কীটপতঙ্গদিন……..
॥ শামীমা জামান ॥
বাসাবাড়ির কাজ শেষে সবে বাড়ি এসে চুলোয় দুটো চাল সেদ্ধর মাঝে কতক আলু চাপিয়েছে কাজলি।
এরই মাঝে চিৎকার –চেঁচামেচিতে পুরো বস্তি মাথায় করে নিয়েছে জালালের মা। এমন কোন দিন নাই যে কালা মোটির চিল্লানি কেউ এই তল্লাটে শোনে না। মাঝে মধ্যে ভদ্র বাসাবাড়িগুলো থেকে জানালা দিয়ে বকাঝকাও আসে। সেসবে অবশ্যি কোন ভয় ডর নেই মর্দানির। গাছিক কাঁচা টাকা হয়েছে ওর চায়ের দোকান দিয়ে। সমিতি টমিতি করে সে এই বস্তির মহাজন। তবু কারো বিপদে একটা টাকা খসে না তার হাত থেকে। কোন কিছু বন্ধক রাখলে টাকা তার সুড়সুড় করে বের হয়। ঘরভর্তি করে ফেলছে ফার্নিচারে। ভদ্রঘরে কার কোন জিনিস বিক্রি হবে খবর পেতেই সে জিনিশ তার ঘরে চলে আসে। পান চিবুতে চিবুতে গল্প করে –‘বুঝলি কাজলি , একটা ফিরিজ কিনে ফ্যাললাম। পঞ্চাশ হাজার টাকা আসল দাম। আমি কিনছি কত দিয়ে জানিস ? মাত্র সাত হাজার টাকা।‘
‘এত কম দামে পাইলা,নস্ট না তো’।
‘চুপ কর মুখপুড়ী,নস্ট হতি যাবে ক্যান ।মহিলা একটা নতুন ফিরিজ কেনবে তাই’।
জালালের মার চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে ওটি কার কান্না শোনা যায় গো ! তার সুমন না। কাজলি চুলো ফেলে পড়িমড়ি করে দৌড়ে গেলো। ব্যাপার কি জানতে মনসুরের মা, সুরমা ,শেফালি সবাই যার যার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। জালালের মা সুমনকে মারছিলো। কাজলি এসে ডান হাত দিয়ে সুমনকে ছাড়িয়ে কৈফিয়ত চাইতেই জালালের মা গাছিক অশ্লীল বাক্যবাণে জর্জরিত করে তাকে। খানিক বাদে শান্ত গলায় বেশ একটা ভদ্রভাব এনে জালালের মা সবাইকে ব্যাপার কি জানায়। মাত্র মাসখানেক ও হয়নি, সে ছয়খানা গ্লাস কিনেছে। সুমন তার ঘরে টিভিতে শাবনূরের সিনেমা দেখছিলো বসে। বেশ ভাল কথা। তাগো ঘরে টিভি নাই তার ঘরে সে আসতেই পারে। কিন্তু এইরকম শয়তানি করে তার নতুন গ্লাস টা ভেঙ্গে ফেলবে। তার পানি খাওয়ার দরকার ছিল বাসায় গিয়ে এক দৌড় দিয়ে খেয়ে আসতো।
কাজলি চোখ মুছতে মুছতে বলে ,’তাই বলে ওর গায়ে হাত দিবা’।
‘গায়ে হাত দিছি বেশ করিছি । এরপর আমার আর একটা অনিস্ট যদি করে না তো আমার চাইতে খারাপ আর কেউ হবেনা’। জালালের মার হাত ধরে তার স্বামী টানতে টানতে ঘরে না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত কারো মুখে কথা ফোটেনা।
তারা ঘরে যেতেই মনসুরের মা, সুরমা,শেফালি কাজলির কাছে এসে তাকে সান্তনা দেয়। জালালের মার উদ্দেশ্যে চারটে কুৎসিত গালি ছোড়ে।
কাজলি সুমনকে ঘরে এনে আরো দু’চারটে চড় কষে তার থেমে যাওয়া কান্না আবার চালু করে দেয়। তার হয়েছে যত জ্বালা । ভাল ঘরের মেয়ে হয়েও আজ তাকে কত গঞ্জনা সইতে হয় শুধু ঐ সুমনের বাপের জন্য। তিন তিনটে ছেলেমেয়েসহ তাকে একা ফেলে সে এই মোহাম্মাদপুরেই কোন বস্তিতে আছে ঘর ভাড়া নিয়ে। কিভাবে কিভাবে তার ভালো সামীটা ঐ জরিনা সুন্দরীর খপ্পরে পড়ছে। জাদুটোনা জানে হারামজাদী। না হলে এই ফুটফুটে চাঁদের মতো তিনটে বাচ্চার কথা কেউ এরকম ভুলে থাকতে পারে। তার না হয় রুপ নাই। গায়ের চামড়া সুন্দর না। নিজের রক্ত মানুষ কি করে ভুলে থাকে। অমানুষ একটা।
এ মাসে কাজলি একটা মেসবাসায় কাজ পেয়েছে। সুরমা তাকে কাজটি জুটিয়ে দেয়। রান্নার কাজ। বাসার কাজের চাইতে বেশি টাকা পাওয়া যাবে। এবার যদি তার ছেলেমেয়ে তিনটেকে দুবেলা খাবার সে ঠিক মতো দিতে পারে। মুদি দোকানে দেনা হয়ে আছে এক হাজার টাকা। দোকানের সামনে দিয়ে সে কাজে যেতে পারেনা। অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে হয়। ছোট প্লাস্টিকের চালের বালতিটা উপুড় করে ফেললো কাজলি। এক মুঠো চালের মতো হবে। এ দিয়ে সে এতগুলো পেট কি করে ভরাবে। ঘরে ডাল ,তেল এমনকি নুন্টুকু পর্যন্ত নেই। সুরমার কাছ থেকে একটু নুন নিয়ে এসে সে বেশি করে পানি দিয়ে চালগুলো সেদ্ধ বসায়। এ বেলা এই ঢলা জাউ দিয়ে পার হয়ে যাবে।
সুমন,পিদিম আর চামেলী তিনজন লাইন ধরে বসে আছে ভাতের হাড়িটিকে ঘিরে।ওই দিকে আবার মনসুরের মা রান্নার সরঞ্জাম নিয়ে চলে এসেছে। এই চুলাটি তারা তিন গৃহস্থ এক সঙ্গে ব্যবহার করে । গোসলখানা আর পায়খানার ও ওই নিয়ম। এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই একচোট লেগে যায় সবার সঙ্গে সবার। কাজলি নরম নিরীহ গোছের বলে নিজে সয়ে নিয়ে সে ঝগড়া ফ্যাসাদ থেকে বেঁচে থাকার চেস্টা করে। তবু জালালের মার মতো মানুষেরা তার সঙ্গে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে ছাড়েনা। কাজলি তা মনে রাখেনা। সুমনের বাপ আনসার থাকতেও তাকে প্রায় প্রতিদিনই মার খেতে হতো। তবু সে তাকে মাফ করে দিত। যার খায় যার পরে সে মারলে তো সহ্য করতেই হবে। এত সয়েও স্বামীকে তার ধরে রাখতে পারলো না সে। জরিনা সুন্দরী যত বড় সুন্দরী ই হোক মানুষ হিসাবে সে নাপাক। তার মতো সতী নয়। সুমনের বাপের মতো এমন কত পুরুষ মানুষকে সে বশ করেছে তার ঠিক নাই। রাতে তার ঘরে টুক টুক শব্দে কেউ দরজায় টোকা দেয়। কাজলি শুয়ে ছেলে মেয়ে তিনটিকে ঘুম পাড়াচ্ছিলো। তারা প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। কাজলির ঘুম আসেনা। সারা রাত তার জেগেই কাটে। ভোর রাতের দিক যখন আযান দেয় তখন হাত পা অবশ হয়ে কিছুটা ঘুম হয়। সকাল সাতটা বাজার আগেই আবার উঠে যেতে হয়। সকালের দিকে কলটা ,গোসলখানাটা একটু ফাঁকা পাওয়া যায়। আটটা বেজে গেলে লাইন ধরতে হয়। দুরু দুরু মনে কোথায় যেন একটা কু ডাক সে শুনতে পায়।
বার তিনেক টোকা দেয়ার পর ভীরু পায়ে দরজা খোলে কাজলি। যা ভেবেছিলো তাই, খসরু! জালালের বাপ। ব্যাটার যে চোখ খারাপ তা সে অনেকদিন ধরেই বুঝতে পারে। লুচ্চা লোকের চাহনি দেখলেই সে টের পায়। এই সব পাপের ঝামেলা থেকে নিজেকে বাঁচাতেই সে কাপড় দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে চলে তাতে পাছে তাকে কেউ কেউ আহারে কি ভালো বউটার কি দশা ! জাতীয় করুনা করে যায় বটে সেসব সে গায়ে মাখেনা। যার স্বামী নেই তার এত দেমাগ কি। সে চলে মাটির সঙ্গে মিশে। খসরু তার ঠোটে তর্জনি চাপিয়ে চুপ থাকার ইশারা দেয়। কাজলি কিছু বলার আগেই সে ঘরে ঢুকে এককোনে হাতের ব্যাগটা রাখে। ব্যাগ থেকে পেঁয়াজকলি পুঁই পাতা উকি দিয়ে আছে । কিছু বাজার আছে ব্যাগে, মুরগীটা জবেহ করে পোলাপানগুলিকে যেন রেন্ধে খাওয়ায় কাজলিকে খসরু সে কথাই জানায়। কদিন ধরেই সে খেয়াল করছে বাচ্চাগুলো কটি জাউভাত খেয়ে আছে। তার ঘরে এত খাবার আর তার পড়শী না খেয়ে থাকবে –এত খারাপ মানুষ সে নয়।
কাজলি মৃদু গোঙ্গানির স্বরে বলে ,’এগুলো নিয়ে যান ।‘
খসরু তার হাত চেপে ধরে। সে এগুলো ফিরিয়ে নিতে দেয়নি। না খেয়ে মরবে তবু সাহায্য নেবে না, এত দেমাগ ভালো না মেয়ে মানুষের। পকেট থেকে সে একটা ছোট কাগজের প্যাকেট খুলে একটা কমদামী লিপস্টিক আর আই ব্রো পেন্সিল কাজলির হাতে দিয়ে জানায় সে যেন একটু সেজেগুজে থাকে। এমন মলিন চেহারা করে রাখলে তার কস্ট হয়।
মেসের ছেলেগুলো বড় ভালো। মাত্র কদিনে তাকে তারা আপন করে নিয়েছে। অন্য বাসার মতো বুয়া ডাকেনা। খালা ডাকে। সে কাজ করে বাসাবাড়িতে। এটাই তার নিয়তি। তবু কেন জানি বুয়া ডাকলে খুব কস্ট হয়। কোন কোন বেয়াদব বুয়াদের মতো সে বলতেও পারেনা –আমারে বুয়া ডাকবেন না।
অনেকগুলো মানুষের ভাত রান্না। মাড় গাললে অনেক মাড় হয়।সেগুলো সে ফেলে দেয়না।খালি পানির বোতলে করে বাড়ি নিয়ে যায়। একটু নুন গুলে দিলে ছেলেমেয়ে তিনটে তার হাপুস হুপুস গিলে নেয়। আজ ও সে তাই করছিল। পিছন থেকে রনি মামা এসে বলে ,’খালা ওটা কি করছেন?’
কাজলি একটু যেন কেঁপে যায়। এত বাসাবাড়িতে কাজ করে কোনো বাসার কোন সামান্য জিনিস ও সে চুরি করেনা। কিন্তু মেসের থেকে সে মামাদের না বলেইতো মাড়টা নিয়ে যায়। হায় আল্লাহ এটাও বুঝি চুরিই হবে। মামাগুলো তাকে কত ভালো ভাবে। কি লজ্জার ব্যাপার হয়ে গেল। কাজলি মিনমিনে নিচু গলায় বলে ,’ আমার পোলাপানগুলোর জন্য নিচ্ছিলাম। চাল কিনতে যদি পারি ভাত রানতে রানতে রাত হবে। এবেলা ওরা এগুলো খেয়েই বেশ থাকে। ‘
ততক্ষণে মাহমুদ ,সাইমন,শামীম মামারা ব্যাপার কি বুঝতে চলে এসেছে। শামীম মামা ধমক দিয়ে বলে ,’খালা আপনি এইটা একটা কাজ করলেন। আপনি এইখান থেকে মাড় নিয়ে যাইয়া বাচ্চাগো খাওয়ান।‘
কাজলি কাঁচুমাচু হয়ে বলে ,’আমার ভুল হয়ে গেছেগো মামা। আর আমি না বলে এমন করুম না।‘
শামীম মামা ফের ধমকে উঠে বলে,’ হ্যা আর এরকম করবেন না। এখন থেকে ভাত তরকারী রান্না শেষে আমাদের দেয়ার আগে আপনার ছেলেমেয়ের জন্য আগে উঠিয়ে রাখবেন বক্সে।‘
রনি,সাইমন ,মাহমুদ মামারা সবাই মাথা ঝাকিয়ে বলল, হ্যা হ্যা।তাই করবেন। কাজলির চোখে পানি এসে গেল। খোদাতায়ালা বুঝি তাকে সেই দিনের সামান্য পুণ্যির জন্য আজকের এই পুরস্কার দিলেন। সেদিন সে খসরুর বাজার খুলেও দেখেনি। যদিও সুরমাকে বলতেই সুরমা বলেছিল –চুপচাপ রাইন্ধা খায়া ফেল পোলাপানগুলিরে নিয়া। এসব কি খসরু দিছে ? দিছে তোরে আল্লাহ খসরুর উছিলায়।‘
সুরমার কথায় ব্যাঘাত দিয়ে সে বলে ,’তুই যে কি কস না। এইসব খাইলে আমার খসরুর কথা না শুনলে চলব ।‘
সুরমা হাঁসের মতো খরখরে গলায় মিচকে হাসি দিয়ে বলে ,’তয় শুনবি।সমেস্যা কি। জালালের মার অবস্থাটা যে তখন কি হপে ভাবলি আমার দারুণ মজা লাগতিছে। বিটিরে একটা শিক্ষে না দিলি আর চলে না । সে যেন এই বস্তির মালকিন হইছে। বুচ্ছিস কাজলি- আমার বুদ্ধি শোন ,এত ভাল থাকলি দুনিয়া চলেনা।এই যে আমি গার্মেন্টস এ কাম করি। অখন কত জনে কত সময় গায়ে পইড়া উপকার করতে চায়। এখন আমি যদি তোর মতো ভাল হইয়া চলি আমারে তারা কয়দিন উপকার করব ? বলে সে তার হাতের মোবাইলটা কাজলিকে দেখায়। ‘এই দেখ এইটা দেখছস ? ইসমাট ফোন। এই দেখ এর মধ্যে কত্ত কিছু আছে। সুরমা আঙ্গুল দিয়ে ঠেলে ঠেলে মোবাইলের ওপর থেকে একের পর এক ছবি সরায়। কত মানুষ দেখা যায়। এক সময় সুরমাকেও দেখা গেল। সে সাজগোজ করে নায়িকা সেজে তাকিয়ে আছে। ও মা ওড়নাটা গলায় ঝুলায়ে রাখছে। বড় গোল গলায় তার উপরের অংশ সব দেখা যাচ্ছে। ‘অই হারামজাদী,অ কেমন ছবি তুলছ?’
সুরমা খিল খিল করে হেসে বলে ,’এইটা হইতেছে ফেসবুক।এইখানে মাইয়ারা এই রকম কইরাই ছবি দেয়। তুই একটা ক্ষ্যাত পাবলিক। এখন দেশটা ডিজিটাল হইয়া গেছে,ফকিরের হাতেও মোবাইল আছে। তারা মানুষ দেখলে লুকায়ে ফেলে। আর তোর কিনা একটা মোবাইল ও নাই। ‘
‘মোবাইল নাই হেই কথা বলস ।আর প্যাটে যে ভাত নাই হেই কথা কে কয়? ‘ কাজলি সুরমার বদ বুদ্ধি না শুনে বুকে পাথর চাপা দিয়ে বাজারগুলো মনসুরের মাকে দিয়ে দেয়।
খসরুকে তো আর ফেরত দিতে পারেনা। পাছে জালালের মা টের পেয়ে যায়। কিন্তু খসরু দেখুক তার বাজার সে খায়নি। তাই তার কথা শোনার ও তার কোন দায় নাই।
জালালের মার ঘরখানি সবার ঘর থেকে একটু উঁচু । দুই সিড়িমতো জায়গা ডিঙ্গিয়ে তার বাঁশ আর কাঠের তক্তায় মোড়া মেঝেতে পা রাখা যায়। ঘরের নিচ দিয়ে ময়লা পানি আবর্জনার স্তূপের ছোট্র না পুকুর না খালটা গলির শেষের ফ্ল্যাটটার কাছে যেয়ে বন্ধ হয়েছে। ময়লা আবর্জনার গা ঘেঁষে ফাকা মতো জায়গাটায় ছেলেমেয়েরা খেলা করে। বস্তির বউরা এ ওর পিছে বসে উকুন বাছে। ময়লা পানি আর মাটির মিলনস্থানে কতক মানকচু আর হেলেঞ্চা শাক টগবগিয়ে বেড়ে উঠেছে তাদের বাড়ন্ত বয়সে। তারই আশপাশ দিয়ে মুরগীর পাল আহার খুঁজে বেড়ায়। জোড়াবেধে হাঁসগুলো কাঁদা খুঁচে আকাশ্মুখো গড়্গড়ি করে প্যাঁক প্যাঁক শব্দ তোলে।
সন্ধ্যেবেলা জালালের মা ঘরেই ছিলো। লাল আর হলুদ রঙ্গের বড় বড় কটকটে ফুল ফুল ছাপার বিছানার চাঁদরে পা দু’খানি ছড়িয়ে সে রিমোর্ট হাতে করে টিভি দেখছে। মেঝেতে আশপাশে কয় ঘরের কয় কুচোপাচা হা করে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। সুরমা সচরাচর তার ঘরে যায়না। অমন দেমাগী বেটির ঘরে বসে সে নিজেকে অত ছোট করে দেয়না। সে থাকে তার দেমাগ নিয়ে। কিন্তু আজ কথা ভিন্ন। তার বশে থাকা স্বামীর কুকীর্তিগুলো একটু রং চং মাখিয়ে তাকে শুনিয়ে তার দেমাগে খানিক ঘা না মারলে চলবে কেন। একটু ইতস্তত করে জালালের মার ঘরে ঢুকে সুরমা কৈফিয়ত দেয়ার মত করে বলে ,’ একটু আসলাম জালালের মা ,সময় মোটে পাইনা যে কারো একটু খোঁজখবর নেব।‘
জালালের মা থানার বড় দারোগার মতো চোখ তুলে অভ্যর্থনাহীন কি চাই ভঙ্গিতে তাকায় সুরমার দিকে। আড়চোখে তাকিয়ে বসতে না বলে কি মতলবে এসেছে সে খবর বোঝার চেস্টা করে। তার ঘরে চারপাশের এই হাড়-হাভাতেরা শুধু চাইতেই আসে। কারো নগদ টাকা চাই তো কারো এক কেজি চাল চাই। সে যেন খাজানা নিয়ে বসে আছে। আর এই মাতারিকে তো সে দুই চোখে দেখতে পারেনা। গার্মেন্টসে দুদিন কাম করে আকাম কুকাম করে দু চার পয়সা রোজগার করতে শিখে ভারী ইসমার্ট হয়ে গেছে। তার আড়ালে সে তার কি কি বদনাম সবার কাছে গেয়ে বেড়ায় ধার দেনা করতে এসে সেগুলো তারা সবই তাকে বলে যায়।
জালালের মা অতি আলসে কন্ঠে বলে ,’বস ,ওই মোড়াটা নিয়ে বস। ‘
সুরমা রঙ্গিন মোড়াটা টেনে বসে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে সে হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরে। স্টিলের শোকেস ভর্তি মাতারি কাচের জিনিস জমায়ে ফেলছে। কত বড় স্টিলের আলমারিও বানিয়েছে সে। ফ্রিজটা কত বড়। রড আয়রনের বড় খাট,পুরানো ড্রেসিং টেবিল ও কিনেছে। আলনায় পরিপাটি কাপড় সাজানো,তারই পাশে থালাবাটি রাখা র্যাকটি। খাটের পাশে পার্টিকেল বোর্ডের নতুন আরেকটি শোকেস যেন জালালের মার মাথার উপর ঝুকে এসেছে। বাপরে বাপ এত মাল বানায়ে ফেলছে মর্দানি।
সুরমাকে জালালের মা পাত্তা না দিয়ে মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখায় ব্যস্ত হয়। সুরমাও কিছুক্ষণ নিরুপায় হয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে। সিনেমার এই পর্যায়ে নায়িকা পপি নায়ক জসিমের ভূমিকায় অবতীর্ণ। সবগুলো শয়তানকে সে একাই মেরে ঘায়েল করে দিচ্ছে। তার পরনের পোশাকটির উপরাংশ ব্লাউজের মতো একটা কিছু। মাঝখানে নাদুস নুদুস বিরতি,নিচে কারুকার্য খচিত পেটিকোটের মতো একটা বস্ত। সুরমা মুগ্ধ হয়ে দেখে আহা কি সুন্দর নায়িকা ! সেও যদি অমন হতে পারতো। মোড়া থেকে উঠে গিয়ে সে খাটে জালালের মার কাছে গিয়ে বসে। যতটা নিচু গলায় গোপন কথা বলতে আছে ততটা নিচু গলা করে সে কুটনামি শুরু করে।
প্রথমটা জালালের মা রাগে এমন কাঁপতে বকতে থাকে যে কাজলিকে গিয়ে পারলে তখনই খুন করে আসে। কিন্তু সুরমা তাকে শান্ত করে। এভাবে রাগলে চলবে না। আসল কাজ করতে হবে। সে কেন অই কাজলির স্বামীর কাছে গিয়ে তার নস্টামীর বয়ান করেনা,একসংগে না থাকলেও কাজলিকে সে ত্যাগ তো দেয়নি। এসব শুনলে সে একটা বিহিত করতে পারে। আর যদি সে জরিনা সুন্দরীকে ফেলে আবার কাজলির কাছে ফিরে আসে সেইটাই হবে জালালের মার আসল নিরাপত্তা। তাই সে পথেই তাদের এগুনো উচিত।
সুরমার কথাগুলো জালালের মার মনে ধরে। ছোট্র একটা হতাশা নিঃশ্বাস ফেলে সে তার একশো বিশ কেজি ওজনের কালো দেহটা নড়িয়ে ফ্রিজ থেকে মিস্টি আর গুড়ের পায়েস বের করে সুরমাকে আপ্যায়ন করে।
সুরমা গদ গদ হয়ে বলে –সে যেন সময় নস্ট না করে। কারো সংসার ভাঙ্গতে দেখলে তার ভাল লাগেনা।তার দু’দুটো ঘর ভেঙ্গেছে ।সে জানে ঘর ভাঙ্গার কস্ট।
পরদিন বেলা ডোবার আগেই কাজলির স্বামী আনসার এসে হাজির। সে আসছে এ খবরটা সুরমা দৌড়ে এসে তাকে জানিয়ে যায়। তোর আর জালালের বাপের কথা কে যেন গিয়ে আনসারকে খবর দিছে,তুই কিন্তুক ভালো সাজতি যাবিনা। বলবি একা থাকিস খাবার নাই,পয়সা নাই একখান পুরুষ মানুষ তো তোর লাগেই। তাতে তার কি।
কাজলি হা করে সুরমার মুখে চেয়ে থাকে।
‘শোন কাজলি,যদি আমার বুদ্ধিডা কাজে খাটে ,তখন বুঝবি আমি তোর কত বড় উপকার কললাম।‘
আনসার এসে একচোট চেঁচামেচি করলে কাজলি সুরমার শিখিয়ে দেয়া কথাগুলো বলে।তাতে আনসার কিছুটা দমে সে তার দুর্দশার কথা কাজলিকে জানায়। জরিনা তার সব টাকা পয়সা হাত করেছে। এখন টাকা রোজগার করতে পারেনা তার ব্যামোর কারনে। সে তাই দুবেলা ভাতটা পর্যন্ত তার সামনে দেয়না। কই কই যেন ঘুরে বেড়ায়। বাজারী মেয়েমানুষ। তার সংসারটা মাঝখান দিয়ে ভেঙ্গে দিল। তবে সেও এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর যাবেনা তার কাছে। বাচ্চাগুলোকে কাছে নিয়ে সে বুকে জড়িয়ে ধরে। তারা কবে এত ডাঙ্গর হয়ে গেলো। কাজলির কাছে তারা ভাত চাইতেই কাজলি অভিমানে ধমকে উঠলো। আজ চাল কিনতে পারেনি। দুপুরে যে মেস থেকে খাবার এনে দিলো তাতে তাদের পেট ভরেনি কেন।
আনসার কাজলির পায়ে ছুঁয়ে ক্ষমা চাইতে আসে। তার বড় ভুল হয়ে গেছে সে যেন তাকে ক্ষমা করে দেয়। খানিক বাদে সে বাইরে যেয়ে ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে আসলো । কাজলি চোখ মুছতে মুছতে ম্যাচের কাঠি দিয়ে চুলা ধরায়। আজ সবাই একসঙ্গে বসে খাবে।