প্রাপক

ঠক্ ঠক্ ঠক্ ঠক্ করে একমনে চিঠির খামগুলোতে সিল মারার ভীষণরকম একঘেয়ে কাজটা করার সময় প্রতিদিন এত এত চিঠি কোথায় যায় কার কাছে যায় তা ভাবার কথা রিয়াজউদ্দীনের কখনও মনে আসেনাই বলে সেগুলোর উপরে কী ঠিকানা লেখা আছে তা দেখার বা চিঠির গতিগন্তব্য সম্পর্কে ভাবার অবকাশ বা আগ্রহ কখনও তৈরি হয়নাই তার। তাছাড়া একটা চিঠিতে সিল মারার কাজটা এত অল্প সময়ের মধ্যে সারতে হয় যে ঠিকানা দেখার সময়ও তার কখনও করা হয়নাই, সময় করা কী, কখনও সে ধরনের ইচ্ছাও তৈরি হয়নাই। কাজের মাঝে অবকাশ তার থাকে না_ তাও ঠিক না, অবকাশ থাকে, মাঝেমাঝে একটু বেশিই অবকাশ থাকে।

রিয়াজউদ্দীনের সামনে তারের জাল লাগানো জানালা যার একেবারে নিচে টিকেট বা খাম কিনতে আসা কিংবা মনিঅর্ডার করতে আসা লোকেদের হাত ঢোকানোর জন্য একটা গোল ছিদ্র আর তার একটু উপরে কথা বলার জন্য আরেকটা চারকোণা ছিদ্র, সে জানালার তারের জালের ভেতর দিয়ে তাকালে সামনে একটু বামদিকে লালরঙের পুরানো পোস্টবক্স আর তাকে ছাড়িয়ে ডানদিকে লেকের ওপারে ঘনগাছে ছাওয়া রাস্তা আর তাকেও ছাড়িয়ে গাছপাতার ফাঁকেফাঁকে দূরে লাল সিরামিক ইটে বানানো ভাসানী হলের এককোণা আর সাদা চুনকাম করা কামালউদ্দীন হলের আরেককোণা দেখা যায়। টিকেট বা খাম কিনতে আসা কিংবা মনিঅর্ডার করতে আসা লোকেদের ভিড় কম থাকলে বিশেষকরে দুপুরের খাবার সময় পাওয়া লম্বা অবকাশে রিয়াজউদ্দীন বরং পোস্টবক্স ছাড়িয়ে সামনের রাস্তায় ছেলেমেয়েদের দলবেঁধে গল্প করতে করতে, হাসাহাসি করতে করতে বা দুষ্টামি করতে করতে হলের দিকে কিংবা ডিপার্টমেন্টের দিকে যাওয়া বা আসার দৃশ্য কিংবা রাস্তার পাশে লেকের পানির সামনে বসে আড্ডা বা গান করতে থাকার দৃশ্য দেখতে খুব পছন্দ করে। আর প্রতিদিনের মতো আজকের লাঞ্চ আওয়ারটা পার হয়ে গেলেই বিকাল চারটার ডাক ধরানোর জন্য রিয়াজউদ্দীন যখন একমনে ঠক্ ঠক্ ঠক্ ঠক্ করে সিল মারায় ব্যস্ত হয়ে যায় এবং একের পর এক সিলমারা চিঠিগুলোকে বামহাত দিয়ে টেনে নিয়ে নিয়ে অটোমেটিক যন্ত্রের মতো করে বামদিকে স্তুপ করতে থাকে তখনই একটা চিঠির উপর ঠক্ করে সিলটা পরার আগে তার ডানহাতটা উপরে থাকতেই থেমে যায় এবং এই ছন্দপতন নিছক হাত থেমে যাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তারও অনেক পরে বিকাল চারটার ডাক চলে যাওয়া এবং ডাক চলে যাবার পরও রিয়াজউদ্দীনের পুরা সন্ধ্যা ও সারাটারাত এলোমেলো করে ফেলে। তার সাতবছরের চাকরি জীবনে এই একই টেবিলে বসে একই তারের জাল দিয়ে আটকানো দুই ছিদ্রওয়ালা জানালার উপরের ছিদ্র দিয়ে একই ধরনের কয়েকটা শব্দ দিয়ে বিন্যস্ত কথা বলে যাওয়া আর নিচের ছিদ্র দিয়ে একই টিকেট আর খাম বিক্রি করা বা মনিঅর্ডার গ্রহণ করা এবং বিকাল চারটার ডাক ধরানোর আগে পর্যন্ত সেই একইভঙ্গিতে ঠক্ ঠক্ ঠক্ ঠক্ করে সিলমেরেযাওয়া জীবনে হাজার চিঠির মধ্যে এই একটি চিঠি তাকে, তার পুরা বিকাল, সন্ধ্যা আর সারারাত এলোমেলো করে দিল, দিতে পারল, কারণ ওতে কোনো ঠিকানা লেখা ছিল না। খামের উপর কিছুই লেখা ছিল না।

প্রত্যেকদিন সন্ধ্যার আগে আগে রিয়াজউদ্দীনদের দুইতিনবাড়ি পর হিরু ব্যাপারির মা আর বৌয়ের অত্যন্ত উঁচু আর তীক্ষ্ন গলার ঝগড়া শোনার ফাঁকে গেটের বাইরে খোলা জায়গাটার ঘনসবুজ ঘাসের মাঝখানে ইংরেজি ‘এস’ অক্ষরের মতো জেগে ওঠা লালমাটির রাস্তাটায় পাকারাস্তা থেকে নামা রিয়াজউদ্দীনের সাইকেলের মৃদূ অথচ নৈমিত্তিক এবং অনিবার্য একটি শব্দ শুনতে পায় রোকেয়া। ঘরের সমস্ত কাজ ঠিকমতো করতে করতেই অনেকখানি কৌতুহল নিয়ে হিরু ব্যাপারির মা আর বৌয়ের ঝগড়ার আকর্ষণীয় শানানো শানানো কথাগুলি শুনতে থাকলেও রোকেয়ার কান ঘড়িধরা একটা সময়ে রিয়াজউদ্দীনের সাইকেলের মাডগার্ডের সাথে চেইনের বাড়ি খাওয়ার শব্দটা ঠিকই শুনতে পায়।

ঘনসবুজ ঘাসের মাঝখানে কালে কালে গেরুয়া গ্রামের প্রায় প্রত্যেকটা পুরুষের, নারীর, শিশুর আর কখনও কখনও তাদের সাথে সাথে চলতে থাকা গরু, মহিষ, ছাগল বা মোরগ-মুরগীর পা পড়ার ইতিহাস নিয়ে জেগে ওঠা লালমাটির রাস্তাটা পাকারাস্তা থেকে ইঞ্চি তিনচারেক নিচু হওয়ায় রিয়াজউদ্দীন যখন সন্ধ্যার ঠিক আগে হিরু ব্যাপারির মা আর বৌয়ের ঝগড়া করতে থাকার সময় সাইকেলে চড়েই সেখান থেকে গেরুয়ার লাল কিন্তু চিকন ‘এস’ আকৃতির রাস্তাটায় নামে তখন অনিবার্যভাবেই সাইকেলের চেইনটা ঝাঁকি লেগে মাডগার্ডের সাথে বাড়ি খায়। রিয়াজউদ্দীনের সাথে বিয়ে হবার পর কিংবা তার দুইবছর পর তার শাশুড়ি মারা যাবার পর কিংবা তারও তিনবছর পর অনেক তাবিজ আর পড়াপানির ফসল হিসেবে রোকেয়ার কোল আলো করে আসা বিজুর জন্মের পর বা বিজুর বয়স আজ নিয়ে একবছর আটমাস হবার পর আজই প্রথম রোকেয়া খেয়াল করে হিরু ব্যাপারির মা আর বৌয়ের ঝগড়া থেমে গিয়ে আবার তারা দুইজন প্রতিদিনকার মতো সব মিটিয়ে একসাথে রান্না করতে বসে গেলেও সেই মৃদূ অথচ অনিবার্য ঘড়িধরা সময়মাফিক সাইকেলে চেইনের সাথে মাডগার্ডের বাড়ি খাওয়ার পরিচিত শব্দটি তার কানে পেঁৗছেনাই। আর রোকেয়া বিকালের সবকাজ শেষে বিজুর ঘুম থেকে ওঠার সময় হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত বিজুর কাথাকাপড় ধুতে ধুতে সাইকেলের শব্দ শুনবে বলে কলপাড়ে অনেক সময় নিয়ে বসে আছে মনে হবার পর একইসাথে সন্ধ্যার অন্ধকার নামা ঘরে একলা থাকা বিজু আর ঘরের বাইরে থাকা বিজুর বাপের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে সে চারপাশে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যা আর সন্ধ্যা নাই, রাতও হয়ে গেছে অনেক্ষণ হয়।

বিজু কি এখনও ঘুমে? বিজু যদি ভয় পায় ভেবে তার খারাপ লাগলেও বিজুর বদলে তার চোখের সামনে সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকারে আরও গাঢ় সবুজের মাঝখানে লালমাটির একটা বিলম্বিত আর নিঃশব্দ এস আকৃতির রাস্তা জেগে ওঠে। সাইকেলের এই সামান্য মৃদূ ধাতব শব্দটি প্রতিদিন রোকেয়াকে কতখানি নিশ্চয়তা এনে দেয় তা রিয়াজউদ্দীনের ঘরে আসার সাতবছর পর এই প্রথম রোকেয়া বুঝতে পারে। ভাবতে না চাইলেও প্রথমবারের মতো রোকেয়ার মনে হয় রিয়াজউদ্দীনের কিছু একটা হয়ে গেলে বিজুকে নিয়ে তার যাবার কোনো জায়গা নাই। বিজুর ভেজা কাথাকাপড় কলপাড়েই ফেলে রেখে ঘরে এসে রোকেয়া দেখতে পায় বিজু বিছানায় বসে ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে চারদিকে তাকানোর চেষ্টা করছে আর বিজুর এই বসে থাকার অসহায় ভঙ্গি দেখে রোকেয়ার সমস্ত অস্তিত্ব কেঁপে উঠলে রোকেয়া দৌড়ে গিয়ে বিজুকে চেপে ধরে উদ্বিগ্ন গলায় ‘বাপ আমার সোনা আমার’ বলে বিছানায় বসলে অন্ধকারে একলা ফেলে রাখার অভিমানেই হয়ত কিংবা সদ্য ঘুম ভেঙে কোনোকিছু বুঝতে না পেরে কিংবা মায়ের অযাচিত কিন্তু গভীর আদর পেয়ে বিজু আল্লাদি ভঙ্গিতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। আর রোকেয়ার দুইচোখও কেমন ঝাপসা হয়ে আসে, বিজুর কান্নার শব্দ ছাপিয়ে পাকারাস্তা থেকে নামা রিয়াজউদ্দীনের সাইকেলের শব্দের জন্য মনেমনে কান পেতে বিজুকে অাঁকড়ে ধরে অন্ধকারে বসে থাকে সে।

বারান্দায় হাতমুখ ধুতে বসে বাইরের অন্ধকারকে আজ অন্য কোনোদিনের চেয়েও অনেক বেশি অন্ধকার আর ভারী মনে হয়, আর মনে হয়, এখানে, বারান্দায় একটা আলোর ব্যবস্থা করার কথা রোকেয়া অনেকদিন মনে করিয়ে দেবার পরও একটা বাল্ব, খানিকটা তার আর একটা হোল্ডার কিনে আনার কথা তার একদিনও মনে থাকে না। রোকেয়া তাকে মাঝেমধ্যে ‘সংসারের দিকে তোমার একদম মন নাই’ বলে লজ্জা দেবার চেষ্টা করে করে ব্যর্থ হয়ে এখন কিছু বলা বাদ দিলেও অফিস থেকে নিয়মের ব্যতিক্রম করে সন্ধ্যার অনেকপরে ঘরে ফিরে বারান্দায় বসে টিউবওয়েল থেকে সদ্যতোলা ঠাণ্ডাপানি দিয়ে হাতমুখ ধুতে ধুতে বারান্দায় একটা আলোর প্রয়োজনীয়তা রিয়াজউদ্দীন অনেকদিন পর নতুন করে আজ অনুভব করে। অন্ধকারে তার দম আটকে আসতে থাকে, আর তা কেবল অন্ধকারের জন্য নয়, দেরি করে আসার বিশ্বাসযোগ্য কোনো কারণ খুঁজে না পাওয়ার জন্যও তার দমবন্ধ লাগে। অন্যসব দিন চারটার ডাক যায় একদিক দিয়ে আর টেবিল গুছিয়ে রিয়াজউদ্দীন বের হয় আরেকদিক দিয়ে; অথচ আজ কী যে হল! চারটার ডাক বিদায় হবার ঘণ্টাখানেকেরও বেশি সময় পর অফিস থেকে বেরুবার তাড়া অনুভব করলেও বারবারই তার দেরি হয়ে যাচ্ছিল। ঠিকানাবিহীন চিঠিটা চোরের মতো পকেটে পুরে সন্তর্পণে বের হয়ে আসার সময় তার একবার মনে হয়েছিল কালামসাহেব নিশ্চয়ই তারই দিকে তাকিয়ে আছে_ সে পেছন ফিরে নিশ্চিত হয়নাই তবে তার মনে হয়েছে, আর এজন্যই সে তখনই চলে আসতে পারেনাই। তার বের হওয়া আবার কালাম সাহেব খেয়াল করছে বলে সে তো আর সাথে সাথেই মত পাল্টে চিঠি রেখে আসার জন্য ঘুরে দাঁড়াতে পারে না। তাই অযথাই বাইরে এসে কিছুক্ষণ সময় ব্যয় করে তারপর একসময় অন্যকোনো কাজের ছুতা করে ভেতরে গিয়ে চিঠিটা সবার অগোচরে ড্রয়ারে রেখে চলে আসার সময় পোস্টমাস্টার কালামসাহেব সত্যিই তার দিকে তাকিয়ে আছে কিনা দেখার জন্য সাহস করে পেছন ফিরে তাকালে রিয়াজউদ্দীন দেখতে পায় কালামসাহেব এতক্ষণ তার দিকেই তাকিয়ে ছিল আর এখন তাকে ঘুরে তাকাতে দেখে অল্প করে হাসে। ব্যাপারটা কাকতালীয় বলে অনেকবার করে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেও তার বারবার মনে হতে থাকে কালামসাহেব মনে হয় এখন হাসিহাসি মুখ করে বলেই বসবেন_

– ‘আপনেই লেখে দিলেন নাকি, ঠিকানাডা? কই, দেহি? কী ঠিকানা লেখলেন?’

কালামসাহেবের কাছে নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করার জন্যই হয়ত রিয়াজউদ্দীন অনর্থক দেরি করতে থাকে। তারপরও সে আর কতটুকু দেরি, তারপরইতো সাইকেল নিয়ে বের হল সে, তারপর সোজা এই বাসায়। তবে? কোথা দিয়ে তবে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল? ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়ে বিশমাইল আসামাত্র নবীনগরফেরত ম্যাটিনি শো ভাঙা লোকেদের ভিড়ের মধ্যে রিয়াজউদ্দীনের সাথে দেখা হয় সাবরেজিস্ট্রার স্যারের। রিয়াজউদ্দীন সিনেমা দেখে বের হল মনে করে রিক্সা থেকেই ব্যাজারমুখে মাথা নাড়লেন স্যার আর তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পাশকাটিয়ে চলেও গেলেন। রিয়াজউদ্দীনের কেবলই মনে হতে থাকে এখন রাস্তার সবলোক ভাবছে সে তবে এতক্ষণ সিনেমা দেখছিল। সিনেমা দেখায় দোষের কিছু আছে বলে রিয়াজউদ্দীন মনে করে না, বরং তার একেকসময় মনে হয় রোকেয়াকে নিয়ে একদিন আসবে, কিন্তু দেড়বছরের বিজুতো আর ঘণ্টাতিনেক অন্ধকারে বসে থাকতে পারবে না, তাকে তখন কার কাছে রেখে যাবে তাই কখনও ঠিক করে উঠতে পারেনাই বলেইতো কখনই রোকেয়াকে নিয়ে সিনেমা দেখতে আসা হয়নাই, এমনকি রোকেয়াকে কখনও আল্লাদ করেও বলা হয়নাই, ‘চলো, সিনেমা দেখে আসি’; তবে সে যাই হোক, সেতো এখন সিনেমা দেখছিল না, নাহয় দেখছিলই, তাতে কার কী, কিন্তু তবু বিনাদোষে দোষী হওয়ার অভিমানে আর সেটা কাউকে বলতে না পারার আকুতিতে তার মনটা খচখচ করতে থাকে।

সে এখন কী করে প্রমাণ করে যে সে সিনেমা দেখে নয়, অফিস থেকে ফিরছে? সে কি সাইকেলে চড়ে দ্রুত চলে যাবে, নাকি শান্তভঙ্গিতে সাইকেল ঠেলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফিরবে, যেন তার কোনো তাড়া নাই? পরিচিত, অর্ধপরিচিত লোকদের দেখলে সে কি মুখ হাসিহাসি করে দুইএক কথা বলার জন্য দাঁড়াবে, নাকি কোনোদিকে না তাকিয়ে গম্ভীরমুখে সোজা বাড়ির পথ ধরবে? আর সে প্রমাণ করবেই বা কার কাছে? কেন করবে? কোন কাজটা করা উচিত হয় তার? রিয়াজউদ্দীনের সত্যিই জানা নাই। তা পুরা বিকাল আর সমস্ত সন্ধ্যাটা সে তবে কোথায় পার করে এল তাও সেজন্য তার জানা নাই। সে কি সাইকেলে চড়েই ফিরল নাকি হেঁটে হেঁটে সাইকেল ঠেলে নিয়ে ফিরল তা তার জানা থাকুক বা না থাকুক, একথা তার জানা নাই যে পাকারাস্তা থেকে নামার সময় তার সাইকেলের মাডগার্ডের সাথে চেইনের বাড়ি খাওয়ার শব্দ শোনার জন্য রোকেয়া কান পেতে ছিল কিনা বা সেশব্দ শেষমেষ সে শুনতে পেয়েছিল কিনা।

নুদাইমাছের লালটকটকে ঝোল দিয়ে খাওয়া শেষ করে রিয়াজউদ্দীন পাতে ডাল তুলে নিয়ে একগ্রাস ভাত মুখে দেবার পর অনেকখানি আনমনা হয়ে পড়লে চিন্তিত রোকেয়া খানিকটা ডাল হাতের তালুতে নিয়ে চকিত চুমুক দেয়, ডালে লবণের অনুপস্থিতি তাকে খুব লজ্জায় ফেলে দেয়। এরকম তার কখনও হয় না।

মাছ দিয়ে ভাত খাওয়া শেষ হবার পর পাতলা মসুরের ডাল দিয়ে আরও খানিকটা ভাত খেতে পছন্দ করে রিয়াজউদ্দীন, মাছের তরকারিতে আলু থাকলে সেই আলু ডালের মধ্যে নিয়ে চটকে সালুন একটু ঘন করে খায় সে। শীতের শুরুতে কচিমুলা উঠলে ডাল দিয়ে ভাত খাওয়ার সময় কাঁচা খাবার জন্য সে কচিমুলা বাজার থেকে কিনে আনে। অন্যদিনে পছন্দ করে শশা বা খিরাই। ডাল দিয়ে ভাত খাবার সময় কাঁচামুলা বা শশা বা খিরাই মুখে দিলে যে কচকচ শব্দ হয় সেটাই পছন্দ রিয়াজউদ্দীনের। কী যে সব ছেলেমানুষী কারবার! পরশু রাতেইতো, বিজুও বসে গেল বাপের পাশে, খালি একটা থালা সামনে টেনে নিয়ে বলল, ‘ছছা কাবো’। রিয়াজউদ্দীন তাই দেখে হাসতে গিয়ে গলায় ঠেকে কেশে টেশে একাকার। হাসে রোকেয়াও। বাপছেলেকে পাশাপাশি বসা দেখে কী এক ভালোলাগায় রোকেয়ার গলাব্যথা হয়ে আসে, বুকদুমড়ে কান্না আসতে চায়। পরশু রাতের সেই ছবি এখনও রোকেয়ার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে।

রিয়াজউদ্দীন যদিও কখনও কোনো বিষয়ে অভিযোগ করে না, তবুও তার আনমনা, অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে যাওয়া মুখ আর মুখ পর্যন্ত না উঠে মাঝপথে থেমে যাওয়া ডালদিয়ে মাখা ভাতভর্তি হাত রোকেয়াকে খুব অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। আবার রোকেয়া কথা ঠেলে তাকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারে না।

অন্ধকার মাঝরাতে রোকেয়ার ঘুম হঠাৎ ভেঙে গেলে সে দেখতে পায় রিয়াজউদ্দীন বিছানায় নাই, না থাকতেই পারে, কিন্তু তবু রোকেয়া কী যেন আঁচ করে আস্তে আস্তে উঠে বারান্দায় এসে দেখতে পায়, অন্ধকার বারান্দায় একলা বসে আরও অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে রিয়াজউদ্দীন। রোকেয়া খুব আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,

– তোমার কী হইছে?

রিয়াজউদ্দীন যেন রোকেয়ার জন্যই অপেক্ষা করছিল, যেন সে জানত রোকেয়া এখন উঠে আসবে। সে অন্ধকারের দিকে তাকিয়েই খুব স্বাভাবিক গলায় বলে,

– মানুষ এতবড় ভুল কেমনে করে?

রোকেয়ার মাঝরাতে ঘুমভেঙে উঠে আসা তাকে একটুও অবাক করে না_ রোকেয়া এটা খেয়াল করলেও তার বদলে সে ভাবতে চেষ্টা করে যে এমন কোনোকিছু সে করতে ভুলে গেছে কিনা যা রিয়াজউদ্দীন খুব আল্লাদ করে তাকে করতে বলেছিল বা কোনোকিছু সে রোকেয়ার কাছে চেয়েছিল কিনা। রোকেয়া মনে করতে পারে না, শুধু রাতে খেতে বসা রিয়াজউদ্দীনের আনমনা মুখটা তার মনে পড়ে। আর মনে পড়ে, প্রথমদিন প্রথমবার রোকেয়াকে চাইতে গিয়ে কতরকম ভণিতা করতে হয়েছিল রিয়াজউদ্দীনকে। খামাখা রোকেয়াকে হাসানোর চেষ্টায় সস্তা রসিকতা আর টেনশনে কিছুক্ষণ পরপর উঠে গিয়ে পানি খেতে থাকা রিয়াজউদ্দীনের হাসিহাসি মুখের মধ্যেই অতি অসহায় অসামান্য দুঃখী চোখদুইটি দেখে কী অসম্ভব মায়া লেগেছিল রোকেয়ার, অথচ রোকেয়াই কি আর ডেকে নিতে পারে তাকে? তাই কি কখনও নেয়া উচিত? রোকেয়ার আরও মনে পড়ে সেই পানি খাওয়াই কাল হয়েছিল রিয়াজউদ্দীনের। অতিরিক্ত পানি খেয়ে বমি করে সমস্তঘর ভাসিয়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে কিংবা হয়ত অভিমান করে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল সে আর তার মাথার কাছে সারারাত জেগে, অদ্ভুত কষ্ট, অজানা অভিমান আর রিয়াজউদ্দীনের জন্য বুকব্যথা করা মায়ায় চোখভিজিয়ে বসে রইল রোকেয়া। কিন্তু সেসব কথা আজ মনে আসার দরকার কী?

– কিছু চাইছিলা তুমি?

খুব সংকোচে নরম গলায় জিজ্ঞেস করে অন্ধকার থেকে মুখ ফিরিয়ে রোকেয়া দেখে রিয়াজউদ্দীন কখন উঠে ঘরে চলে গেছে। ভালো। কোথায় কী? কার জন্য সে কী ভাবছে?

অফিসে এসে ড্রয়ার থেকে সন্তর্পণে চিঠিটা আবার বের করে রিয়াজউদ্দীন উল্টেপাল্টে দেখে। চিঠিটা খোলার একটা ইচ্ছা তার হলেও শেষপর্যন্ত সে তা খোলে না, খুলতে পারে না। কী লেখা আছে এতে, খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু? চিঠিটা না পেঁৗছলে ক্ষতি হয়ে যাবে? খুব বেশি ক্ষতি? কে পোস্ট করতে এসেছিল চিঠিটা? গতমাসে একবার একটা মনিঅর্ডার করতে এসে ভুল করে রুমনাম্বার না লিখে পোস্ট করে চলে গিয়েছিল এক বুড়া ভদ্রলোক, তার ঠিকই মনে ছিল, লোকটা আসামাত্র আটশো টাকার মনিঅর্ডারটা তাই সে তখনই বের করে দিতে পেরেছিল। কৃতজ্ঞতায় বুড়া লোকটা গল্প করেছিল খানিক্ষণ, টাকাটা যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ মহিলা কলেজে তার ছোটমেয়ের কাছে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে টাকা পাঠাতে, তার উপর আবার ভুলভাল নাম্বারে টাকা চলে যাওয়া; টাকা খোয়াবার ক্ষতি নাহয় মেনে নেয়া যাবে, কিন্তু দেরিতে টাকা গেলে মেয়েটা কষ্টে পড়বে_ এইসব গল্প। এরকম অনেক গল্প থাকে। অনেক সমস্যা, টাকা আসতে দেরি হলে ফরমফিলাপ কিংবা ভর্তিবাতিল, কিংবা চিঠির বিলম্বে সম্পর্ক নষ্ট, হাজারটা ভাবনা রিয়াজউদ্দীনকে অস্থির করে তোলে, কতকিছুই থাকতে পারে একটা চিঠিতে। তার ফুপাতোবোনের ভাশুরের বড়মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেল শুধু চিঠিটা এসেছিল ঠিকই কিন্তু দুইদিন দেরি করে।

এইসব এলোমেলো ভাবনার জন্য নিজেকে রিয়াজউদ্দীনের খুব অচেনা লাগে, এলোমেলোইতো, চিঠিতে লোকেদের নানা সমস্যার কথা থাকে জানলেও প্রতিদিন অনেকচিঠিই যে ঠিকমতো পেঁৗছয় না একথাও জানে সে, কিন্তু সেজন্যতো কখনও তার খারাপ লাগেনাই, তাহলে এখন এসব ভাবনার অর্থ কী? পেছনে পোস্টমাস্টার কালামসাহেবের গলার আওয়াজ পেয়ে চট করে চিঠিটা লুকিয়ে ফেলে রিয়াজউদ্দীন এবং সাথেসাথেই এ কাজটার জন্য নিজের উপরই খুব বিরক্ত হয় সে। কার না কার চিঠি, এভাবে তা লুকাতে যায় কেন সে? আর লুকানোর আছেটাই বা কী? সে কি কোনো অন্যায় করছে_ একজন একটা চিঠিতে ঠিকানা লেখেনাই, তাই দেখছে।

একটা ক্লান্তিকর ও বিলম্বিত অপেক্ষার পরও যখন কেউ এসে বলল না, ‘আচ্ছা ভাই শোনেন, গতকাল একটা চিঠি …’ তখন রিয়াজউদ্দীনের ভেতর কোথায় একটা হতাশার মতো জন্ম নেয়। অনেকরকম উত্তর সে সাজিয়ে রেখেছিল, ‘কি মনভোলা মানুষ ভাই আপনে?’

– আর বইলেন না ভাই, খুব টেনশনে আছি, এই টাকা চাইয়া বাড়িতে লেখছিলাম আরকি …

– তাইলে? আপনেই বলেন, আমি যদি খেয়াল করে তুলে না রাখতাম তাইলে কী বিপদে পড়তেন আপনে, বলেন?

এইসব কতকথা ভেবে বসে আছে রিয়াজউদ্দীন আর বোকা মনভোলা লোকটা কিনা আসলোই না। লোকটা? নাকি ছেলেটা, নাকি মেয়েটা? হলে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর বেশিরভাগেরই বাড়ি থেকে টাকা আসে মনিঅর্ডারে। তাদের যে কেউ হতে পারে। ইউনিভার্সিটির এ সাবপোস্টঅফিসে বসে এ সাতবছরে কত ছেলেমেয়েকে সে খুশি করেছে বাড়ি থেকে আসা টাকা হাতে তুলে দিয়ে, ব্যাপারটা সে খুব উপভোগ করে, তাদের খুশিতে সেও খুশি হয়।

হঠাৎ কোথায় একটু কূল পায় রিয়াজউদ্দীন। কালসকালে মাত্র অফিস খোলা হয়েছে এমনসময় একটা মেয়ে এসেছিল, নীল একটা জামা পরা, আনমনা ভঙ্গিতে সে একটা চিঠি ফেলেছিল ডাকবাক্সে, এখানথেকে দেখেছিল রিয়াজউদ্দীন, ধীরপায়ে হেঁটে চলে গেল মেয়েটা তারপর। অবশ্য তারপরে কম করে হলেও পঞ্চাশ কি একশ কিংবা দেড়শ লোক, ছাত্রছাত্রী, অফিসার, বুড়া, চাষা, কামলা, কর্মচারী চিঠি পোস্ট করে গেছে, তবু কেন কে জানে মেয়েটার কথাই তার মনে পড়ে। দুইদিন হল বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হয়ে গেছে, হলগুলো সব খালি না হলেও, ছেলেদের সবগুলো হল মিলে হয়ত জনাবিশেক ছেলে পাওয়া যাবে, কিন্তু মেয়েদের হলেতো কারও থাকার কথা না। খুব চেষ্টা করেও মেয়েটার মুখ মনে করতে পারে না সে। ইস! আরেকটু ভালো করে যদি দেখে রাখত! আশ্চর্য! সে কি আর আগে থেকে জানত নাকি?

কী লেখা আছে ঐ চিঠিতে? কালামসাহেবের দিকে একবার তাকিয়ে সে সাবধানে আবার বের করে চিঠিটা। চিঠিটা আসলে খুলতেই হবে। চিঠির শেষে প্রেরকের নাম থাকারই কথা। সংক্ষিপ্ত হলেও একটা ঠিকানা থাকতে পারে। থাক, কালামসাহেব চলে গেলে খুলব। অফিস শেষ হবার জন্য, পাঁচটা বাজার জন্য তাই অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে সে। আর ক্লান্তিকর দীর্ঘ অপেক্ষার পর অফিস একসময় শেষ হয়।

অফিস থেকে বের হয়ে লেকের পারে এসে সাইকেলটা কাত করে মাটিতে নামিয়ে রেখে অনেক দ্বিধার পর, অনেকবার খুলব কি খুলব না করে শেষমেষ খুলেই ফেলে রিয়াজউদ্দীন। কোনোদিন সে কোনো চিঠি পেয়েছিল কিনা, কিংবা জীবনে আর কোনো চিঠি এতটা অধীর হয়ে সে খুলেছিল কিনা তা এই অসময়েও একবার মনে আসে তার। কিন্তু কোনো চিঠির কথা তার মনে পড়ে না। রোকেয়া তাকে কোনোদিন চিঠি লেখেনাই, কারণ রোকেয়াকে বাড়িতে রেখে চিঠি লেখার মতো দূরত্বে সে কোনোদিন যায়নাই। সেও কোনোদিন কাউকে চিঠি লেখেনাই। রিয়াজউদ্দীন খুবই আশ্চর্য হয়ে যায়। তার জীবনে তবে কোনো চিঠি নাই? এটাই তার প্রথম চিঠি? এক অজানা কষ্টে রিয়াজউদ্দীনের মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।

চিঠির ভেতর সে আসলে কিছুই পড়বে না, শুধু শেষে নাম বা নামের শেষে সংক্ষিপ্ত একটা ঠিকানা থাকলে, থাকারই কথা, সেটাই পড়বে, সে অনুযায়ী চিঠির প্রেরককে খুঁজে বের করা যাবে_ এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে চিঠি খোলে রিয়াজউদ্দীন। কিন্তু চিঠিটা খোলার পর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় সে, চিঠি না পড়ে তার আর কোনো উপায় থাকে না, চিঠির শেষে প্রত্যাশা অনুযায়ী কোনো নাম বা ঠিকানা না থাকায়ই আসলে পুরা চিঠি পড়ে একটা কিছু খোঁজার চেষ্টা করতে হয় তাকে।

মাবু,

কেমন আছো, বাবু আমার? কিভাবে তোমাকে জানাবো বুঝতে পারছিনা। তুমি বাড়িতে যাবার ক’দিন পরই নিশ্চিত হয়েছি। আসলে নিশ্চিত না হওয়ার কোন উপায়ও নাই। আমি তো তোমাকে সেদিন বলেছিলাম যে কিছু একটা হয়েছেই, তা না হলে কখনো আমার এরকম হয়না। একদিনও এদিক সেদিক হয়না। তুমি বলেছিলে দুচারদিন একটু দেরি হতেই পারে। কিন্তু তুমি বাড়ি চলে যাবার পরও যখন হলোনা, মাবু, আজ ১৫ দিন পার হয়ে গেছে, তুমি বুঝতে পারছো? আমি কি করবো মাবু?

আমি ওকে ফেলতে চাইনা। আবার রাখবো সে সাহসও পাইনা। অনেক ভেবে দেখলাম, বাসা ছেড়ে চলে আসার মতো শক্তি সাহস হয়তো আমার নাই। তুমি তো জানো, বাসার সবাই আমাকে কতো ভালোবাসে। আবার আমার সন্তান, ওকেও আমি ভীষণ ভালবাসি, ওকে আমি ফেলি কি করে? আমার প্রথম সন্তান, আমাদের সন্তান। ওর কি দোষ?

মনে আছে মাবু, কতোদিন হাঁটতে হাঁটতে আমার পেট একটু ভারী দেখাতো বলে কিরকম ছেলেমানুষী করতাম, আবার শাড়ি পড়লে তো সেদিন আরো বেশি করে তোমাকে পেটটা দেখাতাম আর বলতাম, বাবু! আমার পেটে বাবু।

মাবু, আমার কেন এমন হলো? আমার বাবুর জন্য আমার অনেক মায়া। জানো, আমি প্রতিদিনই একটু একটু করে বুঝতে পারছি ও বড়ো হচ্ছে। কি এমন বড়ো? আমি তো জানি আসলে এ সময় কিছুই বুঝা যায়না, তারপরেও জানো মাবু, কিরকম যে লাগে, মনে হচ্ছে আমার পেট অনেক বড়ো হয়ে গেছে। শরীর যেন অনেক ভারী হয়ে যাচ্ছে।

প্রতিদিন আমি ওকে স্বপ্ন দেখি, এতো বাবু ও, আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বোঝেনা। মাবু, এমন কেন হলো যে আমার সন্তানকে আমি রাখতে পারবোনা? তবে ও এলো কেন? আমার খুব ভয় করে মাবু, ও যদি অভিশাপ দেয়? যদি কখনো আর আমার বাচ্চা না হয়? তুমি তাড়াতাড়ি আসো মাবু। তুমি আমাকে দেখবেনা? তুমি আমাকে কিছু করতে বলোনা, প্লিজ, আমি আমার প্রথম সন্তানকে বড়ো হতে দিতে চাই।

জানো মাবু, সারাদিনই পেটের দিকে তাকিয়ে থাকি, দেখি ও কতোটুকু বড়ো হল। আমি তো ওকে হাত দিয়ে আদর করতে পারিনা, তাই সারাদিনই বলতে গেলে পেটে হাত বুলাই। খাওয়া-দাওয়াও করছি, তা না হলে ওর কষ্ট হবেনা? আমিতো ওর মা। তুমি তাড়াতাড়ি দেখতে আসো, কেমন যত্ন করছি তোমার বাবুকে। চিঠি পাওয়ামাত্র চলে আসো।

নিচে একটা সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর, আর তা থেকে কোনো নাম উদ্ধার করতে পারে না রিয়াজউদ্দীন।

পুন: ঈদের ছুটি অলরেডি দিয়ে দিয়েছে। কাল মেজোভাই এসেছিলো নিতে। এসাইনমেন্টের কথা বলে আরো দুদিন রয়ে গেলাম। হল প্রায় খালি হয়ে গেছে। মাবু, তুমি চিঠি পেয়েই চলে আসো। হল খালি হলেও সুপার আপাকে বলে হয়তো সোমবার পর্যন্ত থাকতে পারবো। তুমি রবিবারের মধ্যেই আসতে চেষ্টা করো। মাবু, তোমার রাস্তার দিকে সারাক্ষণ চেয়ে থাকবো।

সীমু আপার কথা মনে আছে তোমার, মাবু? ঐ যে ছাঁট কাগজের মলাট-এ কবিতা দিতো। সীমু আপা এখনো ঐ ক্লিনিকে বসে। কাল গিয়েছিলাম সীমু আপার কাছে। সোমবার রিপোর্ট দিবে বলেছে। সীমু আপা তোমাকে দেখা করতে বলেছে। তুমি প্লিজ আসো।

রিয়াজউদ্দীনের হাতপা কেমন ঠাণ্ডা আসতে থাকে। মাথায় একটা দুর্মর কাজের ভার চেপে বসে। চারপাশ অন্ধকার করে নামা সন্ধ্যা রিয়াজউদ্দীনের চারপাশে যে অপারগতা তৈরি করে তা থেকে বের হবার কোনো সম্ভাবনা সে দেখতে পায় না।

খুব ক্ষীণ, খুব সামান্য একটা সূত্র, আর কিছু নাই, ঐটুকু সম্বল করে আগাতে ভয় লাগে রিয়াজউদ্দীনের। ‘সীমুআপা এখনও বসে’_ কোন ক্লিনিকে? উনি কি ডাক্তার? খুব সম্ভবত। চিঠি পড়ে তাই মনে হল। আবার চিঠিটা পড়ে সে। সাভার বাজারের সেই ছোট্ট ক্লিনিকের কথা মনে আসে তার, কী যেন নাম? বিজু হবার সময় পাশেরবাড়ির হিরু ব্যাপারির মা চিনিয়ে দিয়েছিল। রিয়াজউদ্দীন একবার বলেছিল ঢাকা মেডিকেলে নেবে কিনা, কিন্তু সেই ক্লিনিকের, দূরছাই, এখন কি আর কোনোকিছু ঠিকমতো মনে আসতে আছে? দূর! নামে কাজ নাই, ক্লিনিকটাতো চেনে সে। তা সেই ছোটখাটো ফর্সামতো মেয়েটা, প্রথমেতো ডাক্তার বলে মনেই হয়নাই, অথচ ছোটখাটো হলেও কেমন বুবু-বুবু চেহারা, অবশ্য সেটা পরেরদিন রোকেয়া বলে দেবার পর রিয়াজউদ্দীন খেয়াল করতে পেরেছিল, সেই ডাক্তার মেয়েটা, মুখে কি মায়া! বিজু হবার পর ঐ তুলতুলে লাল মাংসপিণ্ডের মতো শিশুটিকে অনেক আল্লাদ করে নিজেই রিয়াজউদ্দীনকে দেখাতে নিয়ে এসেছিল। সন্তানের সেইমুখ আজ এখন এই ঘনায়মান অন্ধকারে রিয়াজউদ্দীনের মনে পড়ে না, সেই ডাক্তারের মুখ তার চোখভরে ভাসতে থাকে। দাদা বলে সেদিন রিয়াজউদ্দীনকে ডেকেছিল মেয়েটা, সৎমার মেয়ে হলেও তার একমাত্র ছোটবোন সাবিহাটা অমন হুট করে মরে না গেলে দাদা’র ছেলে হওয়া দেখে নিশ্চয়ই ঠিক অমনই খুশি হত। সেই ডাক্তার মেয়েটা সেদিন খুব ধমকে দিয়েছিল তাকে,

– আরে! কান্নাকাটি কেন? হঁ্যা? আজান দেন, আজান দেন! কী মানুষ আপনি?

রিয়াজউদ্দীন সেদিন না পারছিল কান্না থামাতে, না পারছিল আজান দিতে। আর কেন সে কেঁদেছিল তাও যদি সে একটু বলতে পারত ডাক্তার মেয়েটার কাছে, যদি সাবিহার কথা সে একটু বলতে পারত। আশ্চর্য মানুষ সে, কোথায় একটু রোকেয়ার কথা তার ভাবা উচিত, কোথায় একটু সদ্যজন্মানো বিজুর কথা সে ভাববে, তা না, সেই কবে মরে যাওয়া তাও সৎমার মেয়ে, তার বৈমাত্রেয় সাবিহার কথা ভাবতে বসে সে, তা একটু ভাবলে দোষ কোথায়, সবদিনতো আর ঘটা করে তার কথা ভাবা হয় না, সাবিহার কথা বললে নিশ্চয়ই ডাক্তার মেয়েটার অনেক মায়া হত, সাবিহার জন্য কষ্ট পেত সে, দুঃখ পেত, নিশ্চয়ই পেত। তবে, একদিন বলবে সে, সেই ডাক্তার মেয়েটাকে একদিন সাবিহার কথা বলবেই সে। সেদিন এইসবই ভেবেছিল রিয়াজউদ্দীন।

আচ্ছা, এই ডাক্তার মেয়েটাই সীমুআপা হতে পারে না? কি এমন অসুবিধা যদি উনি চিঠির ‘সীমুআপা’ হন? চিঠির পুনশ্চতে, ছোট্ট একটিমাত্র লাইনের মধ্যে সীমুআপাকে যতটুকু খুঁজে পাওয়া যায়, রিয়াজউদ্দীনের খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে যে উনিই সেই ‘সীমুআপা’। ‘সীমুআপা’ বললে কি সেই ক্লিনিকের লোকজন ডাক্তার মেয়েটাকে চিনতে পারবে?

আচমকাই রিয়াজউদ্দীনের মনে হয়, আচ্ছা! একটা ‘ছাঁট কাগজের মলাট’ না কি যেন নাম পড়লাম, পত্রিকাইতো মনে হল, সেটা একটা কিনলেওতো মাবুকে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আবারও সেই একই সমস্যা, ‘মাবু’ নাম কি আর সেখানে থাকবে? যদি না থাকে? তাহলে কোন নামটাকে সে মাবু বলে সনাক্ত করবে? তবু সাইকেল ঘুরায় সে। সাভারের মডার্ন বইঘরে এরকম সাহিত্যপত্রিকা ঝুলতে দেখেছে সে। অচেনা এক বিজয়ের আনন্দ রিয়াজউদ্দীনের সাইকেলের প্যাডেলে গতিসঞ্চার করে। এই গতিতে গেলে হয়ত সাত কি আট মিনিটেই ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ধরে সে পেঁৗছে যেতে পারত মডার্ন বইঘরে, কিন্তু, সত্যিইতো, আজ সোমবার পার হয়ে গেল, কথাটা মনে হতেই সমস্ত সাধআল্লাদ কোথায় নিমেষে উবে যায় তার, হল খালি হয়ে গেছে আরও আগে, এখন সন্ধ্যা, বিকালের আগেই খালি হয়ে যাবার কথা। আজ নিশ্চয়ই ঐ মেয়েটাও চলে গেছে। তুরন্ত গতিতে চলতে থাকা সাইকেলে প্যাডেল দাবানোর কোনো শক্তি, সাহস আর ইচ্ছা আর অবশিষ্ট থাকে না রিয়াজউদ্দীনের। তবু তার সাইকেলের নিচ দিয়ে অন্ধকারে ক্রমাগত কালো হতে থাকা কালো পিচরাস্তা কেবলই পেছনদিকে সরে যেতে থাকে। আর এই গতিগন্তব্য শেষ হওয়ার জন্য প্রাপকহীন, ঠিকানাহীন চিঠিটা পকেটে করে উড়তে থাকা সাইকেলের উপর বসে অপেক্ষা করতে থাকে সে।

আবছা অন্ধকারে আচ্ছন্নতার ভেতর তার বিজুর কথা মনে পড়ে, রোকেয়ার কথা মনে পড়ে। রোকেয়াকে নাহোক, অন্তত বিজুকে একবার বুকের সাথে আঁকড়ে ধরার জন্য তার ভেতরে কোথাও আকুলিবিকুলি করতে থাকে।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত