সব তেইশে ফাল্গুন ঘুম ভেঙে প্রথম ফোনটা তাকে করতাম। বছরে এই একটা দিন খুব সকালে ঘুম ভাঙে আমার। ফোন করলেই রাজ্যের কথা মনে হতো তার। আমার কেন এতো সকালে ঘুম ভেঙ্গেছে, অসুখবিসুখ করে নাই তো? নাকি কোথাও যাবো? খুব দরকারি কোনো কাজ আছে বলে এতো সকালে উঠেছি? নাকি রাতে আমার ঘুম হয় নাই? একটা মজার বই পড়তে পড়তে ভোর হয়ে গেছে? নাকি আমার খুব মন খারাপ? নাকি খুব ভালো আমার মন? আমি কি উঠে মুখ ধুয়ে ফোন করেছি, নাকি বিছানা থেকে না নেমেই ফোন করেছি? কেন বেজায় অলস আমার ভোরবেলা ঘুম ভাঙবে? কেন ঘুম ভেঙ্গেই তাকে মনে পড়বে?
আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত আমি তার কাছেই ছিলাম তো। তখন তেইশ ফাল্গুন নিয়ে আমার কোনো আহ্লাদ ছিল না। যেই দূরে সরেছি, অমনি আমার এসব শুরু হয়েছিল। ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছি যখন, তখন মোবাইল ফোনের যুগ ছিল না। কার্ড ফোন ছিল। আমাদের হলে ছিল না, প্রীতিলতা হলে ছিল। তখন আমি ভোরবেলা কার্ড পকেটে নিয়ে প্রীতিলতা হলে গিয়ে ফোন করতাম তার ল্যান্ড ফোনে।
এবার দ্বিতীয় তেইশে ফাল্গুন, আমি তাকে ফোন করতে পারছি না। সব কষ্টই দিনে দিনে কমে আসে, কিন্তু আমার কেন এবার, গত বছরের চেয়েও বেশি কষ্ট হচ্ছে ! গত বছর আমার মনে ছিল, সে আর নেই। কিন্তু এবার আমি ভুলে গিয়ে ফোন করে ফেলেছিলাম ! ও পাশে শিশুকণ্ঠের হ্যালো শুনে চমকে উঠে মনে পড়েছে, সে আর নেই ! তারপর থেকে দম নিতে কষ্ট হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে তাকে হারানোই, আমার একমাত্র কষ্ট। যাবতীয় অপমান, অবহেলা, বঞ্চনা সব তুচ্ছ হয়ে গেছে ! মনে হচ্ছে পৃথিবীটা হয়ে গেছে বিরান, ঝরে গেছে সব গাছের পাতা। আমার জন্য কোনো নদীতে নেই এক ফোঁটা পানি। প্রবল তৃষ্ণায় আমার গলাব্যথা, আমি হাহাকারের মতো মিশে গেলাম বিছানায়। আর একবার তাকে ডাকতে না পারার তৃষ্ণায় পানিশূন্য হয়ে গেছে আমার দুনিয়া। আমার শক্তি নেই, নিজেকে ছিঁড়ে তুলে, পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে দিন শুরু করার।
এক সময় তার একটা মোবাইল ফোন হলো, আমারও। ল্যান্ডফোন তবু ছিল, ওটা সচল থাকলে ওটাতেই ফোন করতাম , ওটাই আমার ফোনে তার নামে সেভ করা। মোবাইল নম্বরটা কেউ জানে না কী লিখে সেভ করা। শেষের দিকে ফোনে বেশি কথা বলতে চাইত না, কোথায় কোন মেডিকেল আরটিকেলে নাকি পড়েছে, ফোনে বেশি কথা বললে কানের ক্ষতি হয়। অনেক পরে আমি বুঝেছি, ওটা অভিমান ছিল। যেন- ফোনে এতো কীসের কথা, আসতে পারো না?
তেইশে ফাল্গুনের ভোরবেলার ফোনে আমাদের অনেক কথা হতো। তার কাছে অনেক খবর থাকত, সারা গ্রামের খবর। কে মরে গেল, মরে যাওয়ার পর কার কবরে এক পশলা বৃষ্টি হল, কার ছেলে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করল, বিয়ের কথা শুনে ছেলের মা কীভাবে কাঁদল, এবার অন্যবারের চেয়ে গরম বেশি পড়বে কিনা, চিনিধরা আমগাছে অনেক মুকুল এসেছে, আমার কি সময় হবে আম খেতে যাওয়ার?
আমার এখন অনেক সময়, আর উদয়অস্ত ব্যস্ত নই আমি। এখন আমি চাইলে প্রত্যেক সপ্তাহে তার কাছে যেতে পারি। কিন্তু তার আর আমাকে দেওয়ার মতো সময় নেই। হয়তো সেখানে সে খুব ব্যস্ত, তার ছোটবেলায় মরে যাওয়া বন্ধু বান্ধবের সাথে গল্প করতে করতে আর আমার কথা মনেই নেই তার। হয়তো ফাল্গুন মাস চলে গেলে তার মনে পড়বে, আহা এবারও ভুলে গেছি। তখন নিশ্চিত মন খারাপ করে ভাববে, মরে না গেলেই ভালো হতো। মনে হবে, আরেকটা ফাল্গুনের তেইশ তারিখ আসার আগেই যেন, সে আমার সঙ্গে যোগাযোগের একটা পথ খুজে পায়।
আমার খুব অভিমান হয়েছিল, ডিস্কানেক্ট হওয়ার অনুভূতি হয়েছিল যখন। একটা মার্চ মাসেই চলে যেতে হলো ! সেই মার্চের ভোর বেলায় আমি প্রায় অনুভূতিশূন্য হয়ে গিয়েছিয়াম। বাড়ি গিয়ে কী কী করলাম, ভালো করে মনেই পড়ে না। খুব লোকজন ছিল, তারপর তিনদিন, সাতদিনের দোয়া আর খাওয়া দাওয়ার অনুষ্ঠান হচ্ছিল। আমি আবার ঢাকায় ফিরে এসেছিলাম। তারপরেই আসলে বুঝতে পেরেছিলাম, চিরতরে ডিস্কানেক্ট হয়ে গেছি। ফোন হাতে নিলেই কথা বলা যেত যার সঙ্গে, তার সঙ্গে আর কোনোভাবেই কথা বলা যাবে না ! পুরোপুরি দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। মাস খানেক পরে একদিন ঘুমানোর সময় এতো কষ্ট হতে লাগল, চোখ বন্ধ করে বললাম, মরে গেলেই তোমার কাছে যাওয়া যায়? সেইদিন রাতে স্বপ্নে দেখলাম- খুব সুন্দর ছোট্ট একটা নদীর পাড়ে একটা চেয়ার পেতে বসে আছে সে। চারপাশ সবুজ আর সবুজ, ঝিরিঝিরি বাতাসে তার ছোট ছোট নীল নীল ফুল আঁকা সাদা শড়ির আঁচল উড়ছে। মুখে মৃদু মৃদু হাসি।
ত্রিশতম জন্মদিনের তেইশে ফাল্গুনে অনেক কথার পরে আমি লজ্জা লজ্জা গলায় বলেছিলাম, ‘আজ তেইশে ফাল্গুন !’ তার তখন মনে পড়েছিল কেন এতো সকালে ফোন করেছি আমি। লজ্জা পেয়ে তার মনে হয়েছিল ফোনটা তারই করার কথা ছিল। ভুলে গেছে বলে লাজুক হেসে বলেছিল, ‘সেদিন খুব রোদ ছিল। ঝকঝকে এক রোদের দিনে হয়েছ তুমি।‘ তারপর আমার ছোটবেলার গল্প শুরু হয়েছিল। আমরা দুজনে খুব হেসেছিলাম। আমি যে কতো বোকা ছিলাম, বলেছিল এক এক করে ; একটা রেডিও আর একটা আয়না দিলে বসে বসে খেলতাম। রেডিও কথা বললে ভাবতাম, কথা আছে মানে মানুষ আছে, আয়নায় উঁকি দিয়ে আমার বয়সি কাউকে দেখে ভাবতাম, খেলার সাথিও আছে। আমি কতো লক্ষি ছিলাম, কখনও খাট থেকে পড়ে ব্যথা পাইনি। আমি যে ঝাল খেতে পারি না, সেটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা ছিল তার। দুধ ভাত খেয়ে আমার দিন কেটেছে। তার যখন দুঃখের দিন, দুধভাত জোগাড় করতে না পারলে, সরিষা তেল দিয়ে ভাত মেখে দিলেই, খেয়ে নিতাম। আমার খাওয়াদাওয়ার কথা বলতে বলতেই তার মনে পড়েছিল, ঈদের সময় আর কাউকে নতুন জামা দিতে না পারলেও, আমার জন্য একটা জামা তার লাগতোই। পুরান জামা পরে আমার ঈদ, তার কিছুতেই সহ্য হতো না। নীল নীল ফুল তোলা নতুন একটা ফ্রক তাকে জোগাড় করতেই হতো। কথা বলতে বলতে তার খেয়াল হয়েছিল, বেলা হয়ে গেছে, আমার হয়তো কাজ আছে, উঠতে হবে। শুভ জন্মদিন বলার লজ্জা কাটাতে আরো কিছুক্ষণ কথা বলেছিল। শেষে খুব লাজুক গলায় বলেছিল- হ্যাপি বার্থ ডে ! আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম, সাবাস মা, এইতো শিখে গেছ।
বড়বেলার জন্মদিনে এইরকম ছোটবেলা ফিরিয়ে নিয়ে এলে, সারাদিন আমি পাখি হয়ে উড়তাম। মনে হত, নীল নীল ফুল ফুল একটা ফ্রক পরে ছুটে বেড়াচ্ছি আমি। নীল রঙ খুব পছন্দ ছিল তার। নীলের আশেপাশে সামান্য সাদা। আমার লাল লাল পাতলা চুল নিয়ে মাঝেমাঝে মন খারাপ হতো তার। আমি পেটে থাকতে খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল বলে, অনেক ওসুধ খেতে হয়েছে। তার ধারণা, সেই কারণে চুল পাতলা আমার। কোন তেল মাখলে চুল ঘন হবে, সেই খোঁজ নিয়ে, কোন দূর শহর থেকে এক তেল আনিয়ে কাউকে দিয়ে মাথায় দিয়ে দিত। আমাকে বসিয়ে তেল দিয়ে দেবে, সেই সময় ছিল না তার। অনেক কাজ করতে হতো তাকে। তেলের তীব্র গন্ধে দম বন্ধ হয়ে এলে, রাগ করতাম আমি। একটু বড় হয়ে যখন দেখা গেলো, আমি অংকে ভালো, তখন তার চুলের দুঃখ কমেছিল।
আজকাল আমার খুব হিসেব করতে ইচ্ছে করে, আমি তাকে কবে কবে কষ্ট দিয়েছি। দুনিয়ায় খুব প্রচলিত আছে, মায়েরা ছেলেমেয়েদের যত ভালোবাসে, ছেলেমেয়েরা ততো নয়, স্নেহ নিম্নগামী। শুধু আমার মা জানত, আমি তাকে তার সমান ভালবাসতাম, কখনও কখনও তার চেয়ে বেশি। আমি তো তাকে একা রেখে মরে যাইনি। এই দুঃসহ কষ্ট সে কীভাবে সহ্য করতে পারত ! ছোটবেলায় খুব অসুখবিসুখ হতো আমার, যখন তখন জ্বর, আর টনসিল। গলাব্যথায় না কথা বলতে পারতাম, না খেতে। আর আমার যাবতীয় ভালোমানুষ বাচ্চার খোলস খুলে পড়ত। এক মুহূর্ত মাকে ছাড়তাম না। কোলে উঠে বসে থাকতাম। বসে বসে কোলে নিলেই হতো না, হাটতে হতো। আমার মনে আছে সিক্স সেভেনে উঠেও কোলে উঠেছি। কিন্তু বড় হয়ে লজ্জা পেয়ে যখন বলতাম, ‘আমি বললেই তুমি শুনতে কেন !’ মা তখন ঝর্ণার মতো হাসতে হাসতে বলত, ‘আমার ভয় করত, যদি মরে যাও !’ তারপরেই কথা ঘুরিয়ে বলত, ‘কষ্ট হয়নি, তুমি খুব শুকনা ছিলে তো !’ আমি হাসতে হাসতে বলতাম, ‘তুমি তখন বুড়ো ছিলে না।‘
একবার আমি তাকে এক তাড়া খুব সুন্দর সাদা কাগজ আর কলম কিনে দিয়ে বলেছিলাম- ‘জীবনী লেখ, মা।‘ তারপর অনেকদিন দেখেছি চুপিচুপি লিখতে। আমি দেখতে চাইলেই লজ্জা পেয়ে বলত- কিছুই হচ্ছে না। একদিন লুকিয়ে দেখলাম- আহ! থরে থরে দুঃখ সাজানো। আমি কখনও জানিনি, এত এত দুঃখ পোষে সে। আর সেখানে আমার দেওয়া কোনো দুঃখের কথা লেখা নেই। আমিই দুনিয়ার একমাত্র বাচ্চা, যে কখনও মাকে কষ্ট দেয়নি ! খুব গর্ব হয়েছিল আমার।
আমি তাকে দেখেছি, সীদ্ধান্ত নেবার সময় কতটা স্বাধীন ছিল সে। পাহাড়ের মতো প্রতিকূল পরিস্থিতি, তার সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াতো। আর সেই পাহাড় ডিঙ্গানো আলোয় আমি অন্ধকারমুক্ত হয়ে বেড়ে উঠতাম।
আর কতোদিন আমি বেঁচে থাকব, আর তেইশে ফাল্গুন আসতে থাকবে ! সে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দিনটাও কেন ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে মুছে যায়নি। কেন অন্যরা নির্লজ্জের মতো আমাকে শুভেচ্ছা জানাবে, এখনও। কেন এদের এত সাহস হবে !
(ঈমান হামিদীর আঁকা ছবিটা পিন্টারেস্ট থেকে নেওয়া)