ধর! ধর! ধর!
নিয়ে গেল। ঐইতো ঐ দিকে। ঐ তুই ঐ দিকে যা। হাতে লাঠি নিয়ে যা।
হাতে লাঠি আছে তো?
ঠিক মাথায় বাড়ি মারবি। মাথায়!
দিনে দুপুরে এই সব হাঁক ডাক শুনে রাস্তার পথচারীরা আতঙ্কে স্থির হয়ে গেল। আশপাশের মানুষজন জড়ো হতে লাগল।
চারদিকে জিজ্ঞাসা।
ঘটনা কি?
ঘটনা খুবই মামুলী।
শিয়াল মুরগি নিয়ে পালিয়েছে। জানোয়ার শিয়ালকে ধরে চরম শাস্তি দিতে সবাই হণ্যে হয়ে ছুটছে।
ছুটাছুটি করে কোন লাভ হয়নি। শিয়াল ঠিকই মুরগি নিয়ে পালিয়েছে।
ক্লান্ত সবাই জড়ো হয়ে আলোচনায় মত্ত হল।
একজন বলল, আরেকটু ঐ দিকে যদি একজন যেত তাহলে শিয়ালকে ধরা যেত। কেউ ঐ দিকে একবারও যায়নি।
আরেকজন বলল, দুর! শিয়াল পালিয়েছে ঐ দিক দিয়ে। ঐ যে বাতাবন আছে না। তার ভিতরে। বাতাবনের ভিতরে কে ঢুকবে? সাপ-খোপ আছে না আছে।
বয়স্ক একজন বলল, মন্টুকে বলেছি বাতাবনের দিকে যা। ও যদি সময়মত যেত তাহলে শালা শিয়াল পালাতে পারত না।
এ কথায় মন্টুর আঁতে ঘা লাগল। চেঁচিয়ে বলল, অ্যাঁ! এখন সব দোষ আমার! আমিতো ঠিকই গিয়েছিলাম। তার আগেই তো হারামি শিয়ালের বাচ্চা মুরগি নিয়ে পালাল।
এ সব শুনে কেউ মাথা ডান থেকে বামে কেউ উপর থেকে নিচে দোলাতে থাকল। তারা যে মাথা দুলিয়ে কাকে সমর্থন করল বুজা গেল না।
এভাবে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো চলল অনেক্ষন ধরে।
হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে সমস্বরে চিৎকার ভেসে এল।
ধর! ধর! ধর!
সবাই লাঠি সোটা নিয়ে ছুটল আবার ঐ দিকে।
কিন্তু বিধি বাম।
এবারও শিয়াল মামা তার বর্গা দেয়া মুরগি নিয়ে পগার পার।
অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে দু’টি মুরগি বিয়োগের ঘটনায় সবাই হত বিহ্বল হয়ে গেল।
মুরগি মালিক সুফিয়া খাতুন বিলাপ করে কান্না আরম্ভ করল।
আজ হাটবারে এই মুরগি বিক্রি করে তার ছেলের পরীক্ষার ফিস দেয়ার কথা ছিল। ঘরে তেল নুন ফুরিয়ে এসেছে। এখনকার মত এই মুরগিটাই ছিল তার শেষ ভরসা। কি হবে আল্লাহ।
সুফিয়ার কান্নাকে উপেক্ষা করে সবাই আলোচনায় অংশগ্রহন করল। কারন এই সব সুফিয়াদের কান্না এখন আর কাউকেই পীড়িত করে না। মানুষের এত সময় কোথায়?
একজন বলল, গতকাল আমার একটা হাঁস নিয়ে গেছে। ঠিক এই সময়।
আরেকজন বলল, দুই দিন আগে আমার মুরগী গেছে।
এভাবে উপস্থিত অনেকেই তাদের মুরগী হারানোর কথা উল্যেখ করল। দেখা গেল অধিকাংশ লোকেরই মরগী বিয়োগ ঘটেছে।
কাউছ মিয়া বলল, মিয়ারা শোন। শিয়ালের উৎপাত বড্ড বেড়েছে। এটা থামাতে হবে। সবাই রেড়ি হও। শিয়ালের বংশ নির্বংশ করতে হবে।
সবাই একবাক্যে রাজি হয়ে গেল।
শুরু হল শিয়াল নিধন যজ্ঞ।
বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে, নিরলস পরিশ্রম করে গ্রামের মানুষ কিছু দিনের মধ্যেই শ-খানেক শিয়াল মেরে সাফ করে ফেলল। এবং এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রইল।
দেখা গেল এখন খুব কমই মুরগি চুরি হচ্ছে।
শিয়ালের উৎপাত কমে গেল।
মানুষের মনে শান্তি শান্তি ভাব।
কিন্তু এই শান্তি বেশি দিন স্থায়ী হল না।
কিছু দিন পর কাউছ মিয়ার ডাক পড়ল চেয়ারম্যান সাহেবের দরবারে।
কাউছ মিয়া শুনল শিয়াল মারা যাবে না। কারন শিয়াল বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী। তাই এটা মারা আইনের পরিপন্থী। শিয়াল নিধন করলে মামলা হবে। বড় কঠিন সে মামলা।
কাউছ মিয়া বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। এমন কথা বাপের জম্মেও সে শোনেনি। বলল, শিয়াল আমাদের মুরগী খাচ্ছে তাই শিয়াল মারছি। এতে অসুবিধা হবে কেন? আর মামলা ই বা হবে কেন?
এ্যানিমেল রাইটের প্রতিনিধি বলল, শিয়ালের কাজ মুরগী খাওয়া। সে মুরগি খাবেই। আপনি আপনার মুরগিকে হেফাজত করেন।
আরেকবার টাস্কি খেল কাউছ মিয়া।
মুরগিকে হেফাজত করমু মানে? এটা কিভাবে?
এই সহজ বিষয় বুঝলেন না? খানিকটা ব্যঙ্গস্বরে বলল প্রতিনিধি। শিয়াল মুরগিকে কোথায় পায়?
কাউছ মিয়া বলল, বাগানে।
আপনি মুরগিকে বাগানে যেতে দিবেন না। প্রতিনিধি বলল।
কাউছ মিয়া, এটা কিভাবে সম্ভব? মুরগী তাহলে কোথায় থাকবে?
আপনি মুরগিকে খাঁচায় রাখুন। প্রতিনিধি বলল। মুরগিকে বাগানে ছাড়বেন না। খাঁচার ভিতরে মুরগি পালুন। দেখবেন শিয়াল আর মুরগির কিছুই করতে পারবে না।
কাউছ মিয়া দেখল মাথার উপর ফ্যানটা ভন ভন করে ঘুরছে। সে ভেবে পেল না এই শীতে ফ্যান ছাড়ল কে? ক্রমে দেখল আশপাশের অন্যান্য জিনিসপত্রও সমান তালে ঘুরছে। এবার সে বুঝতে পারল, ধুর! আসলে তার মাথাটাই ঘুরছে ভন ভন করে।
এই উম্মাদ বলে কি?
সে তার আশে পাশে তাকাল। দেখল মামলার ভয়ে সবাই ভড়কে গেছে।
কাউছ মিয়া গ্রামে এসে সবাইকে ডেকে বলল, আজ থেকে শিয়াল মারা যাবে না। আইনে নিষেধ আছে। তোমরা তোমাদের মুরগিকে হেফাজতে রাখ। ওদেরকে বাগানে চরতে দিও না। ঘরে খাঁচায় বাইন্দা রাখ।
সবাই বেদনার নিঃশাস ফেলে যে যার ঘরে ফিরে গেল।
ঘটনা ঘটতে থাকল কিছু দিন পর থেকে।
গ্রামের মানুষের মুরগির খাঁচার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। যেখানে মানুষের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নড়বড়ে সেখানে মুরগির দশা কি হবে তা সহজেই অনুমেয়।
ফলাফল স্বরুপ রাতের বেলায় খাঁচা ভেঙ্গে মুরগি বিয়োগ ঘটতে থাকল।
শিয়ালের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে লাগল। আগে রাতের বেলা হানা দিত। এখন দিনের বেলায়ও আক্রমন করে। আগে শিয়াল কুকুর দেখলে পালাত। এখন মানুষ দেখলেও ভয় না। শিয়ালের ভয়ে কুকুর সমাজ এলাকাছাড়া। মানুষ হয়ে গেছে জিম্মি।
মুরগির বংশ নির্বংশ। মানুষ টেকা দায়।
গ্রামের মানুষ সহ কাউছ মিয়া গেল এ্যনিমেল রাইটের প্রতিনিধির অফিসে। তারা সবিস্তারে সব কিছু জানাল। বলল, আমরা আপনাদের কথামত মুরগী হেফাজত করেছি। একটা শিয়ালও মারিনি। তবুও হেফাজত থেকে মুরগি বাঁচতে পারছে না। আমরা কি করব বলুন?
প্রতিনিধি বলল, দেখুন, শিয়াল মুরগি খাবে কি খাবে না। মুরগি হেফাজতে থাকবে কি থাকবে না। তা আইনে বলা নেই। আইনে বলা আছে শিয়াল নিধন করা যাবে না। তাই আমরা তো আইনের বাইরে যেতে পারব না।
কাউছ মিয়া মরিয়া হয়ে বলল, এভাবে চলতে থাকলেতো মানুষের টিকে থাকাও দায় হয়ে দাঁড়াবে।
প্রতিনিধি গম্ভীর স্বরে বলল, দুঃখিত! মানুষ এখনো বিলুপ্ত প্রানির তালিকায় নেই।