আমার পূর্ব জন্মের কথা। কত আগের সেসব কথা তা ইতিহাসবিদেরা গবেষণা করে বের করবেন। তবু আমার স্পষ্ট মনে আছে সেই গুহা, গুহার দেয়ালে আঁকা ছবিগুলোর কথা। হ্যাঁ, আমি, আমরা তখন গুহাবাসী আদিম মানব ছিলাম। আমি যাকে ভালবাসতাম সে ছিল শিকারি পুরুষ। দলের সবচেয়ে সাহসী পুরুষদের মধ্যে একজন। তারা বন্য পশু শিকার করে আনতো আমাদের জন্য। মাঝেমাঝে ওদের সাথে আমিও শিকারে যেতাম। দলবেঁধে যাওয়াই সার আমার। তেমন শিকার টিকার পারতাম না আমি। হয়ত কোন খরগোশ বা কোন ছোট প্রাণী কিংবা খাবারযোগ্য বিশেষ কোন পোকা, পাখির ডিম বা ফল সংগ্রহ, এই ছিল আমার খাদ্য সংগ্রহের তালিকা। শিকার করতে গিয়ে প্রায় সময়ই অনেক রকম ফুল সংগ্রহ করতাম। অবশ্য ফুলগুলো থেকে চেষ্টা করলে মধুও খাওয়া যেতো। আর আমার সংগ্রহের খাবারের স্বাদও ছিল ভিন্ন রকম মজার। তাই কেউ আমাকে তেমন কিছু বলতো না। খুব বেশি অকাজের তো নই আমি। তবে বড় কোন মহিষ বা হাতির দলে আক্রমণ করা বা হিংস্র কোন প্রাণীর সাথে লড়াইয়ে আমি কখনওই থাকতাম না। দূর থেকে দেখতাম দলের শিকারিদের লড়াই। আমি যাকে ভালবাসতাম তাকে দেখতাম আরো বেশি। কী বিপুল শক্তি নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ছে হিংস্র পশুর উপর। রক্তাক্ত করছে, নিজেও পশুর আক্রমণে আহত হচ্ছে। তার সাহসিকতা দেখে মুগ্ধ হতাম। বিষ্মিত হতাম।
আমার কথা শুনে আবার ভাববেন না, দলের সব নারীই আমার মত ভীতু বা দূর্বল ছিল। আমাদের দলে বেশ কয়েকজন শিকারি নারীও ছিল। তারাও বেশ ভালো সাহসী শিকারি ছিল।
দলে শিকারি নারী পুরুষদের আলাদা গুরুত্ব ছিল। তারাই আমাদের খাদ্যের যোগানদাতা। তাই খাবারের আর পশুর চামড়ার বেশিরভাগ অংশ ওদেরই প্রাপ্য। দলের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার দায়িত্বও ওদেরই ছিল। তাই ওদের জন্য বিশেষ উপাসনা ও উৎসব করা হতো। তাদের মংগল কামনা করে পুজা করা হতো।
বলছিলাম, আমার ভালবাসার শিকারি পুরুষের কথা। কত জন্ম আগের কথা। তার গায়ের উল্কির ছবি সবই মনে আছে আমার। শরীরে উল্কি আঁকা অত্যন্ত কষ্টকর কাজ। যে তার শরীরে যত বেশি উল্কি নিতে পারবে, সে তত কষ্টসহিষ্ণু, তত বেশি সাহসী। টিয়ানের প্রায় সারা গায়েই ছিল উল্কি। হ্যাঁ, ওর নাম ছিল টিয়ান। আর সব শিকারিদের মত টিয়ানেরও বেশ কদর ছিল। বিশেষ করে মেয়েরা, মেয়েরা সব সময় টিয়ানের সাথে নাচতে কাড়াকাড়ি শুরু করে দিতো। আমি নিজেও টিয়ানের সাথে নাচার জন্য অন্য মেয়েদের মতই কাড়াকাড়ি হুড়াহুড়ি শুরু করে দিতাম। এটা আমাদের উৎসবের একটা অংশই বলা যায়। আবার আমার সাথেও অন্য পুরুষেরা নাচতে চাইতো। আমরা সবাই মিলে আগুনের চারপাশে ইচ্ছে মত নাচতাম। শিকার ধরে আনার পর এই উৎসবের জন্য আমরা মুখিয়ে থাকতাম। তবে আমি চাইতাম শুধু টিয়ানের সাথে নাচতে।
আমি লক্ষ্য করতাম, অন্য সব পুরুষের মত রাকমা-ও আমার সাথে খুব নাচতে চাইতো। রাকমা কিন্তু শিকারি পুরুষ ছিল না। তার শরীরটাও শিকারি পুরুষদের মত সুগঠিত ছিল না। তার গায়ে উল্কির ছবি ছিল খুবই কম। খুব বেশি কাজেরও না সে। বেশ অলস। সবকিছু মিলিয়ে রাকমাকে আমার ভাল লাগার কথা নয়। ওকে আমি এড়িয়ে চলতাম, যেমন অন্য পুরুষদের এড়িয়ে চলতে চাইতাম। আর আমি তো আগে থেকেই টিয়ানকে ভালবেসে বসে আছি। অবশ্য যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে ভালবাসা বা প্রেম ট্রেম নিয়ে কোন ধারণা কারো ছিল না। তবে খুব চাইতাম একজন আরেকজনকে, সেই চাওয়াও ছিল খুব আদিম। আমি যেমন টিয়ানকে চাইতাম, টিয়ানও চাইতো। তবে সমস্যা দেখা দিলো আরেকখানে।
টিয়ানকে যেমন আমি চাইতাম, তেমনি অন্য মেয়েরাও চাইতো। টিয়ানও তাদের কাউকে নিরাশ করতো না। আমাকেও না। আবার অন্য পুরুষেরাও আমাকে পেতে চাইতো।সে সময়ে পরিবারপ্রথার কোন ধারণা না থাকায় এভাবেই সবকিছু চলছিল।ব্যবস্থাটাই ছিল এমন। এতে কারো কোন সমস্যা হতো না। সমস্যা শুরু হলো শুধু আমার। আমি প্রচণ্ড হিংসুটে একটা মেয়ে ছিলাম। অন্যদের মত এত উদার ছিলাম না। টিয়ানকে সবার সাথে ভাগ করে নেবার কোন ইচ্ছাই ছিল না আমার। আমি চেয়েছিলাম টিয়ান শুধু আমারই থাকবে। আমার এমন অন্যায় ও আজগুবি আবদারে টিয়ান বিরক্ত হলো খুব। আর অন্য মেয়েরা মিলে আমাকে মারলো। কারণ, আমি দলের নিয়ম মেনে চলতে চাই না। আমি স্বার্থপর। টিয়ানকে সবার সাথে ভাগ করে নিতে চাই না।
সবার মার খেয়ে আমি তখন দূরে একটা ঝিরির পাশে বসে কাঁদছি। সে সময় রাকমা এসে আমার পাশে এসে বসলো। কেন জানি হঠাৎ-ই আমার মনে হলো, টিয়ানের সাথে সব মেয়ে নাচতে চায়। কিন্তু রাকমার সাথে মেয়েরা তো তেমন নাচতে চায় না! যার সাথে সবাই নাচতে চায়, তার সাথে আমার নাচা কি খুব বেশি জরুরি?
কথাটা ভেবেই আমি রাকমার দিকে তাকালাম। রাকমা আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো, বললো, “চলো, একটা জায়গায়। তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো।”
— কী?
— আগে চলো।
রাকমা আমাকে এরপর একটা গুহায় নিয়ে গেলো। খুব শীত পড়লে এ গুহায় এসে আমরা থাকি। বাকি সময়টায় অন্য গুহাতে। গুহার ভেতরটা আরামদায়ক উষ্ণ হয়ে আছে।গুহার দেয়াল দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। দেয়াল জুড়ে অপূর্ব সব চিত্র আঁকা।
— কে এঁকেছে এসব, তুমি?
রাকমা যেন লজ্জা পেলো। আস্তে করে বললো, হ্যাঁ, আমি।
বিষ্ময় নিয়ে ছবিগুলো দেখতে থাকি আমি। আমাদের দলের শিকার করার দৃশ্য, আগুন ঘিরে উৎসবের দৃশ্য, প্রাণীর ছবি, পাখির ছবি। এর মধ্যে একটা মেয়ের ছবি। বারবার সেই মেয়েটার ছবিই নানা ভংগিমায় আঁকা। এত সুন্দর সেই ছবিগুলো, আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকলাম। কোন ছবিতে মেয়েটার খোলা চুলে অনেক ফুল। কোন ছবিতে মেয়েটা বসে আছে, কোনটাতে ছুরিতে শান দিচ্ছে, কোন ছবিতে মেয়েটার হাতে একটা খরগোশ। আবার কোন ছবিতে মেয়েটা নাচছে।
ঝিরির স্বচ্ছ জলে নিজেকে আমি দেখেছি অনেকবার। দেয়ালের মেয়েটাকে দেখে হঠাৎ যেন মনে হলো , আমি তাকে চিনি! চমকে গিয়ে রাকমার দিকে তাকালাম। বরাবরের মতই একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিলো সে।