খেয়ালি একটা মিথ্যা আমাদের জীবনে এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে এখান থেকে পালাবার পথ নেই৷ আমার স্ত্রী জেরিন এবং আমি, দুজনই এই মিথ্যার জলে অম্লমধুরভাবে আটকে গেছি। দোষটা অবশ্য আমারই৷
.
জেনেটিক্যাল কিঞ্চিৎ ত্রুটি নিয়ে জন্মেছিলাম। Y ক্রোমোজমের লং আর্মের AZF রেজিওনের কই জানি ডিলিশন আছে, ভায়াবল স্পার্ম তৈরির ক্ষমতা আমার নেই। কোনোদিন নাকি হবেও না।
বিয়ের আগে ঘুণাক্ষরে টের পেলেও জেরিনকে আমার নির্মম ভাগ্যের সাথে জড়াতাম না৷ কিন্তু আগে নিজের পুরুষত্ব নিয়ে সন্দেহ ছিল না। সন্দেহ হবে কীভাবে? ওলিগোস্পার্মিক ছিলাম না, নরমাল এমাউন্টেই স্পার্ম তৈরি হত। আর দেখে তো বোঝার উপায় নেই ভায়াবল কিনা। তাই আজ বিয়ের পাঁচবছর পরেও যখন ঘর আলোকিত হলোনা, নিত্যকার পানসে জীবনে সারপ্রাইজ এলোনা, তখন চুপিচুপি হসপিটালে গিয়ে টেস্ট করে দেখি এই রেজাল্ট!
.
আমি বাঙালি পুরুষ, সব পারি কিন্তু পুরুষত্বের ইগোকে অতিক্রম করার সাধ্য আমার নেই। যখন দেখলাম সমস্যা আমারই, সাব-কনশাস জগত জুড়ে তখন নিজেকে স্বাভাবিক প্রমাণ করার প্রবল ইচ্ছা জেঁকে বসলো৷ স্ত্রী এবং সমাজের সামনে নইলে যে মুখ দেখাতে পারবোনা৷ তবে এই দায় শুধু আমার একার? এটা যে সিম্পলি একটা ডিসঅর্ডার, এটা মেনে নেয়ার মেন্টালিটি ক’জনের আছে? অতিশয় শিক্ষিত মানুষকেও দেখেছি এটাকে কার্স হিসেবে দেখতে, এই সমাজেই তারা থাকে। বলা বাহুল্য, আমি ও আমার স্ত্রী, দুজন এ সমাজেরই অংশ।
.
স্পার্মব্যাংক, আইভিএফের মতো অনেক আধুনিক প্রযুক্তি আছে জানি। কিন্তু তাতে যে আমার অপুরুষত্বই প্রমাণিত হবে। পুরুষত্বকে বাঁচাতে তাই ছলনার আশ্রয় নিতে হলো আমায়।
ডিএমসির ফরেন্সিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবে এসব টেস্ট হয় জানতাম। ঢাবির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছেলেমেয়েরা গিয়ে কাজ করে। আমি বছর সাতেক আগে সিএসই থেকে গ্রাজুয়েশনের পাঠ চুকে এলেও সায়েন্স কমপ্লেক্স বিল্ডিংটায় যাওয়া-আসা আছে এখনো। জুনিওর যারা ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবে STS মার্কার এনালাইসিসের কাজ করে তাদের বলে-কয়ে বা অনেকটা বাধ্য করে আমার টেস্ট রিপোর্ট ম্যানিপুলেট করালাম। আমি যে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ, নতুন ফলস রিপোর্ট সেটার সাক্ষ্য দিলো।
.
জেরিনকে রিপোর্টটা দেখাতেই সে এমন নির্ভার হাসি দিলো, দেখে মনে হলো যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। মেজাজ বিগড়ে গেল আমার, রাস্কেলটা আগে তবে ভাবতো আমার সমস্যা আছে? স্ত্রীলোকেরা এমন বাতিকগ্রস্থ কেন?
.
মিথ্যাকে সবলভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে ছলনার শিকলে সত্যের সম্ভাব্য সকল দ্বার রুদ্ধ করতে হয়। বিধাতা মাফ করুক, নিজের ইমেজ রক্ষার্থে সবথেকে বড় প্রতারণাটা করতে হলো এবার।
জেরিনকে একনলেজ করে ওর স্যাম্পল নিয়ে টেস্ট করালাম এবং ডেলিবারেটলি এমন রেজাল্ট প্রডিউস করলাম, যেটায় বোঝা যাচ্ছে জেরিনের সেভেয়ার ইনফার্টিলিটি আছে। বাস্তবিকপক্ষে, আসল রিপোর্টে ওর কোনো সমস্যা ছিল না৷ পুরুষত্বের ইগো রক্ষার্থে আমাকে এ অপরাধ করতে হয়েছে। একজন বিবাহিত মেয়ের কাছে এটা যে কতবড় আবেগের ব্যাপার, সে আমি জানি। ইশ্বরের কাছে ক্ষমা পেলেও সত্য প্রকাশিত হলে জেরিনের কাছে পাবো কিনা জানিনা।
.
জেরিনকে ওর ফলস রিপোর্ট দেখানোর পর থেকে সবসময় সে অপরাধবোধে ভুগতো৷ আমাদের সংসারে কার্সটা যে ওর কারণেই নেমে এসেছে এটা বুঝতে পেরেছিল হয়তো। এটা ওর মাথায় প্রোথিত হলেই আমি স্বার্থক। তবে দীর্ঘসময় ধরে ফিকে-স্বার্থক হয়ে থাকা সহজ কাজ নয়। মাঝেমাঝেই ওকে মনে করিয়ে দিতে হতো,
“আজ তোমার কারণেই আমার এই অবস্থা।”
প্রায়শ ওর অপরাধ স্মরণ করে দিতাম,
“জীবনে কী পাপ করেছিলাম বলো তো জেরিন? একজন সুস্থ স্বাভাবিক পুরুষ হয়েও কেন আমাকে নিঃসন্তান থাকতে হবে?”
জেরিনকে দেখতাম, ওর ভিতরটা কেউ যেন ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। গিল্টিনেসের ভারে টু-কথাটিও বলতো না কখনো। সিক্ত চোখে ভয়াদ্র চাহনি আর একরাশ শূন্যতার এক্সপ্রেশন নিয়ে চলতো সবসময়। ভিতরে হাহাকার প্রতিধ্বনিত হতো বুঝতাম।
জেরিনের এহেন দশায় আমার প্রচন্ড খারাপ লাগতো। পুরুষ হয়েও শাওয়ার নিতে গিয়ে কান্না করেছি কতবার। পুরুষত্ব নেই বলে কি কান্না আসতো?
বোধহয়। এজন্য বের হয়ে আবার আমাকে রুদ্রমূর্তিতে ফিরে আসতে হয়েছে। নিজের ইগো বাঁচাতে আমাকেও কম অভিনয় করতে হয়নি।
.
জেরিন একজন ট্রু লাভিং ওয়াইফ। উপযাচক হয়ে অনেকবার আমাকে বলেছে,
“আমার অপরাধের ভার নিয়ে আমাকে একলা ছেড়ে দাও৷ বিয়ে করো আরেকটা৷”
ফলাফল কী হবে জানা আমার, ভাবি সংকটে ফ্যাকাশে হয়ে যেতাম ওর কথায়৷
“এতবড় আনইথিক্যাল কাজ করতে পারবোনা। ভালোবেসে বিয়ে করেছি তোমাকে। প্রেম যখন করেছি, তখন সন্তান হবে কি হবেনা এই চিন্তায় তো প্রেম করিনি। প্রেমের উপলক্ষ্য ছিলে কেবল তুমি। সেই উপলক্ষ্যটা যে এখনো আমার বদলায়নি গো।”
খুশি হতো খুব। অথচ যখন নিজেকে জেরিন সুস্থ ভাবতো, প্রেমময় কথায় তখন এতটা খুশি হতোনা। কতকদিন ভালোবাসায় ভরিয়ে রেখে বুঝাতাম আমি ওকে কখনো ছেড়ে যাবোনা৷ তবে ভুল করেও ওর সন্দেহের তীর যাতে আমার উপর এসে না ঠেকে, রেগুলারলি আবার হার্টও করতে হতো তাই।
ওর প্রতি আমার ভালোবাসা এবং সন্তানের জন্য ওকে কষ্ট দেয়ায় আমার নিঃসন্তান হওয়ার হাহাকার- এই দুই নৌকার দোলাচালে সে এতটুকু হয়ে থাকতো সদা! মুক্তির পথ খুঁজত কিনা কে জানে!
.
তবে শেষটায় আমি খুঁজতাম মুক্তির পথ। মিথ্যার জালে বন্দী থাকা অসহ্য হয়ে গেছে। বিনা কারণে স্ত্রীর চোখের জল নিতে পারছিনা আর। কিজানি অপুরুষ বলে স্ত্রীর ব্যথায় সমব্যথিত হচ্ছি আর অন্তর্দাহে পুড়ছি অবিরাম! নাহ, আমাকে কনফেজ করতে হবে। ক্ষমা চাইতে হবে জেরিনের কাছে।
কপালে যা আছে হবে, প্ল্যান করেছি এ মাসের শেষে জেরিনকে নিয়ে মালদ্বীপ বা নেপালে যাবো এবং সেখানেই খুলে বলবো সব। ক্ষমা চাবো আমার লাভিং বউয়ের কাছে। সব শুনে সে যদি আমাকে ছেড়ে চলেও যায় তাতেও বাঁধা হয়ে দাঁড়াবোনা।
.
ভিসা প্রসেসিং আর অফিসের কাজ গুছিয়ে নিয়ে আসতে বেশ ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। এরমাঝে রাত্রি করে একদিন বাসায় ফিরেছি। কোত্থেকে জেরিন দৌঁড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে মুহুর্মুহু চুমুতে ভরিয়ে দিলো আমার মুখ। অপ্রস্তুত হয়ে হাসতে হাসতে কোমড় জড়িয়ে ধরে বললাম,
“এত সুখের আতিশয্য! কী হলো হঠাৎ?”
“খুবই ভালো সংবাদ আছে”
“সেতো বুঝতেই পারছি। কি সেটা শুনি তবে”
“এই দেখ আমার প্রেগনেন্সি কিট। আমি প্রেগন্যান্ট”
আকাশ ভেঙে পরলো মাথায়৷ জেরিন কি বলে এসব? আমি তো কখনো বাবা হতে পারবোনা জানি। সামলে নিয়ে জেরিনকে বললাম,
“কি বলো তুমি? তবে ডাক্তার যে বলেছিল তুমি ইনফার্টাইল। জন্ম দিতে পারবেনা কখনো?”
“কিন্তু পেরেছি তো। এই দেখোনা রেজাল্ট।
ইনফার্টিলিটিতে তোমার তো কোনো সমস্যা নেই তাইনা?”
” না, না। তা নেই”
“শুধু আমার ছিল ডাক্তারের ভাষ্য মতে। কিন্তু জানোই তো দেশের চিকিৎসা ক্যামন। কত রিপোর্ট ভুলভাল প্রেডিক্ট করে। আমার কোনো সমস্যা হয়তো ছিল না।”
“তাই তো মনে হচ্ছে”
“তুমি এমন বিমর্ষ কেন? তুমি খুশি হওনি?”
“উ, কি বললে?”
“পাঁচবছর পর এতবড় একটা খুশির সংবাদ দিলাম। তুমি খুশি হওনি?”
“হ্যাঁ, বোকা। অনেক খুশি হয়েছি।”
কৃত্রিম হাসি এনে বললাম জেরিনকে।
.
কিসের নিমিত্তে কী ঘটেছে বুঝতে পারছিনা কিছুই। তবে দোষ আমার এটা বুঝতে পারছি। আমার ইনফার্টিলিটি গোপন করে জেরিনকে দোষ দিয়ে গেছি। একটা অসুখ যেটা হতেই পারে যেকারো সেটাকে নিজেই মেনে নিতে পারিনি। বরং জেরিনকে অভিশপ্ত প্রমাণের চেষ্টা করেছি। অপরাধবোধে ভুগে আমার মুখে হাসি ফোটাতে জেরিন হয়তো অন্যকারো সাথে…. ছিহঃ….সে হয়তো অন্যকারো সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে দেখেছে- যদি হয়! আমার কথার তোড় থেকে বাঁচতে হয়তো ট্রায়াল এন্ড এরর প্রসেসে গেছে সে। সফলও হয়েছে, তাতো হতোই, ওর তো কোনো সমস্যা ছিলনা।
কিন্তু আমি যে ইনফার্টাইল জেরিন তো তা জানতোনা। কাজেই আমি বিশ্বাস করবো সে পরপুরুষের সাহচর্যে আসেনি এবং এই অনাগত সন্তান কেবল আমারই – এ বিষয়ে ওর মনে সন্দেহের লেশমাত্রও ছিলনা।
.
এরপর আমি কিংবা আমরা পরে গেলাম আজীবনের তরে আবার এক মিথ্যার জালে। কনফেজ করার প্ল্যান বাতিল করতে হয়েছে আমাকে, আরো জল ঘোলা হতো তাহলে। বাকিজীবন মিথ্যে অভিনয় করে যেতে হবে, এ সন্তান আমার। জেরিনকেও অভিনয় করে যেতে হবে সে আমার অবর্তমানে তথাকথিত খারাপ কিছু করেনি।
অভিনয় করে বুঝাতে হবে এই সন্তান নিখাদ আমাদেরই। মিথ্যে সুখের জালে আটকে গেলাম দু’জনেই!
.
জেরিনের পেট বড় হয়ে উঠছে ক্রমশ। তৃতীয় কোনো মানুষ নেই, আমাকেই প্রসূতির যত্ন নিতে হয়। আমি যত্নের ত্রুটি রাখিনা। ‘আমাদের’ অনাগত সন্তানকে স্বাগত জানাতে কখনো অফিস কামাই করে, কখনো সারারাত জেগে ওর সেবা করে চলেছি নিত্য। সেবার যাতে ত্রুটি না হয়, সবসময় তাই ওর পাশেপাশে থাকার চেষ্টা করি।
পাশেপাশে আমরা থাকি বটে, শুধু দু’জনের মাঝে মিথ্যার গাঁথুনিতে অদৃশ্য যে দেয়াল গড়ে উঠেছে সেটা লঙ্ঘন করে কেউ কারো কাছে যেতে পারিনা।