রিকশায় প্যাডেল মারতে মারতে আনমনে পেছনে বসা লোক দুইটার কথা শুনে যাচ্ছিলো শহরের হাজার হাজার রিকশাওয়ালাদের একজন শহিদ আলী। এই শহরের রিকশা আর রিকশাওয়ালারাই বুঝি সব থেকে বেশি কথা, ব্যথা, হাসি আর মধুর স্মৃতির সাক্ষী হয়ে থাকে। যে রিকশায় বসে দুইজনের মধ্যে প্রেমালাপ হয় সেই রিকশায় বসেই আবার কতজনের খুনের পরিকল্পনা তৈরি হয়। ভাবলেই কেমন লাগে! একই সাথে কত কত অভিজ্ঞতায় পূর্ণ এই রিকশাগুলো। প্রেমিক-প্রেমিকাদের ছোট ছোট ভারী কথাগুলোও শুনতে পায় শহিদ। আবার কোন কোন দিন শোনে বেশি খাওয়ার কারণে পেটের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে কেউ। তার গোঙানি শুনে আফসোস ও রাগ হয় তার। একবার হয়তো তার ইচ্ছা করে যে বলেই দিবে, লোকটা যেন নেমে যায় তার রিকশা থেকে।
“ভাই কইছে, ভালো দেইখা ইলশা নিতে। কিন্তু বাজারের যে অবস্থারে। বড় ইলশা পাওয়াই যায় কিনা।”
“ আরে পাওয়া যাইব। ভাইয়ের কথা কইলে ভয়েই বড় বড় ইলশা বাইর কইরা দিব দেখিস।”— এতক্ষণ ধরে নানান আলাপের মধ্যে এই কথাগুলো শুনে শহিদ আলীর খানিকটা আগ্রহ জাগে। তার ছোট মেয়েটা সকালেই বলেছে কালকে বৈশাখের পয়লা দিন। পান্তা দিয়া ইলিশ খাবে সবাই। তারও কি আনন্দ! ভেবেই রেখেছে তার বাবাও ইলিশ মাছ আনবে। কতদিন বাড়িতে ইলিশ যায় না। আয়ের যে অবস্থা তার উপরে ইলিশ মাছের আবার দাম নাকি হঠাৎ করে গেছে বেড়ে।
“ মাছ নাকি ইন্ডিয়া গেছে হুনলাম।”— দুইজনের মধ্য থেকে একজন বলল।
” হ। তয় আমরা মনে হয় বেশি দেরি কইরা ফালাইছি রে। ইলশা বাজারে পামু কি না আল্লায় জানে। এ জোরে চালারে একটু”—আগের প্রশ্নের ব্যাপারে কোন আগ্রহই দেখায় না সে।
শহিদ আলীর রিকশার গতি বাড়াতে হয়। বাজারে পৌঁছালে দুইজনের একজন জোরে হাঁক দিয়ে ইলিশ বেঁচা বন্ধ করে দেয়।
“ভাই পাঠাইছে— ইলশা সব ভাইয়ের বাসায় যাইব। মাছ সবগুলা প্যাকেট কর। তিরিশ চল্লিশ কেজি যা হয় সব দিবি।”
“ অত মাছ তো বাজারেই নাই ভাই”— বাজার করতে আসা একজন পাশ থেকে বলে ওঠে।
“ এই তোরে কইতে কইছি কিছু? তোরে কইছি?”— রেগে ওঠে দুইজনের একজন।
লোকটি কিছুটা ভয় পায়। আর কিছু না বলে পিছনে সরে গিয়ে একসময় মানুষের আড়াল হয়ে যায়।
এতক্ষণ শহিদ আলী পাশে থেকে দেখতেছিল সবকিছু। তার নজর একটা চকচকে ইলিশের উপর পড়ে। কি সুন্দর চিকচিক করতেছে। সেইদিন রাস্তার পাশে এক কবিরাজ অষ্টধাতুর আংটি বেঁচতে এসে পারদ দেখাইছিল। মনে হইতেছে সেই পারদ দিয়া ঘষে ঘষে চিকচিক করে ফেলছে মাছটারে। পকেট থেকে টাকা বের করে একবার গুনে দেখলো শহিদ। মনে মনে ভাবলো কেনাই তো যায়।
“চারইশো টাকা কইরাই তো বেঁচতেছে”— বিড়বিড় করে বলল শহিদ।
এতক্ষণে ওই দুইজনের মাছ প্যাকেট হয়ে গেল। চল্লিশ কেজি ইলিশ মাছ আসলেই বাজারে নাই। কিছু জাটকা মাছ মিলিয়ে চল্লিশ কেজি বানিয়ে দিল মাছওয়ালারা। দাম দিল দুইশ করে কেজি। মাছওয়ালারা তখন একটা কথাও বললো না। মাছ নিয়ে ঐ দুইজন চলে যাওয়ার পর কোন এক অদ্ভুত জাদুমন্ত্রবলে ব্যাপারীরা কিছু মাছ বের করে আনলো গোপন ঘর থেকে। কি ভেবে যে এরা মাছ লুকিয়ে রাখে আল্লাই ভালো জানে। শহিদ আগের দেখা মাছের মতই একটার দিকে এগিয়ে গিয়ে আঙুল দিয়ে টিপে দেখলো। বরফের মধ্যে থাকতে থাকতে ঠান্ডায় শক্ত হয়ে গেছে মাছটা।
“ এইডা কত?”
“ বারশো।” মাছের দিকে না তাকিয়েই উত্তর দেয় মাছওয়ালা।
“কী! কেবলই না দুইশো কইরা দিলেন ওনাগরে”
“ ওনারা কি আপনে? একহাজারে নিলে নেন না নিলে না নেন। বেশি মাছ নাই। বেশি কতাও কওয়া পারমু না।”
শহিদ আর কিছু বললো না। পাশের মাছওয়ালাদের কাছে যেয়েও শুনলো বারশোর নিচে কোন মাছ নাই।
“দুই হালা আইসা বাজারের সব মাছ নিয়া গেছে কম দামে। হেই ফিল তুলতাইছে আমগের উপর। হালারপুত হালারা।”— পাশে থেকে একজন জোরেই বলে উঠলো।
বেশ খানিক্ষণ ঘুরেও এক হাজারের নিচে কোন জাটকার পোনাও পেলো না শহিদ আলী। পাশে একটা বড় সিলভার কার্প দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল সে সেটার দিকে। সেই ইলিশটার মত চকচক করতেছে এই মাছটা। কাছে গিয়ে শহিদ খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকলো মাছটার দিকে। শেষে এই মাছটাই কিনে বাড়িতে চলে আসলো সে।
সকাল বেলা সিলভার কার্প মাছের ভাজা খান্ডা দিয়ে শহিদ পান্তা খেয়েছে। পাশে বসে খেয়েছে তার ছোট মেয়েটাও। কয়েকবার করে সে নিজের পাতের মাছ তুলে দিচ্ছিল মেয়েটাকে। মেয়েটা যে কি আনন্দ করেই মাছ আর পান্তা খাচ্ছিলো সেটা দেখে শহিদ আলী আর তার বউ এক দৃষ্টিতে খাওয়া শেষ হওয়া অবধি তাকিয়ে থাকলো। খাওয়া শেষ করে বাইরে গিয়ে বসে একটু জিরাচ্ছিল শহিদ আলী। এই সময় একটু বাতাসও নাই। সকাল সকাল গরমের তাত দেখানো শুরু করছে কেবল। শহিদ আলী দেখলো পাশের বাড়ি থেকে ছেলে-মেয়েগুলো খেলতে আসছে। বৈশাখ আসার আনন্দ ছোটদের মাঝে যেভাবে জোয়ারের ঢেউয়ের মত আসে বড় হতে হতে একদিন তা কেমন যেন ভাটায় পরিণত হয়ে যায়। আসলে শুধু বৈশাখই না, প্রায় সব ব্যাপারেই এমন। পুতুল খেলার একপর্যায়ে আলাপ উঠলো আজকের পান্তা-ইলিশ খাবার নিয়ে। শহিদের ছোট মেয়েটা উচ্ছ্বাসের সাথে সবার আগে বলে উঠলো—
” আইজক্যা আমি ইলশা মাছের পেটি দিয়া পান্তা খাইছি।” বলেই কি এক অভূতপূর্ব আনন্দে হেসে উঠলো মেয়েটি। দূর থেকে দৃশ্যটি দেখেই দাঁড়িয়ে গেল শহিদ। ঘাড়ে ঘামছাটা দিয়ে রিকশা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল সে।