কুকুরটা আমাকে যা বলেছিলো

শূন্য

বাড়ির সামনের রাস্তাতে মালিক ও মা বিহীন অসহায় একটি কুকুরের বাচ্চা প্রতিদিন ঘুরঘুর করতো। দেখতে পেয়ে তাকে বারান্দা দিয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে নিয়মিত খাবার দিতে থাকি। খুব অল্প সময়েই কুকুরের বাচ্চাটি আমার পোষ মেনে যায়। কিংবা বলা যায় কুকুরটিই আমাকে পোষ মানিয়ে ফেলে। কিন্তু তারপরেও ওকে আমার ঘরে জায়গা দিতে পারি না। কারণ, আমার বাসায় কুকুর রাখার অনুমতি নেই। কুকুরটি রাস্তাতেই বড় হতে থাকে এবং তাতেও কুকুরের সাথে আমার নির্মল বন্ধুত্বে কোন ঘাটতি হয় না।

এক

বিকেলে বারান্দা দিয়ে অবাক হয়ে দেখতে পেলাম, পাশের বাসার হিমেলের পেছন পেছন কালু মানে আমার কুকুরটা দৌড়ে যাচ্ছে। হিমেল অনেক হাসছে, একটা একটা চিপস ফেলে দিচ্ছে রাস্তায়। চিপসের লোভে কালু দৌড়াচ্ছে। বারান্দা থেকে হিমেলের গলা শোনা যাচ্ছে, ‘’আয়, আয়, এই যে নে…’’ কালু সেই চিপস খাচ্ছে আর হিমেল খুশি তে হাততালি দিচ্ছে।

দুই

পরদিন সকাল। মা খবরের কাগজ পড়ছে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছি। বাইরে থেকে একটানা কুকুরের ঘেউঘেউ ডাক। খবরের কাগজ নামিয়ে মা বললেন, ‘দেখো, রাস্তায় কুকুরটা কিভাবে ডাকছে!’

মজা করেই মাকে বললাম, ‘’আমাকে ডাকছে, বুঝলে। খিদে পেয়েছে তো, তা-ইই।‘’

–পাউরুটি খাইয়ে খাইয়ে একেবারে পোষ মানিয়ে ফেলেছো দেখি! হাহাহা

— দাঁড়াও, আমি বারান্দা থেকে দেখে আসি। দেখো, একটানা কেমন ডেকেই যাচ্ছে। আমি না যাওয়া পর্যন্ত দেখবে ঘেউঘেউ করতেই থাকবে, থামবে না।

বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি কালুর অস্থিরতা, ‘’ ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ!’’

— কী হয়েছে?

— পাউরুটি দাও। ঘেউ!

— আজ পাউরুটি নেই, শেষ হয়ে গেছে। টোস্ট বিস্কুট খা।

— টোস্ট বিস্কুট খাবো না, শক্ত, খাওয়া যায় না। ঘেউ, পাউরুটি দাও।

— এই, তুই না রাস্তার কুকুর, তোর এত আবদার কিসের? যা দেবো, তা-ই খাবি। এত আহ্লাদ কিসের?

— না, পাউরুটিই খাবো। ঘেউ!

— কালকে খাইস।

— তাহলে অন্য কিছু দাও। বাসায় মুরগির হাড্ডি নেই?

— থাকতে পারে।

— যাও না, নিয়ে আসো না হাড্ডিগুলো।

— একটু দাঁড়া তুই। আনছি। এই নে মুরগীর হাড্ডি। একটু যদি আত্নসম্মান থাকে! কেমন চেয়ে চেয়ে খায়!

— আমি তো কুকুর। আমার আত্নসম্মান থাকতে নেই । (হাড্ডি চাবাতে চাবাতে) খাবার দাও আর না দাও, ডাকলেই দেখবে, কাছে চলে আসবো। (আহ্লাদে গদগদ) ঘেউ!

— মিথ্যুক একটা! গতকাল হিমেল তোকে চিপসের লোভ দেখালো, তখন তুই আমাকে ফেলে ওর পিছে পিছে চলে যাস নি?

— যেন কিছুই হয় নি, নির্বিকার ভংগিতে) হ্যাঁ, তার আগের দিন শান্ত আমাকে বিস্কুট খাইয়েছিল, অরেঞ্জ ফ্লেভারের। খুব মজা।

কথা শুনে মেজাজ গরম হয়ে গেলো। তবুও ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলার মত ওকে বললাম, ‘’কিন্তু, পাউরুটি তোর সবচেয়ে প্রিয়। তাই না? পাউরুটি তোকে কে খাওয়ায়, বল? ‘’

–এহেম, এহেম, তুমিই খাওয়াও।

এবার একটু ধমকের সুরেই বললাম, ‘’তাহলে তুই সবার পিছে পিছে কেন ঘুরিস?’’

— কী করবো? আমি রাস্তার কুকুর। কেউ আমাকে পুরোপুরি আপন করে নেয় না। দেখো, আমার গলায় কেউ একটা বেল্টও বেঁধে দেয় নি। তুমিও দাও নি। মিউনিসিপালটির লোক আসলে কী হবে, বলতে পারো?

— তাই বলে, তুই সবার পিছে পিছে ঘুরবি? তোর কোন আত্নসম্মান নেই! লজ্জা নেই!

‘’ঘাঘাঘাঘাঘা…’’ অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে কালু বললো, ‘’হাসালে, বুঝলে হাসালে। কত হাজার কোটি টাকা লোপাট করেও তোমাদের– মানুষদের লজ্জা হয় না, আর তুমি কি না আমার মত একটা রাস্তার কুকুরের কাছ থেকে লজ্জা, আত্নসম্মান আশা করছো!’’

কালুর হাসি দেখি থামছেই না। একটু রাগ হলো আমার, ‘’বিশ্বাসঘাতক হচ্ছিস দিন দিন।‘’

বারেব্বাহ! একেবারে দার্শনিকের মত ভাব নিয়ে সে বলে, ‘’এটা হলো সংগদোষ। বুঝলে, তোমাদের মত মানুষদের সাথে থেকে থেকেই আজ এ অবস্থা। নিজের স্বার্থটা তো ঠিক রাখতে হবে! ঘেউ!’’
তাজ্জব আমি, ‘’নিজের স্বার্থ আজকাল তোর মত কুকুরও বুঝে গেছে!’’

নির্বিকার ভংগিতে চলে যেতে যেতে আমাকে আবার বলে গেলো, ‘’কালকে পাউরুটি এনে রেখো কিন্তু। আজ যাই। ঘেউ।‘’

তিন

আরেকদিন বিকেলে পাউরুটি হাতে বারান্দা থেকে কালুকে খুঁজছি, পাচ্ছি না। একটু চিন্তাতেই পড়ে গেলাম, কই গেল কুকুরটা? এমন সময় দেখি দূর থেকে উনি হেলেদুলে এদিকে আসছেন! দেরি করে আসায় শাসন করতেই হয়, ‘’ কি রে, কই থাকিস? খুঁজেই পাওয়া যায় না?’’

— আশেপাশেই ছিলাম, দেখো নি?

— সারাক্ষণ টই টই করে ঘুরে বেড়াস। স্থির হয়ে একটু বসলেও তো পারিস?

— তা কি হয়? কত কাজ আছে না? ঘেউ!

— তোর আবার কিসের এত কাজ?

— বলছি, আগে পাউরুটি দাও। ঘেউ!

একটু রাগ দেখাই আমি, ‘’ পাউরুটি ছাড়া তোর তো কোন কথাই নেই। খালি ‘পাউরুটি দাও, পাউরুটি দাও’ এই এক জপনা জপিস! এই নে, খা এবার। ’’

কালু দ্রুত সেই পাউরুটি চাকুম চুকুম শব্দ করে খায়। খেতে খেতে কথা বলে আমার সাথে, ‘’হ্যাঁ, যা বলছিলাম। আমরা কুকুররা কেমন প্রাণী তা কি তুমি বলতে পারবে?’’

আচ্ছা, এমন প্রশ্ন শুনলে বিরক্ত লাগে না? যেন আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন উনি! এটা কোন প্রশ্ন হলো? তবুও জবাব দিলাম, ‘’গৃহপালিত, প্রভুভক্ত! আস্তে খা, গলায় আটকাবে।‘’

–হুম, তবে এখন আমরা আর গৃহপালিত নই। (আবার দার্শনিকের মত একটা ভাব নিচ্ছে, দেখো না কাণ্ড!) কেউ এখন আর কুকুর পোষে না। আবার আমরা বন্য প্রাণিও নই। মানুষের সংগ ছাড়া থাকতে পারি না। এখন আমরা হয়ে গেছি, নাগরিক প্রাণি। এই যে, তুমি একটু আগে জানতে চাচ্ছিলে, কী এত কাজ আমার। ঘেউ। এখন নাগরিক প্রাণি হয়ে আমার কাজ গেছে বেড়ে। এই গলির প্রতিটা বাসা আমাকে দেখেশুনে রাখতে হয়। গৃহপালিত হলে কাজ আমার অনেক কমে যেত। ঘুমোবার আরো টাইম পেতাম। আর এখন, খাটুনি কত বেশি, খাবারের সন্ধানে মানুষের মত ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছি দিন দিন।

— হুম, বুঝলাম। সবার পিছন পিছনেও খাবারের জন্য ঘুরতে হয়। তুই আর ঠিক প্রভুভক্ত নেই। ধান্ধাবাজ হয়ে যাচ্ছিস।

— তবে তুমি আমাকে বিশ্বাসঘাতক বলো, ধান্ধাবাজ বলো আর যাই বলো, আমি কিন্তু নিজের কাজটা ঠিকই করে যাচ্ছি। এ গলিতে কোন চোর ঢুকতে পারবে না। (আনন্দে লেজ নেড়ে) ঘেউ।

— হুহ! তোর যেমন ক্ষিদে! চোর এসে খাবার দিলে তুই ঠিকই পটে যাবি। তুই হবি একটা ঘুষখোর, দূর্নীতিবাজ কুকুর!

–ঘেউ ঘেউ ঘেউ। তীব্র প্রতিবাদ জানাই। এমন কথা তুমি আমাকে বলতে পারলে?

— পারলাম।

— ঘেউ ঘেউ, আমি কি চোর চিনি না?ঘেউ!

— তুই এখন চিনিস খালি খাবার আর নিজের স্বার্থ। অভাবে তোর স্বভাব নষ্ট হয়েছে।

— হুম, তা ঠিক। তোমার অভিযোগ স্বীকার করি, তোমাদের মত মানুষদের সাথে থেকে থেকে আজ আমার কুকুর ধর্ম থেকে অধঃপতন ঘটেছে। (বিজ্ঞের মত ভাব নেয় আবার!) শুধু আমি কেন, কোন নাগরিক প্রাণিই আজ এই দূষণ থেকে মুক্ত নয়। ফিরিয়ে দাও অরণ্য, লও হে নগর…

— এই, এই, খবরদার, লেকচার দিবি না। তোকে পাউরুটি খেতে দিই দুটো সুখ-দুঃখের আলাপ করার জন্য। লেকচার শোনার জন্য না!

ধমক খেয়ে আবার অভিমান করে, ‘’তোমাদের মানুষদের এই এক স্বভাব, দুটো খেতে দাও, তাতেই কিনা খাবারের খোটা!’’

কথা শুনে এমন মেজাজ খারাপ হলো। শেষে মুখ খারাপ করে বলেই ফেললাম, ‘’কুত্তা একটা!’’

গালি শুনে উলটো আরো দাঁত কেলালো। আহ্লাদে গদগদ হয়ে লেজ নাড়াতেই থাকলো, ‘’আমি মাইন্ড করছি না। শত হলেও আমি কুকুর তো! তাছাড়া, তুমিই আমাকে পাউরুটি খেতে দাও কিনা! ঘেউ!’’

চার

অফিস থেকে বাসায় ফেরার জন্য রিক্সা খুঁজছি। এক রিক্সাওয়ালাকে ডেকে যেই জানতে চাইলাম যাবে কিনা, দেখি তিনি খুব উৎফুল্ল! বলে, ‘’আপা, আপনারে নিলে তো আবার ভয় আছে!’’
আমি তো অবাক! কিসের ভয়?

রিক্সাওয়ালা হাসতে হাসতে বলে, ‘’আপনাকে গো বাসায় একটা কুত্তা আছে না?’’

— ওহ হো হো হো। না, না, ও খুব ভালো কুকুর, আমাকে দেখলে খুশিতে দৌড়ে চলে আসে। আপনিও চেনেন নাকি ওকে?

— আরে কী কন চিনুম না? ঐ কুত্তারে এই পাড়ার সবাই চিনে। আপনি তো আপা আবার ঐ কুত্তার লগে কতাবার্তাও কন।

–হাহাহা, হ্যাঁ, ও খুব ভালো কুকুর, মোটামুটি শিক্ষিতও। তবে একটু বেশি কথা বলে আর কি!

— হ, খাওন দিলে, আদর করলে, দেখবেন আর আপনার পিছ ছাড়বো না। এইডাই একটা সিকিউরিটি। উডেন আপা রিসকায়। আপনারে দিয়া আহি।

— হ্যাঁ, চলুন।

পাঁচ

বিকেলে বাসার নিচে নেমেছি। দূর থেকে ভেসে আসছে মাইকে হিন্দি গান – লায়লা মে লায়লা, এসিহো লায়লা…

আর কালু বাসার নিচে রাস্তায় নিশ্চুপ বসে আছে, হিস মাস্টারস ভয়েজের লোগো’র মত। আজকে মুড মনে হচ্ছে অন্য রকম! হতেই পারে, দিন দিন যেমন বিখ্যাত হয়ে উঠছেন উনি! আমি কথা বলার চেষ্টা চালালাম, ‘’কী হলো আজ কোন আওয়াজ নেই! কোন কথাই বলছিস না! কীরে চুপ করে বসে আছিস কেন? এইই, কী হলো তোর? কথা বল?’’

দীর্ঘ নিরবতা ভেংগে হালকা করে কালু জবাব দিলো, ‘ঘেউ’।

–যাক কথা ফুটলো মুখে। তুই এরকম চুপ করে থাকলে আমার ভয় লাগে।

এবার কালুর অবাক হবার পালা, ‘কেন ভয় লাগে?’

—মনে হয় তুই আমাকে কামড়ে দিবি।

— যাহ, তা কেন? তুমি আমাকে পাউরুটি দাও, তোমাকে কামড়াতে যাবো কেন?

— কেন জানিস না? বার্কিং ডগ সেলডম বাইটস? তুই তো আবার ইংরেজি বুঝিস না!

— ঘেউ ঘেউ করা কুকুর কদাচিৎ কামড়ায়, দেখলে ইংরেজিও বুঝি। বাংলা, সমাজ, বিজ্ঞানও বুঝি। অল্প স্বল্প অংকও পারি। কুকুর বলে এতটা মূর্খ ভেবো না।

— উফ! আমার কপালে এসে জুটেছে এক আঁতেল কুকুর!

— রাগ করো না। শোন। আমরা কুকুরেরা যখন তখন ঘেউ ঘেউ করি না। বিশেষ করে চেনা পরিচিত ব্যক্তি—এই যেমন ধর তুমি, আমাকে নিয়মিত পাউরুটি খেতে দাও—এরকম ক্ষেত্রে শুধু শুধু কেন ঘেউ ঘেউ করবো? তাছাড়া বেশি ঘেউ ঘেউ করলে অকারণে এনার্জি লস হয়।

— কিন্তু… ঘেউ ঘেউ না করে চুপ করে থাকলে বুঝবো কী করে তুই আমাকে কামড়ে দিবি না?

— কেন, আমি তো তোমাকে দেখলেই লেজ নাড়ি, দেখছো না!

— হুম, তা অবশ্য নাড়িস। তবু মাঝে মাঝে ভয় লাগে বুঝলি। বিশ্বাস করতে পারি না।

কালু একটু হাসলো আমার কথা শুনে। বললো, ‘’এটুকু বিশ্বাস তুমি আমার মত একটা রাস্তার কুকুরের উপরেও রাখতে পারো। আমার তো আর জলাতংক হয় নি!’’

এমন ইংগিতপূর্ণভাবে কথাটা ও বললো যে, আমি রেগে গেলাম, ‘’তুই আসলে কী বলতে চাস? ‘’

আবারও দার্শনিকের মত একটা ভাব নিলো সে, ‘’ বলতে চাই, আমরা কুকুরেরা মানুষের চেয়েও বেশি সুস্থ। আর তোমাদের মধ্যে এত অসুস্থতা, এত অসুস্থ্তা যে… স্বার্থের জন্য মারামারি কামড়াকামড়ি আমাদের থেকে তোমরা—তোমরা মানুষেরাই বেশি কর। তোমাদের এই স্বার্থপরতা রোগের জীবাণু খুব ভয়ংকর! জলাতংক না হলে আমরা কামড়াই না। আর তোমরা কেন, কখন, কী জন্য, কাকে, কোথায় কামড়াবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। ‘’

আবারও মুখ খারাপ করে ফেললাম, ‘’আঁতেল! শিক্ষিত কুত্তা!’’

কালু এবার লজ্জায় কেমন যেন ছোট হয়ে গেলো। অনুনয় করে বললো, ‘’এই, না না, এভাবে শিক্ষিত বলো না। নিজেকে মানুষ মানুষ লাগে। কুত্তা বলো, কুত্তার বাচ্চা বলো, গায়ে লাগে না। আমরা অন্তত তোমাদের চেয়ে কিছু ভাল আছি। তবুও তোমরা আমাদের নাম দিয়েই নিজেদেরকে গালিগালাজ করো।‘’

জানি, কালু এখন আমার উপর অভিমান করে চুপ করে আছে। কিন্তু তবুও অল্প অল্প লেজ ঠিকই নাড়ছে।

ছয়

আজ কালু আমার আগে এসেছে। বাড়ির নিচ থেকে অল্প অল্প ঘেউ ঘেউ করছে। পাউরুটি নিয়ে বারান্দায় এসে দেখি আনন্দে ঝলমল করছে। খুব লেজ নাড়ছে। এত জোড়ে নাড়ছে, হাতপাখা বেঁধে দিলে বাতাস-ও খাওয়া যাবে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘’কি রে, খুব আনন্দ না?’’

–তা কিছুটা আনন্দেই আছি, বলতে পারো।

রহস্য করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘’এত দ্রুত জুটিয়ে ফেললি!’’

কালুও নিচু স্বরে জানতে চাইলো, ‘’দেখেছো?’’

— দেখবো না, প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তায় তুই তোর জিএফের সাথে… কোন লজ্জা যদি থাকে!

— আমি লিটনের ফ্লাট পাবো কোথায়? ঘেউ?

— তাই বলে সবার সামনে বেলাল্লাপনা করে বেড়াবি?

— শোন, আমাদের কুকুরদের মধ্যে লুকোচুরির প্রাকটিস নেই। প্রেমে আমরা সৎ ও সাহসী। তোমাদের মত ভণ্ডামিও নেই।

আনন্দে লেজ নাড়ছেই তো নাড়ছে। থামাথামি নেই।

ধমক দিলাম একটা, ‘’চুপ থাক, উনি আসছেন প্রেমের সততা শেখাতে!’’

— পাউরুটি আছে?

–ওহ, পাউরুটির কথা মনে পড়লেই তো শুধু আমার কাছে আসা! নয়ত হিমেল, শান্ত, রনিদের পিছন পিছন দৌড়। এখন তো আবার নতুন জিএফ জুটেছে একটা!

— তাহলেই বোঝো, কত কাজ আমার!

পাউরুটি এনে নিচু গলায় জানতে চাইলাম, ‘’কিন্তু এত দ্রুত তোর প্রেমে ব্যস্ত হবার কী দরকার? সময় আসতে এখনো অনেক দেরি আছে তো?’’

আমার বোকামিতে কালু হেসে উঠলো, ‘’বুঝলে না? এ হলো, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব! তুমিই বলো, এটা যে শ্রাবণ মাস কেউ বলবে? আবহাওয়ার উপর দেহ- মনের প্রভাব আছে কি না, তুমিই বলো। ঘেউ! ‘’

এমন আজেবাজে কথা শুনলে মেজাজ ঠিক রাখা যায়? দিলাম ধমক, ‘’চুপ কর তো! পাউরুটি খাওয়া হলে চলে যা। আর জ্বালাইস না।‘’

— ‘’থ্যাংকিউ’’!

খাওয়া শেষে খুশি মনে গান গাইতে গাইতে চলে গেলো, ‘’কুত্তা যেমন ভালবাসে পইড়া থাকা হাড্ডিরে, তত্ত ভালোবাসি তোমারে…’’

সাত

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সাড়ে সাতটা বাজে! আজ অফিসে নির্ঘাত দেরি হয়ে যাবে। দ্রুত কোন মতে রেডি হয়ে দৌড় দিচ্ছি অফিসের উদ্দেশ্যে। এমন সময়ে মায়ের ডাক, ‘’নাস্তাটা করে যাও।‘’
–না, মা, একদম সময় নেই। বাইরে খেয়ে নেবো।

মা একটু বিরক্ত হলো। বললো, ‘’যদি পারো, তবে আজ একটু আগে বাসায় এসো। কাজ আছে।‘’

— ‘’চেষ্টা করবো মা। গেলাম। বাই। ‘’

রাস্তায় এসে দেখি একটা রিক্সাও নেই! এমন সময় কালু দৌড়ে এলো আমার কাছে, ‘’ঘেউ ঘেউ ঘেউ’’

— এই সর, সর। লাফিয়ে একদম গায়ের উপর উঠে যাচ্ছিস তুই।

— পাউরুটি দাও, ঘেউ।

— আমি এখন অফিস যাচ্ছি। এখন কি আমি তোর জন্য পাউরুটি নিয়ে বের হয়েছি নাকি?

— না, পাউরুটি দিয়ে যাও।

— এই যে দ্যাখ, আমার হাতে কোন খাবার নেই। এবার পথ ছাড়। পিছে পিছে আসবি না, প্লিজ!

— পাউরুটি না দাও, আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে যাও। ঘেউ।

— দ্যাখ, তোর জন্য আমার কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে। এই, খবরদার লাফ দিয়ে গায়ের উপর উঠে যাবি নায়ায়ায়া, আআয়ায়া!

একটু জোরেই চিৎকার করে উঠেছিলাম। কালু যেন একটু থমকে গেলো। অভিমানের সুরে বললো, ‘’চিৎকার দিলে কেন? আমাকে তুমি ভয় পাও?’’

— ওমা! পাবো না? যদি কামড়ে দিস?

কালু আস্তে আস্তে বললো, ‘’আমি কিন্তু তোমাকে ভয় পাই না, তোমাকে দেখলেই ছুটে আসি, লেজ নাড়ি।‘’

— আমি তো তোর মত না, ভয় পাবি কেন? এই সর, গায়ের এত কাছে আসিস না!

আমার আচরণে কালু কষ্ট পায়, ‘’তুমি আমাকে এত দূর দূর কর কেন?’’

আচ্ছা, ঘেন্না লাগে না বলুন? গা ভর্তি কাদা ময়লা! একটু যদি বোঝে কালুটা না। বললাম, ‘’যা তাহলে, ভালো করে লাক্স সাবান দিয়ে গোসল করে আয়। গা ভর্তি নোংরা তোর।‘’

— নোংরা না থাকলে তুমি আমাকে ভালবাসবে?

— সে তখন দেখা যাবে।

কালুর অভিমান যেন আর যায় না! বলে, ‘’তখনও তুমি আমার দাঁতের কথা, নখের কথা ভেবে ভয় পাবে। আমি জানি।‘’

— খুব জানিস তুই!

— জানিই তো। বরং, তোমরা মানুষেরাই কারণ ছাড়া আমাদের আঘাত করে আনন্দ পাও। তবুও আমরা যে তোমাদের ভালবাসি নিজের গুণেই বাসি।

— হুম, ভালো যে বাসিস, তা তো ঐ পাউরুটির জন্য, আমি কি আর তা জানি না?

— এখন তো আমি তোমার কাছে পাউরুটি চাচ্ছি না। চাচ্ছি তুমি আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে আদর করে দাও।

— সর তো, অফিস যাবার সময় ত্যক্ত করিস না।

অভিমান আরো বাড়লো কালুর, চোখের কোণায় কি জল নাকি? বললো ‘’ অফিসের সময় না হয়ে অন্য সময় হলেও তুমি আমাকে এভাবেই তাড়িয়ে দিতে। কিন্তু আমি তোমাকে দেখলে সব সময়ই সমান ভাবে লেজ নাড়ি। তোমরা মানুষ কি না, তাই কাউকে ভালবাসতে পারো না।‘’

— তোর লেকচার শুনতে গেলে আমার দেরি হয়ে যাবে। সর, এখন! পিছে পিছে আবার আসছিস কেন?

–যাচ্ছো যাও, তবে মনে রেখো, তুমি আমাকে যতই নাগরিক কুকুর বল না কেন, আঁতেল কুকুর বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করো না কেন, আমি তোমার ঐ ভণ্ড প্রেমিকদের মত নই। আমি শেষ পর্যন্ত একটা কুকুরই। আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারো।

— এসব ইমোশনাল কথা অন্য কাউকে বলিস। অনেক পাউরুটি পাবি। এখন রাস্তা ছাড়।

— এই আমি থামলাম। তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত এখানেই আমি অপেক্ষা করবো।

আমি পাশ কাটিয়ে চলে যাই। আর কালু ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে আমার অপেক্ষায়।

সমাপ্ত

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত