শ্বশুর আমার ভিনদেশির মতো নজর নিছে

গরিবের সুন্দরী বউ বলে সবাই আমারে ভাবি ডাকে। আমার নাকটা যে টানাটানা, তারই প্রশংসা করে বলে, ভাব্বি, হ্যাব্বি!
– কি হ্যাব্বি?
তারা হাসে। কথার শেষটা আর করে না। আমি বুঝি তাদের আধুরা কথার মানেটা। আমি বুক-পাছায় কাপড় টেনে দেহটাক আড়াল করে ঢেকে নেই। দেখি, কটকট করে নোংরা চোখে তাকায় তারা।
এমন কি আমার চ্যাংড়া বয়সী চাচাশ্বশুর, আমাকে ডেকে কয়, কি রে, আবারো জাউরা কথা কইছে তারা?
– কইছে তো। আপনি তো কিছু কন না।
– কি কয়?
আমি কিছু কই না। আমি তারও মতলব বুঝি। সেও ইদানিংকালে বউমা বউমা কয় না।
বরং নানান বাহানায় এই চ্যাংড়া চাচাশ্বশুর ঘনঘন আমার বাড়ির আশপাশে আনাগোনা করে, মোর মুখ থাকি খারাপ কথা শুনির চায়। তার ধান্দায় আমি পা দেই না।

তবে আমি অবশ্য যুৎমতো সুযোগ খুঁজি, জায়গামতো একবার পাই, মনে মনে প্লান করি, তারে আচ্ছামতো অপমান কইরা ছাইড়া দিমু। কিন্তু চ্যাংড়া শ্বশুর বড়ই চালাক, কথার ছলে ধরতে ধরতে সে নানান অছিলায় কথা ঘুরিয়া অন্য দিকে কুচিয়া মাচের মতোন মোচড় নেয়। যতই মোচড় নিক, দিন আসিবে! পুরুষ মানুষের মন তো আমি চিনি, মধুর চাক দেখিলে এইলা খালি শেয়ালের মতো ঘুরঘুর করে।

কখনো ভাবি, রাস্তার খারাপ মানুষগুলাক শায়েস্তা করার জন্য চাচাশ্বশুরকে ব্যবহার করা যায় কিনা। কিন্তু মানুষটাকে আমার সুবিধার মনে হয় না। আমার দূর্বলতার সুযোগ যদি নেয় মানুষটা! এমনিতেই মানুষটা আমার ল্যাংরা ভাতারের ফেন্সিডিল রাখা মামলা নিয়া দেনদরবার করতেছে বলে সময় অসময়ে বাড়ি আসে।
এই যে সে এখন পাথার বাড়ি গিয়া ভিনদেশির ফ্যাক্টরির দেয়াল ধরি ঘুরতে ঘুরতে আমার বাড়ির দিকে নজর রাখছে। আমার ভাতার বাড়ি থাকি বের হওয়া মাত্র সে বাড়ির কাঞ্চাত আসি খাড়া হইবে। কই রে ভাদু? আমার ভাতারোক ডাক দিয়া বাড়ি ঢুকি মোর হাতে খাবার পানি চাইবে। আবার পানি দিবার সময় হাত ছোঁবার চেষ্টা করবে। এইটা তার কোন ধান্দা আমি বুঝি। কিন্তু আমি শুধু ভাতারের দিকে তাকাই মুখ বুঝি সহ্য করি। হোউক মোর চাচা শ্বশুর, ওইলা মুঁই পরোয়া করো না। কিন্তু এই কথাগুলা বুঝাইবার পারো না মোর ভাতারটাক।

মোর ল্যাংড়া ভাতার, যে মানুষটা মোক বিয়া করি কামাই করে খাওয়ায়, গরিব হইলেও মানুষটার মন ভালো। সে আমারে কোনদিন ঠকাইবার চায় না। আমার জন্য বুক আগলে দাঁড়ায়। সেও চাচা শ্বশুরের ব্যাপারটা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারে। কিন্তু বুঝবার পারলেও তার এখন কিছুই কইবার নাই। কারণ, তার যে একখান পা ভাঙি দিছে টহল পুলিশের চামচিকারা, আর তার নামে যে অটোরিক্সায় ফেন্সিডিল রাখার মামলা দিছে, এই মামলা চাচাশ্বশুরই এখন দেখভাল করছে।

কিন্তু মোর কিছুটা সন্দেহ, এই চাচাশ্বশুর মনে হয় ভিনদেশির সাথে মিল দিয়া মোর ভাতারোক ফেন্সিডিলের মামলায় ফাসাই দিছে। তবে এই কথা মোর স্বামী বিশ্বাস করবার চায় না। তার প্রতি এতো বিশ্বাস। বলে, পুলিশের চামচিকারা করিছে এই কাম। তারাই ভাঙি দিছে তার ডান পা।

বাড়ির গাই দুইটা বেচে দিয়া অটোরিক্সা নিছিলাম, ব্যাটারীঅলা। এইটা নাকি চালানো নিষেধ, আইন হইছে। কারো কাছে শুনিও নাই, জানোও না, এমন আইনের কথা। দ্যেশোত যে কোন সময় কি আইন হয়, কায় এর খবর রাখে? এই অটোরিক্সা চালাইছে বলে আইনের লোকেরা ধরি নিয়া থানায় নিছে মোর বোলবোলা স্বামীটাক। মোর মাথাপাগলা স্বামী এতো কিছু বোঝে না, রাগ করি ঢিল মারিছে। এইটা দোষ।
তারা মানুষটাক ধরি নিয়া সে কি মাইর। গাড়িখানা কাড়ি নিয়া মামলা দিছে সেইখানে নাকি ফেন্সিডিল ছিল।

সেই থাকি স্বামী এখন বাড়িত বসা। বসি বসি বান্ধা টাকা চুকুরবুকুর করি খায় আর মামলা চালায়। এরপর কিভাবে দিন চলিবে সেই চিন্তায় মোর ঘুম ধরেনা। অথচ এই মানুষটা বুকের বোতাম খুলি দিয়া ফিল্ডিং মারি হাটি বেড়ায়। চাচাশ্বশুরের সাথে শলাপরামর্শ করে। মোর ভালো লাগে না।
চাচাশ্বশুরোক কই, দ্রুত একটা ব্যবস্থা করেন বাহে।
– চেষ্টা তো চলছে। সময় লাগবে।
– আর কত সময় লাগবে? না-খায়া পেট মোচড়ে বাড়িত বসি আছি। দেখেন একটু তাড়াতাড়ি যানি অটোখান ছাড়ি দেয়।
– এখন আর এইভাবে ছাড়িবে না বাহে। মামলা দিছে। তারা কইছে, আইন আইনের গতিত চলিবে।
– কিসের আইন বাহে? হামরা না খায়া মরি, সেইটার আইন নাই? হামার শরীরের ভেতরকার পেটেরও তো একটা আইন আছেন বাহে, ক্ষুধার আইন। এই আইন খানা ওমার চোখত পড়ে না?
– এই জন্য ভাদুরে কইছিলাম, এইসব বাদ দিয়া ভিনদেশির ফ্যাক্টোরিত একটা চাকরি নে। চাকরিও দিবার চাইছে। এই কথা তো ভাদু শোনে না।
– ঐসব ঢঙের আলাপ বাদ দেন তো বাহে। যেইটা কইছি সেই কাম করেন।

এই এক ধান্দা নিয়া পরি আছে মোর চাচাশ্বশুর, কয়দিন থাকি হামাক ধরিছে, তোমার জমিখানা ভিনদেশিক দে। তায় ফ্যাক্টোররিটা বড় করিবে।
– কোন জমি বাহে?
– তুই যেখানটায় ঘর করি শুতি আছিস।
– ও আল্লাহ কয় কি! মোর ভিটামাটি? এইখান মোর জান। দেহ এইটা মোর। মোর শরীর।
– তাইলে এই শরীরখানাই দে।
কেমন খারাপ মানুষ! সেই দিন তাকে লাঠি নিয়া তাড়া করিছি। আজ আবার সেই কথা তোলে।
সেদিন থাকি মাথায় আমার বাঁজ ভাঙিছে। তারা কোনঠে এবার নজর দিছে দেখেন দেখেছেন? শুনেছেন বাহে কি কয় ওরা? ওমাক দেখিলে শরীর এখন মোর কাঁপি ওঠে। কিছু আর কইতে পারি না। মাথায় চিন্তা ভনভন করে। তাদের নজর দেখি মনে হইছে, চাকরির কথা কয়া তারা শুধু মোর জমি সম্পদ না, আমাকেও ভোগ করিবার চায়।

কিছুদিন থাকি ভাতারও এখন ঘ্যানঘ্যান করা শুরু করিছে, ভিনদেশিক মাটিখান দিলে তারা দু’জনকে পারমানেন্ট চাকরি দিবে। তখন আর দুইজনের জীবন, কোনোমতে চালাই দিতে কষ্ট হইবে না। কিন্তু থাকা যাইবে কোনঠে? হাতে যে কয়টা টাকা ধরি দিবে, সেটা শেষ হইতে কয় দিন লাগবে? কেমন বোকা মানুষ আমার স্বামীটা। বাপ-দাদার ভিটা, সেইটা বেচে দিবার চায়। আমি কয়া দিছি, জান গেলেও এই ভিটা আমি দিমু না। স্বামী কয়, তাহলে আর কি দিয়া রক্ষা করবি?
সেই তো! উপায় পাই না।

এইভাবে দিন যায়। চাচাশ্বশুর আসে, ভিনদেশির কথা কয়া লোভী চোখে তাকায়। আমি এক কথাই কই, জান গেলেও ভিটা দিমু না। কই ঠিকই। কিন্তু ভয় হয়। কেমন করি এই ভিটা আর দেহ খানা আগলে রাখিম মুঁই? কয়দিন আগলে রাখিম? গাড়ি আর স্বামী – দুইটাই এখন হাতছাড়া হইতেছে। এখন কি করি খাইম মুঁই? কেমন করি বাঁচি থাকিম?

পুলিশের কাছে হাত-পা ধরি কত কইছি। এইটা তারা দেখে না। তারা দেখে আইন। তারা আইজ-কাইল করে খালি দিন ঘুরায়। কখনো তারা যৌবনের আইন সামনে আনে, কখনো আইনের থাকি তাগদ দেখায়। জুলুম করে আমার ওপর। আমার যুবতি দেহে নজর দিয়া নিত্য-নতুন কৌশল খাটায়।

এদিকে আবার আশপাশের ছেলেরা ভাবি ভাবি ডাক ধরিছে। ভাব্বি হ্যাব্বি সুর তুলিছে। চাচাশ্বশুর আড়ালে থাকে। কিছু কয়না।

একদিন, দিশা না পাইয়া মন খারাপ করি মুঁই পাথারত বসি আপন মনে চিন্তা করছো। পাশেই বাড়ির কাছ দিয়া ভিনদেশির জমিত মাটি ফেলাইতেছে শকুনের মাথাওলা বড় বড় মাটিকাটা মেশিনগুলা। পাশের ইটরাস্তা থাকি গাড়ির পিছন উড়ে আসা ধুলাবালু দিয়া সারা বাড়িটা মোর ঢাকা যাইতেছে। আমি গালি দিতে দিতে পরিষ্কার করতেছিআর কাঁদতেছি। এমন সময়, এলাকার চেয়ারম্যান সাবকে নিয়ে আমার চাচাশ্বশুর বাড়িতে ঢোকে।
– সালামালেকুম ভাবি।
আমি ভড়কে গিয়া চেয়ারম্যান সাবরে সালাম দেই। বসতে দেই। হাতির পা গরিবের বাড়িত।
চেয়ারম্যান সাব ভালোমন্দ আলাপ করি কয়, এইখানে একটা হোস্টেল দিমু। জমিখানা দিয়া দে। পুব পাশে তোক জায়গা দেইম, বাড়ি করিস।

আমি ‘না‘ কইছি। এতে চেয়ারম্যান সাব চেতিছে। আমি জানি, সে এইখানে হোস্টেল মোস্টেল কিছুই দিবে না। তার দুই দুইটা ছেলে, একটা মেয়ে দেশ বিদেশে পড়ালেখা করে। মানুষে কয় তারা কানাডা অস্ট্রেলিয়াত বাড়ি নিছে। শুনতেছি চেয়ারম্যান সাব এলাকার সব জমিজমা কিনে নিয়া ভিনদেশি মানুষটাক বেঁচে দিয়া বিদেশোত বাড়ি বানায়া সেইখানে থাকার পরিকল্পনা করিছে। সে মোর ভিটা নিলেও ভিনদেশিকেই দিবে। কেনে বাহে, এতো নজর কেনে মোর ভিটার দিকে? ঐ দিকে তোমার যা ইচ্ছা তাই করো, দেশ বিদেশ বেচে ছেচে যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাও, শুধু মুই মোর ল্যাংড়া ভাতার নিয়া কোনোমতে ভিটার গোড়াটা কামড়ে ধরি বুক দিয়া আগলে থাকিম, এইটাও দিতে চান না?

চেয়ারম্যান সাব বাড়ি থাকি যাওয়া মাত্র আইজকে আবার এলাকার চ্যাংড়াগুলা বাড়িত আসি হুমকি দিচ্ছে। কি কপাল মোর! মোরই পাড়ার চ্যাংড়া, একটা ভিনদেশি মানুষের জন্য শাটক দিয়া যায়, কী দুর্ভাগ্য আমার!

দুইটা দিন পার হইছে কেবল, এমন অত্যাচার শুরু করিছে, থাকা মুসকিল। ফ্যাক্টোরির পানি বাড়ির পাশে ফেলে দিয়া ডোবা বানাইছে। কার কাছোত বিচার দিম আল্লাহ ছাড়া? এইলা নিয়া আইজ সকাল থাকিই মোর ভাতারের মেজাজটা গরম। অনাবরর্ত ফেদলা পাড়েছে। আর সহ্য করতে পারছে না। না থাকির পারি সবার বাপ-মা তুলে গাইল দিচ্ছে।

মুঁই দেখছো, চ্যাংড়াগুলা কেনবা লাঠি নিয়া তেড়ে আসতেছে। হায় আল্লাহ, এক চ্যাংড়ার মাথায় বাড়ি দিল মোর স্বামী। হায় হায় করে কি মানুষটা!
মাথা চিপে ধরি বসি পড়ল একটা চ্যাংড়া। এই বার কোথা থাকি যেন ছুটে আসছে মেলা মানুষ। দলবল নিয়া আসতেছে। আল্লাহই জানে, এইবার আমার ইজ্জৎ যাবে, নাকি আমার ভিটামাটি। আমি কোকড়া নাগি চায়া আছি, ঐ যে তারা দা-কুড়াল নিয়া ছুটি আসতেছে। মুঁই দেখছ, মোর চাচাশ্বশুরও সেইখানে আছে। মোর বাড়ির মানুষ যদি মোক না বোঝে, কেমন করি মোর ইজ্জতখানা রক্ষা হইবে? কি যে হইবে এইবার, দিশা পাওনা।

 

শাহ মাহফুজ-এর অন্যান্য গল্পঃ
১.  বেড়ালের স্পর্শ

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত