বই-সৈ

নামটা খুব অদ্ভুত ঠেকে। স্ক্রল ঘুরিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছিল। আবার উল্টো স্ক্রল করে। ‘বই-সৈ’। কী অদ্ভুত নাম! অনলাইন শপগুলোর যে কত রাজ্যের নামের বাহার! তবে এ নামটা শৈলজার মনে ধরে। স্পনসরড পেইজ। ক্লিক করে ঢু মারতে ঢোকে বই-সৈ এ। যদিও এখন তার বই কেনার কথা নয়। অনলাইন শপগুলোর জন্য অবশ্য ‘কথা নয়’ কথাটাই খাটে না। বিনা কথায়, বিনা দরকারেই চোখের লোভকে উপজীব্য করেই দেদারসে বিকিকিনি হয়ে যায় এখানে। বই-সৈয়ের ছবি দেখতে দেখতে শৈলজা সামান্য উত্তেজনা অনুভব করে। জীবনানন্দ দাশের কবিতাসমগ্র- সেই কভারটা যা দীর্ঘ দিন, দিন বললে বোঝা যায় না ঠিক- কয়েক বছর ধরে খুঁজছে সে। পেইজে নক করে ও জানতে চায় বইটা অ্যাভেইলেবল কিনা। দু-মিনিটের মাথায় ও প্রান্ত থেকে উত্তর আসে-‘জি, ম্যাডাম, আপনার ঠিকানা ও ফোন নম্বর দিয়ে অর্ডার করুন।’
অর্ডার কনফার্ম করার ঘন্টা দুই পরেই ফোনটা বেজে ওঠে,
-ম্যাডাম আমি বই-সৈ থেকে বলছি। আপনার বইটা আজ ডেলিভারি হবে। আপনি কি বাসায় আছেন?
-আজই!
শৈলজা অবাক হয়।
-হ্যাঁ। আপনার বাসার কাছাকাছি আরো একটা ডেলিভারি আছে, তাই আপনারটাও সাথে দিয়ে দিচ্ছি।
-ঠিক আছে দিন।
বলে শৈলজা ফোন রাখে। অনি বাসায় নেই। তাই রান্নাবান্নাও করেনি শৈলজা। মেয়েদের এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। বাড়ির লোকদের জন্য সে রাজ্যের জিনিস রেঁধেবেড়ে খাওয়াতে পারে। কিন্তু যেই সে বাড়িতে একা হলো অমনি তার ওপর পাহাড় সমান আলসেমি আছড়ে পড়ে। শৈলজা মাকেও দেখত এমন। নিজেকেও দেখছে। অবশ্য অনি থাকলেই যে ও সবসময় রান্না করে এমন না। সুযোগ পেলে অনি নিজেও করে। আবার কোনোদিন হয়ত দোকানের আহার্যেই চলে যায়। আর এখন তো অনলাইনের এর বদান্যতায় কত বেলায় রান্নাঘরটা ঝিমিয়েই কাটায়। একটা ইন্সট্যান্ট নুডুলস ছিল, সেটাতেই গরম পানি ঢেলে দুপুরের খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেলে শৈলজা। তারপর এক কাপ কফি বানিয়ে বই নিয়ে বারান্দায় যায়। গেল হপ্তায় একটা পাটি কিনে এনেছিল। ছোট্টো। বারান্দার গাছগুলোর জন্য বরাদ্দ জায়গা ছেড়ে দিয়ে যতটুকু অবশিষ্ট থাকে সেখানে বিছিয়ে দেয়া যায়। পাটিটা ফেরিওয়ালার হাতে দেখা মাত্রই কল্পনা করতে শুরু করেছে, ওটা ও বারান্দায় পাতবে। তারপর এই ভরা অগ্রাহায়ণের ঝিরি বিকেলে বিভূতি কিংবা জীবনানন্দ আর কফি নিয়ে আয়েশ করে বসবে এখানে।
শৈলজা খুব আয়েশ করেই এইসব উদযাপন করে নিজের সাথে। যেমন : ওর যদি মনে হয় একটা পরিপাটি ঘরে সুবীর সেনের গলায় ‘এত সুর আর এত গান’ শুনতে শুনতে ও কফি অথবা পাতি ছেড়ে দেয়া রং চা খাবে, যে চায়ের পাতিগুলো পড়ে থাকবে তলানিতে, সাদা কাপের রঙ পানিটা থাকবে ফটফটে সাদা, তারপর আস্তে আস্তে কাপের মাঝ থেকে রং ছড়াতে থাকবে চায়ের; তাহলে শুধু এই চিত্রকল্পের ভেতর অনুপ্রবেশের জন্যই ও ঘরটা গুছিয়ে ফেলবে। তারপর হাজার রকম ফোল্ডারের ভেতর থেকে খুঁজে বের করবে সুবীর সেনের গান। যদিও ইউটিউবে বাজিয়ে দেয়া ঢের সহজ কিন্তু সে তা করবে না। কারণ সেই মুহূর্তে ইউটিউবে বাজাতে গিয়ে তার মনে হবে, স্ব-সৃষ্ট নির্জনতার ভেতর একটা কোলাহলময় মহাপৃথিবীর অহেতুক অনুপ্রবেশ ঘটছে। তো আজ সে সকাল থেকেই ভেবে রেখেছে বারান্দার গ্রিল গলে শহুরে অগ্রহায়ণের দুপুর যখন গড়িয়ে যেতে থাকবে তখন ও একটা নির্জনতার ঘর বানাবে পাটিটা বিছিয়ে। কিন্তু সমস্ত আয়োজন যখন শেষ তখন খুব বেরসিকের মতো হাক ছেড়ে ওঠে ইন্টারকম। চা অথবা কফি খাওয়ার মাঝে কোনোরকম ছেদ ওর পছন্দ নয়। খুব বিরক্তি নিয়ে ফোনটা ধরে। গার্ড জানায়, পার্সেল এসেছে। আরে বাবা, এ দেখি ওভার রেসপন্সিবল!-ভাবতে ভাবতে টাকা বের করতে যায় শৈলজা। জমানো টাকা থেকে এক হাজার টাকা বের করে নিয়ে এসে বেল বাজার অপেক্ষায় দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে।
বেলটা বেজে ওঠে। শৈলজা দরজা খোলে। ডেলিভারি ম্যানের চেহারার দিকে তাকানোটা জরুরি নয় বলেই ও পার্সেলের দিকে তাকায়। হাত বাড়ায়। কিন্তু ডেলিভারিম্যানের হাত দুটো অগ্রসর হয় না, নিশ্চল অবস্থান করে নিজ সীমানায়। শৈলজা এবার হাত দুটোর স্বত্বাধিকারীর মুখের দিকে তাকায়। এবার ওকেও নিশ্চল হতে হয়। দিনের পরিকল্পনা-তালিকায় এরকম কোনো দৃশ্যের মুখোমুখি হওয়ার কথা উল্লেখ ছিল না। হাত-পা-চোখকে অব্যবহার্য জড়বস্তুর মতো মনে হয় শৈলজার। কেবল মাথার ভেতর একটা ঘুনপোকার নাছোরবান্দা ঝিঁ ঝিঁ শব্দের মতো বাজতে থাকে, ‘… সোনালি সোনালি চিল, শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে…কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!’
স্তব্ধতা আর জড়তা ভাঙতে অপর পক্ষই উদ্যোগী হয়। প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
-ভয় নেই ডাকাতি করব না তোমার ঘরে।
মুখে তার মৃদু হাসি। হাসিটিকে শৈলজার মনে হয় অগ্রাহায়ণের হাওয়ার মতো। কোথায় তলিয়ে দেয়! ও আরো জড়, আরো স্থবিরতায় আটকে যায়। শুধু ঝিঁ ঝিঁ আওয়ারজটা অনুভব করে, ‘তখন তোমারে নাই মনে…’
এক হাজার টাকার নোট ধরে রাখা আত্মবিস্মৃত হাতটা বাড়িয়ে দেয়। ও প্রান্তের হাসিটা আরো খানিকটা বিস্মৃত হয়,
-বিকোতে তে আসিনি!
শৈলজা এবার কিছুটা প্রকৃতস্থ হয়। দ্বিধা-সংশয় মেশানো একটা স্বর বোরোয় ওর গলা দিয়ে,
– ভেতরে এসো।
দরোজার বাইরে তখন ঝন ঝন করে হাসি ঝরে পড়ে,
-সিঁধ কাটি যদি!
-সিঁধ কেন কাটতে হবে! সদর দরজাই তো খুলে দিচ্ছি।
শৈলজা দরজা ছেড়ে দাঁড়ায়। তমাল ঘরে ঢোকে। শৈলজার পিছু পিছু বসার ঘরে যায়। শৈলজা একবার ভাবে ওকে কি বারান্দায় পাটিটার ওপর বসতে বলবে? আবার ভাবে, থাক, প্রয়োজন নেই। তমাল নিজেই গিযে সোফায় বসে পড়ে। শৈলজা ততক্ষণে পুরোপুরি ধাতস্থ। স্ব-রূপে আবির্ভূত হয় সে,
-দিলে তো আমার নির্জন দুপুরটাকে খান খান করে! মহিলা কাস্টমার পেলে এমন করে হানা দাও নাকি রোজ রোজ!
তমাল হাসে। চেনা হাসি।
-দিই তো, যদি কখনো জানার প্রয়োজন পড়ে যে জীবুবাবুর বইটা হঠাৎ তার কেন প্রয়োজন পড়ল! তার পুরোনো বইটা কি সে খুইয়ে ফেলল যেটাকে সে শিয়রে নিয়ে ঘুমাত?
শৈলজা হাসে। উত্তর দেয় না। জুড়িয়ে যাওয়া কফির মগটা হাতে নিয়ে কপট রাগে বলে,
– একলা বসে কফি খাওয়ার নির্জনতা-বিলাসটুকু তো করতে দিলে না এবার তবে সঙ্গীই হও! আর কিছু কত খেতে টেতে দিতে পারব না। আমি কত রন্ধনপটিয়সী সে তো তুমি জানোই!
-ঠিক আছে দাও।
শৈলজা উঠে যায়। চুলোয় গরম পানি বসিয়ে রান্নাঘর থেকেই মুখ বাড়িয়ে বলে,
-প্লিজ বলো যে, আগের মতো এক কাপ কফিতে তিন চামচ চিনি খাও না। তোমার কাপে মেপে মেপে তিন চামচ চিনি দিতে আমার খুব সিনেমাটিক লাগছে। যেন আমি তোমার সব অভ্যাস পই পই করে মনে রেখেছি।
তমাল এবার হো হো করে হেসে ওঠে,
-সিনেমার আর বাকি আছে কী সৈ! না, আমি এক চামচও চিনি খাই না। ডাক্তারের বারণ। ডায়াবেটিস ছুঁই ছুঁই করছি।
শৈলজার চেষ্টার্জিত স্বাভাবিকতা আবার ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায় তমালের মুখে ‘সৈ’ সম্বোধন শুনে। বিদ্যুত ঝলকের মতো ওরা মাথায় পেইজটার নাম খেলে যায়-বই-সৈ।
কফির মগ দুটো নিয়ে ও বসার ঘরে আসে। তমালের হাতে একটা মগ দিয়ে ও মেঝেতেই বসে পড়ে। তমাল স্বভাবসুলভ হাসি হেসে বলে,
-যদি কিছু মনে না করেন আমি কি আপনার সমতলে বসতে পারি ম্যাডাম? না মানে, ডেলিভারি ম্যানের অধিকারের আওতায় সেটা পড়ে কিনা?
– ডেলিভারি ম্যানের অধিকারের আওতায় কাস্টমারের বসার ঘরে ঢুকে কফি খাওয়াও পড়ে না।
-এটা কি অনুমতি?
শৈলজা কিছু বলে না। তমাল নিচে নেমে বসে। কফির মগে মগে চুমুক দিতে দিতে বলে,
-তুমি কি তবে ঘরে বসে বসে নির্জনতা-বিলাসই করো? আর কিছু করো না?
-নাহ, করতাম। ছেড়ে দিয়েছি।
– কেন!
– কেন আবার! পৃথিবীতে বিশুদ্ধ চাকুরি নাই দেখে। তোমার অ্যাসিট্যান্ট ট্যাসিস্ট্যান লাগবে নাকি বলো। ভেবে দেখতে পারি।
তমাল কানে ধরে বলে,
-না বাবা, পরের বউকে অ্যাসিস্ট্যান্ট বানাতে চাই না। অনিক মশাইয়ের এত বড়ো সর্বনাশ করতে চাই না ভাই! হোক না সতীন, তা বলে আমি তো আর অতটা মন্দ সতীন নই!
শৈলজা তমালের কৌতুকে হাসে না বরং গম্ভীর হয়। দরজার দিকে চোখটা স্থির রেখে বলে,
-বিয়ে করনি কেন!
– কে বলল তোমাকে! আমি তো এমন কিছু বলিনি।
-জানি না। মনে হলো কেন যেন।
-যাক আমার বিষয়ে এখনো তোমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করে জেনে শিহরিত হলাম। তা অনিক মশাই ফেরেন কখন? আমার সাথে দেখা হলে তো ঠ্যাঙ ভেঙে দেবে না?
-না দেবে না।
শৈলজার ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি। তমাল চোখ ঘুরিয়ে নেয়। দেয়ালে রাখা যুগল ছবিটার দিকে তাকায়। খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, ‘কেমন আছ সৈ?’ কিন্তু তমাল জানে এই সহজ প্রশ্নটাই অনেক সময় অনেক ভারী হয়ে উঠতে পারে। অনেক প্রাচীর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে পারে একটা প্রশ্নে। নিজেকে সামলে নিতে নিতেও মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়,
-সৈ…
শৈলজা তেড়ে ওঠে।
-প্লিজ, এখন আবার সিনেমাটিক কায়দায় জিজ্ঞেস করো না, আমাদের দিনগুলো একেবারেই গেছে কিনা।
হাসতে হাসতেই মগ দুটো নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়। সিংকের ওপর পানি পড়ার শব্দ পাওয়া যায়। পানির শব্দের ভেতর শৈলজা কি নিজেকে লুকোচ্ছে? নাহ, এখন আর নিশ্চয়ই এইসব আবেগে কুপোকাত হয় না ও-ভাবে তমাল। গলার স্বরটা রান্নাঘর অব্দি পৌঁছানোর মতো উঁচু করে তমাল বলে,
-যদি জিজ্ঞেস করেই ফেলি তবে?
-তবে আর কী! আমাকেও বলতে হবে, ‘অবসর তবু নেই…’।
আবার পানির আওয়াজ। সাথে কাপ-চামচের সংঘর্ষের আওয়াজ। খানিক নীরবতার পর শৈলজা আবার কপট রুক্ষতায় বেজে ওঠে। রান্নাঘর থেকেই চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-তোমার দোকানের এমন অদ্ভুত নাম কেন বলো তো? এ আবার কেমন শব্দ ‘বই-সৈ’!
বলতে বলতে দরোজার সামনে এসে দাঁড়ায়। যেন উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে। ওদের প্রতিটি কথার পরেই একটা অস্বস্তিকর নীরবতা ঘাপটি মেরে থাকে। সেই নীরবতার অস্বস্তি দূর করতেই যেন ওরা আরো উচ্চকিত হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ওদের চেনাচেনির বয়সও তো নেহায়েৎ কম নয়। ধরা পড়ে যায় প্রতিক্ষণেই। আর সেটুকু সযতেœ এড়িয়েই ওরা প্রসঙ্গন্তারিত হয়। গলগল করে বেরিয়ে আসতে চাওয়া অজ¯্র কথাকে ছাকুনি দিয়ে ছেকে দু-চারটে কথারই পারস্পরিক লেনাদেনা করে।
শৈলজা দাঁড়িয়েই আছে দরোজায় ঠেস দিয়ে। তমাল চোখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া চকিত চাহনি আবারো সরিয়ে নেয়। শৈলজার নির্জনতার আয়োজন খুঁটিয়ে দেখে। বারান্দায় পাটির ওপর পড়ে থাকা আরণ্যক হাতে তুলে নেয়। পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলে,
-তবে আর তুমি কুশা নদীর তীরে বাস গড়তে গেলে না। এই দমবন্ধ শহরেই থেকে গেলে!
-তুমি ফাঁকি না দিলে হয়ত অন্যকোথাও যেতাম।
ছাকুনির একটা বড়ো ফুটো দিয়ে বোধকরি বাক্যটা বেরিয়ে যায়। আর সেটা সামলাতেই কথার ওপর হাসির আস্তরণ ঢেলে দেয় শৈলজা।
-তা তুমি কি নিজেই বই ডেলিভারি দাও বাড়ি বাড়ি গিয়ে?!
-বই যদি কখনো সৈ-এর সাথে অভিসারের ছুতো পায়, তবে যাই।
এটাও ছাকুনির বড়ো ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া বাক্য। দুজনেই বুঝতে পারে, থামতে হবে। নইলে ছাকুনিটা অকেজো হয়ে পড়বে শীঘ্রই। তমাল তটস্থ হয়,
-নাও করো তোমার নির্জনতা বিলাস। আমি বেরোই। এক কাস্টমার এত সময় গিলে নিলে আমার ব্যবসা সিকেয় উঠবে।
শৈলজা হাসে। সেই হাসি যেন বলতে চায়-আমরা কার কাছে লুকোতে চাইছি নিজেদের!
মুখে বলে,
-যাও। নিজের অপরিণামদর্শিতায় একজন কাস্টমার হারালে।
-হারাতে আপত্তি নেই আজ যদি যথাযথ লোকসান হয়।
শৈলজা প্রশ্নবোধক চিহ্ন চোখে তমালের দিকে তাকায়,
-মানে!
-তুমি যেহেতু নির্জনতা-বিলাস ছাড়া কিছু করো না তাই ধরে নিচ্ছি ও টাকাটা অনিক মশাইয়ের। অনিক মশাইয়ের টাকাটার সৎকার আজ না হয় নাই করলে?-বলে বইয়ের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দেয় শৈলজার দিকে।
-চলি তবে?
-যাও।
তমাল পা বাড়ায়। দরোজার বাইরে বেরুতেই শৈলজা পেছন থেকে ডাকে,
-তমাল…
তমাল চমকে তাকায়। নিজের নামটি মানুষের কাছে কখনো কখনো এত বিস্ময়কর আর বিশেষ হয়ে উঠতে পারে!
-একটু দাঁড়াও- বলে ভেতরে যায় শৈলজা।
মিনিট পাঁচেক পর বাদামি রঙের একটা পুরোনো প্যাকেট নিয়ে ফিরে আসে। তমালের হাতে দেয়।
তমাল সাথে সাথেই প্যাকেটটা খুলে ফেলে। শৈলজা হাসে,
-পুরোনো অভ্যাস এখনো যায়নি! উপহার পেলে আর তর সয় না!
-বিশেষ উপহার হলে তো আরো না। কিন্তু এই বইটা তুমি আমাকে দিয়ে দিচ্ছ! এটা ছাড়া তো তোমার ঘুম হয় না।
-নতুন একটা তো তুমি দিয়েই গেলে।
তমাল খুব চেনা সেই জীবনানন্দ সমগ্রের পাতা উল্টাতে থাকে। প্রতিটি পাতায়, প্রতিটি অক্ষরে, আন্ডারলাইনে, কাগজের রোয়ায় রোয়ায় বিঁধে আছে অজ¯্র দিন, অজ¯্র মুহূর্ত, শৈলজার অজ¯্র নির্জনতা বিলাসের সাক্ষ্য আর অজস্র ক্ষণের শৈলজা! সব শেষে ফেরে প্রথম পাতায়, তামাটে রঙ ধরা পুরোনো কাগজের ওপর টাটকা কালির কতগুলো অক্ষরে,
‘যে তার রুমাল নাড়ে পরাণের গহীন ভেতর…’
তমাল মুখ তোলে। চোখ ফসকে না, এবার সচেতনভাবেই শৈলজার চোখে তাকায়। অস্ফূটস্বরে বলে,
-ভালো থেকো সৈ…
প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা করে না। দ্রুত পালিয়ে যায়।
শৈলজা নতুন একটা জীবনানন্দ সমগ্র নিয়ে বারান্দায় যায়-নিজস্ব নির্জনতায়।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত