ঠিক ছয়টায় টেলিফোনটা বেজে উঠলো।
আমি তখন শাহেদের বিছানার উপর জবুথবু হয়ে বসে আছি। জ্বরগ্রস্ত রোগীর মতো। ডানহাতে একটা গ্লাস ধরা, তার তলানিতে অল্প একটু ভদকা পড়ে আছে। টেলিফোনটা যখন বেজে উঠল তখন আমি শাহেদের বিছানার পাশের টেবিলটায় রাখা চারকোনা ছোট্ট ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ৫:৫৯ থেকে কেবল ৬:০০ হয়ে গেল ঘড়িটায় আর আমাকে চমকে দিয়ে টেলিফোন বাজতে শুরু করল।
এইরকম অদ্ভুত উদ্বেগ মেশানো শব্দ কে তৈরি করেছিল? শুনলেই মনে হয় কোথাও কোন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। ক্রিং… ক্রিং… ক্রিং…। কেমন চাপ পড়ে মাথায়।
আমার বোধহয় গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। উঠে গিয়ে ফোনটা ধরা প্রয়োজন। ফোনটা নিশ্চয়ই শাহেদের জন্য। আমার জন্য হওয়ার কোন কারন নাই। কেউ তো জানেই না আমি এখানে আছি। একমাত্র শাহেদ ফোন করলে আমার উদ্দেশ্যে কলটা আসতে পারে। কিন্তু সে জানে আমি বিকালেই চলে যাবো। আর শাহেদ ফোন করলে আমার মোবাইলেই করতে পারতো। সুতরাং এটা অবশ্যই শাহেদের উদ্দেশ্যে। সে তো চট্টগ্রাম গিয়েছে, আগামী দুইদিনে আর ফিরবে না। যে ফোন করেছে সে শাহেদের মোবাইলে কেন করলো না? ওর মোবাইল কি বন্ধ?
ক্রিং ক্রিং বেজেই চলছে। আমার ফোনটা ধরা উচিৎ। ধরলেই ব্যাখ্যা করতে হবে আমি কে, শাহেদ কোথায় গিয়েছে, কেন গিয়েছে, কবে ফিরবে। কি বিরক্তিকর!
শাহেদ বলে গেছে, ‘এই নে ফ্ল্যাটের চাবি, নিজের মতো করে থাক, কেউ তোরে বিরক্ত করবে না। যাওয়ার আগে চাবিটা নিচের দোকানে রেখে যাস।‘ কিন্তু কেউ একজন বিরক্ত করছে। সে জানে না কাকে বিরক্ত করছে কিন্তু তারপরও করছে।
রিং-এর শব্দ এতোক্ষণে ঘরের বাতাসের সাথে লেগে গেছে। আরে বাবা, কেউ যখন ফোন ধরছে না তখন কেটে দাও। যে কল করেছে তার শাহেদের ফ্ল্যাট সম্পর্কে নিশ্চয়ই কোন ধারনা নাই। এই ছোট্ট এক বেডরুম-এর ফ্ল্যাটের সুদূরতম কোনায় থাকলেও দুই তিন রিং-এর মধ্যে ফোন ধরা সম্ভব, যদি ধরতে চায়। এখনো রিং বেজেই চলেছে। তোমার কি ধারনা এটা বাকিংহাম প্যালেস, অন্য ঘর থেকে এই ঘরে এসে ফোন ধরতে এক ঘন্টা লাগবে? অসহ্য!
এতোক্ষণে তো বোঝা উচিৎ যে এখানে কেউ নাই। তা না, সে কেটে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আবার ফোন করছে। মাঝখানের বিরতিটুকু বোঝার উপায় নাই পর্যন্ত। এতোক্ষণ ধরে ফোন করে যাওয়ার অর্থ কি? অ্যাবসার্ড!
কয়বার রিং হচ্ছে আমার গোণা উচিৎ। ধরি দশবার রিং হয়েছে এতোক্ষণ পর্যন্ত । এগারো… বারো…।
এটা অবশ্য ভাবা ঠিক হলো না যে তার বোঝা উচিৎ এখানে কেউ নাই। আমি তো আসলে আছি। সে যদি কোন বিচিত্র উপায়ে জেনেও থাকে যে এখানে আমি আছি তাহলে এতক্ষণ রিং বাজার পরও কেউ ফোন উঠায় নি বলে তার ধরে নেওয়া উচিৎ আমি আর এখানে নাই। সতেরো… আঠারো…।
শাহেদের বিছানায় আমি বসে আছি আর ফোনটা ধরছি না এটা নিশ্চয়ই সে ভাবছে না। সে যদি ভেবে থাকে যে কেউ একজন বিছানায় বসে বসে ভদকা গিলছে কিন্তু উঠে গিয়ে ফোন ধরছে না তাহলে সেই কেউ একজনটা শাহেদ, আমি না।
বাইশ.. তেইশ..। এরকম অক্লান্তভাবে ফোন করে যাওয়ার অন্য কোন অর্থও থাকতে পারে। হয়তো এটা কোন কোড। তিথির সংগে এমন কোড সিস্টেম ছিল। তিনটা মিসকল মানে আমি তোমার হলের সামনে আছি, বের হও। তখন তিথি দুই মিসকল দিলে তার মানে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। তিন মিসকল মানে আসছি তবে একটু দেরি হবে। আর পাঁচ মিসকল বড়োই নির্মম- আসতে পারবো না এখন, চলে যাও।
ছাব্বিশ… সাতাশ…। হতে পারে এটা নাফিসা। শাহেদের ড্রয়ারে যার ছবি আছে- স্মৃতিসৌধ পেছনে রেখে তার কোমর জড়িয়ে ধরে শাহেদ দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। ছবির পেছনে লেখা- অনেকগুলা উমমমমম… নাফিসা। কি হাস্যকর! হতে পারে প্রতিদিন ঠিক ছয়টায় নাফিসার শাহেদকে ফোন করার কথা। শাহেদ সেই ফোন ধরবে না। যতবার রিং হবে তার একটা মানে আছে- যেটা শুধু সে আর শাহেদ জানে।
উনত্রিশ.. তিরিশ। তিরিশ! তিরিশে থেমে গেল। তিরিশটা সম্ভাব্য মেসেজ, যার মানে শুধু শাহেদ আর নাফিসা জানে!
ধুর, শাহেদের মোবাইলে মিসকল দিয়েই তো এরকম মেসেজ দিতে পারে। আর এখন তো আর কলরেটও এমন কিছু না।
স্তব্ধ। স্তব্ধ। হঠাৎ যেন পৃথিবীটাই থেমে গেল। সবকিছু কেমন শূণ্য হয়ে গেল।
আমার ফোনটা ধরা প্রয়োজন ছিল। হয়তো খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমি হারিয়ে ফেললাম। হয়তো রং নাম্বারে ডায়াল করেছিল কোন সুন্দরী মেয়ে, হয় তো তার সাথে আমার অনেক কথা হতো। হয় তো একদিন দেখা হতো। হয়তো একসময় আমি তার কোমর জড়িয়ে ধরে স্মৃতিসৌধের সামনে ছবি তুলতাম।
গ্লাস হাতে অসহায় চোখে আমি আবার চারকোনা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকি। কোথাও কোন শব্দ নাই। এমনকি এই ডিজিটাল ঘড়িটাও টিক টিক করে না।
ঠিক ছয়টা তিরিশে আবার ফোনটা বেজে উঠলো।
আমি কি ফোনটা ধরবো? ধরার পর যদি জানতে চায় আমি কেন এতোক্ষণ ফোন ধরি নাই তখন কি জবাব দিবো? আসলেই তো- কি কারণে ধরি নাই? কেন? কেন?
বিপন্ন হাতে আমি শূণ্য গ্লাসটিতে আরেকটু ভদকা ঢালি।