যমুনা

রাত কত হবে কে জানে? সেই সন্ধ্যা থেকে একটানা চলেছি। যমুনা আসলে কত বড়? ছোটবেলা যখন আরিচা-নগরবাড়ী আর নগরবাড়ী-আরিচা যমুনা পার হতাম তখন শুনতাম ১১ মাইল পাশ, আমাদের কিরণ মাঝি বলত। আর লম্বায়? কিরণ বলত, তা ধরোগা তুমার হবি শতখানিক মাইল। কিরণের ঠাকুরদা বলত, যমুনা কি আর ছিল? ছিল না। বাপ দাদার কাছে শুনিছি ব্রোম্মপুত্তুরু আছিল, কি তার ঢেউ, কি তার পাশ? তারির জম্ম যমুনা। লম্বায় কত আর পাশে কত, তা যে যত কথাই বলুক আমার কাছে, এখন, মনে হয় যমুনা একটা অগস্ত্য যাত্রা। তার শুধু যাওয়া আছে।

যেদিকেই তাকাই চারপাশে কিছুই দেখা যায় না। তবু আকাশে একটা আলোর আভা, ছায়া ছায়া, আমি আর আমার ভাবনা, বশির মাঝি আর কিরণ মাঝি আর তাদের ভাবনা, তাদের হাতের ফাঁকে বাতাস আড়াল করে রাখা বিড়ির আগুন আর মাঝে মাঝে আঙুলের ফাঁক গলে তারাখসার মত দু’একটা ফুলকির ছুটে বেড়িয়ে যাওয়া, একটা আলোর প্রক্ষেপণের মত, ছায়ার মত, আবছায়ার মত, অস্পষ্ট, ধূসর, অজানা, কুয়াশার মত, কি জানি কেমন, হয়ত খুব সাধারণ, অথবা হয়ত খুবই দামী, গোপনে লুকিয়ে রাখা কোনো পুঁতির মালার মতো।

আর যমুনা, সে তো আরো অস্পষ্ট, আরো ধাঁধাঁর মত, প্রথম থেকেই নিঃশব্দ। স্পষ্ট আর তীক্ষè কেবল শ্যালো মেশিনের একটানা ভটভট শব্দ, বিরামহীন, অবিচ্ছিন্ন নিয়তির মত। এই প্রচণ্ড শব্দ চলেছে সেই সন্ধ্যা থেকে আর এখন প্রায় মধ্যরাত, কিংবা কে জানে শেষরাত। অথবা এইমাত্র ছেড়ে এলাম গোয়ালন্দ, তখন ছিল সন্ধ্যা আর এখন কতদূর এসেছি অথবা আদৌ এসেছি কি না, কয় ঘণ্টা বা কয় মিনিট কিছুই জানি না, তবে শ্যালো মেশিনের একটানা ভটভট শব্দ কেমন যেন কানে সয়ে এসেছে, সব কেমন নিরব মনে হচ্ছে, আর এর মধ্যে শোনা যাচ্ছে যমুনার কান্না। গোপন। থেকে থেকে ফোঁপানির মত। প্রবল শব্দের মাঝখানে নিরব নৈঃশব্দের মত ডুবজল থেকে ভেসে ওঠা কান্না। নাই, তবুও কোথায় যেন খুব আষ্টেপৃষ্ঠে আছে।

ইঞ্জিনের একটানা শব্দ ছাপিয়ে প্রায় নিঃশব্দে কাঁদে যমুনা আর আমি নৌকার সামনের গলুইয়ে বসে ইঞ্জিনের একটানা শব্দ ছাপিয়ে কান পেতে থাকি, শীতে কেঁপে কেঁপে উঠি। শীতেই বোধহয়, অথবা কে জানে হয়ত যমুনার নিঃশব্দ কান্না আমাকে কাঁপিয়ে দিয়ে দিয়ে যায়। আমার অস্তিত্ব প্রবল শব্দে নাড়িয়ে দিয়ে দিয়ে যায়। এখন বোধহয় আশ্বিন মাস, আশ্বিনই হবে, নভেম্বর মনে আছে, আশ্বিন মনে নাই, কয়েকদিন আগে পুরনো একটা খবরের কাগজে দেখেছিলাম কার্তিকের ২৮, তাই বোধহয় এখন আশ্বিন। আশ্বিনে শীতের হাওয়া লাগে, শীত আসি আসি করে। আশ্বিনে নিঃশব্দ যমুনার রাতে নৌকার গলুইয়ে খালি গায়ে বসে মাঝরাতে তাই হয়ত আমার শীত লাগে। মাঝরাত না সন্ধ্যা, অথবা তামাম রাত পার হয়ে গেছে। ‘অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল।’ আর আমি মৃতের মত নৌকার গলুইয়ে একা বসে আছি খালি গায়ে। আকাশ কি ফর্সা হতে শুরু করেছে? চারপাশে কেমন আলো, আমার গা ঠাণ্ডায় প্রায় জমে আসে। আর যমুনা থেকে থেকে নিঃশব্দে কাঁদে। আর আমি সেই ছোট ছোট নিঃশ্বাসের শব্দের মত কান্না শোনার জন্য ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে কান উঁচিয়ে অনন্তে বসে থাকি।

আশ্চর্য। খুবই আশ্চর্য। অনেক্ষণ পর, সন্ধ্যার অনেক্ষণ পর কান্না প্রায় থেমে এলে মেয়েটা তার নাম বলেছিল ‘যমুনা’। সন্ধ্যার একটু পর নৌকা তখন মাত্র গোয়ালন্দ থেকে তীব্র বাঁকের মত চর ঘুরে এসে যমুনায় পড়েছে, তখন মেয়েটা নৌকার ছইয়ের ভেতর বসে প্রায় ফিসফিস করে একটা বেলি ফুলের ধীরে ধীরে ফোটার মত করে, এক ফোঁটা শিশিরের গোপনে বকুল ফুলের উপর এসে বসার মত করে আর একরাশ রেন্ডি কড়ইয়ের পাতা বাতাসে নরম হয়ে ভাসতে ভাসতে বৃষ্টির মত করে নেমে আসতে আসতে বলল, ‘যমুনা’।

– আমার নাম যমুনা।
– ও।

ও ছাড়া আমার আর কীই বা বলার থাকে? আমি তখন ছইয়ের ভেতর থেকে পরাজিতের মত বের হয়ে অনেকটা পথ হেঁটে ক্লান্ত হয়ে নৌকার সামনের গলুইয়ে এসে বসেছি। আমার তখন শীত লাগতে থাকে আর তখন আমি ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে নদীর মসৃণ জলমগ্ন শব্দের মত শুনতে পাই ‘আমার নাম যমুনা’। নৌকার ছইয়ের ভেতর থেকে বের হয়ে মাঝরাতে যতটা পথ পাড়ি দিয়ে আমি সামনের গলুইয়ে এসে বসি, ‘আমার নাম যমুনা’ শব্দগুচ্ছ হয়ত তখন আমার পেছনে পড়ে যায়, সেও হয়ত ততটা পথ পাড়ি দিয়ে অনেক পরে ধীরে ধীরে আমার কানে এসে প্রবেশ করে অথবা ততক্ষণে আমরা হয়ত পদ্মা ছেড়ে যমুনায় এসে পড়েছি বলে আমার কাছে মনে হয় মেয়েটার নাম যমুনা। কিংবা হয়ত ছইয়ের ভেতর থাকতে থাকতেই মেয়েটা আমায় তার নাম বলেছিল যমুনা। আমি শীতে কাঁপি। আমি মধ্যরাতে নৌকার সামনের গলুইয়ে একলা যমুনায় বসে শীতে কাঁপি আর যমুনা আমাকে ছেড়ে ইঞ্জিনের প্রবল শব্দের মত ধীরে ধীরে নিঃশব্দে পেছনে সরে যেতে থাকে। নৌকার গলুই থেকে ছইয়ের দূরত্ব বাড়ার মত করে ঢেউগুলোর সাথে আমার একে একে বিচ্ছেদ ঘটতে থাকে।

আমি খালি গায়ে নৌকার গলুইয়ে বসে আশ্বিনের শীতে কাঁপি আর দুই হাত জড়ো করে বুকের কাছে বেঁধে ওম খোঁজার চেষ্টা করি। আমার হাত আমার শরীর থেকে আর আমার শরীর আর আমি আমাদের হাত থেকে ওম খুঁজি। আর যমুনা অন্ধকার ছইয়ের মধ্যে আমার কালো আর ধূসরে মেশান হাফহাতা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে আরও অন্ধকারের মত বসে থাকে। বশির আর কিরণ মাঝি আজ হারিকেন জ্বালায়নাই, হয়ত তাদের হারিকেন জ্বালাতে কেউ বলে দেয়নাই কিংবা হয়ত সারারাত জ্বলে জ্বলে হারিকেনের তেল শেষ হয়ে গেছে কিংবা হয়ত আজ হারিকেনের তেল কেনা হয়নাই। হারিকেন যদি জ্বালান থাকত আর যদি হারিকেন যমুনার সামনে ছইয়ের সাথে ঝুলান থাকত তাহলে হয়ত আমি যমুনার মুখ এখন দেখতে পারতাম। আমি অন্ধকারে যমুনাকে দেখি। যমুনা কি টের পায়? যমুনাও কি আমাকে দেখে? আমি দেখি যমুনা দুই হাত জড়ো করে বুকের কাছে বেঁধে রাখে। যমুনার হয়ত শীত লাগে না, সে হয়ত বশির আর কিরণ মাঝির সামনে আমার আঁটোসাঁটো গেঞ্জিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠা শরীরের ঢেউ আড়াল করার চেষ্টা করে। শুধু বশির আর কিরণ মাঝি কেন, আমার কাছ থেকেও হয়ত সে আড়াল করতে চায়। কিংবা কে জানে ঠাণ্ডা যমুনার বুকে মাঝরাতে নৌকার ছইয়ের মধ্যে বসে কেবল একটা হাফহাতা পাতলা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে যমুনার শীত লাগে। কান্নার দমকে তার কেঁপে কেঁপে ওঠা সন্ধ্যার পর এক সময় থেমে যায় বলে এখন সে হয়ত আশ্বিনের শীতে কেঁপে কেঁপে ওঠে। তবে যমুনা কেঁদেছিল কি? কই, নৌকার ওঠার আগে যমুনাকে আমি কাঁদতে তো দেখিনাই। তবে এতদূর গলুই থেকে অন্ধকার ছইয়ের মধ্যে আরও অন্ধকারের মতো বসে থাকা যমুনা আসলে কাঁদে কি না তা দেখা যায় না। আমার কেবল মনে হয়।

সবকিছু আমার কেবল মনে হয়। আমার মনে হয় এখন আশ্বিন মাস, আমার মনে হয় এখন মাঝরাত, আমার মনে হয় এই তো ভোর হয়ে আসছে, আমার মনে হয় মেয়েটা আমাকে বলেছিল তার নাম যমুনা, আমার মনে হয় ছইয়ের ভেতর বসে বলেছিল তার নাম যমুনা, আমার মনে হয় আমি উঠে ধীরে ধীরে হেঁটে সামনের গলুইয়ে এসে বসার পর শুনতে পেয়েছিলাম, ‘আমার নাম যমুনা’, আমার মনে হয় ততক্ষণে আমরা পদ্মা ছেড়ে যমুনায় এসে পড়ে উত্তর দিকে ঘুরে রওনা হই বলে সে বলে তার নাম যমুনা। অথবা যমুনা নদীতে এসে পড়ার কারণে আমার মনে হয় তার নাম যমুনা। সে হয়ত কোন কথাই বলেনাই। সব আমার কেবল মনে হয়। হয়ত আমি বাঁচি স্বপ্নের ভেতরে, অথবা বহুকাল আমার ঘুম হয় না, আর আমি আশ্বিনের রাতে নৌকার সামনের গলুইয়ে বসে শীতে কেঁপে কেঁপে উঠি। হয়ত আমি কোনও স্বপ্ন দেখি, স্বপ্নে আমাকে দেখি, যমুনাকে দেখি।

অথচ আমি যখন আমার পরনের গেঞ্জি খুলে যমুনাকে পরতে দেই তখন সেখানে কেবল আমি, বশির আর কিরণ মাঝি নই, আরও অনেক লোক ছিল, তারা অনেকে হাসছিল, তারা অনেকে দেখছিল, তারা অনেকে চোখ দিয়ে খাচ্ছিল, চাটছিল, হাতড়াচ্ছিল, আবার অনেকে হয়ত কিছুই দেখছিল না কিন্তু তখন যমুনা তার হাত বুকে বেঁধে রাখেনাই। যমুনার চোখে তখন কেবলই শূন্যতা, তখন দুপুর, এমনকি তখন যমুনার চোখে কোনও জলও ছিল না, ছিল কি? তখন তার হাতদুটো শরীরের দুইপাশে নিরাবলম্ব ঝুলছিল আর তার পরনে না থাকার মত করে ছিল শুধু একটা ছেঁড়া সেলোয়ার আর তখন আমি আমার পরনের গেঞ্জি খুলে তাকে পরতে দিলাম। আর তখন আমি তাকে আমার পরনের প্যান্ট খুলে পরতে দিলাম না। দিতে পারলাম না। অবশ্য বশির আর কিরণ মাঝি আমায় গেঞ্জি খুলে দিতেও নিষেধ করেছিল। ঠিক মুখে কিছু বলেনাই। শুধু হাত দিয়ে একবার কিংবা হয়ত দুইবার কিংবা হয়ত অনেকবার টেনে ধরেছিল, হয়ত বশির অথবা কিরণ একাই, কিংবা হয়ত দুজনে মিলে আমার হাত অথবা গেঞ্জির হাতা টেনে ধরেছিল। সেই টেনে ধরার মধ্যে একটা বারণ ছিল। আমার মনে হয়।

আমি একবার করে বশির মাঝি আর একবার করে কিরণ মাঝির দিকে তাকিয়ে কিছুই না বলে যমুনার হাত ধরে আমার নৌকায় এনে তুলেছিলাম। বশির আর কিরণ মাঝি তখন সব কাজ সেরে এসে নৌকা ছেড়ে দিয়েছিল। বশির আর কিরণ মাঝি না ফেরা পর্যন্ত আমরা দুইজন নদীর পারে গোয়ালন্দ ঘাটের ভিড় আড়াল করতে নৌকার ছইয়ের ভেতর বসে ছিলাম। শুধুই বসে ছিলাম। আমরা সারা দিনমান বসে বসে অপেক্ষা করেছিলাম।

আমরা কেউ কারো দিকে তাকাই না, আমরা কথা বলি না, আমরা হাতের আঙুলটা পর্যন্ত নাড়ি না। আমরা কেবল পরষ্পরকে গোপন করে নিঃশব্দে নিশ্বাস ফেলি। আসলে নিশ্বাসও ফেলি কি? আমার তো সাহস হয় না। অথচ একটু আগে কোন সাহসে যমুনার হাত ধরে নৌকায় এনে তুলেছিলাম তা আর এখন ভাবতে পারি না।

নৌকার ছইয়ের ভেতর তেমন একটা জায়গা নাই। আমার হাঁটু যমুনার হাঁটুর সাথে লেগে থাকে, আমার পেছনে যাবার জায়গা থাকে না তবু আমি তিল তিল করে প্রাণপণে পিছিয়ে যাই, তবু যমুনার হাঁটু ছেড়ে আমি দূরে যেতে পারি না। নৌকার ছইয়ের মত গোল হয়ে আমাদের মুখ পরষ্পরের অনেক কাছে এসে থাকে বলে আমরা পরষ্পরের কাছ থেকে নিশ্বাসের শব্দ আর নিশ্বাসের উত্তাপ গোপন করতে পারি না কিন্তু তারপরও আমি কম উত্তাপ আর কম শব্দে নিশ্বাস ফেলার চেষ্টা করতে থাকি।

বশির আর কিরণ মাঝি ফিরে এসে সন্ধ্যার একটু আগে আশ্বিনের অল্প শীতে মাগরিবের আজান শুরু হবার পর নৌকা ছাড়লে সম্ভবত ইঞ্জিনের শব্দের আড়াল পেয়ে যমুনা প্রথমবারের মত কাঁদতে শুরু করে। আমি এতক্ষণ পর যমুনার কিছু একটা শুনতে পাব বলে ইঞ্জিনের শব্দ আড়াল করে, ইঞ্জিনের প্রবল শব্দ ছাপিয়ে কান পেতে থাকি আর শুনি যমুনা নিঃশব্দে কাঁদছে। যমুনা কাঁদতে শুরু করলে আমি খুব আস্তে শিশিরের শব্দের মত করে সাবধানে দুইহাত তুলে বুকে এনে বাঁধি। আমার কেমন শীত লাগে। হাজার হাজার বছর স্থানুর মত বসে থাকার পর যখন আমি একবার মানুষ হয়ে হাত ভাঁজ করি তখন সম্ভবত যমুনা প্রথমবারের মত কথা বলে, তখন যমুনা বলে যে তার নাম যমুনা। কিন্তু যমুনার কণ্ঠে কোনও কান্না নাই, কোনও অভিযোগ নাই, আবেগ উচ্ছ্বাস কিছুই নাই। সে কেবল আমাকে জানায়।

– আমার নাম যমুনা।
– ও।

সামান্য ও ছাড়া আমার আর কী বলার থাকতে পারে। তখন আমি খুব সাবধানে উঠে নৌকার গলুইয়ে চলে আসি, আরও সাবধানে পা গুটিয়ে বসে হাত ভাঁজ করি। আর তখন ধীরে ধীরে আকাশ ফর্সা হয়ে আসে। কয়েকটা বালিহাঁস সবকিছু পেছনে ফেলে নিরুদ্বেগে উড়ে চলে যায়। ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে তাদের ডানা ঝাপটানো আর যমুনার সাবধানের ফেলা একটা নিশ্বাসের শব্দের মত করে শোনা যায়, ‘আমার নাম যমুনা’। কী অসম্ভব মিষ্টি আর কী অসাধারণ কোমল গলার স্বর। আমার সারা অস্তিত্ব জুড়ে যমুনার কালো শান্ত শীতল জল চোখের জলের মত নিঃশব্দে বয়ে যায়।

– আমার নাম যমুনা।
– ও।

কিংবা হয়ত যমুনা কোনও কথাই বলেনাই। কারণ আমি তখন নিঃশব্দে ছইয়ের ভেতর থেকে ধীর পায়ে নৌকার গলুইয়ে এসে বসি। আর এই পর্যন্ত আসতে প্রায় হাজার বছর পার হয়ে যায়। তখন আমি যমুনার কথা কিংবা যমুনার কালো মসৃণ জল কেটে নৌকা এগিয়ে যাবার শব্দ শুনতে পাই। অথবা যখন প্রবল ইঞ্জিনের শব্দ সমগ্র যমুনার বহুদূরের দুই পারের গ্রামগুলোতে আছড়ে পড়তে পড়তে ভোর হয়ে আসে আর যখন অমোঘ সত্যের মত, বড় লজ্জার মত করে আমাদের বাড়ির ঘাট কাছে এসে নৌকার গলুইয়ে ভিড়ে যায় তখন বশির আর কিরণ মাঝি ব্যস্ত হয়ে কিন্তু ভীষণ নিঃশব্দে নৌকা ঘাটে বাঁধতে থাকে। বাঁধা শেষ হলে তারা নৌকা থেকে মালপত্র নামানোর জন্য ঘর বাহির করতে থাকে। শুধু আমি আর যমুনা বোধহয় কারো নির্দেশের অথবা পরষ্পরের কণ্ঠস্বর প্রথমবার শোনার জন্য অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করতে থাকি।

আমি যমুনাকে বিয়ে করি। আমি বিয়ে করি না, যমুনার সাথে সম্ভবত আমার বিয়ে হয়ে যায়। আমি কোনও কিছু করি না। আমার সব শুধু হয়ে যায়। মা আমাকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে কী কী সব বলেছিল আমার মনে নাই এখন আর। আমার মনে আছে আমি চারখানা কফিলউদ্দীন বিস্কুট রোদে ছড়িয়ে দিয়ে ইছামতীর পারে বসে আছি। আমার মনে আছে, যমুনার জল কেটে আশ্বিনের শীতে আমি নৌকার গলুইয়ে খালিগায়ে বসে নৌকার ইঞ্জিনের প্রচণ্ড একঘেয়ে শব্দে ভীষণ নৈঃশব্দে উত্তর দিকে চলেছি। মা কী বলেছিল তাই আর আজ আমার মনে নাই। মা কেঁদেছিল কি না, আব্বা চায়ের কাপ নিয়ে কোনও চুমুক না দিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় সারাটা দিন থম ধরে বসে ছিল কি না আর আব্বার সেই আগুন গরম চা ক্রমশ তাপ হারিয়ে ঠাণ্ডা শরবত হয়ে গিয়েছিল কি না তাও তাই আজ আর আমার মনে নাই। আমার কিছুই মনে নাই। খালি মনে আছে অনেক রাতে আমাকে আর যমুনাকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিল কিরণ মাঝি আর কিছু একটা বলেছিল, আমি শুনতে পাইনাই। বশির মাঝি বিদায় নিতে এসে করুণমুখে হাসার চেষ্টা করেছিল, আমি দেখতে পাইনাই।

রাত্রে আমি যমুনার জানালা খুলি। আমি জানালার সবগুলো হুক একে একে খুলি। সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে খুলি। সব বোতাম খোলা হলে, জানালার দুই পাট দুই দিকে সরিয়ে দিলে এক দমকা বাতাস আমার মুখে এসে লাগে। আমি চোখ বুজে যমুনার গন্ধ পাই। আমি যমুনার কালো জলে øান করি, হাতড়াই, খুঁজি, আশ্রয় প্রশ্রয় পাই, কে জানে আর কিছু পাই কি না। কেবল শীতলতা। যমুনার জল বড় শীতল। যমুনা বাধা দেয় না। কেবল আশ্রয় দেয়। আমি সেই আশ্রয়ে নিঃশব্দে যমুনায় ডুবে যাই, ডুব দিই। গোপনে, বড় নিঃশব্দে তলিয়ে যাই। গভীর রাতে বাতাসের শব্দের মত এক ফোঁটা করুন শিশির যেভাবে বকুল ফুলের উপর পড়ে, আলগোছে গড়িয়ে ঢুকে পড়ে বকুল ফুলের মাঝখানের গর্তে, গর্ভাধানে, ঠিক ততটা নিঃশব্দে বুক ভরা দম নিয়ে আমি যমুনায় ধীরে ধীরে ডুবে যাই। তখন যমুনা আমাকে নেয়। দম ফুরিয়ে গেলে ভেজা শরীরে আলগোছে ভেসে উঠি, সাবধানে চোখ তুলে তাকাই। তখনও যমুনা আমাকে নেয়। আমি যমুনার চোখ আর সেখানে শীতল শান্ত চোখের জল দেখতে পাই।

আর আমি অবাক হয়ে দেখতে পাই অত ভীড়ের মাঝখানে যমুনা দাঁড়িয়ে আছে। যমুনার গায়ে কিছু নাই। হাত দুইটা শরীরের দুই পাশে নিরাবলম্ব ঝুলছে। যমুনার চোখে গভীর শূন্যতা, যমুনার সেলোয়ার শতছিন্ন, আর অজস্র চোখ যমুনাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে। আর আমি আমার গায়ের ঘামে ভেজা গেঞ্জি খুলে যমুনাকে পরিয়ে দিই। আর আমি খালি গায়ে আশ্বিনের শীতে নৌকার সামনের গলুইয়ে গিয়ে নির্বাপিত হয়ে বসে থাকি, যমুনা অন্ধকার ছইয়ের ভেতর আরও অন্ধকার হয়ে বসে থাকে। বশির আর কিরণ মাঝির হাতের ফাঁক গলে গলে ঝরে পড়ে বিড়ির আগুনের তারাখসা। তারাখসা দেখলে গোপন ইচ্ছার কথা মনে মনে উচ্চারণ করতে হয়। আমি মনে মনে একবার, অন্তত একবার চিলের চোখে যমুনা দেখতে চাই আর তখন যমুনার দুকূল কাঁপানো ইঞ্জিন নৌকার প্রবল শব্দ ছাপিয়ে শিশিরের শব্দের মতো করে ফিসফিস করে যমুনা আমায় নিঃশব্দে বলেÑ

– আমার নাম যমুনা।
– ও।

আমি নিভে যাই। আমার সকল জল নিমেষে উধাও হয়ে যায়। আমার সকল বৈভব ধূলায় লুটিয়ে পড়ে। আমি যমুনার শান্ত জলের শীতল তোড়ে ভেসে যেতে যেতে শুনিÑ

– আমার নাম যমুনা।
– ও।

আর আমি নিভে যাই। যমুনার চারপাশে আলোর আভা ফুটে ওঠে। আজানের আগেই ভোর হয়ে যায়। বশির আর কিরণ মাঝি আমায় নিষেধ করেছিল আর মা পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে কী কী যেন বলেছিল এখন আর আমার মনে নাই আর আব্বা দক্ষিণের বারান্দায় পাটি পেতে শুয়ে সারাদিন ধরে চা ঠাণ্ডা হতে দিয়েছিল। আর বশির ও কিরণ মাঝির নিঃশব্দ ব্যস্ত ঘর বাহির করা দেখতে দেখতে কারো নির্দেশের অপেক্ষায় আমি আর যমুনা মাথা নিচু করে নৌকার ছইয়ের ভেতরে বসে ছিলাম।

আমি বশির আর কিরণ মাঝির নৌকায় আশ্বিনের শীতে রাতভর যমুনার নৈঃশব্দ খান খান করে যমুনা পার হয়ে যমুনা দেখতে দেখতে গোয়ালন্দ যাই। আর বশির ও কিরণ মাঝির হাতের ফাঁক গলে অজস্র তারাখসার মত ঝরে পড়ে বিড়ির আগুন। তারাখসা দেখলে গোপন ইচ্ছার কথা বলতে হয়। আশ্বিনের ভোরে ফজরের আজানের আগে আকাশে ইঞ্জিনের নৌকার প্রবল শব্দ ছাপিয়ে লাল আলোর আভা জেগে উঠলে আমরা গোয়ালন্দ পৌঁছে যাই। তখন যমুনা জানালা খুলে হেসে তাকায়।

– আমার নাম যমুনা।
– ও।

আর আমি আশ্বিনের শীতে হালকা আলোয় খালি গায়ে নৌকার গলুই থেকে যমুনার চোখের জলের মত কালো গভীর শান্ত জলে নেমে যাই। হারিয়ে যাই। হাতড়াই, খুঁজি। আশ্রয় পাই, প্রশ্রয় পাই। যমুনা আমায় আশ্রয় দেয়, প্রশ্রয়ও। আর আমি কেবল যমুনার শীতল শান্ত চোখের মত কালো জলে ডুবে যাই। যমুনা আমাকে নেয় না কিংবা হয়ত আমি যমুনাকে আর নিতে পারি না।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত