এক.
– জন্মের পর যে মানুষটা মোর কোনোদিনও খোঁজখবরই নেয় নাই, তায় আজ বাড়িত আসি কছে, মুই তোর বাপ। দেখ তো মা, মানুষটাক তুই চিনিস নাকি?
মেয়ে সোনাইর কথায় বাড়ির উঠানে উঁকি দেয় আলে মা। দেখে, দরজায় দাঁড়ানো লম্বা পাতলা এক মানুষ। শ্যামলা মানুষটারে চেনা লাগে। তারে এক নজর দেখেই ধক করে কেঁপে ওঠে আলে মার কলিজা। কিন্তু তারপরেই সে মুখ ফিরে নিয়ে কয়, না তো, চেনো না!
মিথ্যে কথাটা বলে বটে, ভ্রু কুচকে আবার তাকায় সে। এরপর মেয়ের হাত শক্ত ধরে কয়, এটাকে কই থাকি আনছিস তুই? বের করি দে বাড়ি থাকি।
যেন শরীর কাঁপে আলে মার। যেন ভুত দেখে। কাঁপতে কাঁপতে উঠানের খুঁটি ধরে দাঁড়ায়, যেন মাটিতে পড়ে যায়, বলে, ওহ আল্লাহ, এই মানুষটা এতো দিন পর কোথা থাকি আসিছে!
মানুষটা কাহারবা। মেলা দিন পর এসেছে কাহারবা। প্রায় পনের বছর হবে। সেই জাতীয় নির্বাচনের সময়কালে লোকটা হারিয়ে গেল। কই ছিল এতোদিন? কেনো আসিছে? ছটফট করে আলে মা। তার ভেতরের পুরানা আতঙ্ক জেগে ওঠে আবার। সাথে হাজারো রাগ অভিমান ক্ষোভ যা এতোদিন জমা ছিল তার, দাউ দাউ করে সারা শরীরময় আগ্নেয়গিরির মতো ছড়িয়ে পড়ে। মুখ লালচে হয়। হাত-পা থথ্থর করে।
এতোদিনও মানুষটারে সে ভুলে নাই। ভুলতে পারে নাই। কি করে ভুলতে পারে? যে মানুষটা সারা জীবনের ভেতর একটা দাগ দিয়ে গেছে, তারে কি সহজে ভোলা যায়? তাই হয়ত এক নজর দেখেই সে চিনে ফেলে। ক্ষোভ নিয়ে বলে, কি কারণে সে আসিছে?
এতোক্ষণ দু’জনকেই মন দিয়ে খেয়াল করছিল সোনাই। এবার মায়ের হাত ধরে কয়, লোকটা বাড়ির কাছে ঘুরঘুর করছিল। তোমার খোঁজ করি আমার বাপ-মা চৌদ্দ গুষ্টির কথা শুনতে চাইল। দু’এক কথা কয়া ধমক দিছি, কেনো কবো? দেখি লোকটা মুখ গম্ভির করে বইসা রইছে। এরপর আমারে ডাকি কয়, মা-রে, মনে হয় মুই তোর বাপ! কথাটা শুনে আকাশ থাকি পড়িছি আমি, রাস্তার মানুষ কইল মুই তোর বাপ আর বাপ হয়া গেল। তারে টেনে বাড়িত আনিছি।- এ-কথা কি সত্য মা?
– না! এ কথা সত্য না। তোর বাপ মরি গেছে।
– বাপ মরি গেছে তুমি কও, কিন্তু মানুষে যে কয় আমি নাকি জাউরা ছাওয়া(জারজ সন্তান)। বুঝিছি।
সোনাই এইবার লোকটির মুখোমুখি দাঁড়ায়। তার চোখের দিকে কটমট তাকিয়ে থাকে। এই লোকটা তাহলে! এটা সেই জঘন্য লোক যে আমাকে জন্ম দিয়া মাকে বিয়ে না করে পালাই গেছে। সে এবার লোকটার মুখোমুখি তর্জমা আঙ্গুল তুলে কয়, তুই! কোন কালের বাপ তুই?
মেয়ের প্রশ্নে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় কাহারবা। কিছু বলে না। কিছু বলারও নেই। ছলছল তাকিয়ে দু’হাতের তালুতে মেয়ের মুখ তুলে নিয়ে দেখতে তার মন চায়। ছুঁইতে চায়। নিজের মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করতে চায়। বুকের খাঁ খাঁ করা এই হাহাকার সে মেটাতে পারে না। এক অপার কুণ্ঠা হাত-পা কুকড়ে দিয়েছে যেন। পারে না হাত বাড়িয়ে ধরতে। শুধু বলে, মা-রে! ক্ষমা করি দে।
হাত ঝটকা দিয়ে খ্যাপা বাঘের মতো ঝিটকে সরে যায় সোনাই। বলে,
– ক্যান ক্ষমা করিম? তুই মোর বাপ না, বুঝলি! বলেই লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে কয়, চলে যা, এই বাড়ি থাকি চলে যা তুই।
কাহারবা থতোমতো খায়। তবুও তাল সামনে নেয় সে। কিছুক্ষণ আগেও যে সোনাইর ব্যবহার ভালো ছিল, সেই সোনাই যেন বাপেরে চিনতে পেরে ক্ষোভে ফুটছে। অভিমান করে বসেছে বাপের উপর। তাই সে রাগ না করে পিছু হটে।
বাড়ি থেকে বের না হয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে। ঘাড়ের থলেটা নামিয়ে রাখে। বলে, বড্ড পিয়াষ লাগিছে রে মা। এক গিলাস পানি দে। মায়ের হাতে একটু পানি খেয়ে বিদায় নেই।
সোনাই পানি দেয় না, বরং কড়া কথা শুনিয়ে দেয়, ঐ দিকে পানি আছে যা, মসজিদে গিয়ে পানি খেয়ে বিদায় নে।
কথাটা বলে ঠিকই, কিন্তু ছলছল চোখ মোছে এবার। কতদিন বাপ বাপ করে কেঁদেছে। কত কথা শুনতে হয়েছে মানুষের মুখে। জাউরা ছাওয়া, জাউরা ছাওয়া শুনতে শুনতে কানটা ঝালাপালা হয়ে গেছে তার। কত কষ্ট করে বেঁচে উঠতে হয়েছে। পড়তে হয়েছে। লোকজন থুথু ছিটাত, গরম পানি ঢেলে দিত হোটেলের ছোকরারা, পথে স্কুলের ছেলেমেয়েরা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত। সেই খোঁড়া পা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পালাতে হত। তখন ভাবত, হঠাৎ যদি তার বাবা জেগে উঠত মাটি থেকে!
সেই বাবা এসেছে আজ। তবুও এতো রাগ-ক্ষোভ জাগিছে কেন?
এরই মধ্যে আলে মা বেরিয়ে আসে। হাতে গ্লাস ভর্তি পানি তার। মেয়ের হাতে গ্লাস দিতে দিতে কয়, মেয়ে এখন কামাই রোজগার করে, তার জন্য ভাগ বসাতে আসিছে!
খোঁড়া পা নিয়ে সোনাই তখন এলাকার ছেলে মেয়েদের সাথে টিকটক করে কিছু টাকা কামাই করতে শুরু করেছে, সেই ইনকামের কথা বলে আলে মা। কিন্তু কাহারবা নাকোচ করে দেয় কথাটা। কয়,
– না রে আলে, সে অধিকার নাই আমার। খালি এক নজর দেখিবার জন্য আসিছি।
– তা আসবে না কেনে? কলঙ্ক দিয়া যৌবন বয়সের সব কাড়ি নিয়া ফেলি গেছিস, আর এখন আসিছিস বেটিক দেখির? মোর জীবন তুই শেষ করিছিস, তাও হাউশ মেটে নাই?
এরপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে কয়, আবার কেনে আসিছে বুঝি না আমি? মেয়ের কামাই খাবার জন্যি এতোদিন পর আসিছে।
– আলে!
আবেগের খুব আদুরে গলায় বলে সে। নরম সুরে বলে কাহারবা। পরিচিত সুরে। তবুও খেঁকিয়ে ওঠে আলে মা,
– এই মুখে আলে আলে কবি না তুই! একটা শয়তান তুই। জাত শয়তান!
আলে মা কেঁদে ফেলে যেন। সেই সব অতীত স্মৃতি তার মনে পড়ে। সেই সব যৌবনের দিন। যা তার জীবনকে মুখ থুবড়ে ফেলে দিয়েছে।
সেই জাতীয় নির্বাচনের রাতে, যখন ফলাফল ঘোষণায় দেরী হচ্ছিল সেই সময়টায়, বাইরে খুব হট্টোগোল করছিল আর লাফাচ্ছিল লোকেরা, আশা পুরণের উত্তেজনায় ছিল তারা। তারই ভেতরে, খুব গোপনে আরো একটা অবৈধতার জন্ম হতে থাকে। এক রুদ্ধশ্বাস কষ্টযন্ত্রণায় কেঁপে উঠতে উঠতে আলে মা জন্ম নেয় সোনাইকে। দেখে, মেয়েটির পা খোঁড়া। এদিকে তখন তাকে বিয়ে করার আশা দিয়ে কাহারবা উধাও। বুঝতে পারে, অবৈধতায় বন্দি হয়ে গেছে তার চাওয়া পাওয়া। আর এই অবৈধতা জন্ম দিয়েছে এক বিকলাঙ্গ মেয়ে।
সে মেনে নিতে পারে না। আবার ফেলেও দিতে পারে না। তবুও সে সোনাইকে খুব যত্নে কাপড়ের টোপলায় পেঁচিয়ে নেয়। এরপরেই সে নানান জায়গায় নানান ভাবে পালিয়ে থাকে। বৈধতায় আগলে রেখে তিল তিল করে বড় করে মেয়েকে।
আলে মা নাক-মুখ মুছে ফুপিয়ে কয়, কত আশায় ছিলাম, দেখা নাই তোর, এখন আসিছিস? একবারো তুই আমার কথা মনে করলি না?
– বেহুশ ছিলাম রে আলে, কোন তালে যে ছিলাম কইতে পারি না।
– কোন কালে হুশ ছিল তোর? খালি তো উত্তেজনায় লাফাতে পারিস। তোর উত্তেজনায় কি যে পয়দা হইবার পারে, সেইটা কেন বুঝলি না? হুজুকে মাতাল হয়া কি আকাম করি গেছিস, কি সর্বনাশ করি গেলি মোর।
নদীর স্বচ্ছ্ব পানির গতির মতো ক্ষিণ দিনগুলো তার মনে পড়ে। সোনাইর জন্মের প্রায় দশ মাসেরও আগে, অবৈধতার শুরু যখন, গার্মেন্টে চাকরি করার সময়, বেতন ভাতা বন্ধ করে দিলে আন্দোলনে নামে তারা। সেই আন্দোলনের মাঠে দুজনের চিন পরিচয় হয়। আলে মা দেখে, সমানে লাফ মেরে চিৎকার করা কাহারবা তার প্রতি বেশ সদয়। মিছিল শেষে বাসা ফিরে যেতে যেতে নানান স্বপ্ন দেখাত কাহারবা।
আলে মা হাত ধরে কইত, কিছুই হবে না এগুলা করে।
কাহারবার এক কথা, দিন বদলায়। দিন বদলে যাবে।
সেই দিন যে এভাবে বদলে যাবে আলে মা বোঝে নাই। তখন কাহারবার কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস না করলেও মজা করে শুনত সে। কি এমন কথা হতো তখন, স্বপ্ন দেখাত কাহারবা। হাড় ভাঙা পরিশ্রমের পরও আন্দোলনে শরিক হতো তারা, চার্লি চাপলিনের মতো মালিক আর দারিদ্রতা নিয়ে ঠাট্টা করত কাহারবা, হাসত তারা প্রাণ খুলে, প্রত্যাশা থাকত ভালোভাবে বাঁচার, নিজের পাওনা বুঝে নেয়া আর অধিকারের। এই আবদার কি মিছে ছিল?
হ্যা, সব মিছে হয়ে গেছে, যখন নির্বাচনের রাতে জন্ম নেয় সোনাই, তখনই বুঝে গেছে, তার চাওয়া পাওয়া যা চাঁদ সূর্য্য সাক্ষী রেখে মিলেছিল সেদিন। সেই জোছনা রাতে, মিছিল শেষে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পথে।… আর সেসব মনে করতে চায় না আলে মা। ভুলে থাকতে চায়। ভুলে যাওয়া মানুষটা এসে যেন পাপের প্রমাণ দিতে এখন হাজির হয়েছে। কি দরকার ছিল তার এতোদিন পর ফিরে আসার? সে মুখ তুলে চেয়ে দেখে, লোকটা তার মেয়ের সাথে বেশ খাতির জমিয়ে ফেলেছে। সব কি তার হাতছাড়া হবে? ক্ষেপে ওঠে সে। প্রায় লাফ দিয়ে সে কাহারবার কাছে পৌছে,
– কেন? কেন আসিছিস তুই? তোরে আজ মারি ফেলিম! এতোদিন পর আসিলে ক্যেনে?
বলেই গলা টিপে ধরে। তারপরেই শিথিল হয়ে সে গড়িয়ে পড়ে তার অশ্রুর মতো।
আলে মার এমন আক্রমণে কাহারবা নূয়ে পড়ে। লোকটার হাত পায়ে যেন শক্তি নাই, সামান্য প্রতিবাদও সে করে না। বরং প্রায় অবশ হাতে কোনোমতে আলে মাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। সবই তার দোষ। যে দোষের কৈফিয়ত দেয়া চলে না। তারও চোখ আলে মার মতো ছলছল করে। সেই ছলছল অশ্রুজলের ভাসমান কাঁপনিতে সে তার অতীত দিনগুলো আপছা আপছা চোখের সামনে ভেসে বেড়াতে দেখে। সোনাই সহ সে আলে মাকে মেঝেতেই শুয়ে দেয়। মুখে চোখে পানি ছিটা দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে থাকে সে।
মুখে হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে ত্বকের ভাঁজ ফোকরে অতিত দিনগুলো খুঁজতে থাকে। নিঁখুত প্রেমের সম্পর্কই ছিল তাদের। শারিরিক মানসিক দিক থেকে পরস্পরের নিবেদন ছিল পবিত্র। আন্দোলন তো প্রেমের আশির্বাদ হয়েই এসেছিল। সেখানেই দেখা হয়েছিল দুজনের। কী সুন্দর ছিল আলে মা। অল্পতেই হেসে উঠত তার মুখ। সব শুকিয়ে গেছে। বেঁচে থাকার সামান্য আবদারই তো ছিল তার। পূরণ করতে পারে নি সে।
কাহারবার মনে পড়ে, কথা ছিল নির্বাচনের পরেই তাদের বিয়ে হবে। সেসব ছিল যেন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতির মতো। মেলামেশা হয়েছিল সেই প্রতিশ্রুতি থেকেই। হাসি পায়, নিজেকে বিদ্রুপ করে সে। বলে, আলে, আমি আসিছি তো! ফিরে আসিছি।
– কত নিষেধ করিছি মিছিলে যাইও না যাইও না। তাও গেলে।
– আফসোস আলে, কেন যে গেছি সব কিছু খোয়া দিতে, বুঝি নাই। নেতা আইসা সেবার এমন করি কইল, এটা নাকি ক্ষমতা বদলের লড়াই। সবাই গেলে সব কিছুই নাকি বদলে যাবে, তখন নাকি আমরা আমাদের সব পাওনা পাই পাই বুঝে পাব। সব মিথা কথা ছিল আলে। সব মিছে।
– কিন্তু তারপর কই ছিলে এতোদিন?
বিদ্রুপ হাসে সে, মিছিল নিয়া পল্টনে গেছি তখন। আচমকা ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া শুরু হইল। মাতাল হয়া মারামারি আর গোলাগুলি চলিছে। এরই মধ্যে হঠাৎ পল্টনের পূব কোণা থাকি একটা ঢিল না কি জানি আমার মাথার পেছনে লাগল। ফুটপাতে পইড়া গেলাম। এইটুকু জানি শুধু।
এরপর ফুটপাতেই দিনরাত গেছে। ফুটপাতেই ঘুমাতাম। মানুষে খাওয়াত, টাকা-পয়সা দিত। দিন পার হইত রমনা পার্কে। তখন তো জানতাম না আমি নিজে কে। কেউ ডাকত না আমারে। আমার প্রয়োজনও কারো ছিল না। বলতে গেলে, নিজের কোন অস্তিত্বই ছিল না এতোদিন। একদিন ঘুম ভাঙে তোর কথায়। তুই কইলি, কেমন শুকাই গেছিস, বাড়ি চল।
– আলে! তোর কথা মনে হইল আমার। কাঁদে কাহারবা। হাত ধরে কাঁদে। বলে, আমি বুঝতে পারলাম আমার একটা আলে আছে। আলে রে, আমার আলে মা! আমারে ক্ষমা করি দে। তোর জন্য আমি বাঁচি উঠিছি।
আলে মা চোখ মুছে দেয়। কাহারবা বলতে থাকে, এরপর কত খুঁজিছি তোকে। কতখানে খুঁজিছি। সাভারে আসিছি যেখানে ছিলাম আমরা। যেখানে যাই দেখি সবকিছুই কেমন জানি বদলে গেছে। একদিন দেখি, যে লোকটা মিছিলে নিয়া যাইত, মতিন ভাই, সে একটা পাজেরো থেকে নামছে। দৌড় দিয়া তার পিছু নিছি। ধাক্কা দিয়া ফেলে দিল চেলাগুলা।
ভয় লাগল আমার। আবার যদি জ্ঞান হারাই। ফুটপাতে গিয়া দোকানের পাশে বসি পাউরুটি খাইতে খাইতে দেখি, মালিক আর মালিকের মেয়েরা নামছে গাড়ি থেকে। জানতে পারি, আরো দিইটা গার্মেন্ট ফ্যাক্টোরি হইছে। সেসব নিয়া আমার মাথা ব্যথা নাই, খালি তোরে খুঁজি আমি। কিন্তু কই পাবো? বাঁধ ভাঙা নদীর শ্রোতের মতো ছুটে আসা গার্মেন্ট কর্মিদের থাকি আমার আলে মারে কেমন করি খুঁজে পাই? শুধু চায়া চায়া খুঁটে খুঁটে আমার আলে মারে দেখে, এটাই হয়! এটাই হয়! কতজনকে কইছি আর অপমান হইছি। মিথ্যা কমু না আলে, তখন সবাইরে আমার আলে মা লাগে। শুধু কাছে নিয়া চোখ গুলা দেখলেই বুঝি, না, এ আমার আলে মা না। আমি হতাশ হয়া বসে থাকি। লান্স টাইমে, আমার মতো হাজারো কাহারবা খাইতে আসে। কারো চিনিনা।
তবুও আশা ছাড়ি না। একদিন খুঁজে পাই তোর সেই বান্ধবীকে। নাম তার মনে নাই, তার কাছে জানতে পারি, তুই এখনো বিয়া করিস নি। মেয়ে নিয়া এখনো নাকি আমার আশায় বাড়িতে আছিস। তার মাধ্যমে ঠিকানা সংগ্রহ করি এখানে আসিছি।
আলে মা কাহারবাকে গোসল করে কাপড় বদলে ফেলতে বলে। কাহারবা শরীর থেকে ময়লা কাপড় নামাতে নামাতে বলে, আলে রে, আমি আসিছি এইবার তোরে বিয়া করতে।
দুই.
ঠিক কোন তালের মানুষ কাহারবা তখনো জানাই ছিল না আলে মার। কিছু একটা আন্দোলনের ডাক পেলেই মানুষটা ছুটে যেত। যোগ দিত মিছিলে। মানুষটা ফিরে এসেছে এতেই খুশি। মনে শান্তি পায় আলে মা। এক নতুন জীবনের আশায় সে আবারো সংসার শুরু করে। দিন যায়, সুখ প্রশান্তির বসবাসের এক ঠিকানা পেতে হাত ধরে দৌড়াতে থাকে তারা। আলে মা আবারো স্বপ্ন দেখে নতুন দিনের, কাহারবা সুদিনের স্বপ্ন দেখায়। আলে মা কখনো থামিয়ে দেয়, কয়, না এই রকম স্বপ্ন দেখাস না আর। আমি স্বপ্ন দেখলে স্বপ্নগুলা অবৈধর ভেরত ঢুকি যায়। তখন দেখা যাবে, বিকলাঙ্গ আরেক ছাওয়া পয়দা হইছে।
কাহারবা হাসে, বলে, এইবার বৈধ হয়াই লড়াই হইবে।
সোনাইর সাথেও বেশ খাতির হয় কাহারবার। মাঝে মাঝে সে মেয়ের দিকে চেয়ে থাকে। বাপেরই মতন গড়ন তার, মায়ের মতোন গায়ের রঙ। মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে মেয়েকে বলে, মা-রে, আমি তোর বাপ নই!
মেয়ে ধমক দেয়।
আলে মা দেখে, পাঁজরের হাড় বেড়িয়ে গেছে কাহারবার।
– এইভাবে শুকিয়ে গেলে!
– শুকাইলেও রে আলে, বুকের ভেতর এখনো তাগদ আছে। এই দ্যেখ। বলেই সে আলে মার হাতটা বুকে লাগায়।
আলে মা তার হাতটা কিছুক্ষণ কাহারবার বুকের উপরে রেখে হেঁসে কয়, হাড়ের ভেতর ঘন্টা নড়ছে, ঢিগ্ ঢিগ্ , মনে হচ্ছে, জান আছে।
– জান না থাকিলে তোর কাছে ফিরে আসি রে? কি কথা কইলি?
– কইছি ঠিকই। আসিছিস তো শুধু হাড় নিয়া।
– এই হাড়ও কিন্তু জানের কথা কয় আলে!
– কয় তো, কয়, হাড়ে হাড় জোড়া বান্দি মরি যা!
হাঁসে তারা। এইটা ভালো হয়, যদি একসাথে মরি দুজন! এক কবরে মাটি হইল। এক কবরে হাড়বন্দি। মজাই হইবে। মরার পরে তোর সাথে হাড়ে হাড় মিলে শুয়া থাকিম, এটাই সুখ।
– হাড়ের মধ্যে শুয়ে থাকার সুখ কি-রে?
দিন যায় এভাবে। বছর যায়। ঝুপরি ঘরের সংসারটাকেও বেশ গোছগাছ করে নিয়েছে তারা। কাহারবা রিক্সা চালিয়ে সংসারের হাল ধরেছে। তবুও অভাব পিছ ছাড়ছে না। বাড়িটাকে ভালো করার ইচ্ছা জাগে তাদের। একদিন তারা তিনজনে মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, শহরে গিয়ে আলে মা বাসা বাড়িতে কাজ নিবে আর কাহারবা রিক্সা চালিয়ে টাকা কামাই করবে। সোনাই থাকবে বাড়িতে। মাস দু’তিনের মধ্যে যা জুটবে তাই নিয়ে ফিরে এসে বাড়িটা ঠিক করবে।
সিদ্ধান্ত মতো একদিন রওয়ানা হয় তারা।
ঠিকঠাক মতোই শহরে নামে। গাড়ি থেকে নেমে দেখে, রাস্তা অবরোধ। আবারো আন্দোলনের ডাক পড়েছে। রাস্তা ব্লোক করে বসেছে আন্দোলনকারীরা। আবারো সুষ্ঠু নির্বাচনের আন্দোলন শুরু হইছে। রাস্তা বন্ধের কারণে তারাও সেখানে বসে পড়ে। নেতা বক্তব্য দিলে তাদের চোখ চকচক করে ওঠে। আলে মা দেখে, লড়াই পাগল কাহারবার যেন নেশা ধরেছে, তার পেটে ঘুতো মেরে কয়, এই! যে কাজে আসিছিস সে কাজে চল।
– একটা কামের কাম হইবে এবার! কাহারবা থামিয়ে দিয়ে কয়, এইবার সবকিছু মিলবে।
ঠিক এসময় একটা ট্রাক মানুষজনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সামনের নর্দমায় উল্টে পড়ে। আর এতেই এক গাদা কাদা ছিটকে এসে তাদের গায়ের উপর। দেখে, সারা শরীর ভিজে গেছে নর্দমার কাদায়।
ধরফড়িয়ে ওঠে তারা। পরস্পরের দিকে চায়। নিজের শরীরের দিকে চেয়ে দেখে, তাদের আঁচল ভর্তি হয়ে গেছে এক গাদা কাদায়।
শাহ মাহফুজ-এর অন্যান্য গল্পঃ
৫. দৃষ্টিহীনের নগ্নতা দর্শন
৪. রক্ত হিন্দু, রক্ত মুসলমান
৩. দুই নম্বর
২. শ্বশুর আমার ভিনদেশির মতো নজর নিছে
১. বেড়ালের স্পর্শ