বুশরার হাসব্যান্ড মানে আকবর ভাই মনে করতো বুশরার সঙ্গে আমার প্রেম।
উনি যে এরকম মনে করতো এটা আমি শুরুতে বুঝিই নাই।
আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে ওনার মনে সন্দেহটা দানা বাঁধতে বাঁধতে এমন এক পর্যায়ে আসতে শুরু করছে যে, উনি আমার সাথে কথা বলার প্রয়োজন পর্যন্ত অনুভব করছেন। উনি প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় বুশরাকে পিক করতে আমাদের অফিসের নিচে আসতেন। এসে নিচের দোকানে চা-সিগারেট খেতেন। বুশরা নামলে ওকেও এক কাপ চা অফার করতেন। প্রতিবার বুশরা তীব্র অনীহা নিয়ে নাহ বলতো। উনি তখন বাইকটা স্টার্ট করতেন। জিন্স পরা বুশরা দুই দিকে পা ছড়িয়ে বাইকে উঠে বাসায় চলে যেত। আমার মনে হতো বুশরা যে কোনোদিন শাড়ি বা সালোয়ার পরে না সেটার মূল কারণ আকবর ভাইয়ের বাইক। জিন্স পরলে সম্ভবত বাইকে ওঠার সুবিধা হয়। বুশরা যেবার দিনাজপুরে যাবার জন্য সাত দিনের ছুটি নিলো সে বার অফিস শেষ করে নিচে নেমে দেখি আকবর ভাই দাঁড়িয়ে। আমি তো তাকে দেখে অবাক। বললাম, প্রতিদিনের অভ্যাসমতো ভুল করে চলে এসেছেন নাকি? আকবর ভাই কিছু না বলে শুধু হাসে। বলে, চা খাবেন নাকি? এক কাজ করেন আপনি জানি কই থাকেন?
মগবাজার।
তাহলে চলেন টিএসসির দিকে যাই। ওখানে চা খেয়ে আপনাকে মগবাজার নামিয়ে দেবো।
আমি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলাম। বললাম, চলেন।
আমি তখনও বুঝি নাই আকবর ভাই আমার সঙ্গে কী আলোচনা করতে চান। আলোচনার পরেও আমি ক্লিয়ার হতে পারি নাই যে তিনি আমার সঙ্গে কী আলোচনা করলেন। কয়েকদিন পর অবশ্য আকবর ভাই ও আমি দুজনেই ক্লিয়ার হয়ে গিয়েছি। ঠিক ঘটনা বেশ রহস্যাবৃত কিন্তু একটা পার্ট আমরা দুজনেই মোটামুটি বুঝতে পেরেছি।
টিএসসিতে দেখলাম চায়ের দোকানদাররা আকবর ভাইকে মোটামুটি ভাল চেনে। এখানে তিনি নিয়মিত আড্ডা দেন সেটা বোঝা গেল। এটা বলতে গেলে তার এলাকা। দুইজন চা নিয়ে বসে কথা বলতে থাকলাম। এই প্রথম তার সঙ্গে আমার আলাপ হচ্ছে এভাবে। ফলে, এটা সেটা নানা কথা হচ্ছিল। এইসব ইতংবিতং সেরে তিনি বেশ ভদ্রভাবে বুশরার প্রসঙ্গে এলেন। আপনার কী মনে হয় বুশরা কাজটা ঠিক করতে যাচ্ছে?
আমি বললাম, কোনটা?
বুশরা দিনাজপুরে কেন যাচ্ছে সেটা যে আমি জানি না এটা বুঝে আকবর ভাই বেশ অবাক হয়ে গেলেন।
আপনি কিছুই জানেন না? বুশরা আপনাকে কিছু বলেনি? বাসায় তো সারাক্ষণ নাসিফ নাফিস বলে। কিছু একটা হলে জানো নাফিস এই নিয়ে কী বলে। আপনাকে সে জানায়নি কেন দিনাজপুর গেল সাত দিনের ছুটি নিয়ে?
আমি তখনও আকবর ভাইয়ের ভাব বুঝতে পারছিলাম না। তাই বুশরা আমাকে বলেছে কী বলে নাই সেটা আকবর ভাইয়ের কাছে খোলাসা করার ইচ্ছা আমার ছিল না। ফলে, আমি তাকে ফ্লোর দিয়ে রাখলাম।
আকবর ভাই বললেন, বুশরা তো চাকরি ছেড়ে দিয়ে দিনাজপুর গেছে।
আমি বিস্মিত হওয়ার ভঙ্গি করে আকবর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, কী কন!
আকবর ভাই আমার ভঙ্গিটা দেখে আশ^স্থ হলো।
ভঙ্গিটা এমন করলেও আমি আসলে জানতাম বুশরা চাকরিটা ছেড়েই দিনাজপুর গেছে। কিন্তু আকবর ভাই জানে কি না আমি জানি না, বুশরার রিজাইন লেটারটা জয়নুল ভাই মানে আমাদের বস অ্যাকসেপ্ট করেন নাই। বুশরা রিজাইন লেটারটা জমা দেওয়ার আগে আমার সাথে অনেক দিন ধরেই ঘ্যান ঘ্যান করছিল। এই চাকরি ভাল লাগে না। বুননকে একদম সময় দেওয়া হচ্ছে না। এইগুলো সব বাদ দিয়ে কানাডায় অ্যাপ্লাই করবো কি না। বুশরার এইসব কথায় আমি কোনোদিনই কান দেই নাই। কারণ, বেশিরভাগ সময় এইসব অফিস পলিটিক্সের অংশ। বুশরা আর আমি সেম পজিশনের কর্মী। এজও সেম। কাজের সূত্রে আমরা সারাদিন এক সঙ্গেই থাকি। এক সঙ্গে চা খাই, এক সঙ্গে ভাত খাই। কিন্তু আমাদের ওপরের পোস্টটা খালি হয়ে যাওয়ায় দুজনেই একটা তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে আছি। জয়নুল ভাইও সুযোগটা বেশ কাজে লাগাচ্ছে। আমাদের নিজেদের কাজ তো বটেই, নিজের অনেক কাজও জয়নুল ভাই আমাদের দিয়ে করাচ্ছে। আমরা দুজনেই নানাভাবে জয়নুল ভাইকে কনভিন্স করার চেষ্টা করছি যে এজিএম পোস্টটার যোগ্য আমি। এরকম একটা সময়ে বুশরা নানা ইতংবিতং শুরু করলে আমার সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। আমার মনে হয়েছিল, নিজের উইথড্রয়াল সিনড্রোম দিয়ে সে আমার মধ্যে উইথড্রয়াল সিনড্রোম পুশ করতে চাইছে। ফলে, ওর এইসব কথায় আমি তেমন একটা কানও দেইনি, মনও দেইনি। তাই বলে এই না আমি আর বুশরা একজন আরেকজনের পেছনে লেগে আছি। আমাদের সম্পর্ক খুব ভাল। কিন্তু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ব্যাপারে খুব বেশি শেয়ারিং নাই। আমি জানি, আকবর ভাই তার হাসব্যান্ড। বুনন ওনাদের মেয়ে। পাশাপাশি ডেস্কে বসলে যেটুকু জানা যায় সেইটুকু জানি। কিন্তু ইচ্ছা করে আমার একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার আমি বুশরাকে বলি না, সেও বলে না। এই জিনিশটা কী এইটা আমিও বুঝি না। জয়নুল ভাই ম্যানেজমেন্টে ঝানু। উনি বলে, এইটার একটা টার্ম আছে। এটাকে বলা হয় ওয়ার্ক প্লেস দাম্পত্য। আপনি যখন ছুটিতে তখন বুশরা আপনার কাজ করে। আপনিও ওর ছুটিতে করেন। এক সঙ্গে থাকেন আট দশ ঘণ্টা। দুপুরের খাবার, চা কফি, বিকালের স্ন্যাকস এইসব খেতে খেতে এমন একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় যে এটাকে দাম্পত্য বলাই যায়। অনেকে ভাববে প্রেম, কিন্তু এটা আসলে হেলদি ওয়ার্কিং রিলেশন। প্রোডাক্টিভিটি বাড়ে। জয়নুল ভাই ভাল করে জানে প্রোডাকটিভিটি কেমনে বাড়াতে হয়। আমাদের সম্পর্ক ভাল থাকুক আবার প্রতিযোগিতাও থাকুক এটাই তার মূল চাওয়া। যাই হোক, ২৯ তারিখে বুশরা একটা কাগজ আমার হাতে ধরিয়ে দিলো।
দেখো তো, ঠিক আছে কি না।
আমি হাতে নিয়ে দেখি রিজাইন লেটার।
বললাম, ফান করছো নাকি? আজ বাদে কাল এজিএম হবা।
বুশরা বলে, আমি তোমাকে কতবার বলছি না? আমি আর পারতেছি না নাফিস।
আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চিঠিটা নিয়ে সে বসের রুমের দিকে হাঁটা দেয়।
আমি খুবই বিস্মিত হয়ে, তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
কিছুক্ষণ পর বসের রুম থেকে আমার ডাক আসে। জয়নুল ভাই বলে, নাফিস বসেন। বুশরা কী বলে জানেন? সে তো রিজাইন করতে চায়। আমি কিন্তু এতদিন আপনাদের গুড কলিড হিসেবে জানতাম। কিন্তু প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে সম্পর্কের এত অবনতি ঘটেছে সেটা ভাবতেও পারিনি। বলেন, বুশরা কেন চাকরি ছাড়তে চায়। বুশরা বলে, জয় ভাই, সত্যি নাফিস কিছু জানে না। এটা আমার ব্যক্তিগত সমস্যা। আমি আসলে নতুন অফারটা নিতেই চাচ্ছি। এর সঙ্গে নাফিসের কোনো সম্পর্ক নাই।
জয়নুল ভাই রিজাইন লেটারটা বুশরাকে ফিরিয়ে দিলেন। বললেন, আপনাকে সাতদিন ছুটি দিচ্ছি। দিনাজপুরে গিয়ে যদি ভাল লাগে তাহলে চাকরিটা নেন। আর ভাল না লাগলে ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসেন। এর মধ্যে নাফিস কাজ সামলাক। কী বলেন নাফিস?
জি¦, জয় ভাই। এটাই বেস্ট হয়।
বুশরা আমাদের দুজনের আন্তরিকতায় খুব খুশী হয়। কিন্তু যাওয়ার সময় বলে, আমি মনে হয় আর ফিরবো না।
ডেস্কে ফিরে বুশরা বলে, তোমার ড্রয়ারে লেটারটা রাখো। আমি বললে বসকে দিবা।
কথামতো, ৩১ তারিখ সকালে দিনাজপুরের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার কথা বুশরার। আমি একটা টেক্সট পাঠিয়েছিলাম। সাবধানে যেও। টেক্সট পেয়ে বুশরা কল করলো।
নাফিস, কী বলবো তোমাকে। আমার যেতেও ইচ্ছা করছে না, থাকতেও ইচ্ছা করছে না। চার বছরের মেয়েটাকে রেখে যেতে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আপাতত আম্মার বাসায় রেখে যাচ্ছি। নুশরা আছে। ও তো এখন ফ্রি। আম্মা দেখবে, বুনন তো নুশরা বলতে পাগল। কিন্তু নিজের মা দিনাজপুরে, এটা কিছু হয় বলো।
বুশরা কাঁদতে থাকে।
আমি বলি, তুমি তো একবারেই যাচ্ছো না। সত্যি কথা বলতে তুমি তো আসলে সাত দিন পর এসে অফিস করতে শুরু করবা। ফলে এত চিন্তার কিছু নাই। আর যদি দিনাজপুরে জয়েন করো, তাহলে নিশ্চয়ই ধীরে ধীরে সব গুছিয়ে দিবা। বুননকে নিয়ে যাবা সাথে। তবে লোক লাগবে সাথে। তুমি গুড প্ল্যানার, কিছু একটা উপায় বের করবাই।
আসলে কী জানো নাফিস, জীবনটা নিয়ে আমি একেবারেই ঠেকে গেছি। আকবরকে সহ্য করতে পারি না। তোমাকে কখনো বলিনি, কিন্তু পাশাপাশি বসে সাত বছর কাজ করি। তুমি তো কিছুটা হলেও বোঝো। আর কেয়ারের কাজটা ভাল। ওদের অফারও ভাল। সমস্যা এই একটাই ঢাকার বাইরে পোস্টিং।
বুশরা এই প্রথম বলে, কোথায় চাকরি পেয়েছে। বলেই আমাকে সাবধান করে দেয়, জয়নুল ভাইকে বলো না। সবাই তো ওনার বন্ধু। চাইলে একটা ঝামেলা করতেই পারবে।
আমি বুশরাকে আরো স্বান্ত¡না দেই। বলি, খাওয়াদাওয়া ঠিক মতো করবা। আর ফোনে বুননের খোঁজ নিতে থাকবা। দেখবা ভাল ফিল হচ্ছে।
আকবর ভাই যখন বুশরার চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা আমাকে বললো তখন আমি কিছুই জানি না এটা প্রকাশ করাটা আমার জন্য খুব কঠিন ছিল। আসলে তো আমি অনেক কিছুই জানি। কিন্তু বুশরার সমস্যাটা যেহেতু সো ফার আকবর ভাইকে নিয়েই, ফলে আমি ব্যাপারটা তার কাছে খোলাসা করতে চাচ্ছিলাম না।
আমি যে ব্যাপারটা জানি না এটাতে আকবর ভাই একটু খুশী হলেন বলা যায়।
আমার সবচেয়ে বেশি চিন্তা হচ্ছে বুননকে নিয়ে। যদিও ওর নানির কাছে ভাল থাকে। আর নুশরা তো আছেই। তবু, মা নাই। মেয়েটা তো মাকে মিস করবে, তাই না? আকবর ভাই একটু থামে। আমার দিকে তাকায়।
বুশরাকে আমি একবার বলেছিলাম, নাফিসের সঙ্গে নুশরার বিয়ে দিলে কেমন হয়?
আমি একটু সতর্ক হয়ে যাই। তাহলে কি আকবর ভাই শালীর বিয়ের ঘটকালী করতে এসেছে? নুশরা এমনিতে বেশ ভাল মেয়ে। সুন্দরী। লাস্ট বুননের জন্মদিনে বুশরাদের বাসায় ওর সাথে দেখা হয়েছিল। আমাকেও পছন্দ করে বলে মনে হয়। বছরে দুএকবার তো অফিসে আসেই। কিন্তু, আমার মনে হয় নুশরার বন্ধু তমালের সঙ্গেই ওর বিয়ে হবে। আর বুশরাও সেটা চায়। মাঝে মাঝে বুশরা তমালের কথা বলে। নুশরার বন্ধু তমাল আছে না? তমালকে মনে আছে, ওই নুশরা আর তমাল আমাদের অফিসে আসলো না গত সেপ্টেম্বরে। এইসব শুনে আমার মনে হয়, ছোটবোনের জন্য তমালকেই বুশরার পছন্দ। তমাল এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় সিটিজেনশিপ পেয়ে গেছে। ফলে, নুশরাকে নিয়ে আর চিন্তা থাকছে না তাদের। আমি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলি, বুশরা কী বলে?
বুশরা কিছুই বলে না। হাসে। বলে, হলে তো ভাল হতো। কিন্তু নাফিস যা ক্যারিয়ার অরিয়েন্টেড। জিএম হওয়ার আগে বিয়ে করবে বলে মনে হয় না।
আমি হাসি। বলি, আমার তো মনে হয় জানেন আকবর ভাই, নুশরার জন্য বর ঠিক করে রেখেছে বুশরা।
তমাল?
হা। বুশরা গুড প্ল্যানার, এটা মনে রাখবেন।
আমারও তাই মনে হয় মাঝে। তমাল দেশে এলে তো নুশরার সঙ্গেই ঘোরে। কিন্তু মুখে তো কিছুই বলে না। আমাদের বাসায় আসে দুইজনে কিন্তু জিজ্ঞেস কররে নুশরা কিছু বলে না। তমালকে তো আর জিজ্ঞেস করা যায় না।
সত্যি বলতে, আকবর ভাই বলার আগে নুশরাকে নিয়ে আমি চিন্তাও করিনি। ঘটনাবলী অবজার্ভ করেছি। কিন্তু নুশরাকে নিয়ে একদমই ভাবিনি। আমার কাছে বারবারই মনে হয়েছে, তমালকেই নুশরা পছন্দ করে। আর তমালও সম্ভবত তাই করে। স্কুল থেকে ওরা বন্ধু। একই এলাকায় বড় হয়েছে। পারিবারিক সম্পর্কও বেশ ভাল। শাহজাহানপুর এলাকায় নিজেদের বাড়ি। বুশরার বাবার বাড়িও শাহজাহানপুরেই। তমাল দেশে এলে নুশরাদের বাড়িতে দিনের অনেকটা সময় কাটিয়ে দেয়। বুশরাও ওকে পছন্দ করে এটা বলা যায়। এইটুকু আমি অবজার্ভ করে জেনেছি।
আকবর ভাই বলে, সত্যি বলতে বুশরাকে আমি বুঝি না, নাফিস।
আমি অবাক হয়ে আকবর ভাইয়ের দিকে তাকাই। বোঝেন না মানে কী?
