ঘাসের ডগাটা হাওয়ায় দুলছে, দোল খাচ্ছে এক ফড়িং। পাঁচ বছরের রন্তু চেয়ে চেয়ে দেখছে, দৃষ্টিতে গভীর বিস্ময়, ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি। একটু দূরেই খেলছে আরও ত্রিশটা শিশু। তাদের কারো গায়ে দুধ শাদা পুলওভার, কারো গায়ে জিন্সের জ্যাকেট। ছোট ছোট পায়ে দৌড়াচ্ছে, খলখলিয়ে হেসে উঠছে। পুরো দৃশ্যটা খামারের বারান্দায় বসে দেখছেন রাশিদ চৌধুরী।
শীতের বিকেলগুলো খুব দ্রুত শেষ হয়। ঝুপ করে নামে সন্ধ্যা। বিষন্ন পায়ে ধেয়ে আসে কুয়াশার আবছায়া। অবসাদের মত সন্ধ্যাগুলো খুব বেশী স্মৃতিকাতর করে তোলে। সেই কবেকার কথা, রাশিদ চৌধুরী এগ্রিকালচারের ওপর পিএইচডি শেষ না করেই ফিরে এলেন দেশে। পৈতৃকসম্পত্তির সবটুকু বিক্রি করে দশ জোড়া ফড়িং নিয়ে প্রত্যন্ত চরের দরিদ্রতম অংশে গড়ে তুললেন ‘ইন্টিলিজেন্ট ড্রাগনফ্লাই গার্ডেন (আইডিজি)’।
কি সব দিন যে গেছে! বহু বাধা, বহু প্রতিবন্ধকতা বহু অনিশ্চয়তাকে পাড়ি দিয়ে ‘আইডিজি’ এখন বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান। বিশ বছর আগেও এই চরে ভাত খাওয়ার কোনো রেস্টুরেন্ট ছিলো না। আইডিজিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নামীদামী সব রেস্টুরেন্ট, দুটো ফাইভ স্টার হোটেল। প্রতিদিন তিনটা ক্রুজশিপ ভিড়ে চরের জেটিতে। বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা দেখতে আসে বিশ্বের প্রথম ইন্টিলিজেন্ট ড্রাগনফ্লাই গার্ডেন।
রাশিদ চৌধুরীর বাগানে উৎপাদিত হয় বিশ্বের সেরা ফড়িং। দশ মাস মায়ের গর্ভে বেড়ে ওঠে ফড়িং, জন্মের পর একবছর বয়স পর্যন্ত মায়ের কাছেই বড় হয়। এরপর শিশুফড়িংদের আলাদা করা হয়। খুব যত্নে মা ফড়িংদের পরবর্তী গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত করা হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়বার গর্ভধারণের আগেই তারা মারা যায়।
কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিশু ফড়িংদের বড় করা হয়। বয়স তিন বছর হলেই শুরু হয় বিক্রি, চড়া দামে বিক্রি হয় পাঁচ থেকে ৮বছর বয়সী ফড়িং। ওষুধ কোম্পানি, অর্গান সরবরাহকারী সংস্থা আর রোবট তৈরীর কারখানাগুলোই ইন্টিলিজেন্ট ফড়িংয়ের মূল ক্রেতা।
‘ইন্টিলিজেন্ট ড্রাগনফ্লাই ব্যবহার নীতিমাল’ মেনে বিভিন্ন কাজে এসব ফড়িং ব্যবহার করা হয়। শিশুদের বিকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে যান্ত্রিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চাহিদা কমছে, বাড়ছে ফড়িংঅর্গানের চাহিদা। দাম বেশী বলে অসুস্থ শিশুর অভভাবকরা শেয়ারে ফড়িং কেনেন— কারো হয়তো চোখ দরকার, কারো দরকার লিভার, কারো শুধুই কিডনি। রোবট তৈরীর কারখানাগুলো মগজ রেখে ফড়িংয়ের দেহটা পেডোফেলিক রেস্টুরেন্টে বিক্রি করে দেয়।
বাগানে তীক্ষ্ন স্বরে ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে উঠতেই স্মৃতি রোমন্থন হতে বাস্তবে ফিরে আসেন রাশিদ চৌধুরী, বারান্দা থেকে ধীর পায়ে ঘরের দিকে এগিয়ে যান। আজ নিজ খামারে উৎপাদিত ৩১টি ফড়িংয়ের সাথে তিনি ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করবেন। ডিনারের ফাঁকে ফাঁকে তাদের রেশমি চুলে বিলি কেটে দেবেন, তুলতুলে গালে হাত বুলাবেন। গলা আর গ্রীবার কাছে বিলি কাটলেই খিকখিক করে হেসে উঠবে তারা। ডিনার শেষে বিশেষ ব্যবস্থায় ফড়িংগুলোকে চারদিনের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হবে। ঘুম গাঢ় হলে ছোট কফিন আকৃতির কারুকার্যময় বাক্সে ভরা হবে তাদের, আগামীকাল সকালে শিপমেন্ট।
রুটিন ওয়ার্ক অনুযায়ী ডিনারের আগে ‘ইন্টিলিজেন্ট ড্রাগনফ্লাই রফতানি আইনের সর্বশেষ গেজেটটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লেন রাশিদ চৌধুরী, এরপর ক্রেতা সংস্থার কাছে শিপমেন্ট নিশ্চিতকরণ ই-মেইলের শেষ প্যারায় লিখলেন- ‘সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আইন অনুযায়ী ব্যবহারের আগে বা পরে ফড়িংয়ের আত্মা কোনোভাবেই শয়তানের কাছে বিক্রি করা যাবে না, প্রতিটি আত্মাই মূল্যবান।’