– কথা কন না বাহে। মোর জন্য বউ দেখা হছে।
সবাই চুপ হইল মোর কথায়। ব্যাপারটা হইল, আবুল হাসানের সুন্দরী তিন শালিকে নিয়ে মোর বিয়ের আলোচনা চলছে।
আবুল হাসানের তিন তিনটি সুন্দরী শালির মধ্যে মোর বিয়ার আলাপ চলছে দুই নম্বরের সাথে। মোর পছন্দ তিন নম্বর। বেশ চঞ্চল আর উচ্ছ্বল হাসির মাইয়া তিন নম্বর। তারে দেইখা মনটা আমার আনচান করে উঠিছে। এ কারণে আবুল হাসানরে আমি কয়া দিছি, আগে প্রথম শালি দুইটার বিয়া দেন হাসান ভাই, মুঁই তিন নম্বরের জন্য রাজি আছি।
আমার কথায় হাসান ভাই মুখ ভার করে বসে আছে। এমন ভাব করেছে যেন প্রথম শুনল এই কথা। কিন্তু আমি জানি, এ কথা সে প্রথম শুনে নাই। সবাই পাত্রী দেখে তিন নম্বরকেই পছন্দ করে। কারণ তিন নম্বর হলো আকাশের চাঁদ। সে দেখতে যেমন সুন্দরী, তেমনি আবার সরকারি চাকরি করে। আবার নাকি সংসারী মেয়ে সে। এ কারণে আবুল হাসান পাত্রি দেখানোর সময় বড় দুই শালিরে সামনে আনে না। না আনলেও আমি তার শালিদের ভালোমতোই চিনি জানি। অনেকেই জানে। আকাশে চাঁদ উঠলে গোপন রাখা যায় না, আশপাশে ঝলক দিয়া জোছনা আলোকিত করে অস্তিত্ব জানান দেয়। তিন নম্বর শালি এলাকা ঝলক দিয়া সেইরকম জানান দিছে। এ কারণে আর্মি-পুলিশের বাড়ি বাড়ি থাকি প্রস্তাব আসতেছে। কিন্তু আবুল হাসানের পছন্দ আমার প্রতি।
আবুল হাসানের আমারে পছন্দ করার কারণ হইল, আমিও তার মতোন ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসে ছোটখাটো একটা চাকরি করি। পদের নাম কইম না মুুঁই, জেনে রাখেন সরকারি চাকরি। হয়-আরকি টুকটাক আয় ইনকাম। সাথে অল্পআনা পাওয়ার জুটিছে। মানুষে দিছে। সবাই নেতা নেতা কইতেছে। মোর কামাই আর এই রকম পাওয়ারের বহর দেখি আবুল হাসান বুঝে গেছে, খুব অল্প সময়ে মুঁই কোনঠে পৌছে যাইম। সাথে তারও যে কপাল খুলে যাইবে, এই পাক্কা হিসেবটা সে কষে ফেলেছে। তাই প্রতিজ্ঞা করিছে, যেভাবেই হোক, একটা না একটা শালির সাথে তোর বিয়া দিয়ে সমন্ধি করিম।
তার কথা মতো আমিও একটা শর্ত দিছি, আমার চাই তিন নম্বর। আমার শর্তে আবুল হাসান আটকে গেছে। আমি জানি, ওদের জোছনা উজালা করা সুন্দরী চাঁদ তাদের বাড়ি আলোকিত না করে বরং অন্ধকারে কাবু করেছে। কারণ, কনে দেখার লোকেরা মেয়ে দেখে তিন নম্বর পছন্দ করে চলে যাওয়ার ফলে বড় দুইটার আর বিয়ে হচ্ছে না।
বড় দুই বোনরে বাদ দিয়ে একেবারে ছোটটার বিয়ে দেয়ার কথা চিন্তা করতে পারতেছে না আবুল হাসানের শ্বশুর বাড়ির লোকেরা। তারা আমার পিছে লোক লাগিয়ে দিয়েছে। লোকেরা ইনিয়ে বিনিয়ে আবুল হাসানের দুই নম্বর শালির কথা বলে। আমিও তাদের দেখলে মজা নেই। ওদের দেখলেই বলি, সবাই চুপ থাকেন, মোর বিয়ের আলাপ চলছে। এরপর থেকে আবুল হাসানকে আসতে দেখলে আমি আর আমার সাথিরা মিলে তার শালিদের নিয়ে মজা লইতে থাকি।
এরই মধ্যে আমার এক যুগলি দোস্ত বন্ধের দিন দেখা করে। বোঝায়, কানে কানে ফিসফিস করি কয়, শালা তুই একটা গাঁধা! শালি হিসেবে তিন নম্বর পাইবি এইটা তোর কপাল। তিন নম্বর বউ হইলে এরে সামাল দিবার পারবিনা তুই। বরং শালি হইল ফ্রি!
তার কথার মর্ম আমি বুঝি। আমি সেইরকম মানুষ না। খারাপ হইলেও একটা মাত্রা আছে আমার। বিধাতা ওর মতো এতোটা লুচ্ছা করে বানায় নি আমারে। কিন্তু বিধাতার সাথে আমার একটা আড়ি আড়ি ভাব আছে। আমি মনে মনে যেইটা চাই, যেইটা কামনা করি, প্রত্যেকবার বিধাতা তার আশপাশে একটা কিছু গঢ়পড়তা মিলেইয়া দেয়। আমি নিরসটা নিয়া কোনোমতে জীবন পার করি আর আফসোস করি। হায়রে কপাল! আমার যে আরো চাই। আজতক মনমতো আমি পাইলাম না কিছু। আমার বিশ্বাস, এইবারও আমার কপালে তিন নম্বর জুটবে না। কারণ, চাইরোপাশে(চারিদিকে) যেভাবে লোক লাগিছে, মজা লইলেও মোর আর রক্ষা নাই।
বহুত কষ্টে কনেপক্ষ সবেমাত্র প্রথমটার বিয়া দিয়ে দুই নম্বরে আইসা আটকে গেছে। এবারে আমারে, আমার বাপ-দাদা চৌদ্দগুষ্টিরে ধরেছে। দুই নম্বরের সাথেই আমার বিয়া ফাইনাল করতে হবে।
তাদের এত উঠিপড়ি লাগা ভাবটা মোর ভালো লাগছে না। মুঁই বাইলা মাছের মতো ভ্যাটভ্যাট কইরা চায়া থাকি, হাবাগোবা ভাব নিয়া শুইয়া থাকি। মত দেই না।
হঠাৎ মনটা কেনবা খারাপ হইল। আমি মন খারাপ করে বসে আছি। বারান্দার নিচে আম চারার লকলকে কচি পাতার দিকে চায়া আছি। সবুজ মন নিয়া সবুজ ঘাসপাতার ওপর বিয়ে হইবার বাসনা মেলাম করি কল্পনায় ভাসিবার মন চাইতেছে না। পাশেই মাটির পৈঠা চাড়া দিয়া পাপিয়া গাছ বড় হইয়া যৌবনপ্রাপ্ত হইছে। মেলা দিন দেখি নাই, গাছটাতে কচি কচি সবুজ ফল ধরিছে। মাছিগুলা ঘুরঘুর করি মেলামেশা করবার জন্য উতালা হইছে। দেখলাম, তিন তিনটা লাউডগা পাপিয়া গাছের মাথা মোচর দিয়া প্যাচায়া নিছে। আমি ব্যস্ত হইয়া ছাড়িয়া দিবার চেষ্টা করিলাম। এই সময় আমার ছোটবোন আইসা দুই নম্বরের গুণকীর্তন শুরু করিল।
বলল, দুই নম্বর হলে এইগুলা দেখিত। বুঝলি! দুই নম্বর, বেশ সংসারী।
না শুনতে চাইলেও বলতে লাগল, বেশ ধীর স্থির আর বিবেকবাণ, তিন নম্বরের মতো চটাঙ চটাং কথা বলে না। ত্রিংব্রিং করে লাফায় না। দুই নম্বরের মতো দুনিয়ায় আর একটিও সংসারী মেয়ে মেলা ভার। তাছাড়া তোর মতো ভোম্বলদাসের জন্য এমন একজন গোছালো মেয়েই উত্তম।
জীবনটা কি আমার শুধু দুই নম্বরেই আটকে যাবে? আহারে, আমি কাউরে কইবার পারি না, তিন নম্বরের উচ্ছ্বল হাসি যে আমার দিল কলিজায় কুরমুরভাজার মতো ভাঙিচাড়ি নাচন দিয়া ওঠে, তার চকিত চাহনি হলফল করি যে কাঁপনি দিয়া আমার প্রাণে সুর তোলে, আমি যে তার একনা ভ্রুর কাঁপনে সারা দিনমান গুণগুণ গান গাইতে থাকি, এই সুর-লহমার আদি উৎসের দিকে আমি কাউরো খেয়াল করাতে পারি না। তারা কেউ এই দিকে নজর দেয় না। মোর মনের কথা বুঝিবার চায় না তারা। তারা চায়, খালি কোনোমতে মোর একটা বিয়া হউক।
আরে পুরুষ মানুষের বিয়া হইবে না আল্লাহর দুনিয়ায় এই রকম কথা আছে? আজ হোক কাল হোক হইবে তো কারো সাথে। তাই বলে দুই নম্বরের সাথে কেন?
তবে দুই নম্বর যে দেখতে অসুন্দরী তেমন না। কিন্তু দুই নম্বর আমি চাই না। এর একটা অতিত ইতিহাস আছে। বাপে দুই নম্বরি ব্যবসা করত বইলা সেই ছোটবেলা থাইকা আমার বন্ধুরা আমারে স্কুলে যাইতে-আসতে দুই নম্বরের ব্যাটা কইত। কত দুঃখ হইত তখন। পরে টাকা পয়সা মেলা হইলে সেই নাম চুকে গেছে। এখন সমাজে সম্মান হইছে। মিছা কথা কমু না, পাওয়ারটা লাগার পর থাকি দুই নম্বরটাই অলঙ্কার হইছে। এক-দুই বলে কথা না, আসল কথা হইল টাকা আর পাওয়ার। এই দুইটা হইলে মানুষ কদর দিয়া কথা কয়। নেতা নেতা কইতে কইতে মুখ দিয়া ফ্যানা তোলে। তারা জানে, কোনো চুদিরভাই আমারে ‘দুই নম্বর’ -এই কথাটা মুখ দিয়া উচ্চারণ করিলে তার জিবখান টান দিয়া ছিড়ি ফেলামু! এই ভয়ে কেউ কয় না। কয় না বলতে সবাই ভুলে গেছে। বরং বলা চলে দুই নম্বরই যে অর্থ -ক্ষমতা লাভ করার আসল পদ্ধতী- এই ব্যাপারটা বুঝে গেছে। এখন তারাও আমার সাগরেদ হইছে, আমার মতো চেষ্টা করে। শুধু একজনই আমারে দুই নম্বর কওয়া ছাড়ে না। সে হইল জোছনা বাণু।
আমার প্রাক্তন প্রেমিকা জোছনা বাণু। মোর বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা একটা দুঃখ। একটা কলঙ্কলাগা কষ্ট। সে ইদানিং মোর স্বপ্নে আসে। সামনে এসে ঘুরঘুর করে। তারে দেখে আমার নির্ঝর মুখ শ্মশান ঘাটের মতো শুষ্ক হয়। একটা দুরুদুরু ভয়আতঙ্ক দপদপ করে ওঠে। স্বপ্নে আসি সে হুমকি দেয়, সবারে ডাক দিয়া দেখায়া কয়, ঐ দু্ই নম্বরটা বিয়ের কথা কয়া আমার পেট বানাইছে!
আমি চমকে উঠি এই স্বপ্নে। ঘামতে থাকি। এই বুঝি জোছনা বাণু মোর অবৈধতার সবগুলা গোপন কথা হাজির করিবে। এ জন্য আবুল হাসানের ‘দুই নম্বর’ শালির সাথে বিয়ে বইতে আমার আপত্তি। এতে যদি জোছনা বাণু চুপ থাকে, তাও ভালো। সে চুপ থাকিলে আর কোন শালা মোর দুই নম্বরি ফাঁস করিবে না। কারণ মোর আছে টাকা আর পাওয়ার। এইগুলা থাকিলে কোনো শালাই মোর দুই নম্বরী ফাঁস করিবার পারিবে না। খালি পারিবে জোছনা বাণু। কারণ, তার সাথে মোর অর্থ-ক্ষমতার কোনো সম্পর্ক ছিল না। মোর বুঝতে বাকি নাই, অর্থ-ক্ষমতার সম্পর্ক না থাকিলে কাউরে দাস করে রাখা যায় না।
শাহ মাহফুজ-এর অন্যান্য গল্পঃ
২.শ্বশুর আমার ভিনদেশির মতো নজর নিছে
১. বেড়ালের স্পর্শ