বুঝি না মানে বুঝি না। এর তো কোনো ব্যাখ্যা নাই। কিন্তু ও যে হঠাৎ কেয়ারের চাকরি নিয়ে দিনাজপুর গেল। কেন গেল? এটা আমার মাথায় একদম ঢোকে না। আমার কী মনে হয় জানেন, বুশরা সবকিছু ল-ভ- করতে চাইছে। ওর মাথায় কী চলে এটা আমি কখনো বুঝতে পারি না। এখন আরও বুঝতে পারছি না। দিনাজপুর গেল সাতদিনের জন্য। কিন্তু বড় বড় লাগেজ নিলো দুইটা। ওর কাপড় গোছানোর ভাব দেখে মনে হলো, দিনাজপুর গিয়ে আর ফিরবে না। মেয়েটার ভবিষ্যত কী হবে? এটা একবার ভেবেছেন।
আপনার কি মনে হচ্ছে, সে পাকাপাকি দিনাজপুর চলে গেছে?
আকবর ভাই ভাবে। আমিও ভাবি। বুশরাদের বাড়ি তো নোয়াখালি। এমন নয় যে, দিনাজপুরে ওর কোনো পরিচিত সার্কেল আছে। সেখানে গিয়ে আরাম করে জাঁকিয়ে বসতে পারবে। নোয়াখালিতে গ্রামের বাড়ি হলেও ঢাকাতেই বরং ওদের সবকিছু। ঢাকাতেই কমফোর্ট ফিল করে ওরা আজীবন। কিন্তু, আকবর ভাইকে এড়ানোর জন্য ঢাকা ছেড়ে দিনাজপুর যাওয়া ছাড়া ওর সামনে কি আর কোনো অপশন ছিল না? একজনকে পছন্দ না হলে তো ডিভোর্স দেয়া যায়। কিন্তু এইভাবে ল-ভ- করার মানে কী? গুলশানের কর্পোরেট অফিসে এত ভাল চাকরি। এগুলো ছেড়ে কেয়ারে একেবারে জেলা পর্যায়ের চাকরি নেয়ার অর্থ কী?
আমার তো তাই মনে হয়, বলে আকবর ভাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আপনার সঙ্গে তো কখনো এভাবে কথা হয়নি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে আপনার সাথে কথা বলা যায়। আপনি তো বুশরার দীর্ঘদিনের কলিগ। বুশরার মুখে আপনার নামটা অনেকবার শুনতে শুনতে কাছেরই মনে হয়। যদিও খুব ফরমাল সম্পর্ক।
সত্যি বলতে কী আকবর ভাই, বুশরার সঙ্গে আমারও খুব ফরমাল সম্পর্ক। আবার এটাও ঠিক, এক সাথে কাজ করতে করতে এক ধরনের বন্ধুত্ব টাইপ ব্যাপার তো হয়ই। একটা কথা আমাকে বলবেন, আপনার আর বুশরার সম্পর্ক কি ঠিক আছে?
আকবর ভাই একটু ভাবে, আমার দিক থেকে বললে আমি বলবো এভরিথিং ইজ ওকে। আমি তো গরিব ঘরের ছেলে। স্ট্রাগল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। কিন্তু বুশরাদের তো ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় বাড়ি। ঢাকাতেই বড় হয়েছে। অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়ে। কিছু তো গ্যাপ আছেই। এইসব জেনেশুনেই সে আমাকে বিয়ে করেছে। দেখতে দেখতে ছয় বছর হয়ে গেল। কিন্তু আমার মনে হয়, ওকে যেন আজও আমি বুঝতে পারলাম না।
আপনি কখনো কথা বলেছেন ওর সাথে?
কী কথা?
এই যে আপনি বুঝতে পারেন না ওকে। এই ব্যাপারটা নিয়ে কখনো কথা বলেছেন?
জানেন, আমিও মাঝে মাঝে ভাবি কথা বলবো। বিশেষ করে ও যখন জানালো দিনাজপুরে ওর চাকরি হয়েছে। বুননকে নুশরাদের ওখানে রেখে যাবে তখন আমি বলেছিলাম, একা মেয়ে কীভাবে মাকে ছাড়া থাকবে? বুশরা কী বলে জানেন? এমনিতেও তো বুনন দিনে মায়ের বাসাতেই থাকে। আমরা দুজন চাকরি করি। এই শহরে তো দুইজনের চাকরি ছাড়া চলা সম্ভব নয়। আমি তো খরচ কমাতে পারবো না। এইসব কথাবার্তার পর আমার খুব করে মনে হচ্ছে বুশরার সঙ্গে কথা বলাটা জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমি বললাম, একটু জটিলই মনে হচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয় কথা বললে একটা রাস্তা বেরিয়ে আসবে। আপনি কথা বলেন। দরকার হলে আজ রাতেই বুশরাকে কল করেন। দূরে আছে তো। আপনাকে মিস করবে পারে। মেয়ের জন্যও হয়তো মন কাঁদছে।
দেখি। বলে আকবর ভাই চায়ের দাম মেটায়। মোটর সাইকেলে করে আমাকে মগবাজার নামিয়ে শাহজাহানপুরের দিকে চলে যায়। বলে, আজ রাতে নুশরাদের ওখানে থাকবো। রাতে মেয়েকে না দেখলে ঘুম আসবে না। আমার সঙ্গে ফোন নাম্বার বিনিময় করে যাওয়ার আগে।
আমি বলি, রাতে একবার কথা বলার চেষ্টা করবেন।
উনি ওকে বলে।
রাত এগারোটায় আকবর ভাই ফোন দেয়। বলে, বুশরার ফোনটা বন্ধ পাচ্ছি।
লম্বা জার্নি করে গেছে না? দেখেন, হয়তো ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
কিন্তু সারাদিন বুননের খবরও নেয়নি। এটা কিন্তু হওয়ার কথা না। আর যাই হোক, মেয়েকে তো সে ভালোবাসে। নুশরা, ওর আম্মা অনেকবার ট্রাই করেছে। কিন্তু পায়নি ফোনে। শেষবার গাবতলি থেকে বাসে উঠে ওর আম্মাকে ফোন দিয়েছিল। অনেক নাকি কান্নাকাটি করেছে। বলেন তো, কী ঝামেলায় পড়লাম।
ওকে কেউ বাসে তুলে দিতে যায়নি? কোন বাসে গেছে বলতে পারেন?
নুশরা বললো, নাবিল। ও তো সেলফ সাফিশিয়েন্ট। নিজেই উবার ডেকে গাবতলিতে গেছে। ও তো এইসব উঠিয়ে দেয়াটেয়া খুব হেট করে।
একটু পর আমি কল ব্যাক করছি। বলে আমি ফোনটা রেখে দেই।
নিউজ সাইটগুলো ঘুরে দেখি। ঢাকা-দিনাজপুর রোডে কোনো এক্সিডেন্টের খবর নেই। দিনাজপুরের এক বন্ধুর কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে নাবিল বাস কাউন্টারে কল করি। কেউ ধরে না। বুশরার ফোনে ট্রাই করি। সত্যিই বন্ধ ফোন।
আকবর ভাইকে কল দেই।
শোনেন আকবর ভাই কোনো দুর্ঘটনার খবর তো পেলাম না। ফলে, ধরে নেওয়া যায় সে নিরাপদেই পৌঁছেছে। ফোনে হয়তো চার্জ নাই। বাসায় গিয়ে হয়তো দেখবেন চার্জার ফেলে গেছে। কাল সকালে আমি নাবিল বাস কাউন্টারে ফোন করবো। দরকার হলে যাবো নিজে। আপনি চিন্তা করবেন না। কেয়ারের দিনাজপুর অফিসে কল করে জেনে নেওয়া তো আরও ইজি ব্যাপার। আশা করি, চার্জার রেখে যাবার ব্যাপারটাই হবে। সকালে নতুন চার্জার কিনলেই সলভ।
আকবর ভাই বলে, ভুলে চার্জার রেখে যাবার মেয়ে কিন্তু বুশরা না।
অনেক হুঁশিয়ার লোকেরও এমন হয়, আকবর ভাই। চিন্তা না করে ঘুমান। কাল সকালে দেখা যাবে।
আকবর ভাইয়ের আমি ক্লাসমেট মাহমুদকে কল দেই। মাহমুদ কেয়ারে কাজ করে। দিনাজপুর অফিসের সবাইকে চেনে। বললো, এখনই ফোন দিয়ে সে জেনে নেবে বুশরার বিষয়ে।
ঘণ্টা খানেক পর মাহমুদ কলব্যাক করে। বুশরা রহমান না মেয়েটার নাম?
হা।
সে তো জয়েন করবে না বলে দিয়েছে গতকালই। দিনাজপুর যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
কিন্তু সে তো বাসে উঠে আমাকে ফোন দিল।
দেখো, লাভারের সঙ্গে বান্দরবান ঘুরতেছে।
মাহমুদের চিন্তাটা একেবারে ফেলে দেবার মতো নয়। কিন্তু বুশরা প্রেম করবে? আকবর ভাইয়ের সাথে বনিবনা হচ্ছে না দেখে দিনাজপুরের কথা বলে বান্দরবান চলে যাবে? কোয়াইট অ্যাবসার্ড। পারিবারিক ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে সাতদিনের প্লেজার ট্রিপ? কেন যেন হিসাব মেলে না। বুশরাকে দেখে কখনো মনে হয় না জীনে প্লেজারকে সে এত গুরুত্ব দেয়। মানুষের নানা শেড থাকতে পারে। কিন্তু মাহমুদের কথায় আমার উদ্বেগ দূর হচ্ছে না। বারবার মনে হচ্ছে, হয়তো কোনো বিপদেই পড়েছে মেয়েটা।
এভাবে তিনদিন যাবার পর সবার মনে হয়, গুরুতর কোনো ঘটনা ঘটেছে। জয়নুল ভাইই আকবর ভাইকে থানায় যাবার পরামর্শ দেন। ওনার এক ডিআইজি বন্ধুকে ফোনও করে দেন।
এভাবে সাতদিন কেটে যায়।
আমরা এটা সেটা নানা কথা ভাবি। মনের মধ্যে আশা, বুশরা ফিরে আসবে ঠিক সাতদিন পর।
কিন্তু বুশরা ফেরে না।
দশদিন কেটে যাবার পর একদিন সন্ধ্যায় অফিস শেষ করে নেমে দেখি আকবর ভাই দাঁড়িয়ে।
আমি এগিয়ে গিয়ে বলি, চা খাবেন?
আকবর ভাই নিরবে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে গিয়ে বসে।
বুশরা তো অস্ট্রেলিয়ায়।
শুনে চমকে উঠি আমি।
অস্ট্রেলিয়ায় মানে?
আজ তমাল নুশরাকে ফোন দিয়েছিল। সেই বলেছে, বুশরা তার সঙ্গে মেলবোর্নে।
আমি আর আকবর ভাই চুপচাপ চা খেতে থাকি। মাথার মধ্যে অনেক চিন্তা ঘোরে আমার। আমার মনে হয়, ওই সময়টা অফিসের আশপাশে তমালকে আমি দেখেছি। কিংবা আমকে দেখে তমাল আড়ালে সরে গেছে এমন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আকবর ভাইকে আমি সেসব কিছু বলি না। শুধু বলি, বুশরা ইজ অলওয়েজ আ গুড প্লানার।
আকবর ভাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আপনার বাইক কোথায়, আকবর ভাই?
উনি বলে, বাইক দিয়ে আর কী হবে বলেন?
আরেকটা সিগারেট ধরান উনি।
ওনার চোয়ালের দিকে তাকাই। ওনার মুখের দিকে তাকালে চোয়ালটাই সবার আগে চোখে পড়ে। আকবর ভাইয়ের চোয়ালটা অতিরিক্ত ঝুলে পড়েছে।