কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে কক্সবাজার হোটেলে ফিরে একটুও জিরিয়ে নেয়ার সময় পায় না লামিয়া। প্রথমে দিনের রিপোর্টটা তাকে মেইল করে অফিসে পাঠাতে হয়। তারপর গোসল করে, খেয়ে, সব গুছিয়ে নিতে নিতে সন্ধ্যা। রাতের বাসটা তাকে ধরতেই হবে। এই রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সে আর সময় কাটাতে চায় না। অফিসে বলে তাই একদিন আগে ট্যুর শেষ করে নিয়েছে। কাজ যা হওয়ার তা এর মধ্যে হয়ে গেছে। রিপিটেশনের জন্য আরও একটা দিন থাকার কোনো মানে নাই। রোহিঙ্গা নারীদের সমস্যার অন্ত নাই, আবার এমন কোনো সমস্যা নাই যা তাদের জন্য আলাদা। খুন, ধর্ষণ, উচ্ছেদ, প্রেগন্যান্সি জটিলতা–এসবই তো! এগুলো তাবত দুনিয়ার নারীদের সংকট। আর বিপর্যয়ের মাত্রা যত ভয়াবহ হোক সমাধানের একটাই উপায়–এনজিও পরামর্শ। সে জন্য একদিন বেশি কক্সবাজার থাকাটা অর্থহীন। তা ছাড়া এসব অসহ্য, পরাজিত, বিপর্যস্ত নারীমুখ আর দেখতে চায় না লামিয়া।
অফিসে অবশ্য লামিয়া যা বলে তা হয়। এবারও একদিন আগে ঢাকায় ফিরে যেতে তার সমস্যা হলো না। আরমান সাহেব সঙ্গে সঙ্গেই রাজি। একদিন আগে ঢাকা ফিরে যাওয়া নিয়ে তাই লামিয়া চিন্তিত না। ওর চিন্তা শর্মীকে নিয়ে। শর্মীর কী হলো? দুদিন কোনো ফোন করে নাই সে। অথচ এগার দিনের ট্যুরের প্রথম কিছুদিন; প্রতিদিন তো বটেই সকাল, দুপুর করে ফোন করেছে শর্মী লামিয়াকে। অফিসের কী হচ্ছে, ঢাকায় কী হচ্ছে, শাহবাগে কারা ঘোট পাকাচ্ছে, মাসুদ কী করছে, কী বলছে–সব আপডেট শর্মীর কাছ থেকে নগদে পেয়ে যেত লামিয়া। তাদের বন্ধুত্ব তো আজ কম করে হলেও সাত বছরের। এই দীর্ঘ সময়ে দুজনের সম্পর্কের মধ্যে এতটুকু চীড় ধরে নাই। কী অফিসে, রাজপথে, সংসারে।
শর্মীর অবশ্য সংসার নাই, লামিয়ার আছে। তিন বছর হলো সে নির্ঝরকে বিয়ে করেছে। তাদের স্বচ্ছল সংসার। শর্মী প্রেম নিয়ে জটিলতায় আছে, সেসবও লামিয়ার জানা আর এ নিয়ে কোনো সংকট হুট করে যদি এখন তৈরি হয় তাহলেও এভাবে যোগাযোগ বন্ধ থাকার কথা না তাদের। আসলে দুদিন না, তিন দিন হলো তাদের যোগাযোগ বন্ধ বলতে হবে। শেষ যেবার লামিয়া ফোন করেছিল তখন শর্মীর গলাটা ছিল খুব ধাতব, ঠাণ্ডা। এতটুকু জায়গা যেন সেখানে লামিয়ার জন্য ছিল না। এতে লামিয়া অবাক হয়েছে। তার বুঝতে বাকি নাই যে কিছু একটা হয়েছে, কিছু একটা লামিয়া ঘটিয়েছে। যে কোনো ঘটনায় প্রথমে নিজেকে দায়ী ভাবতে শুরু করে লামিয়া। তারপর অন্যদের দোষ দেয়। শর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধের পর ব্যাপারটা আরো বেশি কাজ করছে তার ভেতর।
তাইলে কি মাসুদের জন্য এত কিছু? কিন্তু মাসুদ বিষয়ে লামিয়া আর শর্মীর অবজারভেশন তো একই।
মাসুদের চাকরি বোধহয় চলে গেছে। এটা লামিয়ার চাওয়া ছিল। আরমান সাহেবকে সে মাসুদের বিরুদ্ধে বলেছে। তাতে ওই ছেলের চাকরি চলে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যাপারটা তো ঘটেছে লামিয়া ঢাকার বাইরে থাকার সময়। এতে তাকে নিয়ে সন্দেহ সরাসারি করার সুযোগ কই! মাসুদকে নিয়ে এ কয়দিনে অফিসে কিছু হয়েছে কি না সেটা নিয়ে লামিয়া মনে মনে খুব উদ্বিগ্ন থাকলেও কাউকে আর ফোন করে নাই, শর্মীর কাছেও জানতে চায় নাই। সে একটু সতর্ক থাকতে, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে। আগ্রহ দেখালে যে সন্দেহটা তার ওপর পড়তে পারে সেটা ভেবে লামিয়া কাউকে এ বিষয় নিয়ে ফোন করে নাই। এর ফলে যা হয়েছে, অনেকটা না জানার মধ্যে সে রয়ে গেছে এবং শর্মীরও আর ফোন না করার বিষয়টা তাকে অস্থির করে তুলছে।
এরকম উদ্বেগ নিয়ে কক্সবাজারে আরো একদিন থেকে যাওয়ার মেয়ে লামিয়া না। সে একটু সেন্সিটিভ। সহজে কিছু তার হজম হয় না। এ কয়দিন কক্সবাজার থেকে তার শরীর, চেহারা, চুলের অবস্থা খুব খারাপ। ঢাকায় ফিরেও শুয়ে-বসে কাটানোর সুযোগ নাই। আরমান সাহেব বলে দিয়েছেন একটা এনজিওর গোলটেবিলে তাকে ঢাকায় পৌঁছেই অ্যাটেন্ড করতে হবে। এ জন্য হয়তো তার ট্যুর একদিন আগে শেষ করার সিদ্ধান্ত নিতে তার সমস্যা হয় নাই। আবার এই ডিসিশানটাও ভাবার বিষয়। বাইরের বিষয়গুলো সাধারণত শর্মী দেখে। ওর পরিচিতি বেশি, কিছুটা স্ট্যার ভ্যালু যাকে বলে সেটা তার আছে। লামিয়া অফিসের কাজগুলো বেশি করে। গোলটেবিলে সাধারণত শর্মীর যাওয়ার কথা। তাহলে কী সে ছুটি নিয়েছে, অসুস্থ? সেটা জানারও সুযোগ নাই। কারণ লামিয়া দুবার ফোন দিলেও শর্মী ধরে নাই, কলব্যাকও করে নাই। ফেসবুকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সারাক্ষণ স্ট্যাটাস দিয়ে যাওয়া শর্মী একদম অফ, চ্যাট লাইনেও নাই। কী যে ঘটে গেছে তা লামিয়ার বুঝেই আসছে না।
এ কয়দিন তাই নির্ঝরের সঙ্গে কথা বলেছে বেশি। তারা এবার একটা বাচ্চা নিয়ে নেবে বলে ভাবছে। তার আগে ডাক্তার দেখাবে। ল্যাবএইডে মরিয়ম নামে একজন নাকি আছে ভালো গাইনির ডাক্তার। তাকে একবার দেখিয়ে নিয়ে কাজে নেমে পড়বে। এ নিয়ে হাসাহাসি হলো তাদের। কোথায় গিয়ে কনসিভ করলে ভালো তার আলাপও হয়েছে। লামিয়ার পছন্দ পাহাড়, নির্ঝরের সমুদ্র। সে বলেছে থাইল্যান্ড দ্বীপে নিয়ে যাবে। অবশ্য বাচ্চার জন্ম তারা ওয়েস্ট ওয়ার্ল্ডে দেবে বলে ভাবছে। এসব আলাপ শেষ হলে লামিয়া রোহিঙ্গাদের দূরাবস্থার কথা শুনিয়েছে। এমন নির্মম হতে পারে মানুষের দশা তা সে ভেবে উঠতে পারছে না এতদিন থাকার পরও। বহু বিভৎসতার ঘটনা সে শুনেছে তাদের মুখে! লামিয়ার শুধু মনে হয়েছে এ কী করে সম্ভব। কুকুর-শেয়ালের সঙ্গেও মানুষ এসব করে না মিয়ানমার সেনাবাহিনী যা করেছে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে। আর চরম একটা অসভ্য অবস্থা প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখার নার্ভ লামিয়ার নাই। সে আর কোনোদিন রোহিঙ্গাদের প্রজেক্টে আসবে না। অন্য প্রজেক্টে যাবে, পাহাড়ে গিয়ে মশার কামড় খাবে, দরকার হয় পাহাড় বাইবে, দুর্গম চরে গিয়ে বসে থাকবে–বাট নট হিয়ার এনিমোর। কথা আর ফুরায় না যেন নির্ঝরের সঙ্গে লামিয়ার।
‘বুঝছ নির্ঝর এক রোহিঙ্গা পরিবার করছে কী, নিজেরা স্বামী-স্ত্রী নাম দিয়ে একটা রিলিফ কার্ড তো নিছেই আবার নিজেদের ছেলে আর মেয়েকে স্বামী-স্ত্রী দেখায়া আরো একটা রিলিফ কার্ড নিছে। একটা দিয়ে খাচ্ছে আরেকটা বিক্রি করে দিচ্ছে। হাউ শ্যাভেজ দে আর, ইউ কান্ট জাস্ট ইমাজিন’।
নির্ঝরও এসব শুনে অবাক হয়। দুজনে তারা রোহিঙ্গাদের জন্য কষ্ট অনুভব করে আবার ফিরে আসে নিজেদের নেক্সট থিম্পু ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যানে। সেখান থেকে এসেই ডাক্তার দেখাবে ঠিক করেছে।
তবে এতসব কথার মধ্যেও শর্মীর চিন্তা ভুলতে পারছে না লামিয়া। তার মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে বড় কোনো বিপদ তো আর ঘটে নাই, শর্মী হাসপাতালে–এরকম কিছু। নাহ, তাহলে তো ফেসবুকে খবর হয়ে যেত। শর্মী যে রকম পপুলার! তার ছায়ার নিচে লামিয়া থাকতে পছন্দ করত সামাজিকভাবে। শাহবাগে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে শর্মী সবসময় বক্তৃতা দিয়েছে, মানবন্ধনে সামনের সারিতে দাঁড়িয়েছে। আর যখন গণজাগরণ মঞ্চ হলো, শর্মী তো নাওয়া-খাওয়া ভুলে সেখানে দিনাতিপত করত। অফিস থেকে এসব বিষয়ে তাদের ছাড় দেওয়ার সুব্যবস্থা আছে। শর্মীর জন্য আরো বেশি ছাড় থাকত। সে অনেকটা পাবলিক রিলেশনসের ভূমিকাটা মুফতে পালন করত অফিসের হয়ে। তা শর্মীর জন্য তখন কাপড়, খাবার এসব কী দিনের পর দিন লামিয়া নিয়ে যায় নাই। শর্মীর সঙ্গে সে কী দুই-এক রাত থাকেও নাই রাস্তায়, এই শর্মীর সঙ্গে কী তার আজকের দিনের সম্পর্ক! এভাবে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ার কী মানে আছে? এটা কী অপমান করতে চাওয়া না?
আবার লামিয়া নিজের কোনো দোষ বিষয়েও ভাবে। মাসুদের নামে নালিশ করাটা কি তাইলে ঠিক হয় নাই? কিন্তু ও তো মৌলবাদী, হেফাজতে ইসলামের লোক। তাদের অফিসের জন্য এরকম একজন কর্মী ক্ষতিকর। তাদের রেপুটেশন নষ্ট হয়। সে ফেসবুকে যেসব স্ট্যাটাস দেয় তাতে অফিসের বদনাম হয়। ডোনেশনেও যে টান পড়বে না তা কে বলতে পারে! এখন অনেক ছোট বিষয়কেই ডোনাররা, ডেলিগেটরা গুরুত্ব দিয়ে দেখে।
যে কারণে মাসুদ বিষয়ে লামিয়া নিজের রাগ বা ব্যক্তিগত জায়গা থেকে এসব বলে নাই আরমান সাহেবকে। সে অফিসের ভালোর জন্য বলেছে। শর্মীকেও কত লোক কত কিছু বলত মাসুদ বিষয়ে। তখন সেও তাল দিত তাদের সঙ্গে। মাসুদকে নিয়ে তাদের দুজনের কী কম কথা হয়েছে! মাসুদকে শর্মী হুমকি পর্যন্ত দিয়ছে উল্টাপাল্টা কথা বলার জন্য। বরং লামিয়ার সঙ্গে তার তেমন বিতণ্ডা হয় নাই শুরুতে। পরে দু-একবার শুধু তর্ক হয়েছে।
তাদের অফিসের পেছনে ওই শ্যামলীর ছোট্ট পার্কটার পাশে যেখানে মাঝে মাঝে তারা বসে, সেখানে কয়েকবার কথা হয়েছে। একবার খুব উত্তেজনাপূর্ণ কথাও হয়েছে তাদের। এরপর আরও একবার। তখন থেকে চটে ছিল লামিয়া। এরকম একটা বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা ছেলে মৌলবাদী সংগঠনকে সমর্থন করবে, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে প্রশ্ন করবে–ভাবাই যায় না।
একটা সময়ে লামিয়ার দেশ-জাতি এসব নিয়ে খুব চিন্তা ছিল তা না। শর্মী তাকে উদ্বুদ্ধ করত এসব নিয়ে কিছু করতে। ইডেন থেকে লামিয়া পাশ করার পর এই চাকরিতে জয়েন করেছে বোধহয় ছয় বছর হলো। শর্মী এসেছে নরসিংদী থেকে। সে আগে কয়েকবছর সাংবাদিকতা করেছে। শাহবাগের সার্কেলেই লামিয়ার সঙ্গে শর্মীর পরিচয়। বেশ ছিমছাম, ছটফটে মেয়ে। আড্ডার ভেতর কীভাবে যেন শর্মী কেন্দ্র হয়ে উঠত। খাতিরও করতে পারত সহজে। এভাবে এভাবে লামিয়ার সঙ্গে সখ্য। তারপর এখনকার হাউজে লামিয়ার হাত ধরেই শর্মী চাকরি পেল। যদিও তার যোগ্যতা ছিল। কিন্তু যোগ্যতাই কী সব?
তাদের এ হাউজটা গড়ে ওঠার পেছনে লামিয়ার বাবার অবদান আছে। তার বাবা সচিব ছিলেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। বাবার বন্ধুর ছেলে আরমান বিদেশ থেকে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি মেকিং এসব বিষয়ে পড়াশোনা করে এসেছিল। তার ইনেশিয়েটিভ এ ফার্ম। বাবা বলেছিলেন লামিয়া যদি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পায় তাহলে ফার্মটা তিনি পাস করায়ে দেবেন। বেকার না বসে থেকে লামিয়াও জয়েন করে ফেলে ফার্মটায়। কথায় কথায় শর্মী বিষয়টা জানতে পারে। সেও লামিয়াদের সঙ্গে জয়েন করে।
শর্মী জয়েন করবে শুনে লামিয়াও আর অন্য কিছু ভাবে নাই। সেও ভাবল চাকরি করলে নিজেকে এফিশিয়েন্ট ভাবতে পারবে সে। নইলে হয়তো নির্ঝরের সঙ্গে বিয়ের আগে প্রেম, বিয়ের পরেও প্রেম, ঘুরাঘুরি, খাইদাই–এসব করে তার দিন কেটে যেত। তা ছাড়া লামিয়ার দুই ভাই থাকে বিদেশে। পরে হয়তো সেও চলে যেত। কিন্তু সেখানে না গিয়ে শর্মীর মোহে পড়ে অনেকটা সে সেই যে চাকরিতে ঢুকল আর বের হতে পারল না। নির্ঝর ছাড়া লামিয়ার জীবনে যা যা কিছু ঘটেছে তা শর্মীর কারণে। সে রাজনীতি করতে ও বুঝতে শিখেছে। তা ছাড়া গণজাগরণের তখন যে অবস্থা ছিল, সারাক্ষণ টিভিতে দেখাচ্ছিল, চারদিকে আলোচনা হচ্ছিল–ব্লগাদের মেরে ফেলছিল, মেয়েদের ঘরে বাইরে আনা যাবে না বলে হেফাজত নেমে গেল। কত কী যে ঘটনা, এসব সময়ে চুপ করে থাকাটাও সম্ভব ছিল না প্রায়। তারপর অফিসও তো চাইছিল এগুলোর রিপোর্ট যেন লামিয়া দেয় ঠিকঠাক মতো। সব মিলিয়ে সেই যে সে কী একটা উত্তেজনাকর দিন পার করছিল। পরে বুঝল সে পাল্টে গেছে। চুপচাপ স্বভাবের বাবার দুলালী মেয়েটা এখন তর্ক করতে পারে। মেয়েরা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবে এসব নিয়ে ফেসবুকে লিখছে। নিজের ঘুরাঘারির ছবি তুলে তুলে ফেসবুকে দিচ্ছে। এরকম কোনো সময়েই মাসুদের সঙ্গে তার তর্কের শুরু হচ্ছিল বোধহয়। কিন্তু সেদিন মাসুদ একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল।
ছেলেটা অফিসে ওর নিচের পোস্টে কাজ করে, বেতন কম পায়। শর্মী আর লামিয়া ফ্রি বলে তার সঙ্গে আলাপ করে। ছেলেটার কথা হলো, ‘মেয়েরা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনকে সমাজের জন্য আদর্শ হিসাবে হাজির করে।’ লামিয়া খুব ক্ষেপে গিয়ছিল–
‘ব্যক্তিগত জীবন মানে, জীবন কী সমষ্টিগত হয় নাকি। আমি আমার মতো জীবন-যাপন করলে কেউ কেন বাধা দিতে আসবে’।
‘বিষয়টা বাধারযোগ্য কি না সেটা পরে। আগে তো বলুন যে একজন ব্যক্তির জীবন আদর্শ হিসাবে সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক কি না। কেউ যদি চায় সে ঘরের মধ্যেই থাকবে। বের হওয়ার স্বাধীনতা যেমন থাকবে, ঘরে বসে থাকার, পর্দা করার স্বাধীনতাও থাকতে হবে’।
‘পর্দা আবার স্বাধীনতা হলো কীভাবে? ওটা তো পরাধীনতা, মেয়েদের ভুল বুঝিয়ে এসব করানো হচ্ছে। আমাদের দায়িত্ব থাকবে না একটা’?
‘দায়িত্ব আপনি হয়তো নিয়েছেন কিন্তু আমার তেমন গরজ নাই। আপনি যে জায়গা থেকে কথাটা বলছেন এসব সমস্যার সমাধান সমাজে আগেই ঘটে গেছে। মিডলক্লাস বা আপার মিডলক্লাসের সমস্যাকে সবার সমস্যা হিসাবে দেখান তো ঠিক না। তা ছাড়া দেখুন…’
‘না না, শুনুন মাসুদ। আপনি কী বলতে চাইছেন, এদেশে মেয়েরা লাঞ্ছিত হচ্ছে না। তাদের আটকে রাখা হচ্ছে না। হেফাজত বলছে না মেয়েদের আটকে রাখতে, ওরা ফাঁসি চাইছে না’।
‘ফাঁসি তো গণজাগরণও চেয়েছে’।
‘সেই ফাঁসি আর এই ফাঁসি কী এক হলো? আপনি কিন্তু এঁড়ে তর্ক করছেন। কথার পিঠে কথা বলে তর্ক চালিয়ে যাওয়াটা কিন্তু খুব বাজে অভ্যাস’।
‘আমি বলতে চাইছি…’
‘হ্যাঁ আপনার বলতে চাওয়া আমি বুঝেছি। আপনি জানেন যে আমাদের অফিস কেমন, আপনি তারপরও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে যাচ্ছেন। এগুলা কেউ কখনো খেয়াল করলে আপনার সমস্যা হবে না’?
‘অফিস আর আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস দুটা তো আলাদা জায়গা’।
‘না আপনি পড়ে আছেন আগের যুগে। করপোরেট ওয়ার্ল্ড ডাজনট বদার ইউ টু ডু সাচ অ্যা থিং, ইউ নো। আপনি অফিসে যেভাবে চলেন, ফেসবুকেও সেভাবে চলবেন। অনেক অফিস এসব মেনটেন করে’।
কথা সেদিন আর হয়নি বোধহয়। কিন্তু মাসুদ কথাগুলো কেমনভাবে নিল কে জানে? লামিয়া এতটা রেগে গিয়ে কথা বলে নাই আগে কখনো। আর অফিসের সিনিয়র যখন কিছু বলেন সেটা আদেশ মিশ্রিত–এই কাণ্ডজ্ঞানও মাসুদের আছে কি না কে জানে? এসব ক্যালাস ছেলে নিয়ে সমস্যা। বিষয়টা শর্মীকেও জানান হয়েছিল। শর্মী হেসে ঠিক করেছিস বলে আর কথা বাড়ায়নি।
এরপর আবার একদিন কথা হলো কী নিয়ে যেন, ও নারীবাদ। তার কথা হলো, নারীবাদীরা সবসময় ক্ষমতার সঙ্গে জুড়ে থাকে। কিছু অংশের অক্ষম পুরুষদের বিরুদ্ধে পাওয়ারকে ব্যবহার করে তারা গোটা সমাজে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। ছেলেটার কথা হলো, কিছু অংশের আপার মিডলক্লাস মেয়েদের হাতে নারীবাদ জিম্মি। সেই তার এক কথা, এদের ব্যক্তিগত জীবনকে নাকি আদর্শ হিসাবে হাজির করে নারীবাদীরা সমাজে গোষ্ঠী বা পরিবারের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। লামিয়া এগুলো একদম সহ্য করতে পারে না। সহজ হিসাব মেয়েরা নিপীড়িত, অত্যাচারিত, তাদের মুক্তি দরকার। সেখানে এসব আউলা যুক্তি ডেকে এনে মেয়েদের আরো বিপদে ফেলাটা খারাপ পদ্ধতি। শেষ যেবার তর্ক হলো তারপর আসলে আর স্থির থাকতে পারে নাই লামিয়া। আরমান সাহেবকে সব বলে দিয়েছে। বলেছে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে অফিসের পরিবেশ নষ্ট হবে। আমাদের একজন কর্মী বাইরে এসব বলে বেড়ালে প্রতিষ্ঠানেরই ক্ষতি হবে। নানা লোক নানা কিছু বলবে। আরমান সাহেব যদি মুখের কথায় কাজ না করেন তাহলে লিখিত অভিযোগ দেবে লামিয়া।
মাসুদের সঙ্গে সেদিন আসলে খুব ক্ষেপেছিল লামিয়া। শুরুতে যদিও সে হেসে হেসেই কথা বলছিল। এর আগেও সে ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ নিয়ে বলল এটা তো পুঁজিবাদের সংকট। আধুনিকতার সংকট। সে পুরুষদের কোনো দোষ দেখতে পায় না। ছেলেটার সঙ্গে বোধহয় এ জন্য কোনো মেয়ে ঘোরে না।
সে বলে এটা নাকি ক্লাস কনট্রাস্ট।
‘আপনি যে পোশাক পরেন তা অফিসের পিওনটার কাছে খুব অ্যাট্রাকটিভ হয়। সেক্সুয়ালি অ্যারাউজড হতে পারে সে। যাই পরেন না কেন, সেটা দামি, তার সাধ্যের বাইরে। তার ওই পোশাক বা আপনার মতো সুন্দর-সুশোভিত শরীরের প্রতি একটা অ্যাপাথি তৈরি হয়। আপনি তার কাছে যান না, তার সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। কেন আখতারুজ্জামা ইলিয়াস যখন ‘কীটনাশকের কীর্তি’ দিয়ে ছোটলোকের ছেলেকে ইউজ করে বড়লোকের মেয়ের প্রতি সেক্সুয়াল রিভেঞ্জ নিতে যায়, সেটাকে তো খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করা হয়। আপনারা কী যান ওদের কাছে, খবর নেন, ক্লাসের গরিমা ভাঙতে পারেন? ফলে সোসাইটিতে এগুলা থাকবে, ক্লাস স্ট্রাগল ছাড়া কমবে না। সমাজ যত ট্যাবুর মধ্যে থাকবে তত এসব ঘটবে। মেয়েরা যা করে সে হলো লেমেনটেশন, বিলাপ। এটা নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবা হয় না, আলাপ হয় না। কথাও তো বলা যায় না এসব বেশিরভাগ মেয়ের সঙ্গে। নারীবাদীরা যা করে তা হলো পুলিশিং, ওরা খালি চ্যাটাং চ্যাটাং মারায়।’
কী সব বলে, মোটেও পছন্দ হয় না। ভয়ংকর মনে হয় মাসুদকে লামিয়ার, জঙ্গি মনে হয়। এসবের মধ্যে তো লামিয়ার থাকার কথা ছিল না। সে সারাদিন ঘুমাত, বিকালে সোনারগাঁওয়ে সুইমিংয়ে যেত, সন্ধ্যায় এখানে-সেখানে ঘুরে রাতে বাসায়। সকালে টোস্ট, মাশরুম, সসেজ, কফি এসব দিয় নাশতা করতো। সামারে ঘুরে আসবে ইউরোপ, চাচার বাড়ি মাধবপুর। তার তো এখানে এসব মিন মাইন্ডেড ক্লাসের সঙ্গে থাকার কথা না। যদি তারা কথাটা শুনে চলত, মানত, ফলো করত তাও একটা কথা থাকত। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এক দৈব নিয়ে লামিয়ার মতো মেয়ে এসব চামার ছেলের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করছে! রাগটা তার কত গভীর তা বলে বুঝানো যাবে না। তার মুখের ওপর ‘মারায়’ শব্দটা ইউজ করবে, এটা সে জীবনেও ভাবতে পারে নাই।
তা ছাড়া কতটা ইললজিক্যাল ছেলেটা। নিজেদের শ্রেণির মধ্যে কী যৌননিগ্রহ হয় না, মেয়েরা অপদস্থ হয় না! বুক টিপে দেয় না ছেলেরা যখনই সুযোগ পায়? তখন কী হবে ওর শ্রেণিতত্ত্বের। পয়সাওয়ালাদর ক্লাসে তো পারভারসন আরো বেশি। ইয়ং মেয়েরা, ছেলেরাও বটে পারভারসনের স্বীকার হয়। লামিয়ার জীবনে এ অভিজ্ঞতা নাই। তার আরেক বান্ধবী সুমী তার জীবনে আছে। সে অবশ্য বিষয়টাকে হালকাভাবে নিয়ে নিয়েছে এতদিনে। সুমিরও অনেক ছেলের সঙ্গে শোয়ার ঘটনা আছে। পরপুরুষ তার শরীরের কোথাও হাত দিলে সে হয়ত চড় দিয়ে দেয়। একবার পুঁচকে এক ছেলেকে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী হয় শুধু হাত দিয়ে? আর কিছু করতে চাস তুই?’ ছেলেটা নাকি পা ধরে মাফ চেয়েছিল। এমন কত ঘটনা এ শহরে। কিন্তু তাই বলে এখানে শ্রেণি ডেকে এনে বিষয়টাকে জাস্টিফাই করার কী আছে!
এসবও সহ্য হচ্ছিল। কিন্তু হুট করে ছেলেটা বলতে গেলে সেদিন বেয়াদপিই করল। লামিয়া বলছিল হেফাজতের কথা, হেফাজত এখন কেমন সরকারেরর সঙ্গে খাতির রেখে চলছে। কোথায় গেল তাদের এতদিনের নৈতিকতা, সরকার বিরোধিতা। মাসুদ বলে কী, ‘আপনি তো হেফাজতবিরোধী, আপনার তো এতে খুশি হওয়ার কথা। একদল মানুষ যদি নিজের আগের কথায় ঠিক থাকতে না পারে, আর সে যদি আপনার বিরোধীপক্ষ হওয়ার পরও আপনার দলেই যোগ দেয়, তাহলে আপনি জিতলেন না?’
‘আমি তো বলছি আপনার কথা। আপনি হেরে গেলেন না? এখন আপনার কী হবে’।
‘আমি তো হেরেই আছি। আপনারা লাগাতার জিতে চলেছেন। যাদের সমালোচনা এতদিন করে এসেছেন, তারা নিজেদের শুধরে নিয়ে আপনাদের দলে যোগ দেওয়ার পরও আপনারা না জিতে থাকছেন কীভাবে? আগেরবারও তাদের সঙ্গে জিতেছিলেন তাদের ঢাকা ছাড়া করে। এবার জিতলেন ঢাকায় এনে। একই জেতাকে আপনারা কয়বার করে জিততে চান। যারা হেরেই আছে তাদের আবার হারাতে চান? এটাকে কী বলা যায়, মানসিক সংকট? কোনও জেতায় পরিপূর্ণ জেতার তৃপ্তি আসছে না, নাকি অন্য কিছু?’
এ ছেলের সঙ্গে তর্কে যাওয়া বৃথা। খুব বেয়াড়াটাইপ। কী বলে সবসময় তা বোঝাও যায় না। কোথাও হয়ত তার অভিমান আছে, কে জানে। কিন্তু সে শাউট করেছিল সেদিন। যা করাটা ঠিক না। এটা মানতে পারে নাই লামিয়া। এরপর আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে আসাটা অশোভন হলেও সে চলে এসেছিল। এভাবে মানসিক অবস্থা নিয়ে একজন সিনিয়রকে প্রশ্ন করাটা কী তার ঠিক হলো?
আর সে তো লামিয়ার নির্দেশও শোনেনি ফেসবুকে পোস্ট দিয়েই যাচ্ছে। হেফাজতের ‘তেঁতুল তত্ত্ব’ও সে কীভাবে যেন জাস্টিফাই করল। এরপর যত বুদ্ধিজীবী আছে গণজাগরণ মঞ্চের সময় বিরোধিতা করেছিল, তাদের সঙ্গে ছবি দিচ্ছে, তাদের লেখা শেয়ার দিচ্ছে, তাদের যুক্তিকে যুক্তি হিসাবে হাজির করছে। জঙ্গি হামলায় বড়লোকের ছেলেদের সম্পৃক্ততা নাকি আধুনিকতারই আরেক সংকটের নাম–এসব লিখে যাচ্ছে। তার সামনে কোনো কথা নিয়ে দাঁড়ালেই উল্টাটা শোনাবে। লামিয়ার সঙ্গে মাসুদের মতের মিল হবে না কোনোদিন। অফিসের জন্য এসব কাজ খুব খারাপ হচ্ছে। তাই আরমান সাহেবকে অভিযোগ করেছিল। তখনো রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ট্যুরের প্রোগ্রামটা ঠিক হয় নাই। এরপর এখানে কক্সবাজার এসে তিন দিন আগে মেহজাবিন মেসেজ করল শুধু ফেসবুকে যে ‘মাসুদ কি আর থাকছে না?’। লামিয়া মেসেজটা সিন করে নাই। একটা লাইন তো ফলে সে পড়ে নিতে পেরেছে। তার অভিযোগ যে কাজে লেগেছে সেটা বুঝার জন্য এটুক মেসেজই যথেষ্ট। এর বেশি আগ্রহ না দেখানোই নিরাপদ। মাসুদ ছেলেটা যদি জেনে যায়, তাহলে লামিয়ার খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে।
তবে তারচেয়ে খারাপ হলো মেহজাবিনের ওই মেসেজের পর থেকে শর্মীও যোগাযোগ রাখছে না।
২.
বাস ছুটে চলেছে রাত কেটে। অর্ক মুখার্জির গান শুনছে লামিয়া চোখ বুজে। শরীরটা অবশ হয় আছে। মাথায় চিন্তার জট। গান শুনে সেটা কিছুটা কাটানোর চেষ্টা। অর্কর গান ইদানিং তার খুব ভালো লাগছে। গলা বেশ খেলাতে পারে সে। হানি সিং-এর গান আবার তেমন ভালো লাগছে না। মাঝখানে কিছুদিন আবিদা পারভীন শুনেছে। সুফি ধারার গানগুলো বেশি জনপ্রিয়। সেগুলো শুনতে লামিয়ার ভালো লাগে। এর আগে পিংক ফ্লয়েড শুনত, ইগলস শুনত। বয়সের সঙ্গে বোধহয় গানের রুচির পরিবর্তন আসে।
বাস কতদূর আগাল কে জানে? অনেক দূর কক্সবাজার থেকে ঢাকা। প্লেনে যাওয়া যেত, কিন্তু রাতে ফ্লাইট নাই। রাতে ফ্লাই করতেও চায় না সে। বাসই ভরসা। তেমন কিছু খায়ও নাই এর মধ্যে। বাস কোথাও থামলে রুটি আর সবজি খেয়ে নেবে। পথে নির্ঝরের সঙ্গে কয়েকবার কথা হয়েছে। ও একটা বিজনেস হাউজে কাজ করে। মাঝে মাঝে দেশের বাইরে যেতে হয়। এখন অবশ্য মুন্সিগঞ্জ আছে। ওদের কোম্পানির কোন একটা জায়গা দেখতে বোধহয় গিয়েছে। কালই ফিরবে বিকাল বা সন্ধ্যা নাগাদ। তার মানে উত্তরা বাসায় একাই ঢুকতে হবে লামিয়াকে। সকালেই আবার অফিস। এভাবে একা একা ঘুরতে তার খুব অস্বস্তি হয়।
তার বান্ধবী সুইটি সবসময় নাকি ব্যাগে একটা ছুরি রাখে। এত রাতে এ বাসের মধ্যে আর দুজন মেয়ে বোধহয় আছে। কিন্তু নিরূপায় সে। কিছু তো করার নাই যদি কিছু ঘটে যায়। যদিও সে সিঙ্গেল সিটেই বসেছে। ভাবতে ভাবতে তন্দ্রা এসে যায়। কুয়াশার মতো ক্লান্তি নামে শরীরে। ঘুম পুরো শরীর জড়িয়ে ধরছে ধীরে ও কোমলভাবে। বাসের ভেতর ঘুমিয়ে পড়ল কখন বুঝতে পারে না। ঘুম ভাঙল বাস থামলে। লামিয়াকে নামতে হবে এখন। কর্কশ ঢাকার ভোরে চলে এসেছে সে।
৩.
রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে একটা উবার খোঁজার চেষ্টা করে লামিয়া। এত ভোরে উবার পাওয়া মুশকিল। সিএনজি ফলে ভরসা। একটা খরখরে রাস্তা ধরে, এবড়ো-খেবড়ো ঢাকার দালানের মুখগুলো দেখতে দেখতে, রমনা, মগবাজার, তেজগাঁও, মহাখালি হয়ে উত্তরার বাসায় ঢুকতে ঢুকতে প্রায় সাতটা। তার মানে একটু গা এলানোরও সময় নাই। গোসল করে, টোস্ট বানিয়ে কফি খেয়েই দৌড় দিতে হবে। ঘরে আর কেউ নাই। লামিয়া না থাকলে নির্ঝরও বাসায় আসে না। হয় তার বাবার বাসায়, নয় বন্ধুদের বাসায় রাত কাটায়। আজ কখন ফিরবে, কখন বাজার হবে, রান্না হবে কে জানে? কাজের বুয়াটাকেও তো ডাকতে হবে।
নির্জন বাসায় ঢুকে আঠার মতো শরীরে লেগে থাকা ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করে লামিয়া। অফিসে আবার যাওয়ার জন্য শরীর তার মোটেও উপযুক্ত না। উপায় নাই কোনো, যেতেই হবে। অফিসের পরিবেশ লামিয়ার মুডের ওপর ডিপেন্ড করে অনেকটা। সে খুশি থাকলে অফিস খুশি। তার মুখ বেজার থাকলে অফিসে মেঘ ঘনায়ে আসে। নিজে যদিও অফিস মেনটেন করে, তারপরও তার মনে হয় এই দেশে করপোরেট হতে গিয়ে অযথা একটা নকশা চলে। মাসুদ ছেলেটা যত আজেবাজে বলুক–এখানে ঘোড়ার আগে গাড়ি তো দূরে থাক, শুধু চাকা-ছাড়া-গাড়ি এনেই ঘোড়ার গাড়ি চালানোর ভণিতা করে যেতে হয়। রাস্তা ঠিক নাই, জব সিকিউরিটি নাই–সেই দেশে এত করপোরেটগিরির কী দরকার! এই যে লামিয়া এতদিন থাকল কক্সবাজার, দিনে একবার করে গেল আর আসল, কী হলো তাতে। সেই একই তো রিপোর্ট, একই স্ট্যাটিসটিকস। সে ঢাকা বসেই এসব করতে পারত। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের কি কিছু হবে এসব করে? খরচ দেখানো জন্য অযথা দশ দিনের একটা অভিনয় লামিয়া করল। খুব বিরক্ত লাগতে শুরু করল তার। নিজে নিজে মাসুদের অনেক কথাকে সায় দিলেও কখনো প্রশ্রয় দেয়নি বেশি বলতে। প্রতিষ্ঠানের প্রতি তার একটা লয়্যালটি আছে। সেটা শুধু এমপ্লয়ি হিসাবে না, শুরু থেকে সে এর সঙ্গে জড়িত বলেও।
এসব ভাবতে ভাবতে নিজের গায়ের টপস, ব্রা, লেগিংস, প্যান্টি খুলে একদম খালি গা হয়ে শুয়ে থাকে কিছুক্ষণ। খুব কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমাতে ইচ্ছা করছে তার। ঘুম দিয়ে ওঠার পর স্যান্ডইউচ আর একটা কড়া কফি খেয়ে ঘুম দিয়ে যদি বিকালের দিকে অফিস যাওয়া যেত তো খুব ভালো লাগত। সে উপায় নাই এখন। এ জন্য কিছুটা নিজেও দায়ী হয়তো।
তার বারবার মনে হচ্ছে মাসুদের ঘটনাতেই বোধহয় শর্মী ক্ষেপেছে। আসলেই কী হয়েছে সেটা জানতে হবে। লামিয়া এভাবে অভিযোগ তোলার পর যেহেতু পরিবর্তন ঘটেছে, এখন তাকেই হ্যান্ডেল করতে হবে বিষয়টা। দেখা যাক কী হয়!
নিজেকে জোর করে বিছানা থেকে তোলে। গিজার ছেড়ে হালকা গরম পানিতে শাওয়ার নিয়ে নেয়। একটা ব্লু অ্যান্ডি সিল্ক থ্রিপিস পরে নেয়। সঙ্গে টিপ, চুলটা শুকায় নাই তেমন, ছেড়ে রেখেই বাসা থেকে বের হয় ল্যাপটপ আর প্রয়োজনীয় কাগজ নিয়ে। নির্ঝর ড্রাইভারকে নিয়ে নিজের গাড়িতে মুন্সিগঞ্জ গেছে। লামিয়া নিজেই নিজের গাড়িটা নিয়ে বের হয়। বের হতে হতে প্ল্যান করে আজ আবার বাসায় ফিরবে না। বুয়াকে ফোন করে দিতে হবে কাল আসার জন্য। কাল শুক্রবার, বৃহস্পতিবার রাতটা কোথাও হ্যাঙআউটে যাবে।
এখন তাকে অফিস-এনজিও মিটিং-অফিস করতে হবে। সন্ধ্যায় কমলীদের বাসায় যাবে। ফোন করে নির্ঝরকেও বলতে হবে এক বোতল ভদকা নিয়ে সে বাসায় যেতে। কমলীর বর আর ওরা দুজন মিলে ভালোই আড্ডা জমবে। কমলীনি যদি চায় তো বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করা যাবে। তারপর নির্ঝরকে লম্বা একটা চুমু খাবে। সেই চুমু যেন থামবে না। উহ কতদিন হয়ে গেল ওসব হচ্ছে না!
নয়টার আগেই অফিসে পৌঁছে যায় লামিয়া। আরমান সাহেব সদা প্রস্তুত লোক। লামিয়া তাকে অফিসেই পেয়ে যায়। হাংকটাইপ একটা লোক। বেশ পাকাপোক্ত শরীর, টাক মাথা, লম্বা চিপ, শক্ত চোয়াল। তিনি মেয়েদের দিকে বিশেষভাবেই তাকান বলে মনে হয় লাশিয়া আর শর্মীর। এটা নাকি এক ধরনের অ্যাপ্রিসিয়েশন। যদিও লামিয়া এ আওতার বাইরে। কিন্তু অন্য অনেক মেয়ের শরীর মাপা, তাদের সঙ্গে কথা বলা–এসব আরমান সাহেব করেন বলে সন্দেহ জাগে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না, এটা যেন গ্র্যানটেড একটা বিষয় হয়ে উঠেছে এ অফিসে। কারণ কেউ অভিযোগ করে না। তবে তিনি সীমাও ছাড়ান না আবার নিজেকে লুকানও না। লামিয়া ব্যাপারটা ভালোভাবে নেয় না যদিও, কিন্তু কী করবে বুঝতে পারে না। লোকটা চতুর, যে কারণে ঠিক ধরাও যায় না তাকে। নিছক সন্দেহ থেকে কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। শর্মী বলেছিল মওকা মতো ধরা যাবে।
লামিয়াকে দেখেই একটা হাসি দিলেন সেই আরমান সাহেব, বসতে বললেন। নিজে কফি বানাতে উঠে গেলেন। কফি নিয়ে এসে এক কাপ লামিয়াকে আরেকটা নিজে নিয়ে চেয়ারে বসলেন। এর মধ্যে কোনো কথা হলো না। কফিতে চুমুক দিয়ে, সেটা গিলে, ঠোঁটে একটা চাপ দিয়ে মুখ খুললেন আরমান–
‘মাসুদকে সিলেট পাঠিয়ে দিয়েছি। পানিশমেন্ট পোস্টিং। আমাদের ওখানে কোনো কাজ নাই বেসিক্যালি। কিন্তু একটা নামকাওয়াস্তা প্রজেক্ট খুলে রাখা। এখন সে যদি থাকে তো থাকল। যদি আমরা দেখি যে সে আর লিখছে না তেমন কিছু তাহলে তো তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে ঢাকায়। তবে আমি মনে করি উই আর ফিনিশড উইথ হিম। আমরা মাসকয়েক পর আরেকজন জুনিয়র নিয়ে নেব, খরচটাও কমবে’।
‘আর শর্মী?’
‘দ্যাটস অ্যা মিসারি। আই কান্ট কালেক্ট হার। থ্রি মোর ডেজ আফটার মাসুদস ট্রান্সফার, সি ডিডন্ট কাম টু অফিস, হার ফোন ইজ অফ টিল দেন, সি জাস্ট লিভ অ্যা মেসেজ দ্যাট শি ইজ সিভিয়ারলি সিক। বাট আপনি তো জানার কথা’।
‘না, আমি কিছু জানি না। কেউ কিছু জানে না ওর বিষয়ে। ও কোথায় আছে জানেন’?
‘আই ইনকোয়ারড হার বয়ফ্রেন্ড। হি টোল্ড মি অ্যাকচুয়েলি শি ইজ নো মোর ইউদ হিম। দে সেপারেটেড উমম মোর দেন মানথস এগো। হি গিভ মি দ্য মেড সারভেন্টস নাম্বার, আই কলড হার, সি অ্যাশিওর মি দ্যাট যে শর্মী বাসাতেই আছে, কিছুটা জ্বর জ্বর একটা ভাব হয়তো, মে বি মিনস, বাট সে ঘরেই আছে’।
‘কিছু কী জানা যায়নি?’
‘নাহ, কিছু না’।
‘ওকে, তাহলে আমি বের হই। মিটিং আছে’।
‘প্লিজ। কিছু জানামাত্র আমাকে জানাবেন। ইউ নো শি ইজ আওয়ার প্রেশাস ওয়ার্কার। থ্যাংকস ফর ইউর ওয়ার্ক অ্যাট কক্সবাজার, আই অ্যাপ্রিশিয়েট ইউ’।
আর কিছু না বলে বেরিয়ে যায় লামিয়া। অফিসের গাড়ি নিয়ে বেইলি রোডের দিকে রওনা হয়। আবার জ্যামের মধ্যে পড়তে হচ্ছে তাকে। এ দশ দিন অন্তত জ্যাম ছিল না। এত গাড়ি দেখলেই তার বিরক্ত লাগতে শুরু করে। শিশুমেলা দিয়ে আগারগাঁও হয়ে, প্রধানমন্ত্রীর অফিসের পাশ দিয়ে, র্যাংস ভবনের ফ্লাইওভার হয়ে সাতরাস্তা হয়ে ঘুরে ঘুরে বেইলি রোড যখন পৌঁছাল তখন দশটা পনের। একটা ছিমছাম ঘরের মধ্যেই, অনেকটা ডায়নিং টেবিলে কিছুটা অকঅয়্যার্ড মনে হলেও খারাপ লাগছে না এমন করে বৈঠক সাজানো হয়েছে। এখনও সবাই আসেনি। ঢাকায় সময় মেনটেন করা তো খুব টাফ–তাই কেউ কিছু মনে করছে না। নিজের পরিচয় দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসল লামিয়া। শর্মী হলে নিশ্চয় এরা চিনত তাকে। একজন জিজ্ঞেসও করল শর্মীর কথা। ওর খুব প্রসংশা করল। লামিয়াও একদিন হয়তো এ জায়গায় যাবে। সবাই তাকে চিনবে। কিছু হলে টিভিতে কমেন্ট নিতে আসবে। টক শোতে যাবে সে। শর্মীর ক্ষেত্রে যেমন হয়। নারী, প্রগতি, মুক্তচিন্তা–এসব বিষয় মানে শর্মী। অথচ সে আজ নাই। কোথায় আছে নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। ওর কী হয়েছে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ লামিয়াও জানে না।
৪.
আসলে কি লামিয়া তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ? শর্মীর তো কোনো প্রেমই টিকল না। আরমান সাহেব তো আজ বললেন বাবুইয়ের সঙ্গেও প্রেমটা নাই। এটা হাওয়ার কথা তো ছিল না। ওরা একই পলিটিক্যাল বিলিফের লোক, ওদের মত ভিন্নতা কেন দেখা দিল? বাবুই না শর্মী কে অন্য প্রেম খুঁজে নিয়েছে কে জানে। বাবুই কী পারবে এত সহজে আরেকটা প্রেম খুঁজে নিতে, মেয়েদের পক্ষেই তো বেশি সহজ পলিগ্যামাস হওয়ার। বাবুইয়ের মতো অর্থকষ্টে ভোগা, কালোমতন একটা ছেলে কীভাবে শর্মীর মতো লুকিং লাভলি একটা মেয়ে পাবে। আর শর্মীর এত প্রেম, এত রাজনীতি এসবের মধ্যে আসলেই বা লামিয়া কে? সে ঠকলই শেষ পর্যন্ত!
লামিয়া ভেতরে ভেতরে ফোঁপাতে থাকে, এ শহরে কাউকে আসলে বিশ্বাস করে চলা যায় না। কারুর ওপর ভরসা রাখা যায় না। নিজের অস্তিত্ব, নিজের উন্নতি নিজেকেই করতে হয়। শর্মী আর যাই হোক যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ার মতো অশোভন কাজটা না করলেও পারত। বাবুইয়ের সঙ্গে ও দিনের পর দিন তার ঘরে ছিল, ওদের দুজনকে রেখে নির্ঝার আর লামিয়া কতদিন বেরিয়ে গেছে। ওরা দেশের বাইরে ঘুরতে গেলে শর্মী আর বাবুই সেখানে রাত কাটিয়েছে। ওরা শরীর দেওয়া-নেওয়া করেছে। শর্মীর শরীর নিয়ে কোনো এথিকস নাই। নাই বলে সে শুতে পারে একের পর এক আরেকজনের সঙ্গে। যে এটা পারে তার পলিটিক্যাল বিলিফও তো চেঞ্জ হতে পারে। সে বন্ধুকেও ছেড়ে যেতে পারে সহজে।
লামিয়ার আরো মনে হয়, মাসুদ হয়তো পটিয়ে ফেলেছে তাকে। ছেলেটার মায়া মায়া মুখ দেখে শর্মী গলে গেছে। বাচ্চাদের মতো মুখ দেখলে শর্মী পটে যায়। এই ছিল তার মনে? লামিয়াকে নামিয়ে দিয়ে নিজে সটকে পড়েছে। ছি, এটা খুব বাজে কাজ করল শর্মী। সে লামিয়াকেও হারাল, এতদিনের বন্ধুত্ব হারাল। যতদূর মনে হচ্ছে চাকরিটাও সে ছাড়বে।
বৈঠকে তেমন মন বসল না আজ আর। মিটিংয়ের ডকুমেন্টসগুলো মেইল থেকে ডাউনলোড দিয়ে নিল। একটা স্যুভেনির, একটা খাম–এসবও দিল। খাবার আয়োজন থাকলেও সেটা এড়িয়ে সব নিয়ে বেরিয়ে এল লামিয়া।
গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে, মাসুদকে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে ফোন দিল–
‘হ্যাঁ মাসুদ আমি লামিয়া বলছিলাম। আপনি এখন কোথায়?’
‘আমাকে তো আপনি পাঠিয়েছেন, আবার আপনি বলছেন আমি কোথায় আছি’।
‘দেখুন যা হয়েছে অফিসের ডিসিশন। কিন্তু আমি আপনাকে একটা ব্যক্তিগত ব্যাপারে ফোন করেছি’।
‘আপনি বললেন করপোরেটে ব্যক্তিগত আর অফিস বলে আলাদা কিছু নাই। আবার আপনি এখন বলছেন অফিস নয় ব্যক্তিগত কাজে ফোন দিয়েছি, ম্যাডাম আপনি না খুব নাটক জানেন’।
‘দেখুন প্লিজ এখন আমি তর্ক করব না। আমি পরে আপনাকে ফোন দেব বা আপনি আমাকে যা খুশি বলবেন। আমাকে এখন শর্মীর খবরটা দিতে পারবেন একটু’।
‘শর্মীকে আপনি চিনতে পারেন নাই এত দিনেও’।
‘ হ্যাঁ হ্যালো, কী বললেন, হ্যালো হ্যালো…’
‘বললাম, শর্মী ম্যামকে আপনি আর পাচ্ছেন না আগের মতো’।
‘কোথায় আছেন হ্যালো হ্যালো, কোথায় ধ্যুৎ শুনতে পাচ্ছি না। আমার খুব দরকার, প্লিজ বলুন কোথায় আছে, ওহ নেটওয়ার্ক এত ডিস্টার্ব। হ্যালো মাসুদ…’
অক্টোবর, ২০১৮, মিরপুর
[আদর্শ থেকে প্রকাশিত ‘মেয়েদের এমন হয়’ বই থেকে।]