্তি হতো।

ছোট্ট জগলুল জানতো না, তার বাবা-মায়ের যৌন জীবন ঠিক স্বাভাবিক ছিলো না। জানলে সম্ভবত আরও কিছুটা কষ্ট পেতো। বাপের প্রতি ঘৃণাবোধও হয়তো বাড়তো। তারপর এক সময় বুঝতে পারতো, এটা আসলে অস্বাভাবিক কোনও চর্চা নয়। এর জন্য রাগান্বিত হবার সুযোগ থাকলেও বদলানোর সুযোগ ওর হাতে নেই।

*

রমিজ উদ্দীন সচরাচর সন্ধ্যায় বাসায় থাকেন না৷ যেই অল্প কিছুদিন তিনি বাসায় সন্ধ্যা কাটান তার সবগুলোই তিনি ছেলের পেছনে কাটাতে চান। রমিজ উদ্দীন চন্দ্রিমার এক বেশ্যার জারজ সন্তান হিসেবে নিজের শৈশব পার করেছেন, বাবাকে তিনি কখনও দেখেন নি, দেখার প্রয়োজনও অনুভব করেন নি। বস্তুত তার মা তাকে বুঝিয়েছিলো, তার বাপ অনেকগুলো, প্রত্যেকেই তাকে ভালোবাসে, প্রত্যেকেই মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে। পাঁচ বছর বয়সেই রমিজ উদ্দিনের জ্ঞান হয়, মা তাকে মিথ্যে বুঝিয়েছেন। তিনি মন খারাপ করেন নি। ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক হিসেবে নিয়েছেন। শরীর খাটানোর বিষয়টি তখনও তার কাছে পরিষ্কার হয় নি, কিন্তু সেটা যে ভালো কিছু না, সেটা বেশ্যাপল্লীর বাকি মানুষদের কথাবার্তা আচার আচরণে বেশ বুঝতে পারতেন৷ মা একটা খারাপ কাজ করছে খারাপ সময়টাকে পার করবার জন্য, ভালো সময় এলেই তারা এখান থেকে বেরিয়ে যাবে, এভাবেই ভাবতে পছন্দ করতেন তিনি।

তার মা আর কখনও বেশ্যাপাড়ায় বাইরে পা রাখতে পারে নি। জীবনের যৌবন সে নটি পাড়ায় পার করেছে, মধ্য বয়সের শেষ দিকে যখন তাকে মুক্তি দেয়া হলো তখন সমাজ থেকে তাকে নিষেধাজ্ঞা জানানো হলো। মা তার আবারও পুরাতন নীড়ে ফিরে গেলেন। রমিজ উদ্দিন তাতেও মন খারাপ করেন নি। সমাজের রীতিনীতি মানতে হবে, এটাই বাস্তবতা, এতে অখুশি হবার কিছু নেই। মাঝেমাঝে অবশ্য তার আফসোস হয়। আজকাল সময় পালটেছে, বস্তি ভর্তি বেশ্যা থাকলেও এখন লোকে কিছু বলে না, জেনে, বুঝে অদেখা করে। মা আর দশ পনেরো বছর পরে জন্মালে এখন আরামে এরকম কোনও একটা ছোটখাটো জায়গায় ঘর ভাড়া করে তাকে নিয়ে থাকতে পারতো৷

কিন্তু আফসোস, আফসোস পর্যন্তই সীমাবদ্ধ, এই সামান্য আফসোস তার মন খারাপ করতে পারে না। যে বিষয়টা তার মন খারাপ করে সেটা হচ্ছে তার নিজের ছেলে তাকে খুব একটা পছন্দ করে না। সৎ মাকে এতো পছন্দ করে অথচ নিজের বাপকে ছেলেটা পছন্দ করে না!

রমিজ উদ্দিনের নিজের জীবনকে বেকার মনে হয়। ছেলের মন জেতার জন্য মাঝেমাঝেই দিনে অহেতুক খরচ করে এটা সেটা নিয়ে আসেন। ছেলে সেসব আনন্দিত মুখে গ্রহন করে, কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন, ছেলের সেই আনন্দের ছিটেফোঁটাও তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় না। ছেলে তাকে ঠিক সেই নজরে দেখে যেই নজরে বয়স হবার পর থেকে তিনি নিজের মিথ্যে বাবাদের দেখতেন।

রমিজ উদ্দিনের কষ্ট হয়। রাগও হয়। কিন্তু কাউকে তিনি কিছু বলে উঠবার মন করে উঠতে পারেন না। খুব রাগ হলে মাঝেমাঝে ছেলেকে তিনি বিনা কারণে শাস্তি দেন। ছোট ধরণের শাস্তি৷ বাসায় অল্প সময়ের জন্য আটকে রাখেন কিংবা খেলতে যেতে বাধা দেন। শাপলা ভালো মেয়ে, তার মুখের ওপরে কিছু বলে না৷ ছেলেও কিছু বলে না। ছেলের ভেতরের প্রচ্ছন্ন নির্লিপ্ততাকে তিনি পড়তে পারেন। তার আর ছেলের মধ্যকার ক্ষীণকায়, পাতলা, রক্ষণশীল মানসিক আবরণীটাকে তিনি অনুভব করতে পারেন। কিন্তু সেই আবরণী ভেদ করবার কোনও সাহস তিনি করে উঠতে পারেন না৷ হয়তো তার ভয় হয়, আবরণী ভেদ করলে তিনি নিজের ছায়াকেই দেখতে পাবেন।

*

চৈত্রের এক ভ্যাঁপসানো রাতে রমিজ উদ্দিন বাড়ি পড়ে আছেন। শাপলা বাণু রান্নাঘরে ঘাম ঝড়াচ্ছেন। তার রান্নার হাত অসম্ভব রকমের ভালো৷ আক্ষরিক অর্থেই তিনি যা-ই রাধেন তা-ই অমৃত হয়। স্বামী তাকে রান্নার প্রশংসায় সব সময়ই পঞ্চমুখ করেন। ছেলেও তার রান্না বেশ পছন্দ করে।

রোজার ঈদ চলে এসেছে আজ বাদে কাল, একেবারে ঘরের মুখে। জগলুল উদ্দিন মুখ কালো করে পড়ার টেবিলে বসে আছে। এসময় সাধারণত রমিজ উদ্দিন ঘরে থাকেন না, ও স্টেশনে এদিক ওদিক বসে আড্ডা দেয়৷ কদিন ধরে বাপ ওর ঘরে থাকছেন, সন্ধ্যা থেকে পড়তে বসাচ্ছেন। জগলুল উদ্দিনের অসহ্য লাগছে। ঈদের আগে মানুষ এভাবে কোনওদিন পড়ে নাকি?

এদিকে রমিজ উদ্দিন অলস সময় কাটাচ্ছেন। তার সময় কাটছেই না। সপ্তাহ দেড়েক আগে মদ্যপ অবস্থায় এক ছোকড়ার সঙ্গে তার কিঞ্চিত বাকবিতন্ডা হয়েছিলো। বাকবিতন্ডা হাতাহাতি পর্যন্ত চলে যেতো কিন্তু তার আগেই আসেপাশের বন্ধুস্থানীয় লোকেরা দুজনকে আলাদা করে এনেছে। তিনি একরাশ গালমন্দ করে তারপর বাড়ির পথ ধরেছিলেন। এখন তিনি কিছুটা দুশ্চিন্তায় আছেন। জানা গেছে সেই ছোকড়াটি স্থানীয় ছাত্র নেতা রুহুল বাঞ্চোদের প্রিয় মুখ। যে সকল অশ্রাব্য গালি তিনি সেরাতে দিয়েছেন সেসব কিল, ঘুষি, লাথি হয়ে ফিরে আসবার জোড়ালো সম্ভাবনা আছে বলে তিনি আশংকা করছেন। তাই কদিন ধরে রাতে বাড়িতেই আছেন, পান করতে বেরোচ্ছেন না।

নটা পর্যন্ত উঠে পড়বার পর জগলুল যখন উঠতে গেলো তখন হাতে আর কোনও কাজ না পেয়ে রমিজ ছেলেকে ধমক দিয়ে পুনরায় পড়তে বসালেন। জগলুল উদ্দিন বিরক্তিতে ফেটে পড়লো, কিন্তু বাপের মুখের উপর কিছু বলতে পারলো না। গুম হয়ে শুধু সামনের খুলে রাখা বাংলা বইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।

এগারটা নাগাদ ছেলেকে ছুটি দিলেন তিনি। জগলুল উদ্দিনের বেজার মুখ দেখে বোধহয় তার অনুশোচনা হলো। তাছাড়া আটটার দিকে ফেরার পথে জগলুলকে মার্বেল খেলা থেকে উঠিয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন তিনি ধমকে। তাই সাত পাঁচ ভেবে ছেলেকে বললেন গায়ে জামা চাপাতে, বাপ-বেটা একসাথে কিছু সময় বাইরের হাওয়া খেয়ে আসবেন। ছেলের সঙ্গে একান্তে তার তেমন সময় কাটানো হয় না। এই সুযোগে সেটাও হবে।

শাপলা বাণু ভাত বেড়ে ফেলছিলো, রমিজ উদ্দিন না করলেন। মিনিট ত্রিশেক পরে একেবারে ছেলেকে নিয়ে ফিরে খাবেন। জগলুলকে তাড়া লাগালেন তিনি। অহেতুক তাড়া, তাড়া দেয়ার কোনও প্রয়োজন আসলে নেই। ছেলেকে নিয়ে হাঁটবেন এই কথা চিন্তা করে তিনি সম্ভবত কিছুটা উত্তেজিত। বারে বারে তাড়া লাগালেন ছেলেকে। জগলুল চোখমুখ শক্ত করে জামা গায়ে দিলো। বাপকে ও এমনিতেই পছন্দ করে না, তার উপর আজ তো ধমকে খেলা থেকে উঠিয়ে এনেছে। বাপের উত্তেজনা ওকে না ছোঁয়াটাই স্বাভাবিক।

পিতাপুত্র বাসা ছেড়ে বেরুলো। রাস্তা জনশূন্য। সাধারণত এই সময়ে এতো কম মানুষজন থাকে না, ঈদ কাছিয়ে যাওয়ায় সম্ভবত পথ ভীড়শূন্য হয়ে গেছে৷

পথের পাশের সব দোকান বন্ধ, গলিটা অন্ধকার হয়ে আছে। এই অন্ধকারের মধ্য দিয়ে রমিজ উদ্দিন ও জগলুল উদ্দিন চুপ করে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের দিকে এগোচ্ছে। রমিজ উদ্দিন হঠাৎ আবিষ্কার করেছেন, ছেলের সঙ্গে গল্প করবার মতো কোনো কথা আসলে নেই। নাকি আছে কিন্তু এখন মনে পড়ছে না?

রমিজ উদ্দিন মনে করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আমোদপ্রিয় মানুষ, গল্পের তার অভাব হবার কথা নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে শালার কিছুই মনে পড়ছে না!

ওদিকে জগলুল উদ্দিনের গায়েও দীর্ঘ নীরবতার অস্বস্তিকর হলকা এসে লেগেছে। বাপের সঙ্গে কখনই তেমন করে কথা হয় নি ওর। তাছাড়া ওরা কোথায় যাচ্ছে তাও ও জানে না। হাসনাইনের কাছে শুনেছে, মুরাদপুরের এক মদখোর নিজের দু বয়স বয়সী মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছে কদিন আগে মদের পয়সা না থাকায়। ওর যদিও বয়স বারো, কিন্তু ওকেও যদি সেকারণেই নিয়ে বের হয়ে থাকে বাপ?

স্টেশনের সমস্ত দোকান এগারটার ভেতরেই বন্ধ হয়ে যায়। এখন ঈদের সময়, নটা সাড়ে নটার ভেতরেই দোকান পাঠের ঝাপ সব নামিয়ে ফেলা হয়েছে। রমিজ উদ্দিন হাজার ভেবেও ছেলেকে বলবার মতো কোনও কথা খুঁজে পান নি৷ এখন তিনি কোনও দোকান খোলা আছে কিনা তার আশা করছেন। দোকান খোলা থাকলে ছেলে কিছু কিনে দেয়া যাবে, আইস্ক্রিম কিংবা মিষ্টি জাতীয় কিছু। শাপলার মুখে তিনি শুনেছেন, জগলুল আইসক্রিম বিশেষ পছন্দ করে।

সমস্ত দোকান বন্ধ। জগুলুল আর রমিজ স্টেশন পেরিয়ে মেইন রোডের দিকে এগোলেন৷ জগলুলের একটু ভয় ভয় করতে শুরু করলো। বাপ ওর কদিন ধরে রাতে মদ খেতেও যাচ্ছেন না। এমন একটানা কখনও হয় নি। সে কী তাহলে পয়সার ওভাবে ওকে বিক্রি করে দিতে নিয়ে যাচ্ছে?

মেইনরোডে ধরে একটু সময় হাঁটবার পর একটা দোকান খোলা পাওয়া গেলো। এই দোকানটি চব্বিশ ঘন্টার দোকান। খুব বড় কারণ ছাড়া এই দোকানকে ঝাপ নামানো অবস্থায় কোনওদিন দেখেন নি রমিজ।

বেরুনোর পর জগলুলের সঙ্গে তার প্রথম বাক্য বিনিময় হলো, ” কী খাইবা? ”

জগলুল বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলো৷ রমিজ উদ্দিন আবারও বললেন, ” কী খাইবা? ”

জগলুল মিনমিন করে বলল, ” আপনে যা পছন্দ করেন…”

রমিজ উদ্দিন একটা কোন আইসক্রিম পছন্দ করলেন ছেলের জন্য। টাকাটা দেবার সময় ছেলের মুখের দিকে আড়চোখে তাকালেন তিনি। ছোট্ট একটা তৃপ্তির নিশ্বাস তার ভেতর থেকে বেড়িয়ে গেলো৷

ছেলে তার খুশি হয়েছে।

ফেরার পথে ছেলের সঙ্গে টুকটাক কথা শুরু হলো রমিজের। বস্তুত তার ছেলে যে খুশি হবার চাইতে বিস্মিতই বেশি হয়েছে, এটা সে ধরতে পারলো না, পারলে বোধহয় অতটা তৃপ্তি থাকতো না তার নিশ্বাসে৷

সুন্দর, সুখী সুখী একটা সময় যাচ্ছিলো৷ ছেলের সঙ্গে ভালো সময় মাত্র কাটাতে শুরু করেছিলেন তিনি। রমিজ উদ্দিন খুশি ছিলেন। জগলুল উদ্দিন বিস্ময়ে ছিলো। কিন্তু তবুও তাদের দেখে সৃষ্টিকর্তা এবারে মুচকি হাসি হাসতে পারলেন না।

রমিজ উদ্দিনের পিতৃহৃদয় পরিপূর্ণ উষ্ণতা ছড়ানোর আগেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটা ঘটে গেলো। যে ছেলেটির সঙ্গে তার কুৎসিত বাগবিতণ্ডা হয়েছিলো, দৈবক্রমে তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো রমিজের। ছেলেটি রোডের একটা বন্ধ টং দোকানের পেছনের দিকে বসে মদ গিলছিলো আর কয়েকজনকে নিয়ে। রমিজকে দেখে চিনতে পারে নি প্রথমটায়। রমিজও ছেলেটিকে দেখতে পান নি। ছেলেকে নিয়ে তিনি ধীর পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ ছেলেদের মধ্যে কে যেনো একটা ঢিল ছুড়ে মারলো। জগলুল উদ্দিন পায়ের চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়লো ব্যথায়। রমিজ পুত্রের এহেন পরিণতিতে বিষম রেগে উঠে নিজের গলার সমস্ত রগ ফুলিয়ে ছেলেদের দলটিকে উদ্দেশ্যে গালি দিয়ে বসলেন।

দীর্ঘশ্বাস ফেলবার সুযোগ থাকলে সৃষ্টিকর্তা হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন, কিন্তু তিনি তো এসব অনুভূতির ঊর্ধ্বে, তিনি শুধু তাকিয়েই রইলেন।

ছেলেটি রমিজ উদ্দিনের গলা চিনে ফেলল। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে এগিয়ে এলো সে। রমিজ উদ্দিনের রুদ্রমূর্তি তৎক্ষণাত হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। ছেলেদের দলটি এসে গাল মন্দ শুরু করে প্রথমেই একটা প্রকাণ্ড চড় বসিয়ে দিলো তার গালে৷ চড়ের প্রতিক্রিয়ায় রমিজ উদ্দিন কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখের সামনে অন্ধকার দেখলেন। সে অন্ধকার কাটবার আগেই মুখে, পেটে, পিঠে সমানে কিল পড়তে শুরু করলো। কে যেনো তলপেট বরাবর খুব জোরে একটা লাত্থি দিলো। ব্যথায় রমিজ উদ্দিনের মুখটা নীল হয়ে গেলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়বার সময় তার মুখ থেকে অদ্ভূত গোঙানির

আওয়াজ বেরুলো।

রাতের নিস্তব্ধতা লাথি আর গালির শব্দের আড়ালে চাপা পড়ে গেলো। ঘটনার ভয়াবহতায় পাশে বসে থাকা কিশোর জগলুলের মুখটা আতঙ্কে সাদা হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে এমন কী ছোট্ট কোনও আর্তচিৎকারও বের হচ্ছে না ওর। বাপকে এখন আর ও দেখতে পাচ্ছে না। মানুষগুলো গোল হয়ে দল বেধে লাথি দিয়ে যাচ্ছে তাকে। জগলুলের হাতের কোণটা এখন আর ওর হাতে নেই।

বাপের কিনে দেয় আইসক্রিমটা বাপের মতই ধুলোর পড়ে খাবি খাচ্ছে এখন৷

জগলুল উদ্দিন বহুকষ্টে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি সঞ্চয় করলো।

ছেলেগুলোর ওর দিকে কোনও মনোযোগ নেই।

জগলুল উদ্দিন বাপকে ফেলে পালিয়ে গেলো।

রমিজ উদ্দিন মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা গেলেন।

পরদিন তার মৃতদেহ পুলিশ এসে নিয়ে গেলো। ছেলেগুলো সব কদিন গা ঢাকা দিলো। কদিন মানুষ খুনের ভয়াবহতায় আতঙ্কে কাটালো। তারপর ভুলে গেলো। কিন্তু কেউই রমিজ উদ্দিনের মৃত্যুতে দুঃখ পেলো না। না পাওয়াটাই স্বাভাবিক, রমিজ উদ্দিন মজার মানুষ হলেও প্রয়োজনীয় কোনও মানুষ ছিলেন না।

শাপলা বাণুকে আবারও ভাইয়েদের ঘরে যেয়ে উঠতে হলো ।

*

আমাদের গল্প শুরু হয়েছিলো জৈষ্ঠ্যের এক ভ্যাঁপসা গরম রাতে, যে রাতে রমিজ উদ্দিন নিজের প্রথম স্ত্রীকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিলেন। সেই হত্যার কোনও বিচার হয় নি। বছর সাতেক পর চৈত্রের এক ভ্যাঁপসা গরম রাতে রমিজ উদ্দিন মার খেতে খেতে মারা গেলেন, এরও কোনও বিচার হলো না। সমস্ত জীবন মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাওয়া রমিজ সময়ের স্রোতে ভেসে ভেসে পশু হয়ে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর দেখা গেলো, তার জীবনের মূল্য কোনও পশুর থেকেও কম। কীট পতঙ্গ কুচলে ফেলার মতোই সকলে তার অস্তিত্বকে কুচলে ফেলে এগিয়ে গেলো। ব্যতিক্রম হলো শুধু একজন, তার নিজেরই ছেলে জগলুল, যার সমস্ত ঘৃণা ফিকে হয়ে গিয়েছিলো বাপকে ফেলে পালিয়ে আসবার অহেতুক অপরাধবোধে।

রমিজ ছেলের ভেতর নিজের ছায়া দেখতে পাবেন ভেবে ভয় পেতেন। তার ভয় অমূলক প্রমাণিত হলো। দেখা গেলো জগলুল এখন নিজের ভেতর নিজের ছায়া দেখতে পেয়েই ভীত হয়।

বেশ্যাপুত্র রমিজ উদ্দিনের পুত্র সন্তান জগলুলের উদ্দিনের জীবনে কোনও জাদুকরী ঘটনা আর কখনও ঘটলো না। বাপের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সম্ভাবনাময়, উচ্ছ্বল জগলুল হারিয়ে গেলো। বাপের মতোই সমাজের কীটপতঙ্গদের ভীড়ে ওর ঠাই হলো।

(সমাপ্ত)

দ্বিপ্রহর
– রিফু

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত