মকবুল মিয়াকে আমি ঠিক প্রথম কবে দেখি তা আর এখন মনে করতে পারি না। হতে পারে বছর খানেক আগে। অথবা তারও আগের কোন একদিন।
এই মফস্বলে প্রতিদিন হাজার মানুষ দেখি। তাদের ভাবলেশহীন মুখগুলো এই দেশের আর সব মানুষের মতই। সেখানে নতুনত্ব কম। পোশাকের ধুলো ময়লা ঝেড়ে প্রায় সভ্যতার খোলস পড়ে নাগরিক হয়ে ওঠা আমার চোখে এইসব মানুষগুলোকে দেখে একটু মায়া মায়া জেগে উঠতে চায়। মকবুল মিয়া এদেরই একজন হবে হয়ত। সে মনের ফ্রেমে বন্দি হয়ে থাকার মতন কোন খোয়াবি চরিত্র না।
তবুও মানুষটা একসময় কি করে যেন আমাকে তার নামটা স্মরণ রাখতে প্রায় বাধ্য করে। পর পর কয়েকদিন অফিসে আমার সামনে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকলে আমি তাঁর দিকে কিছুটা মনোযোগ দিতে বাধ্য হই। লোকটার হাতে মনে হয় সবসময় একটা ছাতা থাকে। পায়ে খড়ম। কাঠের তৈরি বিশেষ ধরণের এই পাদুকার প্রায় জাদুঘরে ঠাই পাবার জোগাড়। বুঝতে পারি, মকবুল এই ঐতিহ্যটিকে বেশ যত্নে জিইয়ে রেখেছে। অথবা তার ভীষণ অভাব অনেকদিন কোন জুতোর দোকানে পায়ের মাপ দেবার সুযোগ দেয় নি! আমার ভয় হতে থাকে, কখনও মেলতে গেলে হয়ত ছাতার ডাটিগুলো আলাদা হয়ে খুলে খুলে ঝুপঝুপ খসে যেতে পারে। অথবা ওর ভেতর থেকে লাফিয়ে নামতে পারে একটা নাদুসনুদুস ধেড়ে ইঁদুর।
এর ভেতর একদিন বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে মকবুল নাতি দীর্ঘ একটা ইতিহাস বলার জোগাড় করে। তার দাদাবাড়ি ছিল কোঁচবিহার। সীমানার ওপারে দিনহাটা গ্রাম। ৪৭-এর পর এপারে ঠাঁই মিলেছে। আমার এতো ইতিহাস শোনার মতন সময় নেই। আমি ব্যস্ততা দেখাই। মকবুলকে পরে আসতে বলি। লোকটা একটু মাথা নিচু করে থাকে কিছুক্ষণ। এরপর উঠে যায়। দুদিন পর আবার আসে।
তার নামটা ইতোমধ্যে আমি ভুলে গেছি।
ভুলে যাওয়াই উচিত।
আগেই বলেছি মকবুল মিয়ার কোন ঐতিহাসিক বা নৃতাত্ত্বিক অথবা আর্থসামাজিক মূল্য আমার কাছে নেই। আমি স্বভাবমতো আবার তার নাম জানতে চাইলে সে দেশভাগের গোড়া থেকে শুরু করে। আমি আবার অধৈর্য হয়ে তাঁকে থামতে বলি এবং পরে যেকোনো দিন আসতে বলি। মকবুল মাথা নিচু করে চলে যায়। এবং তার দুই অথবা চারদিন পর আবার আসে।
এইভাবে অনেক কয়েকবার, অথবা অনেক কয়েকমাস পূণঃ পূণঃ আমার সামনে এসে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকলে বোধহয় একসময় লোকটা আমার মনোযোগ আকর্ষণ করবার মতো যথেষ্ট উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে। আমি পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকাই। তখন মনে পড়ে এই লোকটার গাঁয়ের মলিন সবুজ রঙের কুঁচকানো পাঞ্জাবিটাই আমি আগে একবার অথবা বহুবার দেখেছি। তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি বুঝি আগের থেকে একটু লম্বা আর অসংলগ্ন হয়ে বেড়ে উঠেছে বেয়ারারকম।
উমবারতো এঁকো নামের একজন অতিবিখ্যাত দার্শনিকের সৌন্দর্য বিষয়ক কোন এক তত্ত্ব নাকি বোঝায় যে সৌন্দর্য কোন বিশেষ গুণ নয়। বরং সম্পর্কের ফলাফল। মকবুল মিয়ার পূণঃ পূণঃ আগমন ও উপস্থিতিতে আমি বোধ হয় এইরকম একটা সম্পর্কের ভেতর ঢুকে যাই। আমি মকবুলের পায়ের খড়মের ফিতের বিকল্প হিসেবে উঁচু হয়ে থাকা কাঠের বর্তুলাকার অংশটার মসৃণতা দেখে এর কারিগরের প্রশংসা করি মনে মনে। ইট সুরকি মোড়ানো চত্বরে গুটানো ছাতা হাতে তার ঠুকঠুক হেঁটে চলা বেশ শৈল্পিক জ্ঞান হয়।
আরও একদিন, আবযাব কথা শেষে অন্যান্য দিনের মতো মকবুল তার কাজের কথা পাড়ে। কাজটা, তার ভাষায়, কঠিন কিছু না। তার বাড়ি ভিটের এক চিলতে জমি। জমিটুকু তারই অন্য একজন ভাই বা চাচা বা জ্ঞাতি গোপনে বেদখল করতে চায়। মকবুল জীবিত বলে কিছু করতে পারছে না এখনও। তার কিছু একটা হলেই জমিটুকু দখলে নেবে। পাঁচ পাঁচটি মেয়ে নিয়ে তার স্ত্রী তখন খুব একটা অসহায় অবস্থায় পড়ে যাবে। এইটুকু বলে মকবুল দম নেয় প্রতিদিন। এরপর কেমন শূন্য দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকায়। আমাকে এখন এই জমিটুকু উদ্ধার করে দিতে হবে। আমি তাঁকে আশ্বাস দেই। মকবুল খুশি হয়। খুশি হয়ে আমার নাম করে কিছু প্রশংসাসূচক বাক্য রচনা করে। আমি পুলকিত হয়ে উঠি মাছের মতন। পিওন ডেকে একটা পান এনে মকবুলকে খাওয়াই। সে খুশি মনে চলে যায়।
দিন কতক পর আবার মকবুলের শীর্ণ ছায়া পড়ে আমার বারান্দায়। তাঁর কাজ হয়নি এখনও। আমি তহশিল অফিসের কথা বলি। সেখানে খোঁজ লাগিয়েছি। খবর এলো বলে। মকবুল খুব একটা সন্তুষ্ট হয় না। সে ব্যাজার মুখে বলে যে স্থানীয় তহশিলদার খুব বদ লোক। জমি বেহাত হবার পেছনে তাঁর যথেষ্ট হাত আছে। তাঁকে দিয়ে কাজটা হবার নয়। তহশিলদার এমন কিছু করলে তবে রে, বটে রে জাতীয় কিছু আগ্রাসী বাক্য উদগীরণ করলে তা শুনে মকবুল আশ্বস্ত হয় এবং চলে যায়। আমিও যথারীতি তাঁর বাড়ি ভিটের কথা ভুলে যাই।
একদিন কালীগঞ্জ থেকে কাকিনা যাবার পথে গাড়ির ড্রাইভার একটা বাড়ির দিকে ইঙ্গিত করে। রাস্তার ধার ঘেঁষে ছোট্ট একটা বাড়ি। দুইটা মোটে ঘর। টিনের চালা আর মোটা শনের বেড়া। এই বাড়িটা নাকি মকবুলের। বলতে ভুলে গেছি, খুব ঘন ঘন অফিসে যাতায়াত করায় আমার এখানে অন্য সবাইও মকবুলকে ভালই চেনে। মকবুলের বাড়ি দেখে আমার এই জমিটার কথা মনে পড়ে। জমিটা অন্য কারুর নামে আছে এখন। যেকোনো দিন সেই অন্য কেউ মকবুলকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিতে পারে। আমার মন একটু বিষণ্ণ মতন হয়। হবেই বা না কেন! এই বিষণ্ণতাটুকু উপভোগ করতে করতে আমি গাড়ির খোলা জানালা গলে আকাশে তাকাই। একটু পরে মাটিতেও চোখ যায়। ধানক্ষেতে কেবল পাক ধরেছে। এবার ফসল বেশ ভালো হয়েছে। খুব দ্রুতই মকবুলের ভিটে আমার চিন্তার স্রোত থেকে হারিয়ে যায়।
এরমধ্যে আরও কিছু দিন সূর্য অস্ত যায় এবং চন্দ্র উদিত হয়। তিস্তার জল কমে হাঁটুর নিচে নেমে যায়। আমিও মকবুলের কথা প্রায় ভুলে গেলে একদিন সে আবার হাজির হয় অসময়ে। তাঁর কাজটা আদৌ হবে কিনা এবিষয়ে সে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করলে আমি ক্ষেপে যাই। বলি যে আমার ওপর ভরসা না থাকলে সে যেন চলে যায়। অন্য কাউকে নালিশ দেয়। মকবুল অবশ্য চলে যায় না একথা শুনে। বরং তাঁর পুরো পরিবার নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়ে জমির দাবী জানানোর ইচ্ছা পোষণ করলে অথবা প্রকারান্তরে হুমকি দিলে আমি একটু ঘাবড়ে যাই। তবে দ্রুতই সামলে উঠি আমি। এইরকম নির্বিষ হুমকি দিয়ে সে আমায় তীব্রভাবে কূপিত করে রাখতে পারেনা দীর্ঘক্ষণ। অতঃপর একসময় তাঁর ক্ষয়ে যাওয়া খড়মের আওয়াজ মিলিয়ে যেতে যেতে আমিও ভুলে যাই তাঁর অস্তিত্ব।
আরও আরও কিছুদিন চলে যায়। মকবুল নামের অতি ক্ষীণ দেহী মানুষটি দীর্ঘদিন আমার সামনে না এলে পরে আমি তাঁর কথা বেমালুম ভুলে যাবার পর একদিন হঠাৎ তাঁর বাড়ির পাশের রাস্তা পেরুবারকালে গাছ ফুল লতা ইত্যাদি প্রাকৃতিক শোভা নজর করবার ফাঁকে নতুন গজিয়ে উঠা একটা ছোট্ট কবর আমার দৃষ্টিকে পলকহীন করে তোলে।
ড্রাইভার বলে- স্যার। মকবুলের কবর।
আমি কিছু বলি না। কবরের শিয়রে আড়াআড়ি পুঁতে রাখা খেজুর গাছের ডাল দুটি অল্প হাওয়ায় দুলতে থাকলে আমি ড্রাইভারকে তাগাদা দেই। গাড়ি ছোটে দ্রুত।
আমার কেবলই মনে হতে থাকে, পেছন থেকে কেউ একজন খড়ম পায়ে খুট খুট শব্দ তুলে এসে বলছে- স্যার- আমার জমিটা!!