যে ব্যথাটা প্রচন্ড লাগে অথচ একটা উহ্ শব্দ পর্যন্ত করা যায় না সেই ব্যথারা জমে গলা অব্দি উঠে আসে। কন্ঠনালীতে ঘুরে ফিরে আবার বুকের ভেতর মিশে যায়। তখন খুব গলা ব্যথা হয়। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সারা শরীর নীল হয়ে উঠতে চায়। তেমন ব্যথা নিয়ে তপতী সকাল থেকে সংসারের কাজ করছে। ব্যথাগুলো একদিনে জমা হয়নি। ঘুম ভাংলে সংসারের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফের ঘুমুতে যাবার আগে পর্যন্ত প্রতি মুহুর্তে এই ব্যথা ভোলার জন্য যুদ্ধ করে চলেছে তপতী।
মেয়ের স্কুলড্রেস গুছিয়ে বিছানায় রেখেছে। ক্রস ওড়না, বেল্ট, সালোয়ার, কামিজ, সেমিজ। ক্লাস নাইনে উঠেছে মেয়ে তবুও সব কাজ তপতীকে করে দিতে হয়। অথবা তপতী ইচ্ছে করেই করে। যেন হাতে, আঙুলে, ত্বকে মেখে মেয়েটাকে চোখের সামনে নিত্য আবিষ্কার করে।
আজকাল বেশ মুখরা হয়ে উঠেছে মেয়ে। একটু একটু জেদ করা শুরু হয়েছে। আজকেই স্কুলে যাবে না বলে জেদ ধরেছিল। তপতী বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করালো। মেয়ের বাবার সাথে স্কুলে আজ পাঠাতেই হবে।
আজ দুপুরটা তপতী একা থাকতে চায়। একান্ত নিজের মতো। মেয়ে ঘরে থাকলে সেটা সম্ভব না। এতো বড় মেয়ে একটু পর পর চিৎকার করে ওঠে ওমা কোথায় গেলে, মাগো কাছে এসো, মা ওটা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে, মা সেটা করি চল। একটা পাঁচ ছয় বছরে বাচ্চারা যা করে তপতী’র মেয়ে তার মায়ের সাথে ঠিক সে আচরণ করে। একটা সময় তপতীর ভয় এসেছিল এই মেয়ে কী বড় হবে না! সবার সাথেই যদি এমন করে তাহলে খুবই সমস্যার একটা বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু খুব খেয়াল করে তপতী দেখেছে বাইরের মানুষের সাথে এমনকি মেয়ে তার বাবার সাথেও খুব মেপে বুঝে কথা বলে।
মেয়েটার বয়স এখন চৌদ্দ বছর আট মাস। বিয়ের ছয়মাসের মাথায় মেয়েটির জন্ম। প্রিম্যাচ্যুর বেবি। সাড়ে সাত মাসে জন্ম। বিয়ের পূর্বে তপতী এবং তার স্বামী আতিক জেনেছিল তাদের সন্তান আসছে। জানিয়েছিল দুই পরিবারকে। নয়তো তাদের বিয়ে হওয়া অসম্ভব ছিলো। কত ঝড়-ঝাপটা বয়ে গেছে সদ্যোজাত শিশুটি আর তার নব্য মা-বাবার উপর দিয়ে মেয়েটি হয়তো কখনো জানবে না। তপতী বলবে না।
ক্লেশের অতীত যত তাড়াতাড়ি পারা যায় মাটি দিয়ে দেয়া ভালো। নয়তো সেই ক্ষতের গহবর আশপাশ ধরে টান দেয়। ফ্লোর থেকে চিরুনিটা ড্রেসিং টেবিলে তুলে রাখতে রাখতে অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তপতীর ভেতর থেকে।
হঠাৎ তপতী’র মনে হয় অতীতে গিয়েও তাহলে শান্তনা মেলে! যেন অতীতের তুলিতে অতীতকে একটু একটু করে মুছে দেবার ব্যবস্থা। নিজেকে নিজে ভুলানোর খেলা! কিন্তু তখনই আবার অতীতের আরেক শাখা এসে গলাটা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করতে চায়।
এর মধ্যে তপতী’র মেয়ে বাথরুমের দরজা একটু ফাঁক করে দেখে তপতী ঘরে আছে। সে সশব্দে বলে, ওহ্ মা তুমি এই ঘরে আছো ভালো হলো। আমি টাওয়েল নিতে ভুলে গেছি। বারান্দা থেকে এনে দাও তো। বলে দাঁত বের করে হাসে।
প্রচ্ছন্ন আহলাদি আবদারের হুকুম যেন!
এমন স্বরে নিজের মা’কে কখনো কিছু আনবার হুকুম করতে পারত তপতী! প্রশ্নই আসে না। সে কপট ধমকের সুরে মেয়েকে বলে, এতো বড় মেয়ে নিজের জিনিস নিয়ে বাথরুমে যেতে পারো না!
মেয়ে নাকি সুরে বলে, আহহা বললাম তো ভুলে গেছি।
তপতী বলে, একই ভুল তুমি রোজই করো।
ফুরফুরে মেজাজে আতিক শিস দিতে দিতে বের হয় গোসল সেরে। তপতী মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে বলে, মেয়ে বড় হয়েছে এখনো তোমার অভ্যাস ঠিক করলেনা!
আতিক হাসে আর বলে, মেয়ে তো বাবার সব কিছু জন্মের পর থেকেই দেখেই বড় হচ্ছে। হুট করে আকাশ থেকে পড়েনি।
টাওয়ালে মাথা মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখমণ্ডলের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে আতিক। থুতনির নিচে ডাবল চিন সামান্য উঁকি দিয়েছে আর চুলের ভেতর কয়েকটা রূপালি রঙের চাকচিক্যের আভাস দেখে হাত দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে কালো সাদার অনুপাত নিয়ে তৃপ্ত বোধ করতে করতে হঠাৎ আয়নার ভেতর খেয়াল করে ফোনটা বিছানায় রাখা! অথচ আতিকের যতদূর মনে পড়ে সে ফোন চার্জে দিয়েছিল। নাকি দেয়নি! গতরাতে অনেক রাত পর্যন্ত ফোনে ছিল সে। যা গতানুগতিক ধারার একদম বাইরে। রাত এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে অবশ্যই ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস করে দিয়েছে তপতী। এই সব একঘেয়ে অভ্যাস থেকে একটু বাইরে পা দেয়াতেই মন হালকা বোধ হচ্ছে – ভাবে আতিক। আর কত রুটিন! আর কত স্ট্রাগল। জীবন কী শুধু ঠেলা আর যুদ্ধতেই কেটে যাবে!
আতিক ফোনটা হাতে নিয়ে চেক করে। নাহ ফোন চার্জে দেয়া হয়নি আজ। বিছানায় নিজেই রেখে গেছিল। মেসেঞ্জারে গুডমর্নিং, হ্যাপি বার্থডে, লিখেছিল। সর্বনাশ বলে মনেমনে। গতরাতের চ্যাটিং কিছুই ডিলিট করা হয়নি। এশা অবশ্য মনে করিয়ে দেয় রোজ টেক্সট গুলো ডিলিট দিও কিন্তু। এই এশা মেয়েটাকে এখনো ঠিক বুঝতে পারেনা আতিক। চৌত্রিশ বছর পর পুনরায় পরিচয় হলে সব কিছু নতুনই মনেহয়।
এশার বাবা এবং আতিকের বাবা কলিগ ছিলো। সেই সুবাদে এশা এবং আতিকের বন্ধুত্ব। দুই বছরের বড় ছিল এশা। পাশাপাশি বাড়ি আর একই স্কুলছিল দুজনের। আতিক ক্লাস ফাইভে আর এশা সেভেনে তখন একদিন এশার বাবা ডিবি লটারি পেয়ে সপরিবারে ইউএসএ চলে গেলো। দীর্ঘদিন আতিকের খুব মন কেমন করত এশার জন্য।
জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের হাত ধরা, মেয়েলি বিষয় গুলো জানার অভিজ্ঞতা হয়েছিল এশার সাথে। সে হারিয়ে গেলে খালি খালি লাগবে এটাই স্বাভাবিক। তারপর ভাগ্যের কী পরিহাস হঠাৎ চৌত্রিশ বছর পর আবির্ভাব হলো এশার। এশাই খুঁজে বের করেছে আতিককে। মাত্র দুই সপ্তাহ ধরে আবার দুই বন্ধু ফিরে পেয়েছে তাদের বাল্যবন্ধুকে। যদিও এশা বলেছে তার জীবনে প্রথম চুমুও আতিকের ছিল। কিন্তু আতিক কিছুতেই মনে করতে পারেনা এটা কবে ঘটেছিলো! অফিসে বসে কথাগুলো শুনতে শুনতে আতিকের শরীর যেন একটু ঝাঁকি দিয়ে উঠেছিল।
এশার সাথে পুনরায় যোগাযোগ হবার কথাটা আতিক কয়েকবার বলতে চেয়েছে তপতীকে। তপতী জানে খুব ছোটো বেলায় এশা নামে আতিকের একটি বান্ধবী ছিল। প্রেম ভালোবাসা বোঝার আগে তাদের বন্ধুত্ব থেমে গিয়েছিল। এরপর দ্বিতীয় নারী তপতী আসে আতিকের জীবনে যখন তারা কলেজ জীবন প্রায় শেষ তখন।
কিন্তু চুমু খাবার কথাটা বলে খুব অস্বস্তিকর একটি অনুভূতি তৈরি করেছে এশা যার ফলে তপতীর কাছে এশার কথাটা বলতে গিয়ে বারবার থেমে গেছে।
খুব বেশি পজেসিভনেস ছাড়া তপতীর ভেতর আর কোনো বাড়াবাড়ি নেই ভাবে আতিক। বরং একটু বেশিই গুছানো স্বভাবের। এইসব বাড়াবাড়ি গুলোই হয়তো তাদের স্বামী স্ত্রী হতে বাধ্য করেছে। আতিককে পাবার জন্য তপতী সব করতে প্রস্তুত ছিলো। যখন দুই পরিবার কিছুতেই তাদের বিয়েতে রাজি না তখন তপতীই বুদ্ধিটা বের করেছিল। জীবন যুদ্ধে আতিককে ডানা মেলে আগলে রেখেছে। তপতীকে কিছুতেই দুঃখ দিতে পারবে না আতিক।
এশা জীবনে ফিরে আসার পর নিয়মতান্ত্রিক একঘেয়ে জীবনে অন্যরকম একটা সুখ খুঁজে পায় আতিক। সেই সুখের সাথে আগে পরিচয় ছিল না। তাই সারাক্ষণ তপতীর কাছে ধরা পড়ে যাবার ভয় হয়। কিন্তু এশাকেও হারাতে চায় না আতিক। জীবনে রোমাঞ্চকর এই অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতে চায় না।
মেসেজ গুলো ডিলিট করতে করতে একবার দরজার দিকে তাকিয়ে নেয় আতিক। তপতীর অবস্থান বোঝার চেষ্টা করে। আছে নিশ্চয়ই মেয়ের ঘরে। মেয়েটা জন্মাবার পর ধীরে ধীরে তপতীর সব মনোযোগ সরে যাচ্ছে মেয়ের দিকে। এ নিয়ে আতিক বহুবার অভিযোগ করেছে। তপতী হাসে, কানেই তোলে না। মা মেয়ের সাথে সাথে সারাক্ষণ একই স্থানে থাকা চাই। এমনকি এখনো ঘুমের সময় হলে মেয়ে মা’কে ছাড়া ঘুমুতে পারেনা! মেয়ে ঘুমুলে তপতী নিজের শোবার ঘরে আসে। আজকাল অবশ্য মেয়ে তার মায়ের থেকে একটু দূরে থাকতে চায় খেয়াল করেছে আতিক। তপতীকে সে-ও বলে এতো বড় মেয়েকে কী ঘুম পাড়াতে হয় তোমার? এখন তো বাচ্চা নেই। ক্লাস নাইনে পড়ে। তপতী মুখ লাল করে বলে, আমার লজ্জা লাগে মেয়ের ঘুমের আগে শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করতে।
আতিক ভাবে মেয়ে জাতিটাই অদ্ভুত! নিজের মেয়েকে সেও কিছু কম ভালোবাসে না।
আতিকের যদিও আজ ইচ্ছে ছিল মেয়ের মা স্কুলে নিয়ে যাক কিন্তু আজ ঘুম ভেঙে অব্দি তপতীর মুড কিছু বুঝছে না আতিক। কয়েক দিন ধরেই সহজ সরল ঘোর সংসারী তপতীকে খুব অমনোযোগী মনে হচ্ছে তার। নাকি আসলে বেশি ভাবছে সে! অফিসের কাপড় পরে চুলটা যত্ন করে আচড়ে নেয়। বেল্টটা আবার ঠিক করতে করতে নিজের ভুড়ির দিকে দেখে। খুব ছোটো খাটো একটা ভুড়ির উদয় হচ্ছে আজকাল।
খাবার ঘর থেকে আতিক হাক দেয় মা মেয়ের উদ্দেশ্যে, কই তোমাদের হলো? আজ আমার এক জায়গায় যেতে হবে, জরুরি মিটিং আছে আধা ঘণ্টা আগে বের হবো বলেছি তো আগেই।
তপতী সোজাসুজি কিচেনে চলে যায়। আতিকের চোখ জোড়া তাকে অনুসরণ করছে বুঝতে এতোটুকু অসুবিধা হয় না তার। দু’জন দু’জনকে প্রতি পদে চেনে বলেই জানত তারা। আজ সকালে এমনকি কয়েক ঘন্টা আগে পর্যন্ত।
এই বিশ্বাস নিয়ে প্রেম এবং বিয়ের বাইশ বছর একসাথে আছে। অথচ কিছুই চেনেনি! একটু গলা শুকিয়ে আসে আতিকের।
মেয়ের টিফিন বক্স রেডি করতে করতে আরেকবার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চায়। যে মানুষটিকে ঘিরে তপতীর জীবন মরণ সুখ আনন্দ সে-ই এমন ব্যথা দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ভাবলে দম বন্ধ হয়ে আসে তপতীর। কয়েকদিন ধরে আতিকের ছটফটে ভাবটা তপতীর দৃষ্টি এড়ায়নি। যে কাজ কখনো করবে বলে ভাবেনি সেই কাজটাই করে বস্ল তপতী। আতিকের ফোন চেক করলো। এবং আজ সকালেও।
এই তপতী কী হয়েছে তোমার? শরীর ভালো? জিজ্ঞেস করে উত্তরের অপেক্ষা করে না আতিক। কাছে এসে তপতীর কপালে হাত রাখতে চায়। চকিতে তপতী মাথা একদিকে হেলে সরিয়ে নেয়। যেন কিছুতেই তাকে ছুঁতে দেয়া চলবে না। নিজের এই আচমকা সরে যাওয়াটা তার ইচ্ছেতে করেনি। ভেতর থেকে অন্য কেউ করিয়েছে। তপতীর মন হুহু করে ওঠে। আতিক একটু অবাক হয় তপতীর এই দ্রুতবেগে সরে যাওয়া দেখে। এমন কখনো করে না তপতী।
কিন্তু আতিকের আজ এতো কিছু ভাববার অবসর নেই। মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে তাকে দ্রুত সোবহানবাগ যেতে হবে। এশার ফ্ল্যাটে। কথা ছিল সকাল সকাল যাবে। ব্রেকফাস্ট একসাথে করার আবদার ছিল এশার। আজ এশার জন্মদিন। চৌত্রিশ বছর পর তাদের দেখা হবে।
আতিকের পেছনে তাকিয়ে মনেমনে তপতী বলে, একটু জোর করে বরং ছুঁয়ে দাও, ধরে রাখো কয়েক মুহূর্ত, মাত্র কয়েক মুহূর্ত ধরাছোঁয়ার ভেতর থাকলেই ভিতরের দুমড়ে যাওয়া তপতী আবার জুড়ে যাবে একসাথে। প্লিজ এখনো সময় আছে আমাকে সব বলো।