রক্ত হিন্দু, রক্ত মুসলমান


হিন্দু রক্তগুলো শরীর থেকে বের করার চেষ্টা করছেন তহুরা বেগম, ব্লেড দিয়ে হাতের আঙুল  কেটে টিপে টিপে রক্ত বের করে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ফোঁটা ফোঁটা ফেলছেন। এরপর মন দিয়ে খুঁটিয়ে একে একে শণাক্ত করার চেষ্টা করছেন, যেন আলাদা করবেন, কোন রক্তকণাগুলো হিন্দু আর কোনটা মুসলমান।


বড় ছেলে আহসান বাড়িতে ছিল না। বাড়িতে ঢুকেই সে মা! মা! ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকল।
আহসানের ডাকে দ্রুত শতর্ক হলেন মা। সবকিছু আড়াল করার চেষ্টা করলেন।
আহসান বুঝতে পারল মা কিছু লুকানোর চেষ্টা করছেন।
– মা, আবার তুমি রক্তবিভাজন শুরু করেছ? আবার কি তোমার মাথা মোটা ছেলেটা এসেছিল?
– না-রে বাবা, তুই খালি সব সময় ওর দোষ ধরিস।
– তোমারে কইছি না, রক্তের মধ্যে হিন্দু মুসলমান নাই, আবার এসব কি শুরু করছ? আবার ওর কথা শুনেছ?
– না-রে বাবা। তুই চুপ থাক তো। ও বলবে কেন?
বলেই তহুরা বেগম আয়নাটা মুছে ফেলতে লাগলেন। রক্তরসে আয়না পরিষ্কার না হয়ে কিছুটা ঘোলাটে হয়েছিল। আবারো মুছতে মুছতে বললেন তহুরা বেগম,
– তা বাবা, তুই কি মোসলমান কাউকেই পাইছিলি না, কেনো তুই হিন্দু মাইনষের রক্ত আমার শরীলে দিলি?
তহুরা বেগম অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অ্যাপেন্ডিসাইড অপারেশন। অপারেশনে রক্ত লেগেছিল। সেই রক্ত দিয়েছিল বড় ছেলের বন্ধু ভবেশ। ধর্মে হিন্দু ভবেশকে তহুরা বেগম ভালোভাবেই চেনেন। কখনো আলাদা চোখে দেখেন নি তিনি। কিন্তু সেই রক্ত দেয়ার আজ প্রায় সাত-আট মাস পেরিয়ে গেছে। এতোদিন পরে মায়ের এমন আচরণে আহসান চিন্তিত হয়ে ওঠে। মা এ-কী শুরু করেছেন!
– মা, রক্ত রক্তই। রক্তে হিন্দু মুসলমান নাই। কেন বুঝতেছ না এই কথা?
– না বাবা, সারা শরীরটা আমার অপবিত্র হয়া যাইতেছে। তোর ঐ হিন্দু ছাওয়ালটার রক্ত শরীরে নেয়ার পর থাকি এমন হইতেছে। কেনো তুই হিন্দু মাইনষের রক্ত আমার শরীলে দিলি?
ভয়ানক চোখে তাকায় আহসান। এ কি কথা কয় মা! হাসপাতাল ছাড়ার সময়ও তো একথা বলেন নি। অবশ্যই এই বিষ অন্য কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছে। যদি কেউ ঢুকিয়ে থাকে, ভয়ানক বিষ ঢুকিয়েছে এটা। এবং তার ধারনা, এই বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে হয়ত ছোটভাই রুহান।


ভবেশ এসেছে।
– আহসান শোন, গত দুই দিন থাকি রুহান আমার সাথে বসতে চাইতেছিল। কি নাকি ওর জরুরী কথা আছে। গতকাল আসতে কইছিলাম, সে আজকে সকালবেলা কয়েকজনকে নিয়ে এসেছিল। দেখ আহসান, তোদের তো কখনো আলাদা চোখে দেখি নাই। কিন্তু আজ রুহান এসে আমার বিশ্বাস, ঈশ্বর নিয়ে কথা বলে। আমাকে কোরআন হাদিস বোঝায়। আমারে কয়, ঐসব ভূয়া। ওগুলা বাদ দিয়া আমারে ইসলাম গ্রহণ করতে কয়। কিন্তু এইটা তো নিয়ম না আহসান। ধর্ম প্রচারের এইটা কি নিয়ম? কি শুরু করেছে সে, আমারে, আমার বাড়ির সবাইরে কয়া যুক্তিতর্ক করি সে আবার এসব কথাবার্তা ফেসবুকে প্রচার করতেছে। এখন সে তো ছোটভাই, কিছু কইতেও পারতেছি না। কি করব ক’ তো?
– আচ্ছা এই শুরু করেছে না? দেখছি আমি। ওটার মাথায় যে কি ঢুকেছে বুঝতেছিনা। তুই চিন্তা করিস না, আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।


বাড়িতে আহসান, অপেক্ষা করছে। রুহান বাড়ির দরজায়, বাড়ি ঢুকতেছে।
– এই, এদিক আয়। কি বলেছিস তুই ভবেশকে?
– তাদের ইসলামের দাওয়াত দিছি।
– ইসলামের দাওয়াত বুঝিস তুই? গাঁধা কোথাকার? মানুষকে অপদস্থ করার নাম ইসলামের দাওয়াত? ফেসবুকে এসব দিছিস কেন? কী করতে চাস তুই?
রুহান চুপ করে থাকে।
– কি রে, কথা কইস না কেন? তুই তো ইসলাম প্রচার না করে বিষ ছড়াই বেড়াইতেছিস!
– আমি না, তুমি! তুমিই মায়ের শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছ ভাইয়া। তুমিই আমার মায়ের সারা শরীরটা অপবিত্র করে ফেলতেছ। অপবিত্র রক্ত ঢুকিয়ে দিছ। তোমার জন্য মা কষ্ট পাচ্ছে।
– কি বলছিস রে, এই গাঁধা? কি বলছিস তুই? তুই তাহলে মায়ের মনে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছিস, না?
– আমি বিষ ঢুকাই নাই। বিষকে পবিত্র করতেছি।
– তোকে রক্তের পবিত্রতা খুঁজতে হবে না গাঁধা! রক্তের পবিত্রতা না খুঁজে তুই নিজের ঈমানের পবিত্রতা খোঁজ। গাঁধা কোথাকার, ইসলামের তুই তো বারোটা বাজাবি রে দেখছি। যারা মায়ের জীবন রক্ষার্থে রক্ত দিল, তাকেই তুই সবার সামনে অপদস্থ করিস? কি, তোর মাথায় কি-এসব ঘোরে?
– আমি ঠিকই করছি। সে মুসলমান হলে, তবেই মা শান্তি পাবে। তখন তার রক্ত হবে মোসলমানের রক্ত। এছাড়া মা কোনোভাবেই হিন্দুর অপবিত্র রক্ত শরীরে নিয়ে পবিত্র হয়ে থাকতে পারবে না। কয়া দিলাম।
বলেই রুহান বাড়ি থেকে আবার বেড়িয়ে গেল।
আহসান বোকার মত ফ্যালফ্যাল তাকায়।


তহুরা বেগম নামাজ পড়ছেন।
সৃষ্টিকর্তার কাছে রোগমুক্তির জন্য শুকরিয়া আদায় করার পরিবর্তে কেঁদে কেঁদে মোনাজাত করছেন, হে আল্লাহ, কেনো তুমি আমাকে মেরে ফেললে না? কেনো সুস্থ হওয়ার জন্য আমাকে এক হিন্দুর রক্ত শরীরে নিতে হলো, আমার সারা শরীর অপবিত্র হয়ে গেছে।
হায় খোদা, এই অপবিত্রতা কিভাবে পবিত্র হবে?
মানসিক যন্ত্রনায় ঢুকে গেছেন তিনি। নিজেকে অপবিত্র মনে করছেন। একারণে,
তহুরা বেগম ডেটল, হালাল, পবিত্র হওয়ার এমন সব নানান সাবান দিয়ে গোসল করছেন। আতর খুশবু মাখছেন। তিনি খাঁটি মুসলমান হইতে চান। আপাদমস্তক। পোশাক পরিচ্ছদে, আহারে বিহারে, আচারে ব্যবহারে, কথা কাজে। সংস্কার সংস্কৃতিতে- তা ছাড়া এক আল্লাহর জন্য জীবন মন পবিত্র হয় না। তাই তিনি পরিশুদ্ধ হতে থাকেন। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই তার মনকে পবিত্র করে তোলে না। রুহানের কথা মনে পড়ে। হিন্দু যে প্লেটে খায় সে প্লেট সাত ধোঁয়া না দিলে খাওয়া যাবে না। আর তার রক্ত! সত্যমিথ্যা যাচাই করেন না মা। সব সময় তার মনে হতে থাকে, তার সারা শরীরের রক্তগুলো দিনকে দিন অপবিত্র হয়ে যাচ্ছে।


নিজেকে কেটে কেটে রক্ত আলাদা করতে যাইওনা মা, তোমার গোঁয়ার ছেলের মতো নিজেকে অন্ধ করে ফেলিও না। জীবন বাঁচানোর জন্য মদও হালাল। ঠিক তেমনি জীবন বাঁচানোর জন্য যে রক্ত তুমি নিয়েছ, সেসব তোমার শরীরে হালাল ও পবিত্র হয়ে গেছে। তুমি কলেমা পড় মা। হিন্দু থেকে যখন কেউ মুসলমান হয়, তখন কিন্তু রক্ত-মাংস শরীর বদল করে আসে না। ঈমান মা, তুমি লা-ই লাহা ইল্লাল-লাহ মুহাম্মাদুর রাসুরুল্লাহ বলতে থাকো, বলতে বলতে তোমার মুখ দিয়ে ফেনো তোলো, দেখবে তোমার সারা শরীরের রক্তকণা শুধু না, সারা মনপ্রাণ মুসলমান হয়ে গেছে। তুমি কলেমা পড় মা। শরীরের প্রবাহমান রক্ত সবসময়ই পবিত্র মা।
আহসান ভাবে, বাড়িতে বড় আলেম ডেকে এনে মাকে বোঝাতে হবে। হয়ত তাঁর কথায় মায়ের মন শান্ত হবে। মন পবিত্র হয়ে উঠবে।
আহসান বড় আলেম ডেকে আনে। তাঁর(বড় আলেম-এর) কথায় মায়ের মন শান্ত হয়। মা নিজেকে পবিত্র মনে করেন। আহসান খুশি হয়।


রুহান বাড়ি আসে যায়। রুহান নিজের মতো চলে। মায়ের সাথে কথা হয়। মা তার উল্টাপাল্টা কথার প্রতিবাদ করেন। আহসান নিজের ভাইকে আয়ত্মে রাখতে পারে না। মাঝে মাঝে আহসান বাড়ি ফিরে দেখে, মা নামাজ শেষ করে আয়নার সামনে দাঁড়াচ্ছেন। আঙুল টিপে টিপে মাঝে মধ্যে রক্ত বের করার চেষ্টা করছেন মা।

আহসান খেয়াল করে, মা বুঝলেও কোথাও কিছুটা গোলমেলে রয়েই গেছে। যে বিষ একবার মনের ভেতর ঢুকে গেছে, সে বিষ সহজে বের করা সম্ভব হচ্ছে না।

এদিকে নিজের ছোটভাই রুহান, সে আপাদমস্তক খাঁটি মুসলমান হতে চায়। কিন্তু সে যা ব্যাখ্যা দেয় সেসব তার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয় না।

আহসান বিষণ্ন মনে বাইরে এসে দাঁড়ায়। নদীর পাড় ধরে খোলা আসমানের দিকে তাকায়। শান্তি পায় না।
সে চোখ বুজে থাকে কিছুক্ষণ। চোখ খুলে দূর সীমায় নদীপাড়ের রাস্তায় তাকায়। দেখতে পায়, রুহান তার বন্ধুদের নিয়ে ফেজবুকে অন্য কোথাও হিন্দু মোসলমান নিয়ে বাহাজ করার জন্য ছুটছে।

বাড়ি ফিরে আসে আহসান। দেখে, মা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। আঙুল টিপে নিজের মুখ পরখ করে দেখছেন। মা কি মনের ভেতর এখনো বিষ নিয়ে আছেন? বিচলিত হয় আহসান। সবকিছুই বিচলতার ভেতর দিয়ে তার সামনের দিনগুলো অগ্রসর হতে থাকে।

শাহ মাহফুজ-এর অন্যান্য গল্পঃ

৩. দুই নম্বর 
২.
শ্বশুর আমার ভিনদেশির মতো নজর নিছে
১.  
বেড়ালের স্পর্শ

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত