এই মুহূর্তে বসে আছি একটা বিশাল বড় বাংলো বাড়ির দুই তলার বারান্দায়। হাতে এক স্টিক গাঞ্জা। বাড়িটা একটা মফস্বল শহরের আবাসিক এলাকায় অবস্থিত। এইখানে গাঞ্জা পাওয়া অনেক টাফ। তয় গাঞ্জা যারে খায়, তার কাছে গাঞ্জা ক্যামনে ক্যামনে য্যানো চইলা আসে। মনে হয় গাঞ্জার নিজের হাত পা আছে! বাড়িটা তিন রুমের, দুই রুম লাগোয়া মাঝখানে দরজার একটা কাঠামো আছে, কিন্তু দরজা নাই। নিমেষেই এক রুম থেকে আরেক রুমে যাওয়া যায়। দুই রুমের সাথেই এট্যাচ বাথরুম আছে, যদিও রুমের সাইজের তুলনায় বাথরুমের আকার যথেষ্ট ছোট। মনে হয় দুই তলার এই সাইডটা বানানো হইছিলো অতিথিদের থাকবার জন্য, কিন্তু এই বাংলো বাড়ির মালিক যেহেতু বাসায় থাকেন না, ফলে পরবর্তীতে ভাড়া দেবার জন্য সম্ভবত প্ল্যানের বাইরে বাথরুম বানানো হয়েছে। আমি যে রুমের বারান্দায় বসে আছি সেই রুমে পুরানা আমলের খুবই মনোরম ডিজাইনের সেগুন কাঠের বিশাল বড় এক আলমারি বসানো আছে, এটা বাড়িওয়ালার বানানো, উত্তরাধিকার সূত্রে এই বাসায় যে ভাড়াটিয়া উঠে এটা তারা ব্যবহার করতে পারে। আলমারির উপরের দিকটা বুক শেলফ হিসেবে ব্যবহার করা যায়, নিজের ড্রয়ারগুলোতে কাপড় ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিস রাখা যায়। এইখানে যেমন প্রচুর বই রাখা আছে উপরের থাকগুলোতে, নানান টাইপের বই- গল্প, উপন্যাস, কবিতা, দর্শন, রাজনীতি অর্থনীতি, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, সাইন্স, অভিধানসহ নানান ধরনের বই! এই দুই রুমের প্রথমটাকে মানে যেটা দরজার বাইরের দরজার সাথে লাগানো সেটাকে অনায়াসে একটা বড় ড্রইং রুম হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আমার অবশ্য সেসবের বাতিক নাই বা সেটা নিয়ে চিন্তাও নাই, কারণ এটা আমার বাসা না, আমি এখানে থাকিও না। কয়েকদিন ধরে আসছি, এইখানে আমার এক বড় ভাই থাকেন, আইসা ভাইয়ের ঘাড়ে ঝুইলা পড়ছি! তয় কয় দিনের জন্য তা জানি না! বড় ভাই অফিসের কোন একটা ট্রেনিংয়ে চলে গেছেন, এখন আমি একাই আছি আপাতত। দিব্যি কেটে যাইতেছে, নো চিন্তা ডু ফূর্তি। খাও দাও হাগো মুতো ঘুমাও কোনো চিন্তা নাই। রান্নাঘরে খাবারের সব রসদ জমা আছে, ক্ষুধা লাগলে শুধু কষ্ট করে বানায়া খাও। আচ্ছা কোথায় ছিলাম জানি! ওহ হ্যা! বাসার বর্ণনায়! তো মাঝখানে ডাইনিং রুমটাকেও দেখে মনে হয় এটাও প্ল্যানের বাইরে ছিল, এত ছোট ডাইনিং রুম কোনো রকম একটা ডাইনিং টেবিল বসানো গেছে। সাথেই লাগোয়া রান্নাঘর, এটা বেশ সুন্দর। রান্নাঘরের জানালা দিয়া পাশের একতলা ছাদ পিটানো বাড়ির ছাদ দেখা যায়। ওই বাড়ির যিনি মালিক কিংবা মালকিন তার ছাদ বাগানের বড় শখ বোঝা যায়, পুরো ছাদ ভর্তি ড্রাম কেটে বানানো কাঠামোর মধ্যে নানান ফুল ঘাস আর লতাপাতার গাছ, কী নেই সেখানে! বেলী থেকে শুরু করে শিউলী, কাঠ গোলাপ, গোলাপ, গাঁদা, হাস্নাহেনা, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ, জারুল, নানান জাতের ঘাস, লতাপাতা আর ক্যাকটাস, তিন দিন ধরেই দেখছি এক বয়স্ক মহিলা প্রতিদিন বিকালের শেষের দিকে খুব যত্ন করে পানি দেন গাছগুলোতে, একা একা গাছের সাথে কথা বলেন। যদিও এইটা মফস্বল শহর, চারিদিকেই গাছ আর গাছ, যেমন ওই ছাদ বাড়ির সামনেই বাড়ির আঙিনা জুড়ে আম জাম কাঠাল আর জামরুলের গাছে ভর্তি, সাথে কিছু লেবু গাছও আছে। ওই বাড়িটা এই বাড়ির দক্ষিণ দিকে, ওই বাড়ির বাউন্ডারির ভেতরেই টিনের চালের কয়েকটা আধা পাকা বাড়ি আছে ছোট ছোট খুপড়ির মতোন নীল রঙের কিছু বাড়ি। এই বাড়িগুলোতে টিনের চালের ওপর দিয়ে পলিথিনের বড় একটা আস্তরণ দিয়ে ঢেকে দেয়া, সম্ভবত বৃষ্টির পানি যাতে ঘরে না ঢুকতে পারে তার ব্যবস্থা করা আরকি! এই বাড়িগুলোতে নিম্ন আয়ের বা নিম্ন মধ্যম আয়ের মানুষজন থাকে, একটা করে বড় রুম, সেটা বেডরুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, একটা ছোট রুম সেটাতে মালপাতি রাখে অথবা ছেলে মেয়েদের শুইতে দেয়, আর একটা ছোট রান্নাঘর! বাথরুম বাইরে, এটা সবাই মিলে ব্যবহার করে অনেকটা মেসবাড়ির মতোন, একটা বড় টিউবওয়েল পাড় আছে, কলের পানি সবাই খায়! এই বাসার বারান্দা থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর এই সারি সারি টিনের চালের বাড়িগুলোর জানালাগুলো থেকে যে আলো নির্গত হয় সেই আলো একটা ঘোর লাগা বোধের ভেতর নিয়ে যায়, মনে হয় য্যানো সিনেমার কোনো রিলের ভেতর ঢুকে পরেছি। দূর থেকে আলোতে প্রতিটা জানালাকে এক একটা স্বাপ্নিক দৃশ্য মনে হয়, তখন মনে হয় জগতের সব কিছু আসলেই আলোর খেলাধূলা! দিনের সূর্যের আলোয় বাড়ির ফুল অবয়ব যেই ইমেজ নিয়ে চোখের ভেতর দিয়ে মাথায় আলড়ন তুলে, সেই একই অবয়ব সন্ধ্যার কৃত্রিম আলোয় অন্য রকম আরেকটা ইমেজের জন্ম দেয়! এই যে ইমেজের ফারাকটা এটা তাহলে হচ্ছে কী জন্য! আলোর জন্য কি? যাইহোক, রান্নাঘরের পূর্ব দিকেই সাথে লাগানো আরেকটা বাথরুম, এটা মূলত রান্নাঘর আর ডাইনিংয়ের সাথে লাগানো, এট্যাচ না পূর্ব দিকের বড় রুমটার সাথে। এই রুমটা বাড়ির বাইরের দিকে, সাথে লাগোয়া একটা বারান্দা আছে। এই বারান্দা দিয়ে বাড়ি ঢুকার মেইন গেটটা দেখা যায়। একটা পুরানা আমলের ডিজাইন করা গেট, তবে সুন্দর। এই গেটের বামপাশে কয়েকটা হাস্নাহেনা গাছের সারি আর ডানপাশে অনেকগুলো ফুলের সারি, কী ফুল সবগুলোর নাম জানি না, তবে বুনো ভাঁট, মাটিকলমি ফুল থেকে শুরু করে কয়েক প্রজাতির বিদেশি ফুলও আছে। এই ফুলের গাছের মাঝখান দিয়ে চলে আসা মেইনগেটমুখী সরু এই পিচ ঢালাই করা সরু রাস্তাটা সামনে মোটামুটি শর্ট পিচ ক্রিকেট খেলা যায় এরকম একটা পাকা লনের সাথে মিশেছে। আর ওই হ্যাঁ সরু এই রাস্তাটার অর্ধেক অংশ জুড়ে পাশের উত্তরমুখী বাড়িটা থেকে লিচুর কয়েকটা ডাল ছায়া দিচ্ছে লিচুসহ। লনের উত্তর দিকে একটা গাড়ি ঘর, মানে গাড়ি রাখার ঘর, যদিও কোনো গাড়ি নেই। এই ঘরের পেছনেই এই বাড়ির কেয়ারটেকারের থাকার জন্য একটা বাড়ি, কেয়ারটেকারের ঘর আর গাড়ি রাখার ঘরের মাঝে একটা বড় পানির কুয়া। কেয়ারটেকার চাচা বউ এবং ছেলেকে নিয়ে এইখানে আছেন প্রায় এক যুগ হইলো। এইটাই এখন ওদের ঘর বলা যায় আরকি! এই পানির কুয়া এই অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্ভবত, যে কয়টা বাড়িতে গিয়েছি সব জায়গায় পানি কুয়া আছে। আর ওহ হ্যাঁ আমি যে অংশটাতে আছি এখন এইখানে ঘরগুলোতে বাইরে থেকে ঢোকার জন্য দুইটা দুইটা দরজা আছে, একটা ড্রয়িং রুমের সাথে আগেই বলেছি, আরেকটা ডাইনিং রুমের সাথে। আমি এখন অংশটাতে আছি সেই অংশটার বিপরীতদিকের অংশটায় বিশাল বড় স্পেস নিয়ে বড় একটা ফ্যামিলি ভাড়া থাকে, যদিও তাদের চিৎকার, চেচামেচি ও কথাবার্তা শুনেছি, কারও মুখ এখনো দেখি নি। নিচ তলার একটা সাইডে দুই রুমের একটা ফ্ল্যাটে একজন ভাড়াটিয়া থাকেন ফ্যামিলিসহ, আর বড় অংশটা যেটাতে হলরুম আর সিনেমারুম আছে ওইটা সব সময়ই তালাবদ্ধ থাকে। বাড়ির কেচি গেটের সামনে বিশাল একটা আম গাছ আছে আর একটা ঝাউগাছ ও একটা দেবদারু গাছ। আমগাছ আর ঝাউ গাছটা ছাদ বরাবর আরও অনেকখানি উপরে উঠে গেছে, ঝাউ গাছটা সোজা ললম্বাভাবে আর আমগাছের একটা অংশ লম্বাভাবে আর বাকি অংশটা ছাদের দিকে এমনভাবে হেলে ছায়া দেয় যাতে আবার আমের মৌসুমে গাছ থেকে হাত দিয়েই আম পেড়ে খাওয়া যায়। আমের গাচটার বামপাশে একটা কাঁঠালগাছ কাঁঠালের ভারে কুঁজো হয়ে রয়েছে! আম গাছটার হেলে যাওয়া অংশের ছাদে সিমেন্ট দিয়ে বসে গল্প করার জন্য চারজনের মুখোমুখি টুল বসানো হয়েছে। পুরো ছাদের কর্ণার দিয়ে কেয়ারটেকার আফসার আলী ও তার ছেলে রাকিব টমেটো, মরিচ, বেগুন আর ধনেপাতার গাছ লাগাইছেন। বিকেলে ছাদটাতে গিয়ে বসে থাকতে অনেক ভালো লাগে, পাখির কিচিরমিচির শোনা যায়, মেঘেদের রূপ ও রঙের পরিবর্তন দেখা যায়, পাখিদের উড়াউড়ি আর রাস্তায় ও অন্যান্য বাসার ছাদে নর নারীর নানাবিধ প্রাত্যহিক জীবনের কাজের প্রতি মনোনবেশ করা যায়! ছাদের পশ্চিম দিকটায় মানে আমি এখন যে রুমেত বারান্দায় বসে আছি সেই রুমটার পশ্চিম দিকের জানালার সাইডটায় নানা জাতের কাঠের গাছ সেগুন, শাল, মেহগণি থেকে শুরু করে সারি সারি নারকেল গাছ, আম, জাম, কাঁঠাল আর জামরুলের গাছ দিয়ে ভর্তি। আমি যে বারান্দায় বসে আছি সেই বারানার সামনে বারান্দার গ্রিল ঘেঁষে বিশাল মোটা এক সেগুন গাছ উঠে গেছে, বারান্দার পশ্চিমদিকটার অংশে একটা পেয়ারা গাছ। আর পূবদিকে কিছু কলা গাছ লাগানো।
এখন বাজে রাত দুইটা। আমি হাতে এক স্টিক গাঞ্জা লইয়া বইসা আছি কোলাহল থেকে দূরে মহাজাগতিক এই বারান্দায়! বসে বসে দেখছি কয়েক সেকেণ্ড পরপর আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে একটা নিয়মিত বিরতিতে। বিদ্যুৎ চমকানোর এই ব্যাপারটায় সম্ভবত একটা চমৎকার নিয়ম ও ছন্দ আছে, আর আলোর খেলাটা তো আরও জোশ! আলোর পরিমাণটা একটু বেশি হইলে, সময়টা একটু বাড়লে আকাশে মেঘের নানান রূপ চোখে পড়ে! কখনো মনে হয় পাখি উড়ে যাচ্ছে, কখনো ঘোড়া, কখনো হাতি কিংবা কখনো সম্পূর্ণ মানুষ আবার মাঝেমধ্যে রূপকথার দৈত্যও দেখা যায় মেঘের অবয়বে! আমি আসলে অপেক্ষা করছি বৃষ্টি শুরু হবার। বৃষ্টি শুরু হিলে বৃষ্টির বাড়া কমার ছন্দের সাথে আলোর ছন্দ মিলিয়ে একটা কম্পোজিশন তৈরি হয় চোখ আর কানের ক্রিয়ায় মাথার নিউরণের ভেতর! ঠিক তখনই আমি গাঞ্জাটা ধরায়া ছন্দের সাথে তাল মিলায়া মিলায়া টানতে টানতে জীবনের হ্যাজা পচা পাঁক বিদঘুটে অন্ধকার পেরিয়ে মৃত্যুর মতোন স্বচ্ছ সত্যের আলোর অনুভূতির ভেতর হারায়া যাইতে যাইতে জীবনের প্রতি কোনো আক্ষেপ না রাখার বাসনায় এই মুহূর্তটাকে উপভোগ করি হয়তোবা! ওহ, আমার পরিচয় দিই নি! আমি রমিজ! আপনারা চাইলে যেকোনো নামে আমারে ডাকতে পারেন! কেননা মৃত মানুষের কোনো নাম থাকে না! জীবিতের মুখের নামই তার নাম। আমি আপনাদের মস্তিষ্কের হারিয়ে যাওয়া সেই মৃত অনুভূতির স্বাদ যাকে আপনারা প্রতিদিন মরে মরে খুঁজছেন আর হাইহুতাশ করছেন। আমাকে খুঁজলে পাবেন নিজের ভেতরেই!