৩২ নাম্বার বঙ্গবন্ধুর বাড়ি

ঈদের পঞ্চমদিনের বিকেল। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের লেক। প্রকৃতিতে বইছে আষাঢের মনমুগ্ধ বাতাস। লেকের ধার ঘেঁষে ছোট ছেলে মেয়েরা ছুটোছুটি করছে সবার পরনে ঝলমলে নতুন পোশাক। দেহ মনে তাদের অপার আনন্দ খেলে বেড়াচ্ছে। ফেরিঅলারা বেলুন, রঙিন ঘুড়ি, খেলনার পসরা নিয়ে কেউ বসে আছে আবার কেউ এ মাথা হতে ও মাথায় ছুটতে ছুটতে বিচিত্র গলায় হাঁকছে এই বেলুন নেবে বেলুন, ঘুড়ি ঘুড়ি। ছোট ছেলে মেয়েরা তার কাছে ছুটে যাচ্ছে। কোন একটা হাতে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে বাবা-মায়ের কাছে আবদার করতে “এটা কিনে দাও না মা”। বাবা-মায়েদের আজ মন ভালো কোন কিছুতেই যেন আজ না নেই। পছন্দের নতুন বেলুন ঘুড়ি খেলনা পেয়ে ওরাও আত্বহারা। এই ঈদ বিকেলে আজ যেন, কোথাও কেউ গোমড়া মুখে বসে নেই । ভিক্ষুক বা জীর্ণ শীর্ণ চেহারার পথ শিশুদেরও আজ আনন্দ! আজ তারা হাত পেতে ভিক্ষা চাইতে ভুলে গেছে। ওরাও মেতে উঠেছে আনন্দে। যেন সবাই আজ এক কাতারে। আনন্দ ভর করে আছে দুই হাজার সতের সালের টগবগে তরুণ রাতুলের মনেও। আহা! আজ কত দিন পর সে এখানে এলো। আনন্দ ভরা চোখ হঠাৎই আটকে যায় লেকের সামনের বাড়িটাতে। মনের আয়নায় দেখতে পায়; ৩২ নাম্বারের দোতলা বাড়ি থেকে এক বলিষ্ঠ চেহারার পিতৃবৎ একটি মানুষ মুগ্ধ নয়নে শিশুদের ছোটাছুটি দেখছেন। দেখতে দেখতে নিজেকে হারিয়ে ফেলছেন টুঙ্গিপাড়ার সেই কৈশোর কাটানো দিন গুলোতে। চোখের কোনে খানিকটা জল ভরে ওঠে। টলমলে জলে আবছা হয় চোখের দৃষ্টি। বোধহয় অজস্র স্মৃতিরপাতা ঘিরে ধরেছে বারান্দায় দাঁড়ানো বলিষ্ঠ ওই মানুষটিকে। পাঞ্জাবীর কোনায় চোখের জলটা মুছে নেন তিনি। ছোট্ট ট্রেতে করে দু’মগ চা হাতে বলিষ্ঠ মানুষটির পাশে তাঁর সহর্ধমিনী এসে দাঁড়াতেই প্রত্যাশিত হাসিতে মুখখানা ঝলমলিয়ে ওঠে। সহধর্মিনীর হাত থেকে চায়ের মগটা নিয়ে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে সামনে দিকে হাত প্রসারিত করে বলেন “ দেখো দেখো রেণু, আমার বাঙলার শিশুরা কেমন ঈদের আনন্দ করতাছে।” পাশে দাঁড়ানো রেণু বলিষ্ঠ লোকটির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকেন তাকিয়ে থাকেন বারান্দার ছাড়িয়ে নিচের মানুষজনের আনন্দ উল্লাস। অস্ফুটে বলেন,“হ্যাঁ এই তো তোমার বাংলা, তোমার জনগণ”। যাদের এই আনন্দ ফিরিয়ে দেবে বলে কারাবরণ করেছো বারবার আর কাঁদিয়েছো আমাকে। আজও রেণুর চোখে জল চলে এলো। সে জল লুকাতেই বুঝি চায়ের কাপ ট্রে হাতে দ্রুত ভেতরে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। বলিষ্ঠ লোকটি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে রেণুর চলে যাওয়া পথের দিকে। সত্যিই কত কষ্টই না সহ্য করতে হয়েছে একহারা গড়নের ওই শান্ত মানুষটিকে! বলিষ্ঠ মানুষটির বুক ভেদ করে একপি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আহ্ বেচারি রেণু! হঠাৎই কিসের খেয়ালে অনেকটা দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করেন তিঁনি। তাঁর বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা জানে এ সময় অসম সাহসী এই মানুষটির বৈকালিক হাঁটার সময়। তবুও তড়িঘড়ি করে নামতে থাকা বলিষ্ঠ মানুষটিকে দেখে খানিকটা অবাক হন কর্ণেল জামিল। তিনি মানুষটির সার্বক্ষনিক ছায়াসঙ্গি হয়ে পাশেই থাকেন। আজো তার বাত্যয় ঘটলো না। তাঁদের দুজনকে এগিয়ে আসতে দেখে পাহারারত দুজন গেট খুলে দেয়। জামিলের সঙ্গে আরো দুজন তাঁদের সঙ্গে চলতে থাকেন দূরত্ব বজায় রেখে। সবসময় রক্ষী নিয়ে ঘোরা মোটেও পছন্দ নয় মানুষটির। বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর কাজ কারবার অনেক সময় তাঁর কাছে বাড়াবাড়িই মনে হয়। সিঁড়ি বেয়ে নেমে ঘাসে ছাওয়া এক চিলতে উঠোনটায় এসে দাঁড়ান মানুষটি। বুক ভরে নিশ্বাস নেন। মূহুর্তেই উঠোনের কোন থেকে ছুটে আসা হাসনাহেনার গন্ধে বুকটা ভরে যায় তার। কিছুক্ষণ আগে আষাঢ়ের এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। চারিদিকে বয়ে যাওয়া ঠান্ডা বাতাসে মন ভরে ওঠে তার। ধীর পায়ে এগিয়ে যান গেটের দিকে। গেট পেরিয়ে নামেন পিচঢালা রাস্তায়। যেখানে আজ জমা হয়েছে আনন্দ মুখর মানুষের দল। রাস্তার পাশের ঘাসগুলো বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে সতেজ হয়ে উঠেছে। ঢলমল করছে ঘাসের ডগা তাতে তখনো লেগে রয়েছে বৃষ্টির জল মুক্তোর মত। চারপাশটা ভালো করে দেখে নেন মানুষটি । চারপাশে অনেক মানুষ কিন্তু নিরাপত্তা বলয় তাঁকে ঘিরে আছে । সঙ্গের তিনজন অফিসার ছাড়াও আশে পাশে পুলিশ, পিজিআর,বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা পুরো জায়গাটি কর্ডন করে রেখেছে সতর্ক প্রহরায়। নিরাপত্তার ঘেরাটোপ পেরিয়ে মানুষটির দৃষ্টি আটকে যায় তিন চার বছর বয়সি একটি ছোট বাচ্চার দিকে । যে কিনা অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে বাবার কোল থেকে তাঁর দিকে ছোট হাতখানি বাড়িয়ে চিৎকার করে বলছে, ‘‘বাবা বাবা ওই দেখ বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু। হ্যাঁ এতক্ষণ ধরে টগবগে তরুণ রাতুল যাকে মনের আয়নায় দেখতে পাচ্ছিলো, সাদা পাজামা পাঞ্জাবিতে বলিষ্ঠমানুষরূপে তিনিই বঙ্গবন্ধু। জাতির শেখ মুজিবুর রহমান। বাচ্চাটিকে দেখে বঙ্গবন্ধুর মন আশ্চর্য কোমলতায় পেয়ে বসে। তিনি কর্ণেল জামিলকে নির্দেশ দেন বাচ্চাটিসহ বাবাটিকে তার কাছে আসতে দেয়ার। লোকটি কাছে আসতেই বাচ্চাটির দিকে হাত বাড়িয়ে দেন তিনি। বঙ্গবন্ধু হাত বাড়াতেই কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিশুটি। বঙ্গবন্ধু বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরছেন দেখে আরো অনেক ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা তার কাছে ভিড়তে চায় । যারা এতক্ষণ লেকের চারপাশের হইচই করে খেলছিল। বাচ্চারা ভিড় করলেও নিরাপত্তার কড়াকড়ির কারনে কেউ তাঁর কাছে ঘেষতে পারছিলো না। বঙ্গবন্ধুর ইশারায় সব বাচ্চারা একছুট্টে তাঁর কাছে আসে। বঙ্গবন্ধুকে কাছে পেয়ে আনন্দে মেতে ওঠে। তাকে ঘিরে গাইতে, জুতো ছুড়েঁ ফেলে দিয়ে ভেজা ঘাসের উপর নাচতে থাকে। বাচ্চাদের দেখাদেখি বঙ্গবন্ধুও জুতো ফেলে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে থাকেন বাচ্চাদের আনন্দ উৎসবে। মনে ভাবেন এইতো স্বর্গ, এইতো আমার পূণ্যভূমির সন্তানেরা। বঙ্গবন্ধুকে খালি পায়ে দাঁড়াতে দেখে কর্ণেল জামিল বলে ওঠেন, স্যার আপনার ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। ঘাসের ভেতর সাপ খোপ কিছু থাকতে পারে। খালি পায়ে দাঁড়াবেন না স্যার প্লিজ। একথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠেন বঙ্গবন্ধু। হাসতে হাসতেই বলেন, আমি গাওঁ -গেরামের পোলা আর তুই আমারে ঠান্ডা আর সাপের ভয় দেখাস! ঘড়িতে তখন সন্ধ্যে সাতটা । এই সময়টা বঙ্গবন্ধু নিয়ম করে টেলিভিশনের খবর দেখেন। খবরে মগ্ন হয়ে গেলে চ্যানেল পাল্টে পাল্টে অনেকগুলো টেলিভিশনের খবর দেখেন । দেশের মানুষের হাল হকিকত জেনে নেন। রেণু! বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিব এই সময়টায় খানিকটা অবসর পান। পানের বাটা থেকে পান সাজিয়ে নিয়ে চিবুতে চিবুতে কখনো টেলিফোনে মেয়ে, নাতী-নাতনীদের সাথে কথা বলেন। বই পড়েন নয়তো স্বামীর সঙ্গে বসে খবর দেখেন। সেদিনও যথারীতি বঙ্গবন্ধু খবর দেখছিলে। সংবাদ পাঠক পাঠিকাদ্ধয় হাসি মাখা মুখে স্বাগত জানালেন দর্শকদের। সারাদেশের সবাই খুশি মনে ঈদ উদযাপন করছে এই খবরই ছিলো সংবাদের পুরো অংশ জুড়ে । প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদ যাত্রায় কোন ভোগান্তি হয়নি। মানুষ নির্বিঘ্নে প্রিয়জনের কাছে যেতে পেরেছে । আবার ঈদের ছুটি কাটিয়ে কর্মস্থলে ফিরতেও শুরু করেছে। একটা চ্যানেলে চোখ আটকে গেল বঙ্গবন্ধুর। একটু ভিন্ন রকম খবর দিয়ে নিউজ বুলেটিন শেষ করতে চাইলেন সংবাদ পাঠক । চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে নৌ বাহিনীর জাহাজ বিএনএস পদ্মা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে । বৈশ্বিক মন্দা ও বিশাল সামরিক ব্যয় মেটাতে গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে বির্পযস্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের দারিদ্র পীড়িত জনগনের মধ্যে এই ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হবে। এই খবর শোনার পর মুর্হুতেই বুকের ভেতরটায় কেমন যেন মোচড়াতে থাকে বঙ্গবন্ধুর। পাশে বসে পান চিবুতে থাকা স্ত্রীকে বলেন, শুনছো রেণু, শুনছো- আমরিকা আমাগো থেইক্যা এখন ত্রাণ নেয়”। এই আমরিকা একদিন আমাগোরে কইছিল তলা বিহীন ঝুড়ি” এখন আমরাই ওদের সাহায্য করতেছি । এই রাতুল এই কী ভাবছিস এখানে একলা দাঁড়িয়ে? চল চল ওদিকে যাই মামুন ফোন দিচ্ছে বারবার। বন্ধু তুহিনের তাড়া খেয়ে মনের আয়না থেকে মুখ তোলে রাতুল। তাকে কেমন বিষন্ন দেখায়। সামনেই ১৭ই মার্চ। ৯৭ বছরে পা দিবেন বঙ্গবন্ধু । এদিনে নাতি নাতনীরা ৩২ নম্বরের বাড়িতে ঘরোয়া আয়োজনে তাঁর জন্মদিন পালন করবে কথা তো এমনই ছিলো। অন্যান্য বছরের মতো এবারের জন্মদিনে অনেক মানুষ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ৩২ নাম্বার বাড়ির সামনে জড়ো হবে। বঙ্গবন্ধু বারান্দায় এসে সবার উদ্দেশ্যে হাত নাড়বেন। যেমনি, হাত নেড়েছিলেন ৭১ সালের ১৭ মার্চের দিনটাতে। সেদিন স্বাধীনতা পাগল বিক্ষুধ জনতা বাঙলার লাল-সবুজ পতাকার মাঝে হলুদ মানচিত্র খচিত পতাকা নিয়ে জড়ো হয়েছিল এই ৩২ নম্বর বাড়ির সামনেই। তারপরে যুদ্ধ, স্বাধীনতা, বাংলাদেশ। ঢের পরে সাতানব্বই বছর বয়স আসার আগেই বঙ্গবন্ধুর জীবনে ১৯৭৫ সালের ভয়ঙ্কর ১৫-ই আগষ্ট এর কালরাত্রি বদলে দিল চিত্রপট। বুকটা ভয়ানক মোচড়াতে থাকে রাতুলের। আনন্দে মেতে থাকা বন্ধু তুহিন মামুনের কলরবের পাশে বিষন্ন রাতুল হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে যায় ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার বঙ্গবন্ধুর বাড়ি।

(কাল্পনিক)
(সাম্প্রতিক দেশকাল পত্রিকার ২২ মার্চ ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত