মা বুনেছিলেন লাউ গাছ। এক ছুটির দিনে বাবা বেঁধে দিলেন মাচা। মায়ের যত্মে গাছটা তরতরিয়ে বেড়ে উঠল। মাচার ওপরটা ভরে গেলো খসখসে সবুজ পাতায়। একদিন দেখা গেলো মাচার নিচে ঝুলছে নধর নধর লাউ।
মায়ের যত্ম আর থামেনা। গোড়ায় পানি দেন। সার দেন। মাটি নিড়ান। পাতায় পাতায় হাত বুলান। আদর যত্মে আহ্লাদী লাউগুলো বেড়ে ওঠে দ্রুত। মা লাউ দিয়ে শোল মাছ রান্না করেন। আমরা খাই। লাউ-ইলিশ রান্না করেন। আমরা খাই। লাউ চিংড়ি রান্না করেন, আমরা খাই। খুব ঘনঘন আমাদের ঘরে মাছ বা মাংস থাকে না, সেসব দিনগুলোতে মা লাউ দিয়ে ডাল রান্না করেন। আমরা খাই। আমাদের শরীর থেকে লাউয়ের ঘ্রাণ বের হয়। মাচায় লাউ হয়ে ঝুলছি, মা কাটতে আসছেন- মাঝে মাঝে এমন স্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠি। সারারাত জেগে থাকি।
বাবার কাছে টাকা না থাকলে মা বিষন্ন মনে লাউ কেটে দেন। বাবা খুব সঙ্কোচে মায়ের গোপন দীর্ঘশ্বাস লাউ বিক্রি করতে বাজারে নিয়ে যান। যেতে যেতে সস্তা শার্টের রংচটা হাতায় চোখ মুছেন। মা আঁচলে মুখ ঢাকেন, কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে থাকেন। বুকের ব্যথাটা যন্ত্রণা দিলে লাউ গাছের পাশে পিড়ি পেতে বসেন। বড় আপা মা’র মাথায় তেল দিয়ে দেয়, আমি পা টিপে দেই। ব্যাথা চেপে মা হাসেন। মলিন হাসি। মন খারাপ হয়।
বাবার সঙ্কোচ বাড়তে থাকে। মা গাছ লাগিয়ে যান। মা’র যত্নে তিনটে পেঁপে গাছ বেড়ে উঠেছে। পুইশাকে ভরে গেছে আরেকটা মাঁচা। কাকরোল গাছে অনেক কাকরোল ধরেছে। মা যে কি খুশি! এক একদিন লাউ বাদ দিয়ে মা পেঁপে রান্না করেন। এক একদিন পেঁপে বাদ দিয়ে পুইশাকের চচ্চরি করেন। এক একদিক সব বাদ দিয়ে কাকরোল ভাজেন। আমরা খাই। একদিন খাচ্ছি, এমন সময় রান্নার পাট চুকিয়ে, গাছের মায়া ছাড়িয়ে মা চলে গেলেন। মা খুব বেশী দূরে যান নাই। খুব কাছাকাছি আছেন। বাড়ির পেছনের পরিত্যক্ত জমিতে আমড়া গাছের নিচে তাকে রোপন করে দিলো সবাই।
আমি রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে আমড়া গাছের নিচে যাই, উঁচু হয়ে থাকা মাটিতে সকাল বিকাল পানি দেই। হাত বুলাই। ওপরের মাটি নেড়ে চেড়ে দেই। ঝরে পড়া পাতা পরিস্কার করি। রোজ ভোরে গিয়ে দেখি- মা গাছের বীজ ফুটে পাতা বের হয়েছে কি না।