আশেপাশের রাজ্য সহ এই রাজ্যের সব গণ্যমান্য মানুষের হাসি আর হৈ হল্লায় আসর প্রায় জমজমাট। স্বয়ং রাজা- রাণী উভয় উপস্থিত সেখানে।
সুন্দরী মাখন রঙা রমনীরা যাদের সোনালী কোঁকড়ানো চুল, টিকোলো নাক, আঙ্গুর এর মতো টুলটুলে লাল ঠোঁটে মিষ্টি হেসে ঘুরে ঘুরে সবার পানপাত্রে সুরা ঢেলে দিচ্ছে। নারী পুরুষ সকলে খুব মূল্যবান রেশমের কাপড় পরিহিত তাতে মুক্তা, স্বর্ণখচিত কারুকাজ করা।
সকলের মিলিত উচ্চস্বর হাসি আনন্দ আর পানপাত্রের টুংটাং শব্দের সাথে মিলিত হয়েছে মিহি আনন্দ বাদ্য। কেবল রাজা পানপাত্রের সুখস্পর্শ নিচ্ছেন না। তার বিরস মুখে জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন হাসি টেনে রাখতে। মান্যগণ্য এতো লোক এসেছেন। সকলকে সম্মানের সঙ্গে নিমন্ত্রণ পত্র এবং উপঢৌকন পাঠিয়ে আসতে বলা হয়েছে। সবাই আসতে শুরু করেছে আরো দিন তিনেক আগে হতে। আজও সকাল থেকে বেশ কয়েকজন নিমন্ত্রিতরা এসে পৌঁছেছেন। দরাজ হাতে রাজ ভাণ্ডার থেকে খরচ চলছে। সকল মেহমানকে আনন্দিত দেখাচ্ছে। মধ্যাহ্ন নাগাদ প্রাসাদের মূল ফটক বন্ধ করে দেবার হুকুম ছিল। প্রহরীরা তা-ই করেছে।
আসলে এটি একটি স্বয়ম্বর সভা অনুষ্ঠান। এই দেশের রাজকন্যার হঠাৎ ভীষণ কঠিন অসুখ হলো। এক সন্ধ্যায় বাগান থেকে বেরিয়ে ফিরে রাজকন্যা কিছু মুখে তুলছেন না। অনেক বলে কয়ে রাজা একবেলা যদি খাওয়াতে পারেন বাকি দুইবেলা সে অনাহারী থাকে। ডাক্তার কবিরাজ কোন রোগ ধরতে পারেন না। তাই চিকিৎসাও সম্ভব হয় না।
শেষমেশ অঙ্গ রাজ্যের এক নামি-দামি গুনিনকে খবর দেয়া হলো। তাকে রাজকন্যার কক্ষে যখন আনা হল তখন ক্লান্ত রাজকন্যা অতল ঘুমে তলিয়ে আছে। গুনিন তাকিয়ে থাকে। এমন রূপ থেকে সহজেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া যায় না। অতঃপর রাজা তাকে ভিন্ন কক্ষে নিয়ে গেলে গুনিন বলল, রাজকন্যার অসুখ সারবে একটা কাজ করলে।
রাজা উদগ্রীব হয়ে বললেন, কী কাজ মহাশয় বলুন, আমি তা-ই করব।
দাড়ি গোঁফ আর অদ্ভুত সজ্জায় সজ্জিত গুনিন তার জ্বলজ্বলে সবুজ চোখ মেলে বলে, রাজকন্যাকে বিয়ে দিন। সে সুস্থ হয়ে যাবে আবার হাসবে, গাইবে, খাবে।
রাজা অসহায় বোধ করলেন। এই মুহূর্তে মেয়ের জন্য যোগ্য বর কোথায় পাবেন। রাজকন্যাকে তো যারতার হাতে তুলে দেয়া যায় না।
গুনিন উপায় বাতলে দিল। বলল, একটা স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করেন। রাজকন্যা নিজে বাছাই করে নেবেন তার জীবন সঙ্গী।
বুদ্ধিটা রাজার পছন্দ হলো। রাজার কেবল একটাই আশা মেয়ের মুখে হাসি ফুটবে। সে হাসে না বলে রাত যেন ফুরায় না। দিন হয়ে যায় মলিন।
কিন্তু তিন দিন ধরে কন্যা ঘরের থেকে বের হন না। রাণীর অশ্রু সব বিফলে যায়।
রাজা চিন্তিত। এভাবে অকারণে মেহমানদের কতদিন আর আটকে রাখা যায়। আজ যদি রাজকন্যা ঘর থেকে বের না হন তবে সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে রাজার।
আর যদি বের হয়ে এমন কাউকে পছন্দ করে যার সাথে ঠিক সম্বন্ধ করা যায় না। আজ বিকেলে রাজা খেয়াল করেছেন কিছু অচেনা লোকজনও প্রবেশ করেছে রাজ সভায়। রাজকন্যাকে কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে দেবেন রাজা সেই সুযোগও পাচ্ছেন না। ওদিকে প্রথম থেকেই কথা দিয়েছেন কন্যাকে, মা তোমার যাকে ভালো লাগে তুমি এসে কেবল তার হাত ধরবে। বাকি সব কাজ আমার। রাজকন্যা তার বাবার চোখে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে কেবল মাথা সামান্য কাত করেছিল। রাজার বুক ভেঙে যায় কন্যার শুকনো মুখের দিকে দেখে। সে এই পৃথিবীর ভালো মন্দ কিছুই বোঝে না।
এই সময় হঠাৎ করেই সভা কক্ষের সব যুবাদের গল্প কথা, তাদের মা বাবাদের ফিসফাস স্তিমিত হয়ে এল। কারণ রাজকন্যা তার ঘর হতে বের হয়ে ধীর পায়ে উপর তলার সিঁড়ির সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। তারপর উপস্থিত সকল সুধী গণের দিকে চোখ বোলালেন অত্যন্ত নির্লিপ্ত ভাবে।
রাজকন্যা লক্ষ করতে পারলেন না তিনি যাকে খুঁজছেন সে উপস্থিত ব্যাক্তি বর্গের মাঝে দাঁড়িয়ে তার দিকে লক্ষ করছে, ভীষণ উজ্জ্বল দুটি চোখ দিয়ে। যেন ওই চোখ যে দিকে একবার দৃষ্টি মেলবে সব বুঝে নেবে, অন্তরের অন্তঃস্থল পর্যন্ত।
রাজকন্যার ম্লান মুখ দেখে পিতা দীর্ঘশ্বাস চাপেন। পিতা হয়ে দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করেন কন্যার কার্যক্রম দেখেন। তীক্ষ্ণ ভাবে খেয়াল করছেন কন্যা কেমন উদাস আর মলিন। তবে উপস্থিত সকল নারী রাজকন্যার রূপ এবং পোশাকের ব্যাপারে ফিসফাস করছে।
সেসব কথা কানে পৌঁছে সেই উজ্জ্বল চোখের মানুষটির। এবং ভিতরে ভাল লাগায় ভরে যায়। নিরাভরণা রাজকন্যা নিজেই এক টুকরো আলো। সাদা রঙের রেশমের লম্বা জামা মাটি ছুঁয়ে নিচে নেমে এলেন। যেন আকাশ থেকে পরী নামছে।
সেই মুহূর্তে উজ্জ্বল চোখের মানুষটি সবাইকে ঠেলে সামনে দাঁড়াল। রাজা দেখলেন তার কন্যার মুখ খানা হঠাৎ যেন সূর্য হয়ে জ্বলে উঠল। অনেকেই তখন লক্ষ করছে রাজকন্যার নিষ্প্রাণ মুখখানা প্রাণ পূর্ণ হয়ে উঠেছে। তার ঠোঁটে খুশির ঝিলিক।
রাজকন্যার কোন দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সে হাত বাড়িয়ে দিল সেই উজ্জ্বল দৃষ্টি র মানুষটির দিকে।
এক মুহূর্ত দেরি না করে সেও রাজকন্যার হাত ধরল। মুক্তোদানার মত দাঁত ঝিলিক দিল। শুধু একবার। রাজকন্যা সাধ্য মত শক্ত করে ধরে নিল সেই হাত তারপর সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে উপরে উঠতে লাগল দুজন, সেই সিঁড়ি আর ফুরায়না। দুজনের হাসিও আর থামেনা। ছুটতে থাকে দুজনে , এ পথ সে পথ, এ ঘর, ও ঘর, পেরুতেই থাকে। রাজ বাড়ি লোকে লোকারণ্য। ঘরের যেমন অভাব নেই মানুষের ও অভাব নেই। শেষ পর্যন্ত তারা একটি ঘর পেল যেখানে কেউ নেই। নীল পুরু গালিচা বিছানো। দুজন কাছাকাছি বসল যেন নীল সাগরে হংস মিথুন। এর মধ্যে সারা বাড়ির মানুষ এবং রাজা নিজেও ছুটলেন কন্যার পেছনে। কারণ যে ছেলেটিকে বাছাই করেছে রাজকন্যা তার পরিচয় কেউ বলতে পারছে না। রাজার কেবল মনে হচ্ছে এই যুবক তার চেনা। কিন্তু কই তিনি চিনতে তো পারছেন না।
কোথায় তারা।এক এক করে সব ঘর খোঁজা শেষ হলে এই ঘরটাতে উঁকি দিয়ে গেল সবাই।
মানুষটির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন রাজকন্যা — সেদিন সন্ধ্যায় একবার দেখা দিয়ে চুমু খেয়ে অমন চলে গেলে কেন? আর কেন এলে না?
মানুষটিও ফিসফিস করে বলে এসেছিলাম। তুমি ঘুমিয়ে ছিলে।
দৃষ্টিতে কপট অবিশ্বাস ফুটিয়ে, নিচের ঠোঁট কামড়ে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে রাজকন্যা। মানুষটি বলে, বিশ্বাস করো রাজকন্যা আমি এসেছিলাম এবং আজকের এই দিনটির ব্যবস্থা সেদিন পাকা করে গেছি।
রাজকন্যা বলে, বিশ্বাস করলাম, এখন আমার হাত ধরে থাকবে। বাবা এসে যা-ই বলুন না কেন হাত ছাড়বে না।
নিচু কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ় কন্ঠে মানুষ টি বলল — কখনও ছাড়বোনা।
বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়ছে ছেলে আর মাথা এদিক ওদিক করছে। মনেহচ্ছে ওর নিশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে। মা কান পাতেন কী বলছে ছেলে বিড়বিড় করে? ছাড়বো না, ছাড়বো না!
মা আস্তে আস্তে ছেলের মাথায় হাত বুলান, ডাকেন ঘুমন্ত ছেলেকে, এই মামুন, মামুন কী বলছিস বাবা? স্বপ্ন দেখছিস? কী ছাড়বিনা?
ছেলে চোখ পিটপিট করে তাকায় মায়ের দিকে! প্রথম কিছুই বোঝে না। তারপর সহজ সরল হাসিতে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।