সংশয়

এই ভয়টাই পাচ্ছিল চিত্রবাহন। সে যখন দেখত কনকনে শীতে পরনে একটা ধুতি আর গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে তেল-লোশন ছাড়া উস্কো-খুস্কো চুল নিয়ে সদ্য অনাথ হয়ে যাওয়া ছেলেরা হাতে কুশাসন নিয়ে ২১ দিনের হবিষ্যি করার জন্য ঘুরে বেড়াত, তখন শুধু তার মনে হতো, ‘মা তুমি আমারে আর যখনই ছাইড়া যাওনা কেন শীতকালে ছাইড়া যাইও না’। কিন্তু মা তার অন্য সব আবদারের মতো এই আবদারটাও রাখতে পারলেন না। তিনি কনকনে মাঘ মাসের শুরুতেই চলে গেলেন। চিত্রবাহন যতটা না মাতৃশোকে তার চেয়ে বেশি শীতে কাতর হয়ে পড়ল। মা মরলে প্রথম তিন দিন খেতে ইচ্ছে করে নাই বটে, তবে দিনের পর দিন ফল-মূল আর আতপ চালের ভাত ফুটিয়ে ঘি দিয়ে মেখে খাওয়া, তাও আবার স্বপাক আহার! মায়ের প্রতি তার শোক কমিয়ে এনে তলানিতে ঠেকিয়েছে। ঘরে তার নতুন বৌ, দুমাস আগে বিয়ে হয়েছে। সে বেচারিও স্বামীর ওপর নেমে আসা এই সব নিয়মের অত্যাচারে অসহায় হয়ে পড়েছে। নিয়ম যে সব অক্ষরে অক্ষরে মানতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নাই, তবে দিদিদের চাপে পড়ে মানতেই হয়। নিয়মের কোনো রকম ব্যত্যয় হলেই তারা কথা শোনাতে ছাড়বে না। যতটা না তাকে কথা শোনাবে তার চেয়ে বেশি শোনাবে বেচারি নতুন বৌকে। যে তার সঙ্গে পড়েই ভাই তাদের বদলে গেছে। ভাই যে কখনোই এসব নিয়ম-কানুনের ধার ধারেনা, এটা তারা মনেও রাখবে না। মেয়েটা এমনিতেই ভয়ে কাঠ হয়ে আছে। বিয়ে হওয়ার পর পরই শাশুড়ি মরে গেল; কে কি ছুতো ধরে সেই ভয়ে অস্থির।
আর মা’রও যা আক্কেল মরতে মরতে সেই বিয়ের পরেই মরতে হলো। আগে মরলে নির্ঘাত সে শীপ্রাকে বিয়ে করত। মেয়ে একটা মাইরি! যেমন তেজ, তেমন যৌবনের ধার। এমন মেয়েকে কি ওর এক্স স্বামীর মতো মিনমিনে পুরুষের পক্ষে ধরে রাখা সম্ভব!
তবে একদিক থেকে মা ভালোই করেছে, এখন তার বৌও আছে আর শিপ্রাও আছে।
তবে বিয়ে করেছে বলেই হয়ত এই অল্প বয়সী মেয়েটার ওপর তার একটা এক্সট্রা মায়াও আছে, তাই তো চিত্রবাহন মনে মনে বিরক্ত হয়। দিদিদের এই বেহুদা উৎপাত কবে যে বন্ধ হবে কে জানে! চার বোনের এক ভাই সে। বাবা বেঁচে থাকতে তারা প্রায় সময় বাপের বাড়িতেই পড়ে থাকত বাচ্চা-কাচ্চাসহ। ভাড়ার ঘর থেকে শুরু করে ফলের বাগান পর্যন্ত সব জায়গায় তাদের এবং তাদের বাচ্চাদের দস্যিপনা চলত। সারাদিন যে এতো খেতে পারত কি করে! এর মধ্য থেকে মা লুকিয়ে চুরিয়ে কখনো ধমকি ধামকি দিয়ে ফলটা মিষ্টিটা, সন্দেশ বা দই তার জন্য আলাদা করে রেখে দিত। শত হলেও একমাত্র ছেলে বলে কথা!

মা মাঝে মাঝে তার পাতে এটা ওটা তুলে দিতে দিতে তার ক্যালকেশিয়ান বত্মীয়দের টোনে বলত, ‘এই হা-ঘরেদের জন্য তো কিছুই রাখার জো নেই। একে তো বিয়ের সময় কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালতে হইছে, তার পরে বিয়ের পরও নানা ছুতোয় বাপের বাড়ি এসে ওঠা। আরে বাবা বাপের সম্পত্তিতে যদি এরা ভাগও পেত তাহলেও কি এতো সোনা, এতো টাকা, জিনিস পত্তর পেত! বাপের আর কতটুকুই বা আছে! চার মেয়েরে বিয়ে দিতে গিয়ে জায়গা জমি বেচে, ধার দেনায় লোকটার জীবনটাই তো ছারখার হয়ে গেল’।
তবে এতো কিছুর পরও বাবা একমাত্র ছেলের জন্য একটু সম্পত্তি যে কত কষ্টে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে সে কথা এক বাবাই জানত। তবে চিত্রবাহনকে সে জন্য ঠেকে থাকতে হয় নাই। ভগবানের করুণায় তার টাকা পয়সার অভাব নাই এখন। সে ব্যবসায় ঝোপ বুঝে কোপ মারতে জানে। নির্বাচনের সময় সে এমপির নির্বাচনী ক্যাম্পেইন করেছিল চুটিয়ে তাই সে চাল-ডাল-আটার ডিলারশিপ সহ ওএমএসের লাইসেন্স পেয়ে যায়। এই ক’বছরে টাকা পয়সাও জমিয়েছে বেশ। সে একখানা সম্পত্তিও কিনেছে তবে সেখানে এখনো সরাসরি দখল নেয় নাই। একদল ভাড়াটে তুলে দিয়েছে গোপনে তাদের কাছ থেকে ভাড়াটা নিয়ে নেয়। চিত্রবাহন সব সময়ই হিসেব কষে চলেছে, কিন্তু আবারো বিপত্তি বাধিয়েছে মা। মরার পর প্রায় প্রতি রাত্তিরেই এসে বসে তার সামনে। শীতের প্রকোপে চিত্রর অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসতে চায় না। মেঝেতে পাতা মাদুরের তলায় যেন কেউ বরফের চাকতি রেখে দিয়েছে, সেখান থেকে আলপিনের খোঁচা দেয়ার মতো শীত খোচা মারে কিছুক্ষণ পর পর।
হবিষ্যির সময়ে বিড়ি সিগারেট খেতে কোনো নিষেধ নাই বোধ হয়। ঠাকুর মশায় যেমন বলেন নাই, তেমন চিত্রও জিজ্ঞেস করে নাই। শেষে আবার বলে বসে নিষেধ আছে! কে যায় ওই সব ঝামেলায়। সিগারেট যেমন তেমন গাঁজায় দিনে একবার টান না দিলে তার ঘুম আসে না। শীত যখন কিছুতেই বাধ মানতে চায় না তখন গাঁজা পোরা সিগারেটে টান দেয় চিত্র। আহ্ গাজার ধোঁয়ায় গোটা পৃথিবীটা যেন দোলা দিয়ে যায় চোখের সামনে।
ভোর রাতের দিকে যখন ঘুমটা আসে জাকিয়ে তখন মা এসে বসে তার বিছানার পাশে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আহারে আমার বাছার কত কষ্ট’! সেই দীর্ঘশ্বাসের শীতল বাতাস তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়। সে বিরক্ত হয়, না বলে আর পারে না, এতো কষ্টই যখন বোঝো তখন এই কনকনে শীতে আমাকে ছেড়ে গেলে কি করে!

মা হাসেন। বলেন, যাওয়া-আসা কি আমার হাতে আছে! তারপর স্বগোতক্তির মতো বলেন, যখন যার সময় হবে!

তুমি তো বেশ ভালই আছো মনে হচ্ছে মা। শীত-টিত কিছু নাই। একটা শালও তো গায়ে জড়াও নাই।

কী যে বলিস বাপ! আর ভালো থাকা! ঝুলে আছি আরকি। শ্রাদ্ধ শান্তিটা ভালো করে না হওয়া পর্যন্ত ভালো থাকি কি করে বল! তা হ্যারে বাপ, শ্রাদ্ধে খাওয়া-দাওয়ার কি ব্যবস্থা করলি বল দেখি!

কেন ওই সবাই যা খাওয়ায় বেগুন ভাজা, লাবড়া, রুই মাছ ভাজা আর মুগের ডালের সাথে সবজি মিশিয়ে ঘ্যাট। শেষ পাতে একটু দই।

ব্যাস্ হয়ে গেল!

কেন মা, এ তো অনেক।

চিত্র তুই তোর মা’র জন্য এই করবি! কিপটে ছেলে আমার। সব ব্যপারে তো কিপটেমি করেই গেলি, তাই বলে মায়ের ব্যপারেও!
কেন মা, কি এমন কিপটামি করলাম বলতো?

হা ভগবান, এই ছেলে পেটে ধরছিলাম! আমি কি খেতে ভালোবাসতাম তাও জানে না!
জানি মা, কিন্তু ওসব কি আর শ্রাদ্ধে দেয়া যায়! আমারে কি রাজা-বাদশা পাইছো? এমনিতে তো দল-বেদল, জাত-বেজাত মিলিয়ে চার-পাঁচশো লোক নিমন্ত্রণ করছি। এক ডেকরেটর ওয়ালারাই বাড়ির উঠোনে প্যান্ডেল করা চেয়ার-টেবিল, থালা-বাসন সবকিছু মিলাইয়া চাইয়া বসছে পঞ্চাশ হাজার টাকা। তার ওপরে যদি খাওয়ায় এতো খরচ করি।

তাই বইল্যা তুই ভিক্ষুকের খাওয়া খাওয়াবি!
শোন বাপ, আমি রুইমাছ দুই চক্ষে দেখতে পারতাম না, তুই খাওয়াবি ভেটকি মাছ। পাবদা মাছ পছন্দ ছিল তা তোরে খাওয়াইতে বলতেছি না, তা বলে মাংস খাওয়াবি না! মা এবার আয়েশ করে বসে মুখের মধ্যে কিছু একটা চিবাইতে চিবাইতে বলল, মাংস খাইতে কত পছন্দ করতাম! তোর বাপ চইল্যা যাওয়ার পর আর ওইসব ছুইয়াও দেখি নাই। কতকালের উপোস, তা এখন মরার পর উৎসগ্গ করবি তাও ওই ঘ্যাট-ঘোট! তা হবে না বাপু। মা রাগ করে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
চিত্রবাহনের মনে তখন অন্য চিন্তা, মা এতো আয়েশ করে কি চিবাইতেছে? পান তো মনে হলো না, মরার পর কি তাইলে চুইংগাম খাওয়া ধরছে!

ছেলে কোনো সাড়া শব্দ করতেছে না দেখে মা আবার বলল, কিরে চিত্র কি ভাবতেছিস?
কিছু না মা।

যাই ভাবোস বাপ, খাওয়া-খাদ্যটা আমার ইচ্ছা মতোন দিস।
চিত্র তখন মনে মনে ভাবে, মা কি তার টাকা-পয়সার হিসাব সব জানতো? কিন্তু তা কেমন করে হয়! সে তো মাকে তার সব রকম আয়ের উৎস সম্পর্কে কখনো জানতে দেয় নাই! এমনকি তার বৌ সুলেখা যে তার সর্বক্ষণের সঙ্গী তাকেও তো কোনো দুর্বল মুহূর্তেও তার টাকার উৎস জানায় নাই। কিন্তু মা কেন এইভাবে আবদার করতেছে, মা তো অবিবেচক না!

সে যে চাকরির তদবির করে এমপির কাছ থেকে ঘুসের টাকার একটা হিস্যা পায় সে কথা তো মাকে কখনো বলে নাই! এলাকায় যতো চাকরি প্রার্থী তার একটা অংশ তার কাছে এসে ভীড় করে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, পুলিশের সেপাই বা হাসপাতালের আয়া থেকে ফ্যামিলি প্লানিংএর মাঠকর্মী বা যুব উন্নয়নের নাইট গার্ড যখন যে চাকরির সার্কুলার হয় সব এসে ভীড় করে তার কাছে। যোগ্যতায় আজকাল সরকারি চাকরি হয় না, চাই তদবির, তার চাইতে বেশি ঘুস। তো সেই ঘুস সংশ্লিষ্ঠ তদবিরের দায়িত্ব আবার ভাগ ভাগ করা আছে, তাদের কমিউনিটির লোকেরাই শুধু তার কাছে আসে। টাকা-পয়সায় একটা দফা-রফা হলে চাকরি নিশ্চিত। মা কি জানতো এদের চাকরি পাইয়ে দেয়ার বদলে সে ঘুসের টাকার একটা হিস্যা পায়! লবিইস্ট হিসেবে তার হিস্যা ক্ষুদ্র তারপরও তো সে ফুলে ফেপে উঠেছে সেই টাকায়। তার জাত গোত্রের লোকেরা তো এক্ষেত্রে তাকেই বিশ্বাস করত। টাকা গেলেও যেন চাকরিটা নিশ্চিত হয় সেই চিন্তা সবার মধ্যে। টাকাটা খোয়া গেল, ওদিকে চাকরিটাও হলো না এমন অনিশ্চয়তা তার বেলায় ছিল না। যদিও বাইরে থেকে তাকে দেখলে কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পাবে না যে তার টাকা আছে। সে একটা ভেক ধরে থাকার চেষ্টা করে। তবে মা সবটা না জানলেও ছেলের যে টাকা আছে এটা বুঝত। এখানে সেখানে জায়গা জমি কিনতে বলত। চিত্র যখন সেবার চৌধুরীদের বাড়িটা গোপনে কিনে নেয়- মা খুশি হয়েছিল। কেউ না জানলেও মাকে সে জমি কেনার বিষয়টা জানিয়েছিল। চৌধুরীদের পোতায় একটা পুরনো ভাঙ্গা দালান পড়েছিল। মা বলেছিল, ওটা ভেঙ্গে একটা বড় বাড়ি কর। কিন্তু চিত্র রাজি হয় নাই। বাড়ি করতে গেলেই সবাই যেমন জেনে ফেলবে তা ছাড়াও জমি কেনাটা তার কাছে ইনভেস্টমেন্ট। দিনে দিনে দাম বাড়বে বেচে দিলেই ফের টাকা হাতে চলে আসবে। বাড়ি করার হাঙ্গামায় কেন যাবে, তাকে কি ভুতে পেয়েছে! সে একটা এক্সিট রাখতে চায়। সব সময় তার মাথায় একটা সেকেন্ড হোমের চিন্তা ঘুরপাক খায়। এখানে সে টিনের ঘরে থাকে এই বেশ আছে। চৌধুরীরা চলে যাওয়ার সময় জমিটা জলের দরে পেয়েছিল কিনেছে। আবার কখনো মালদার পার্টি পেলে বেচে দেবে এখানে শিকড় গেড়ে বসার কিছু নাই। যে কোনো সময় যদি দেখে ঘোর বিপদ উপস্থিত সে সেখানে পাড়ি জমাবে। রজিনীতিবিদ থেকে আমলা তাবত বড় বড় দুর্নীতিবাজের সেকেন্ড হোম থাকলে দোষ নাই, শুধু তাদের বেলাতেই যত দোষ। এতো দেশের টাকা, দেশের টাকা বলে হাহুতাশ লোকের। দেশের টাকা দেশে থাকতেছে কই। হাজার হাজার কোটি টাকা ডানা গজিয়ে উড়াল দিচ্ছে না!

মা আবার এসে চিন্তার মাঝখানে বাগরা দেয়। উড়াল দিতে চাস বাপ?
মনটা সবসময় কেন পালাই পালাই করে মা? ভিতরে কি যেন একটা নাই নাই ভাব হয় কেন?
এই সব রাজনীতির দোষ। এই পৃথিবীটা যে পচে গেল সব তো ওই রাজনীতির কুটচালে।
মা লেখাপড়া কম জানলেও এটা খুব ভালো জানে। তাই মায়ের কথা ফেলে দেয়া যায় না। এই তো সেদিন দেখলাম। ওই যে ল্যাংড়া ভিক্ষুকটা রাস্তায় ভিক্ষা করে, ঘরে ফেরার সময় তার দানে পাওয়া হুইল চেয়ারটা ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে পরমা। টুপি পরা ভিক্ষুক মোজাম্মেল এনজিওতে চাকরি করা পরমা বসুর সাথে হাত নাচায়ে নাচায়ে গল্প করতে করতে যাইতেছে। কই ওই যাওয়ার মধ্যে তো শুধুমাত্র মানবিক সম্পর্ক ছাড়া কোনো ধর্মের ভেদরেখা টানা ছিল না! পরমা বা মোজাম্মেল কেউ তখন হিন্দু মুসলমান না, দুজনই মানুষ। অথচ এইসব সম্পর্কের মধ্যে যত ভেদ-ভাও করে রাজনীতি। নোংরা রাজনীতি দেশে দেশে ধর্ম নিয়া খেলে। ধর্ম তাদের যুতসই হাতিয়ার হয়।

চিত্র সারাদিন ব্যাস্ত থাকে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে আর রাত গভীর হলেই আবার সেই মা। গত দু’রাত হলো আসছে বসছে কিন্তু কিছু বলছে না। সারাক্ষণ অভিমানী বালিকার মতো গাল ফুলিয়ে বসে থাকছে।

ইদানিং গাঁজাতেও আর নেশা হয় না। শালা গাঁজাতে ভেজাল মেশায় কিনা কে জানে! নেশার আরো অনেক জিনিশ আছে, কিন্তু সে এগুলা কেন খাবে! তার দুঃখটা কি! বলতে গেলে সে একজন সুখী মানুষ। সুখী মানুষেরা রাম খায়, হুইস্কি খায়, গাঁজা-ভাঙ খায় না। কিন্তু চিত্র তার কলেজ বেলার নেশা ছাড়তে পারে না। এইটা সে শখেই খায়, মহাদেব শীবও তো খাইত।
তৃতীয় রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখে মা আবার তেমন চুপ-চাপ বসে আছে, মুখটা খুব বেশি ফ্যাকাশে আর মলিন দেখাচ্ছে। চিত্র বলল, আচ্ছা মা, তোমার কি হইছে বলতো? জীবিত থাকতে তো তুমি আমারে জ্বালাতন করতা না, মরার পর হলো কি! আমি তোমারে যত জ্বালাইছি তার শোধ নিতেছো?

এরে তুই জ্বালাতন বলতেছিস? তোর আছে তাই তোরে দিতে বলতেছি। মরার পর এই একটা সুবিধা হইছে বুঝলি, যার যা গোপন ব্যাপার আছে সব জাইনা ফালাইতেছি।

এতো কিছু জানতেছ আর কেন তোমার শ্রাদ্ধে তোমার পছন্দের খাবারগুলা খাওয়াইতে পারতেছি না সেইটা জানতেছ না!

জানছি বাপ। খাওয়াবি তো সব আপনজনদের, দেশ-গেরামের মানুষইতো সব, তা একটু ভালো খাওয়াইলে দোষ কি!

দোষ তো ওইখানেই মা। সবাই যে ট্যাকের খবর জাইনা যাবে। তখন কি আর আমি ধান্দাবাজ-চাঁদাবাজদের হাত থাইকা রেহাই পাব!

তুইওতো ধান্দাই করস বাপ। ধান্দায় ধান্দায় কাটাকাটি। তার চেয়ে বরং এসব কাজ ছাইড়ে দে বাপ। তোর চিন্তায় মনটা বড় উতলা হয় রে।

অবস্থা এমন হয়েছে যতই দিন যাচ্ছে মা তার পিছু ছাড়ছে না। তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছে। চিত্র এক সময় না পেরে স্ত্রী সুলেখাকে জানায় বিষয়টা। সুলেখা বেশ বুদ্ধিমতি মেয়ে বলেই জানত চিত্র কিন্তু সেও এক্ষেত্রে কোনো ভালো পরামর্শ দিতে পারল না। সে বলল, মা যখন চাইতেছে তখন খাওয়াও না।

কি বুদ্ধি তোমার! এতো লোকরে ওইসব খাওয়াতে গেলে দুই লাখ টাকা নাইমা যাবে।

গেলে যাবে। মা যখন বলতেছেন তুমি মাইনা নাও না। শোন, যদি না মানো, তাহলে যদি উনি ব্রহ্মদত্যি হয়ে ঘাড়ে চেপে বসেন!

চিত্র মনে মনে ভাবে মা ব্রহ্মদত্যি হলে তাকে সামলানো যাবে কিন্তু বাইরের লোক, তাদের সামলাবে কি করে!

আজ রাত্রে মা আসলে তার সাথে এর একটা হেস্ত ন্যাস্ত করতে হবে। মাকে বুঝিয়ে বললে মা বুঝবে না? আর যদি না বুঝতে চায় তো মোক্ষম ঘা-টা দিতে হবে।

রাত গভীর হয়। ভোর রাতের দিকে শীত তার সর্ব শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে চিত্রর ওপর। ঘরের পাশের আমগাছটাতে একটা হুতোম প্যাঁচা থ-থ করে ডেকে যাচ্ছে। ওর ডাকের মধ্যে কেমন একটা গা ছম ছম করা ব্যপার আছে। চিত্রর বুকের ভেতরটা কেমন হুহু করে ওঠে। সে এপাশ ওপাশ করে কিন্তু মা আসে না। মা কি তাহলে তার সমস্যাটা বুঝতে পেরেছে, না কি রাগ করেছে তার ওপর!

এমন সময় মায়ের গলা ভেসে এলো, রাগ কেন করব বাপ, তোর মোক্ষম ঘায়ের অপেক্ষায় আছি।

মা, কথাটা আমি ঠিক ওইভাবে বলতে চাই নাই। তুমি যদি আমারে এতো চাপ দাও তাইলে করার তো আর কিছু নাই। তুমি মা, তোমার কথা ফেলি কি কইরা। তাই ভাবতেছি তোমার শ্রাদ্ধশান্তিটা কইরাই দেশ ছাইড়া চইলা যাব।

কেন? তুই কিছু আজাইরা টাকা কামাইছো, এইটা বৈধ করার জন্য দ্যাশ ছাড়বি! এ তোর বাপ-দাদার ভিটা। তার চাইতে বরং তুই ওই ধান্দাবাজি ছাড়। দ্যাশ তোরে কি দেয় নাই! দ্যাশ তো খালি কতগুলা প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর সমষ্টি না, দ্যাশ দ্যাশ হয় তো এর মানুষ নিয়া, তাদের সাথে আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব কত ভালো-মন্দ স্মৃতি। এরে ছাড়বি ক্যান? এরে তুই ভালোবাসস না?

এই ভালোবাসা-টাসার কথা উঠলে চিত্র একটু চিন্তায় পড়ে যায়। কাকে বলে ভালোবাস! আর সেটা আসেই বা কোথা থেকে? দেশ নিয়ে তেমন কোনো বিপাকে না পড়লে এই যেমন দেশভাগ, দেশান্তর বা যুদ্ধ নিদেন পক্ষে প্রবাসকাল এইসবের মুখোমুখি না পড়লে এসব অনুভূতি তো তার মাথাতেই আসার কথা না। তারপরও বলল, সে কথা যদি ধরো তো- ভালোবাসি মা। কিন্তু এই কথা বিশ্বাস করবে কে! চাকরির দালালি করছি, পয়সা নিছি। পয়সা আমি খাই না কে খায় সেই কথা কেউ বিচার বিবেচনা করে না। সবাই তো ভুল বোঝে। সেই ভুলের বোঝা দিনে দিনে পহাড়ের মতো চাইপা বসতেছে আমার ওপর। ভয় বড় বেশি ভয় পাই এখন দেশটারে।

তাইলে তো বলব ভয়ে ভয়েও কাটা-কাটি, কাউরে কোনো দোষ দ্যাওন যায় না। তুই যদি অবিশ্বাস কর বাপ, তরে বিশ্বাস করব কে! তুই বরং বাপ সব ছাইড়া দে, দেখবি ভয়, অবিশ্বাস, ভুল বেঝিাবুঝি কিচ্ছু থাকবে না।

মা একটা হাই তোলেন, তাকে বেশ ক্লান্ত আর বিষন্ন লাগছে আজ। এরপর একটু যেন আড়মোড়া ভেঙ্গে বলেন, তুই যদি সব ছাড়তে পারতিস আমার এভাবে দুশ্চিন্তা নিয়ে ঝুলে থাকতে হইত না, শান্তিতে ওপরে যাইতে পারতাম। কি বাপ, যা বলতেছি করতে পারবি না?

একই কথা বার বার! বিরক্তিতে চিত্রর ঘুম ভেঙ্গে যায়, বরং বলা যায় ঘুমটা সে ইচ্ছে করে ভেঙ্গে ফেলে। সেই রাত পাখিটা এখনো ডেকে যাচ্ছে একটানা থ-থ-থ। ওপাশে বিছানায় সুলেখা দিব্যি ঘুমিয়ে আছে। মহিলাদের কি শীত কম নাকি কে জানে! সে একবার ভাবে সুলেখাকে ডেকে তুলবে, পরক্ষণে আবার সিদ্ধান্ত পালটায়। এই রাত্রি দ্বিপ্রহরে ঘরের মধ্যে কেউ জেগে নেই, আর জেগে থাকলেই বা কি! সব কিছু যে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে এমন দিব্যি তো কেউ দেয় নাই! কে কোন নিয়মটা সম্পূর্ণ মানে! সুলেখা শিপ্রার মতো হট না হতে পারে, তবে একটা কাপড়ের পুটলি হিসেবে মন্দ না। তার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়া যাক।
এই ভেবে সব রকম সংস্কারকে পায়ে দলে ধীরে ধীরে লেপটা নিয়ে বিছানায় উঠে শোয় চিত্রবাহন। মনে মনে ভাবে এই বিষয়টা তো এতাদিন তার মাথাতেই আসে নাই, ঘুমটা আরামসে দিতে পারলে মৃত মায়ের কি সাধ্য তার সাথে নীতিকথা বলতে আসে!

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত