ট্রাকের পেছনে সাপের মতো আঁকাবাঁকা লম্বা লাইন দেখে বুক ধড়ফড় করে আলেয়া বেগমের। আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে সে দাঁড়িয়ে পড়ে নাম না জানা একটি গাছের ছায়ায়। দূর থেকে সে স্বগতোক্তি করে— সক্কাল সক্কাল আইলাম, তাও এত্ত ভিড়! হতাশা ঝরে পড়ে তার কণ্ঠে।
এ সময় নাম না জানা গাছটার ডালে একটা কোকিল ডেকে ওঠে। অন্যদিন হলে আলেয়া বেগম কোকিলটাকে খুঁজবার অর্থাৎ দেখবার চেষ্টা করত। আজ ট্রাকের পেছনের দীর্ঘ মানবসারি তাকে ভুলিয়ে দেয়, এখন বসন্ত কাল এবং সময়টা কোকিল ডাকার। জীবন-বসন্তের পাতা শুকিয়ে গেলে অনেক কাক্সিক্ষত এবং প্রিয় জিনিসের দিকে তাকাবার ফুরসত থাকে না মানুষের। আলেয়া বেগম এমন একজন মানুষ, যার জীবন-বসন্তের পাতা অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে। পরক্ষণে মনে পড়ে, শুকাবে কী, আদৌ কি তার জীবনে বসন্ত ছিল কোনো কালে?
কোল ঘেঁষে হর্ন বাজিয়ে একটা ইজিবাইক বেরিয়ে গেলে ঘোর ভাঙে আলেয়া বেগমের। অভ্যস্ত দ্রুততায় মুখে আঁচল চাপা দিয়ে সে গুটিয়ে নেয় নিজেকে নিজের ভেতর। ইজিবাইকে চটের বস্তা হাতে দুজন মহিলাকে দেখে আলেয়া বেগমের মনে হয়, এরাও তার মতোই হতভাগা। অচিরেই টিসিবির কমমূল্যের পণ্য নেয়ার জন্য তাদেরকে এক সারিতে যুদ্ধ করতে হবে ট্রাকের পেছনে।
আদতে আমাদের গল্পের আলেয়া বেগম ইজিবাইকের ওই দুই মহিলার চেয়েও হতভাগা। কারণ, মহিলা দুটোর তবু ইজিবাইকে চড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। আর আলেয়া বেগমকে করিমন্নেসা মহিলা কলেজের মাঠে আসতে হয়েছে দুই কিলোমিটার দূরের পালপাড়া থেকে পায়ে হেঁটে।
ছেলেটা যদি মানুষ হতো, এই দুর্যোগ পোহাতে হতো না আলেয়া বেগমকে। খোদা যাকে পরীক্ষায় ফেলে তাকে সবদিক থেকে নাজেহাল করে ছাড়ে। নয়তো এত ভালো একজন মানুষের এত খারাপ ছেলে কীভাবে হয়!
আল আমিনের কথা ভাবতে ভাবতে ম্রিয়মান চেহারায় এগোতে থাকে আলেয়া বেগম। কত আশা করে ছেলেটার নাম রেখেছিল আল আমিন। মসজিদের ইমাম সাহেবই দিয়েছিল নামটা। আল আমিন মানে বিশ্বস্ত। ইমাম সাহেব বলেছিল, নামের আসর মানুষের ওপর পড়ে। দোয়া করি আপনার ছেলেটা আমাদের নবির মতোই বিশ্বস্ত হয়ে উঠুক। মা দুটো পয়সা বাঁচানোর জন্য ট্রাকের পেছনে দৌড়ায় আর ছেলে গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকে স্টেশনে—এই বুঝি বিশ্বাসীর নমুনা!
চোখেমুখে বিজয়ের আলো নিয়ে উল্টোদিক থেকে আসছে কয়েকজন মহিলা। তাদের চেহারায় শ্রান্তি, বোগলের নিচে ব্লাউজে ঘাম, তবু জোড়া জোড়া চোখ উদ্ভাসিত, আনন্দে। ব্যাগের ভেতর যে উঁকি মারছে হঠাৎ স্বর্ণ হয়ে ওঠা সয়াবিত তেলের বোতলের মাথা!
আলেয়া বেগম লোভী লোভী চোখে তাকায় ওই হলুদাভ তরল পদার্থের দিকে। যেন সোনা গলিয়ে জল বানিয়ে বোতলজাত করা হয়েছে—এমনই অভিব্যক্তি তার তাকানোর ভেতর। ওই তেলের জন্যই তো সংসার ফেলে তার ছুটে আসা এই জাহান্নামে।
কতদিন ধরে ভাবছে আলেয়া বেগম—সংসারে সয়াবিনের বিকল্প কিছু কি নেই! যেটা হবে সস্তা। আল আমিনের আব্বার সাথে এই নিয়ে আলাপও করেছে সে। বাজারে পাম ওয়েল আছে, সরিষার তেল আছে, খোলা সয়াবিনও পাওয়া যায়। কিন্তু সবগুলোর দামই যে নাগালের বাইরে! কয়েকদিন সে তেল ছাড়াও রান্না করে দেখেছে। ব্যাঙের চামড়ার মতো খসখসে তেলবিহীন তরকারি মুখে রোচেনি একদম।
আলেয়া বেগম মাঝে মাঝে ভাবে, এমন যদি হতো, এক সকালে হঠাৎ তাদের টিউবওয়েল থেকে পানির বদলে সয়াবিন তেল উঠতে শুরু করল! বউয়ের কথা শুনে হো হো করে হেসেছিল আল আমিনের বাপ জহুরুল ইসলাম।
হাসো ক্যান! খোদায় ইসমাইলের পায়ের দাবদাবানিতে যদি জমজমের ঝরনা বাইর করতে পারে, কল দিয়ে তেল বাইর করতে পারব না?
পারব না ক্যান! অবশ্যই পারব। কিন্তু তোমার কল দিয়েই ক্যান তেল বাইর করব খোদায়! তুমি কি কোনো নবির মা? তুমি হইলে গাঞ্জাখোরের মা।
স্বামীর কথায় ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এসেছিল আলেয়া বেগমের চেহারায়। আল আমিন গাঞ্জাখোর—এর দায় কি শুধু তার একার? এরপর দুদিন সে ভালো করে কথাই বলেনি স্বামীর সঙ্গে। অভিমান!
লাইনের দখল নিতে দুজন মধ্যবয়সী মহিলা মারামারির সঙ্গে ঝগড়া করছে শালিকের কিচিরমিচিরের মতোন। তাদের দেখাদেখি হাতাহাতি শুরু হলো অন্যদের ভেতরও। মুহূর্তে কলেজ মাঠের ঘাসবিহীন জায়গাটা ভরে উঠল ধুলোয়। একজনের চিৎকার কানে এল আলেয়া বেগমের— তুই না গেল দিন একবার নিলি। আবার আইজ আইছিস ক্যান! তোর লাগে কত!
আজই প্রথম টিসিবির প্যাকেজ নিতে আসা আলেয়া বেগম বুঝতে পারে, ইতোমধ্যে এরা পরস্পরে পরিচিত হয়ে উঠেছে এই যুদ্ধের সুবাদে। তখন দ্বিতীয় জনের উত্তর শোনা যায়— দাম আরও বাড়ব। এখন বেশি করে না কিনলে সামনে কি তোর চ্যাট খামু?
এ কী মুখের ভাষা! এদের সাথে কীভাবে পেরে উঠবে আলেয়া বেগম। পুলসিরাতের কথা মনে হয় তার। নিজেকে মনে হয় দুনিয়ার সবচেয়ে আসহায় মানুষ। হাতের মুঠোয় ব্যাগটা চেপে ধরে আরেকটু এগিয়ে যখন সে লাইনের এলোমেলো লেজ ছুঁতে যাবে, তখন হঠাৎ মধ্যবিত্তীয় লজ্জার হুল ফুটতে থাকে শরীরে। কেউ যদি দেখে ফেলে!
অভাব আলেয়ার চিরকেলে সঙ্গী। সুস্থ থাকার দিনে স্বামী ছিল একটা বেসরকারি ব্যাংকের কেরানি। রোড এক্সিডেন্টে ডান হাতটা অচল হয়ে গেলে চাকরিটা চলে যায় তার।
ভাগ্যিস সে বছরই একমাত্র মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। পড়শীদের পরামর্শে বাড়ির সামনে চায়ের দোকান খুলে বসেছে জহুরুল। এখন দোকান আর বাড়িই তার পৃথিবী। এই দুটো জায়গার বাইরে অন্য কোথাও সে যায় না বলে সংসারের দায়দায়িত্ব স্বউদ্যোগে উঠে পড়েছে আলেয়ার কাঁধে।
সংসারে তাদের অভাব আছে, তাই বলে টিসিবির মালের জন্য ট্রাকের পেছনে যুদ্ধ করবার মতো অভাব তাদের কোনোকালেই ছিল না। কিন্তু করোনা পরবর্তী সময়ে হঠাৎ সবকিছুর দাম বেড়ে গেলে সয়াবিনের মতো তাদের অভাবটাও লাগামছাড়া হয়ে গেছে। আবার আল আমিনের কথা মনে পড়ে আলেয়ার—ছেলেটা যদি মানুষ হতো!
করিমন্নেসা মহিলা কলেজ মাঠের খবর এক প্রতিবেশী দিয়েছিল আলেয়াকে। কিন্তু এই মাঠে যে চুলোচুলি হয়, সেই খবর দেয়নি প্রতিবেশী। আলেয়ার একবার মনে হয় ফিরে যাবে। পরক্ষণে মনে হয় জয়ী হতে হলে যুদ্ধ করতেই হবে। তাছাড়া এতটা পথ পায়ে হেঁটে এসে ফিরে যাওয়া বোকামি। ফলে সে লম্বা লাইনের লেজে নিজের অধিকার স্বত্ব মজবুত করতে গিয়ে দেখে, একটু সামনে সংকুচিত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফাতেমার শাশুড়ি, মানে তার বেয়াইন।
মুহূর্তে সে দুই পা পিছিয়ে এসে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে, লজ্জা আর সংকোচে তার বুক ধড়ফড় করে। তখন একটা অলক্ষুণে কাক মাথার ওপর দিয়ে কা কা ডেকে উড়ে যায় আর আলেয়া বেগম ভাবে, বেয়াইন তাকে দেখে ফেলেনি তো!
লজ্জা এবং চুলোচুলির এই পরিমণ্ডলে, বিশেষত যেখানে বেয়াইনের মতো নিকটতম আবার দূরতমও, এক আত্মীয় থাকে, সেখানে অবস্থান করতে পারে না আলেয়া। ব্যাগখানা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে অন্ধকার চেহারায় সে ফিরে আসে ঘরে।
সেই রাতে মেয়ের কাছে ফোন করে আলেয়া। উদ্দেশ, ওর শাশুড়ি তাকে করিমন্নেসা মহিলা কলেজ চত্বরে দেখেছে কিনা এবং বাড়িতে গিয়ে এ সংক্রান্ত কোনো গল্প করেছে কি না কৌশলে জেনে নেয়া। কিন্তু ফাতেমা এ বিষয়ক কোনো কথাই বলে না মাকে। এমনকি টিসিবির ট্রাকের পেছনে ছুটবার মতো দারিদ্র্য যে ওদেরকেও গ্রাস করেছে, এই তথ্যটাও বেমালুম চেপে যায় মায়ের কাছে সবকিছু শেয়ার করা ফাতেমা। আলেয়া বেগমের বুকের খচখচানি যায় না। সে টানা কণ্ঠে ‘রাখি’ বলে ফোন রেখে দেয়।
পরের সপ্তায় আবারও টিসিবির ট্রাকের পেছনে দৌড়নোর সময় এলে জহুরুল বলে, আইজ বোরকা পিন্দে মুখ ঢেকেঢুকে যাও।
স্বামীর পরামর্শে মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আলেয়ার। বোরকা পরতে পরতে হঠাৎ তার কী খেয়াল হয়, সে হতাশ ভঙ্গিতে বলে, বোরকা তো ওই একখানই। ঢেকেঢুকে গেলেও যার চিনার, সে ঠিকই চিনে ফেলবে। বলে সে বোরকার ছদ্মবেশ নেয়ার চিন্তা বাদ দেয়।
আজ আর সরাসরি লাইনে প্রবেশ করে না আলেয়া। যুদ্ধের অগ্রবর্তী সৈন্যরা যেভাবে দূর থেকে শত্রু-শিবির পর্যবেক্ষণ করে, আলেয়াও তেমনি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি যাচাই করতে থাকে। তখন সে অবাক হয়ে খেয়াল করে, এই পর্যবেক্ষক দলে সে একা না, তার মতো আরও কয়েকজন মহিলা সসংকোচে দাঁড়িয়ে নিবিড় চোখ রাখছে টিসিবির ট্রাকের ওপর।
এই বিপন্ন মুহূর্তে মহিলাগুলোর প্রতি কোমল আত্মীয়তা অনুভব করে আলেয়া। সে গালভর্তি হাসি নিয়ে হলুদ শাড়ি পরা এক মহিলার দিকে এগিয়ে গেলে হলুদ শাড়িটি বিরক্ত হয়। শামুকের মতো নিজেকে হলুদের ভেতর গুটিয়ে নিয়ে সে তাকিয়ে থাকে পায়ের পাতার দিকে।
সেদিনের সেই কাকটা আজও মাথার ওপর চক্কর কাটে। আর তখন গতদিনের মতোই দুই মহিলা চুলোচুলি শুরু করে ট্রাকের পেছনে। মুহূর্তে ধুলোয় ভরে ওঠে করিমন্নেসা মহিলা কলেজের চত্বর। চুলোচুলি যত তীব্র হয়, ধুলোর আস্তরও ততো গাঢ় হয় আর সেই ধুলোর আস্তরের ভেতর দিয়ে ট্রাকের উল্টোপাশে ফাতেমার শাশুড়িকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আলেয়া বেগমের হৃদকম্পন শুরু হয়।
আলেয়া বেগমের বুঝতে বাকি থাকে না, বেয়াইনও তাকে দেখেছে, এবং সেও দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছে আলেয়াকে। বেয়াইনের হাতে ধরা পড়ার লজ্জায় টিসিবির স্বল্পমূল্যের সয়াবিন তেল আর কেনা হয় না নব্যদরিদ্র আলেয়া বেগমের। ফলে দিনে দিনে তারা তেলবিহীন তরকারিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে থাকে। আবার ফোনের ওপাশে ফাতেমার কণ্ঠ এমন শুষ্ক শোনায়, আলেয়া বেগমের মনে হয়, ওদের তরকারিতেও পড়ছে না সয়াবিনের ফোঁটা। তাইতো এমন রসকষহীন ফাতেমার কণ্ঠস্বর। এবং এই সমস্যা দুটি পরিবারের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না আর। ধীরে ধীরে, ধরা পড়ার এই মধ্যবিত্তীয় লজ্জা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ে পালপাড়া এবং তার আশপাশের অঞ্চলে।
আলেয়া বেগম তেলবিহীন তরকারি রাঁধে আর একটা নতুন বোরকার জন্য আফসোস করে। নতুন একটা বোরকা পেলে বোরকাটা সে গা চাপিয়ে দিব্যি বেয়াইনের নাকের সামনে দিয়ে ঘুরে আসতে পারত।
আফসোসের কথাটা স্বামীর কাছে এক রাতে ভাগাভাগিও করে আলেয়া। জহুরুল শুষ্ক হাসি দিয়ে বলে, শেষে বোরকা বেইচ্যা ত্যাল কিনতে হইব।
একদিন বোরকা-বিষয়ক এক সুসংবাদ ভেসে আসে পালপাড়ার বাতাসে। কানাইখালির মোড়ের এক দোকানদার নাকি ভাড়ায় বোরকা খাটাচ্ছে। ঘণ্টায় বিশ টাকা। মহূর্তে কাচের মার্বেলের মতো চকচক করে ওঠে আলেয়ার চোখ ও মন।
বিশ টাকা ব্যয়ে পরিচয় গোপন করে এখন থেকে অনায়াসে টিসিবির তেল কিনতে পারবে সে। সংবাদটা শোনার পর পরের বুধবারের জন্য সে উন্মুখ হয়ে থাকে। কখন আসবে সেই মহেন্দ্রক্ষণ! যাবার পথে ভাড়ার দোকান থেকে বোরকা চাপিয়ে সে ছুটবে টিসিবির ট্রাকের কাছে আর ফেরার পথে বোরকাটা ফেরত দেবে ভাড়ার দোকানে।
অবশেষে বুধবার এসেই যায় ক্যালেন্ডারে। আলেয়া বেগম পাখিদের মতো উড়তে উড়তে ছুটে যায় কানাইখালির মোড়ে আর তখনই ডানাভাঙা শালিকের মতো ভঙ্গ হয় তার এতদিনের স্বপ্ন।
যে বেয়াইনের কাছে ধরা পড়ার ভয়ে সে এতদিন টিসিবির ট্রাক থেকে দূরে দূরে ছিল, সেই বেয়াইনকে সে ভাড়ার দোকান থেকে নেকাব বাঁধতে বাঁধতে বেরিয়ে আসতে দেখে।
লুকানোর কথা আজ ভুলে যায় আলেয়া বেগম। বাজপড়া তালগাছের মতো মোড়ের ওপর সে আর তার সময় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।
১৫ এপ্রিল, ২০২২।