– ঘটনাটা অইলো কালামের, মানে টেকপাড়ার ফোচু কালামের। গ্যাদাকালে বারো মাস ওর নাক দিয়া সর্দি গড়াইতো, হালায় ফোচ ফোচ কইরা নাক টানতো, নাম অয়া গেলো ফোচু কালাম।
আকবর চাচা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বিরক্তির সুরে বলেন,
– ত্যানা প্যাচাও কেলা! ঘটনা কও, মিয়া।
– ফোচুর তো পড়ালেখা অয় নাই। ক্লাস ফাইবে ইনবারসিটি পাস দিয়া কিছুদিন কামকুম করছে। পরে ঢুইকা গেছে ল্যাংড়া মিজানের পাট্টিতে।
– ও। মাগর কলাইম্যার বাপ বহুত ভালা আদমী আছিলো, টাকা আছিলো না হালার কলিজা আছিলো শরীল ভরা। পেটের ভুড়ি ভরা মহব্বত।
রমিজ মাথা দোলায়। আকবর চাচার সামনে আনন্দ বেকারির কাচ্চা বিস্কুটের প্লেট ও চা এগিয়ে দেয়,
– হ, চাচা। আমরা দুপুইর্যা রোইদে গাবাইলেও বকতো না।
– কালাইম্যার কথা জানি কি কইতা ছিলা!
– ল্যাংড়া মিজানরে ক্রস ফায়ার দেওনের পর বহুত দিন কালামে ভাগলপুর আছিলো।
– ভাগলপুরে ওর কে থাকে?
– চাচা, ভাগলপুর মানে ভাইগ্যা গেছিলো। পরে ফিরা নিজে ছিনতাই পাট্টি খুলছে।
আকবর চাচা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। আগের মত পঞ্চায়েতের রমরমা থাকলে কালামকে জুতিয়ে সোজা করে ফেলতেন। কিন্তু ওই দিন আর নাই, মুরুব্বীদের শাসন কেউ মানেনা। রমিজ বলতে শুরু করে,
– পনরো বিশ দিন আগে, ওই যে টানা বিষ্টি অইলো, তহন কালামে একটা বড় দাও মারছে।
– বড় দাও মানে?
– ওইদিন বিষ্টির লেগা দোকানপাট আগে আগে বন্ধ অয়া গেছে। রাস্তায় ভিড় নাইক্কা। রাইত দশটায় রাস্তা ফাক্কা।
– তো?
– কালামে একটা রিকশা আটকাইছে। রিকশায় এক বুড়া কই জানি যাইতাছিলো। বুইড়ার পকেটে হাত দিয়া দেখে বহুত টাকা। কালামে টাকা লয়া টানাটানি করনের সময় বুড়ার গলায় চাক্কু দিয়া দিছে পাড়, বুইড়া মাথা কাটা মুরগির মতন ছটফটায়া স্পট ডেড। রিকশাওলা লাশ ফালায়া রিকশা লিয়া দিছে লৌড়।
আকবর চাচা যেনো বিশ্বাস করতে পারছেন না,
– কও কি ভাতিজা!
– হ, চাচা। পুলিশ ঘটনা লিয়া ঘাটায় নাইক্কা। ওইদিকে কালামও বউ লয়া আন্ডারগাউনে গেছে গা। মাগর, ওর অইছে আজীব ব্যারাম। ওর বউ আয়া সাবেত কবিরাজের কাছে বহুত কান্নাকাটি করছে।
– কুন সাবেত! ওই যে জ্বীন পালে!
– হ, চাচা।
– সাবেত হালারে পালে কে, আবার ওই পালবো জ্বীন! ভাতিজা, কালামের ব্যারামটা কি!
রমিজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে কামড় দিয়ে বলে,
– ঘটনার শুরু ছিনতাইয়ের রাইত থেকা। কালামের ঘরে খাওন আছিলো না। ওর ৬বছরের মাইয়াটা গরুর গোশতের ভুনা দিয়া পারোটা খাইবার চাইছিলো। বুইড়ার কাছ থেকা ছিনতাই করা দুইটা ৫শ টাকার বান্ডিল লিয়া বাজারে গিয়া জুম্মনের কাছ থেকে রান আর সিনা মিলায়া গোশত কিনছে। ময়দা আর তেল লিয়া বাড়িতে ফিরছে।
আকবর চাচা বিরক্তি গোপন না করেই বলেন,
– দূর হালায়! তুমি আবার ত্যানা প্যাছাইতাছো কেলা! তোমগো চোদ্দ গুষ্টিতে তো কেউ ত্যানার ব্যবসা করে নাই, তুমি এই অভ্যাস পাইলা কই।
রমিজ কিছুটা বিব্রত হয়, কাঁচুমাচু স্বরে বলে,
– ওর বউ গোশত ভুনা আর পারোটা বানাইছে। পরোটা দিয়া গোশতের টুকরা চাইপ্যা ধইরা মুখে দিয়া চাবাইতে চাবাইতে আৎকা কালামে কয়, “থু: থু: থু: তরে আইন্যা দিলাম গরুর গোশত, তুই বুইড়া মাইনষের গোশত রানলি ক্যান!” বউ তো ভ্যাবাচ্যাকা খায়া গেছে, “বুইড়া মাইনষের গোশত পাইলি কই?” কয়া বউরে দিছে মাইর। বমি কইরা ঘরবাড়ি ভাসায়া দিছে।
– তারপর?
– কালাম অহনে গোশত ছাড়া কিছু খাইবার পারেনা। মাগার ওর বউ মুরগি, গরু, খাসি যেইটার গোশতই রান্ধে কালাম মুখে দিয়া বমি কইরা দেয়, ওর কাছে সব গোশতই বুইড়া মাইনষের গোশত লাগে।
আকবর চাচা কিছুক্ষণ উদাস হয়ে বসে থাকেন, এরপর খুব জোড় দিয়ে বলেন,
– ভাতিজা, ওই রাইতে তুমিও তো কালামের লগে আছিলা। কি আছিলা না!
রমিজ হকচকিয়ে ওঠে। মুহুর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বিস্কুটে কামড় দিয়ে চিবুতে চিবুতে আকবর চাচার চোখে চোখ রেখে দৃঢ়ভাবে বলে “না”। আকবর চাচা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিদায় নেন, আর তখনই রমিজের মনে হতে শুরু করে ও বিস্কুট চিবুচ্ছে না, চিবুচ্ছে বুড়ো মানুষের মাংস- নোনতা, শক্ত, স্বাদহীন মাংসের রোয়াগুলো আটকে যাচ্ছে দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে।