হিমঘরে পৌঁনে দুইদিন

হিমঘরে পৌঁনে দুইদিন

আফসার উদ্দিন যখন মারা যান তখন রাত তিনটা বাজে। হাসপাতালে তখন তার কাছে দুই ছেলে আর তার বৃদ্ধা স্ত্রী ছিলেন। তার মৃত্যুতে ব্যাকুল হয়ে কেউ কাঁদছিল না! কে কাঁদবে! তার স্ত্রী বিলকিস বেগমের বয়স আশির কাছে। এ বয়সে কান্না করার জন্য যেটুকু শারীরিক শক্তির দরকার এখন তার সেটারও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কাঁদলে পেটের নাড়িতে টান পড়ে। পেট ব্যথা করে। তাছাড়া আর কতই বা কান্না আসে! গত সতের দিন ধরে হাসপাতালের এই ছোট কেবিনে অনেক কেঁদেছেন তিনি। চোখের জল এখন শুকিয়ে এসেছে। স্বামীর লাশের পাশে চুপচাপ বসে রইলেন বিলকিস বেগম। তার আর কিছু করার নেই। স্বামীর প্রতি তার সব দায়িত্ব আজ থেকে শেষ হয়ে গেল। এখন যা করার তার ছেলেরাই করবে!
ছেলেরা এরই মধ্যে আত্মীয় স্বজন সবাইকে ফোন করে জানানো শুরু করেছে। ফোনের কথোপকথন তার কানে কিছু কিছু আসছে, হ্যাঁ হ্যাঁ! তিনটায় মারা গেছেন। না, মারা যাওয়ার সময় একা ছিলেন না! আমরা পাশেই ছিলাম। হ্যাঁ বড় ভাইয়ার কাছে কানাডায় খবর পৌঁছে গেছে। উনি আগামীকাল রওনা হবেন। পড়শু এসে পৌঁছাবেন! বোধ হয় ছোটবোনকে বলছে। মেঝো ছেলের কথা শুনে বিলকিস বেগম মনে মনে হাসেন। কে আর পাশে ছিল! ওরা দুই ভাই তো ক্যান্টিনে খেয়ে বারান্দায় বসে গল্প করছিল। তলপেটের চাপে বিলকিস বেগমের ঘুম ভেঙে যায়। বাথরুমে ঢুকে হালকা হয়ে এসে উনি স্বামীর গায়ের কাপড়টা টেনে দিতে গিয়ে হঠাৎ টের পান মানুষটার বুকতো ওঠা নামা করছে না। উনি স্বামীর বুকে কান পাতলেন। তবুও কোনো শব্দ পেলেন না! কিন্তু নিজের ওপর তার তেমন আস্থাও নেই। ইদানীং কানে উনি বেশ কম শোনেন। চোখ তো অনেক আগেই গেছে। বছর সাতেক আগে ছানি অপারেশন করানোর পর কিছু দিন বেশ ভালো দেখত। বরং একটু বেশিই দেখত। তারপর ধীরে ধীরে সে দৃষ্টি আবার ক্ষীণ হতে শুরু করেছে। এ কথা উনি ছেলেদের আর জানাননি। কারণ তিনি আবার অপারেশন করাতে চান না! ক’দিনই বা আর বাঁচবেন। এর মধ্যে আর চোখে পট্টি বাঁধতে চান না তিনি। দৃষ্টির চেয়ে উনি এখন অনুভূতি দিয়েই বেশি কাজ করেন। গতরাতেও অভ্যাস বশত তার স্বামীর গায়ে হাত রেখে বুকের ওঠানামা টের না পেয়ে তিনি বাইরে গিয়ে ছেলেদের ডেকে আনলেন। ছেলেরা প্রথমে নিজেরাই বোঝার চেষ্টা করলেন এবং পরে নার্স ও ডাক্তার এসে বললেন, নেই! উনি চলে গেছেন। বোধ হয় ঘন্টাখানেক আগেই!
এতক্ষণে তার ছেলেরা যেন হাঁফ ছাড়লেন! ছোট ছেলে মনে মনে ভাবছিল, সেই কবে থেকে হাসপাতাল, ডাক্তার আর বাসা। কাহাতক আর সওয়া যায়! বউ- বাচ্চা, ব্যাবসা- বানিজ্য একেবারে উচ্ছন্নে গেল! বউতো ছেড়ে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। গত সাত- আট রাত সে একা আছে। বিয়ে হয়েছে বছর ঘোরেনি এখনও। সে বেচারা কি স্বামী ছাড়া একা রাত কাটাতে পারে! সারারাত বেচারি মোবাইল ফোনে ঘ্যানঘ্যান করে। যাক! বাড়ির বাইরে আর রাত কাটাতে হবে না। মেঝোভাই এগিয়ে এলেন, টগর! তুই গাড়ি নিয়ে আম্মাকে রেখে আয়। আর আসার আগে বাসার সামনের জায়গাটা কাউকে দিয়ে পরিস্কার করিয়ে রেখে আসিস। লাশ তো ওখানেই রাখতে হবে। এখানকার সব ব্যবস্থা আমি করছি। সুমিকেও ফোন করে দিয়েছি। ওরা সকালেই চলে আসবে।
লাশের গাড়িটা যখন বাসার সামনে এসে দাঁড়াল তখন নরম সকাল। মিহিদানার মতো ঝিরিঝিরি পাতলা এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গেছে। রাস্তার কোথাও কোথাও অল্প পানি জমে আছে। অনেকটা চোখের কোলে জল জমে থাকার মতো। রাতের জমাট বাঁধা কষ্ট অনেকটাই মিলিয়ে গেছে ভোরের আলোয়, মুছে গেছে বৃষ্টির জলে। বড় ছেলে কানাডা থেকে ফোন করে বলেছে, বাবাকে ফ্রিজিং লাশের গাড়িতে রেখে দিবি আমরা না আসা পর্যন্ত! যত টাকা লাগবে আমি দেব!
না, টাকার অভাব অবশ্য নেই আফসার উদ্দিনের। এক জীবনে সে যত টাকা ন্যায়- অন্যায় পথে উপার্জন করেছেন তাতে তিন পুরুষ বসে খেতে পারবে। নারায়ণগঞ্জের বিশাল এক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, স্পিনিং মিলের মালিক তিনি। মালিক এই চারতলা বাড়িরও। এক তলা- দুই তলায় তার পরিবারের বাস। তিন- চার তলা ভাড়া দেওয়া! দুইটা ফ্লোরে চারটা পরিবার থাকে। আফসার উদ্দিন বরাবরই খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন। বাড়িটা তিনি বানিয়েছিলেন একদম মনের মতো করে। বাড়ির নাম রেখেছিলেন বিলকিস ভিলা। পুরুষ মানুষের এই কাজটা বোধ হয় উত্তরাধিকার সূত্রে সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে পাওয়া। স্ত্রীকে তুমি ভালোবাস আর না বাস, একাধিক নারীর সঙ্গে ভাব- ভালোবাসা থাকলেও বাড়ির নাম রাখেন তারা স্ত্রীর নামে। এটা যতখানি না স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করা, তারচেয়ে অনেক বেশি সমাজকে নিজের চরিত্র জাহির করেন। আফসার উদ্দিনও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। সারা জীবন ব্যবসা বানিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন, টাকার পেছনে ছুটেছেন। স্ত্রীকে সময় দিতে পারেননি। তাই বুঝি সান্ত্বনা স্বরূপ স্ত্রীর নামে বাড়িটা করে দিয়েছিলেন। না যেন তেন একটা দালান না। সুন্দর একটা বাড়ি বানিয়েছিলেন। সামনে পেছনে ফাঁকা জায়গা রেখে। ইট কাঠের চাপে যেন দম বন্ধ হয়ে না আসে। তিন ছেলে আর একমাত্র মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তাদের বিয়ে দিয়েছেন। নাতি- নাতনির মুখ দেখেছেন। যথেষ্ট বিলাসবহুল জীবনও কাটিয়েছেন। অথচ আজ যখন সতের দিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থেকে বাড়ি ফিরলেন তখন আর তার নিজের বাড়ির ভেতরে, নিজের ঘরটায় যাওয়ার অধিকারটুকুও নেই! একা পড়ে রইলেন ঠান্ডা গাড়ির ভেতরে কফিনের বিছানায়।
খবর পেয়ে এরই মধ্যে আত্মীয়- স্বজনরা অনেকেই চলে এসেছে। বাসায় লোকজন গিজগিজ করছে। মেয়েও স্বামী- সন্তানদের নিয়ে চলে এসেছে। অনেকেই বিলকিস বেগমকে ঘিরে বসে আছে। কেউ কাঁদছে, কেউ বা আবার হাসছে প্রাসঙ্গিক কোনো কথায়। এক জীবনে মানুষের কত স্মৃতিই না জমা হয়। সব কি আর দুঃখের! সুখের স্মৃতিও তো থাকে। তা কথা প্রসঙ্গে সে সবও তো মনে পড়ে। আর সে সময় যদি হাসি আসে তাহলে সেটা কি দোষের! তাতে বিলকিস বেগমের খারাপ লাগলেই বা কী! শিশুরা ছুটোছুটি করছে; খেলছে। এক সঙ্গে এতগুলো শিশুতো আর একত্রিত হয় না আজকাল, কোনও উৎসব ছাড়া। সঙ্গী পেয়ে তাই ওরা মেতে উঠেছে নতুন নতুন খেলায়।
একটা সময় এই বাড়িটা লোকজনে গমগম করত। আফসার উদ্দিন যখন বাড়িটা করলেন, কত মানুষের আনাগোনা ছিল এ বাড়িতে। নানা রকম অনুষ্ঠানও তখন লেগেই থাকত। ছেলে- মেয়েদের জন্মদিন, তাদের বিয়ে শাদি সবই তো এ বাড়িতেই হলো। অথচ এখন আর তেমন কেউ থাকে না এখানে। বড় ছেলে তার পরিবার নিয়ে কানাডায় থাকে। মেয়ে থাকে ঢাকায় শ্বশুরবাড়িতে। মেঝো ছেলে শিমুলও তার বউ- বাচ্চা নিয়ে থাকে ঢাকায়। যদিও সে বাবার গার্মেন্টস দেখাশোনার জন্য প্রতিদিন নারায়নগঞ্জে আসে। কিন্তু ছেলে মেয়ের জন্য ভালো স্কুল কলেজ নাকি নারায়ণগঞ্জে নেই। তাই ওদের নিয়ে ঢাকায় থাকতে হয়। দো’তলায় ছোট ছেলে তার বউ নিয়ে থাকে। স্পিনিং মিলটা এখন সেই দেখাশোনা করে। যদিও বিষয় সম্পত্তি এখনও ভাগ বাটোয়ারা হয়নি। নিচতলায় স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন আফসার উদ্দিন। সঙ্গে থাকে আরও তিনজন। একজন গৃহপরিচারিকা আর একজন বাবুর্চি। একজন ম্যানেজারও আছে। সে থাকে সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। একজন ড্রাইভারও আছে। সেও রাতে থাকে না। সকালে এসে নাশতা খায়। দুপুরে বাইরেই খেয়ে নেয়। রাতে খেয়ে চলে যায়। মানুষ বেশি না হলেও রান্না কম হয় না। প্রায় প্রত্যেকের জন্যেই আলাদা আলাদা খাবার তৈরি করতে হয় বাবুর্চিকে। কেউ খায় ভাত- মাছ, কেউ মাংস। কেউ বা রুটি- সবজি খায়। কিন্তু আজ এ বাড়িতে চুলা জ্বলছে না। মরা বাড়িতে নাকি আগুন জ্বালাতে নেই। তাই খাবার আসছে আত্মীয় স্বজনদের বাসা থেকে। এরই মধ্যে অনেক খাবারই চলে এসেছে। বিশাল ডাইনিং টেবিলের অর্ধেকটা ভরে গেছে টিফিন কেরিয়ার আর হটপটে। আগতদের যে যার ইচ্ছে মতো খাবার নিয়ে খেয়ে নিচ্ছে। কেউ বা তার বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে, কেউ নিজে খাচ্ছে। পরিবেশন করার কেউ নেই। নিজে নিজেই নিয়ে খাচ্ছে। বাবুর্চি আর বুয়া শুধু প্রয়োজনীয় বাসনপত্র এগিয়ে দিচ্ছে। এরই মধ্যে একজন এসে বলল, যে হুজুররা কোরআন খতম করছে তাদের নাশতা দিতে হবে। বুয়া জানতে চাইলো হ্যারা কয়জন? জবাব এলো বারোজন। বুয়া নাশতা দিতে দিতে বলল, মানুষটা মইরা গেছে তার জন্যে যে একটু কানমু হেই সময়ও নাই! খালি এইটা দ্যাও! ওইটা দ্যাও! বিড়বিড় করতে করতেই একরাশ পরিস্কার থালা রেখে এঁটো বাসন নিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে যায় সে। এই বারোজনকে এখন কী নাশতা দেবে আপাতত সে চিন্তায় অস্থির। খালাম্মারে তো আর এই সময় জিজ্ঞেস করা যায় না! চা বিস্কুটই দিতে অইব! মনে মনে ঠিক করে নেয় সে।
বেলা পড়ে এলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে দেখে অনেকেই বিশেষ করে যাদের ছোট বাচ্চা আছে তারা একে একে নিজেদের বাসায় ফিরছে। বাসা এখন অনেকটাই ফাঁকা। বিলকিস বেগম শুয়ে আছেন নিজের ঘরে দুজনের বিছানায় একা। এতকাল পাশে আরো একজন মানুষ ছিল। আজ ফাঁকা জায়গাটায় হাত দিয়ে বুকটা ব্যথায় চিনচিন করে উঠল। লোকজনের ভিড় কমতেই বিলকিস বেগমের চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। চোখ বুজে মনে মনে ভাবেন, মানুষটা নিজের বিছানা ছেড়ে ঘরে বাইরে লাশের গাড়ির ভেতর শুয়ে আছে। নিশ্চয়ই খুব ঠান্ডা লাগছে। আপন মনে বিড়বিড় করে বললেন, কেউ গিয়া মানুষটার গায়ে একটা কম্বল দিয়া আয়! বলতে বলতেই উনি কখন যে ঘুমিয়ে পড়লেন!
সন্ধ্যার পর এলাকায় মাইকিং শুরু হলো, একটি শোক সংবাদ! গতরাত তিনটায় বিশিষ্ট সমাজসেবী আফসার উদ্দিন ইন্তেকাল করেছেন! ইন্নালিলাহি…! তার নামাজে জানাজা আগামীকাল বাদ জোহর অনুষ্ঠিত হবে! এলাকার ভেতরেই বার বার ধ্বনিত হতে থাকে আফসার উদ্দিনের মৃত্যু সংবাদ। কেউ কেউ জানা খবর আবার জানল। কেউ বা প্রথম শুনল। খবরটা শুনে কেউ বা কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেও পরক্ষণেই আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে রাত নেমে আসে বিলকিস ভিলার আঙিনায়। বাইরের কাজ শেষ করে যে যার ঘরে ফিরতে লাগল। রাতের আলো- আঁধারীতে লাশের ঠান্ডা দুধশাদা গাড়িটা তখন জ্বলজ্বল করছে। সবাই চলে গেলে টগর দোতলায় নিজের ঘরে ঢুকল অনেকটা সন্তর্পনে। সমালোচনা করার লোকের তো আর অভাব নেই! দেখলে কেউ না আবার বলে বসে, বাবার লাশ রেখে ছেলে ঘুমাতে যাচ্ছে। না ঘুমিয়েই বা করবে কী! ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। স্বামীকে ঘরে ঢুকতে দেখে রত্না এগিয়ে গিয়ে দরজার সিটকিনি তুলে দিলো। তারপর বিছানায় গিয়ে স্বামীর পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। টগরের চোখ বুজে আসছিল। কিন্তু রত্না হাত তখন তার শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর জায়গা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর সে স্পর্শে পুরুষের শরীর একটু একটু করে জেগে উঠছে। রত্নার কামনার স্পর্শ বেশিক্ষণ আর অগ্রাহ্য করতে পারে না টগর। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনেই সম্পূর্ন নগ্ন হয়ে মেতে ওঠে উত্তাল সঙ্গমে। তারপর ক্লান্ত হতে হতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে দুজনেই।
আরও একটা রাত কেটে গেল। ভোরের নরম আলো ফুটতে শুরু করেছে। জেগে উঠছে পাখিরা। দীর্ঘরাত শেষে পেটে ক্ষুধা নিয়ে জেগে উঠছে শিশুরা। আর ঘুম ভাঙা মায়েদের কেউ বা শিশুর মুখে গুঁজে দেয় স্তন। কেউ এগিয়ে যায় রান্না ঘরে দুধ গরম করতে। ফজরের নামাজ শেষ করে চলে এলো হাফেজের দল। কিছুক্ষণের মধ্যেই কোরআন তেলোয়াতের সুর, আতর লোবানের গন্ধ আবার যেন মৃতবাড়ির পরিবেশটা ফিরিয়ে আনল। লাশের গাড়িটি ঘিরে আবার জমে উঠতে থাকে জীবিতদের ভিড়। এরই মধ্যে ফোনে জানা গেল আফসার উদ্দিনের বড় ছেলে এয়ারপোর্ট থেকে রওনা হয়েছে। অপেক্ষার প্রহর কাটতে থাকে ধীরলয়ে। আবারও বাড়তে থাকে আত্মীয়- স্বজনদের আনাগোনা।
আজ সকাল থেকেই আফসার উদ্দিনের বাড়িতে চুলা জ্বলছে। গৃহপরিচারিকা জমিলা বুয়া ফিরে পেয়েছে তার নিজের কর্তৃত্ব। সকালে এরই মধ্যে সে এক প্রস্থ চা করেছে। ম্যানেজার হোটেল থেকে পরোটা, ভাজি, হালুয়া নিয়ে এসেছে সবার জন্য। এত লোকের জন্য ঘরে নাশতা বানানো সহজ হবে না ভেবেই শিমুল ম্যানেজারকে পাঠিয়েছিল নাশতা আনতে। বিলকিস বেগম রাত থেকেই না খাওয়া। বেশ বেলা হয়েছে। মেয়ে তাই মাকে ধরে এনে বসালেন নাশতার টেবিলে। মায়ের সঙ্গে বসল ছেলেরাও। মাকে বলে- কয়ে তারা খাওয়াতে চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে নিচে গাড়ি এসে থামার শব্দ হলো। সঙ্গে মানুষের হৈ চৈ। মনে হয় বড় ভাই এলেন! বলতে বলতে উঠে গেল ছোট দুই ভাই! মেয়ে বিলকিস বেগমকে ধরে নিচে নিয়ে গেল। ততক্ষণে আগন্তুকের গাড়িটি ঘিরে ধরেছে উৎসাহী স্বজনরা। তারা একের পর এক শোকগ্রস্ত সন্তানকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ভালো না লাগলেও আত্মীয়দের মন রাখতেই সব কিছু সইতে হচ্ছে পলাশকে। বড় ছেলে বলে কথা। তার দায়িত্ব যে অনেক। মাকে আসতে দেখে পলাশ ভিড় এড়িয়ে মায়ের দিকে এগিয়ে গেল। মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে সদ্য পিতাহারা সন্তান। বিলকিস বেগমেরও এবার শোকের বাঁধ যেন ভেঙে যায়। সে শোক কি স্বামীর চলে যাওয়ায় নাকি ছেলের দূরে থাকার সেটা সে নিজেও ঠিক বুঝতে পারলেন না। পাশে রাখা চেয়ার টেনে পলাশ মাকে বসালেন। তখন এগিয়ে এলো বড় বউ, সঙ্গে নাতি- নাতনি। ছেলের বউ শ্বাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলেও নাতি- নাতনি একটু দূরে থেকেই দেখছে দাদিকে। বড় ছেলের ঘরে এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটা বড়। মেয়ের জন্ম দেশেই হয়েছিল। ছেলের জন্ম হয়েছে ও দেশে। দু’ বছর আগে একবার এসেছিল ওরা। ছেলেটা তখন একদম ছোট, কোলে থাকত। এখন হাঁটছে। কী সুন্দর হয়েছে দেখতে। হালকা- পাতলা গড়ন। গায়ের রঙ দাদার মতো ধবধবে ফর্সা। মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল। ঠিক যেন আফসার উদ্দিনই আবার ছোট হয়ে ফিরে এসেছেন। বিলকিস বেগম হাত বাড়ালেন নাতির দিকে। নাতি কাছে না এসে আরও একটু দূরে সরে গেল। পলাশ ছেলেকে কোলে করে মায়ের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, এটা তোমার দাদি, গ্রান্ডমাদার! ছেলে সে কথা কানে না নিয়ে বলল, হোয়্যার ইজ গ্রান্ড পা?
সকালে এই প্রথম ফ্রিজিংগাড়ির দরজা খুলে কফিনের ঢাকনা খোলা হলো। কাফনের শাদা কাপড়টা সরিয়ে আবার যখন মুখটা বের করা হলো দেখে থেমে যাওয়া কান্নার রোলটা আবার ধ্বনিত হতে লাগল। ছেলে মেয়েরা আবার এক সঙ্গে সবাই বাবার মুখটা দেখে শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। বরফ হয়ে যাওয়া বাবাও যেন ছেলে মেয়েদের এক সঙ্গে দেখে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আধবোজা চোখে। এরই মধ্যে মুরুব্বিরা তাড়া দিতে লাগলেন, লাশের সামনে কাঁদতে নেই! আর বেশি সময়ও নেই। যাও যাও! তোমরা ওযু- গোসল করে তৈরি হয়ে এসো। জানাজার সময় হয়ে আসছে। কয়েকজন জোর করে সরিয়ে নিয়ে গেলো ওদেরকে।
বাসার ভেতর ঢুকে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল ওজু- গোসল নিয়ে। বিলকিস বেগম নিজের ছিানায় বসতে গিয়ে অনুভব করলেন খাটটা আগের চেয়ে অনেক বড় মনে হচ্ছে। অথচ স্বামী যতদিন অসুস্থ হয়ে বিছানার অর্ধেকটা জুড়ে শুয়ে ছিলেন তখন মনে হতো খাটটা ছোট। দুজনের জায়গা হচ্ছে না। আর এখন মনে হচ্ছে তার একার জন্য খাটটা বেশি বড়। বড় ছেলে এসে বসতেই মেজ ছেলেও এসে দাঁড়াল মায়ের কাছে। এগিয়ে এলো মেয়ে- জামাই। কথা তুলল বড় ছেলে, আম্মা এবার সব কিছু ভাগ করে একদম ঝামেলা মিটিয়ে যাব। বার বার তো আসা যায় না। কী বলেন? বিলকিস বেগম ছেলের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বিড়বিড় করে যেন নিজেকেই বলে, মানুষটার জানাজার সময় হইয়া আসছে। দুই দিন ধইরা মানুষটারে তোরা আটকাইয়া রাখছস ঠান্ডা গাড়ির ভিতরে। এবার তারে আগে বিদায় দে! মাটি তারে ডাকতেছে! আর তখনই পাশের মসজিদ থেকে জোহরের আজান ভেসে আসে। সবাই কেমন চুপ হয়ে যায়। আজান শেষ করে সেই মাইকেই মুয়াজ্জিন নামাজ শেষে আফসার উদ্দিনের জানাজার ঘোষণা দেন। এবার নড়েচড়ে ওঠে ছেলেরা। লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে। মাকে তো আবার নিচে একবার আনতে হয় লাশের কাছে। বড় ছেলেই এগিয়ে যায় মায়ের কাছে।
গতরাতের একলা কফিনকে ঘিরে এখন লোকে লোকারণ্য। ভিড় ঠেলে বিলকিস বেগমকে আর একবার লাশের কাছে আনা হলো শেষবারের মতো স্বামীর মুখটা দেখতে। কিন্তু তার ক্ষীনদৃষ্টি আরও যেন ঝাপসা হয়ে এলো। তিনি কিছুই দেখতে পেলেন না। সেই ফর্সা লম্বাটে মুখ, টিকালো নাক, ঝকঝকে দাঁত কিছুই চোখে পড়ল না! শুধু শাদা কাফনে ঢাকা একটা লাশই ভেসে রইল ছানিপড়া চোখে।

অলঙ্করণ: রাজিব রায়

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত