আকাশে আমাবস্যার চাঁদ। জানালার ফাঁক গলে মেঝেতে আলো ঝলমল করছে। শুটকি মাছের ভর্তা, মুলা শাক, ডাল ভর্তা দিয়ে রাতের খাবারটা শেষ করে শুয়ে সেকান্দার আলী বলছে, খাবার শেষ হয়নি? পায়ের গোড়ালিতে খুব ব্যাথা, টিপে দাও গো। কোনো কথা বলল না হাপ্পু বেগম। থালা, বাটি ধুঁয়ে পান বানিয়ে চাবাইতে চাবাইতে সেকান্দার আলীর পাশে এসে শুয়ে পড়ল সে।
টিনের ঘর। চারপাশ পাঠশোলা, ছনের তৈরি বেড়া দেওয়া। সামনে ও পিছনের দরজা বাঁশের ফালি দিয়ে লাগানো। ফাজিলপুর গ্রামের কামারপুর সড়কের পাশেই এই ঘরটিতে সেকান্দার আলী থাকেন। হাপ্পু বেগমের সঙ্গে তের বছরের সংসার। দুঃখ, বেদনা, যাতনা-এই ঘরটাতেই মিশে আছে বছরের পর বছর। এই তো তিনদিন আগেই দুইজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেল। অবশ্য এই ঝগড়া বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। এরকম ঝগড়া, মান-অভিমান তাদের মধ্যে প্রায়ই হয়। কিন্তু সেদিনের ঝগড়াটা ছিল বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে।
আজ থেকে তের বছর আগে হাপ্পু বেগমকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসে সেকান্দার আলী। কিন্তু তাদের ঘরে কোনো সন্তান আসেনি। গ্রামের কত ডাক্তার, কবিরাজ, হুজুরের কাছে চিকিৎসা ও পানি পড়া নেওয়া হয়েছে সন্তান জন্মদানের জন্য- তার ইয়ত্তা নাই। কিন্তু কোনো ওষুধ কাজে আসেনি।
হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। বিকেলে আজকের মাটি কাটার কাজ তাই শেষ করতে হলো। কোদাল, টুকরি নিয়ে গেল মন্টু মাদবরের বাড়িতে। মন্টু মাদবরের মাটি কাটার কাজ করে প্রায় তিন মাস ধরে। সেকান্দার আলীর তাই গত তিনমাস ধরে সংসারের টানাপোড়েন নিয়ে কোনো দুঃচিন্তা করতে হয়নি। কারণ প্রতিদিনের মাটি কাটার টাকা দিন শেষে দিয়ে দেয় মন্টু মাদবর। সেকান্দরের ঘরে আজ চাল নেই। সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় হাপ্পু বেগম বলে দিয়েছে বাজার থেকে চাল নিয়ে আসতে।
বৃষ্টি শেষ হয়েছে। বৃষ্টিস্নাত বিকেলে আবহাওয়া বেশ মায়াবী। কামারপুর বাজারে আজ হাট। সপ্তাহের রোববার ও বৃহস্পতিবার এখানে হাঁট বসে। এই দুইদিন সাপ্তাহিক হাঁট এখানকার আদি ঐতিহ্য। মন্টু মাদবরের কাছ থেকে দিনের ময়না নিয়ে বাজার থেকে দুই কেজি মোটা ইরি ধানের চাল, সিলভার কার্প মাছ, লাউ কিনে বাড়ি ফিরল সেকান্দার আলী। রোজকার মতো আজও রাতের খাবার শেষ করে শুয়ে পড়ল সে।
ভোরের আলো ফোটার আগেই আজ বের হলো মাটি কাটার কাজে। পথে দেখা হয়ে গেল ডাক্তার বাদশা মিয়ার সঙ্গে। সকালে প্রতিদিন হাঁটে। বাদশা মিয়ার নিত্যদিনের অভ্যাস এই হাঁটা। ভোরের মুক্ত বাতাস, নিস্তব্ধতা তার ভীষণ প্রিয়। বিশেষ করে সকালের পাখির ডাক, ওহ! কত যে প্রিয়!!! এই সাত সকালে সেকান্দার আলীর সাথে দেখা হতেই সেই চিরচেনা জিজ্ঞাসা- সেকান্দার ভাই কেমন আছেন?
-আছি ভালো। আপনি ভালানি?
-আছি ভালো। ভাবী কেমন আছেন?
-আর বইলেন না। ওই যে, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়েই তো যত গ্যাঞ্জামে থাকি। আর ভাল্লাগে না।
-আচ্ছা সেকান্দার ভাই, যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলতে চাই।
-বলেন বাদশা ভাই (মনে মনে ভাবছে, কত আশা ছিল একটা মেয়ে সন্তানের)।
সুন্দর সকাল। গ্রামের লোকজন ঘুম থেকে উঠতে শুরু করেছে। যে রাস্তা দিয়ে সেকান্দার- ডাক্তার সাহেক হাঁটছেন সেই রাস্তার দুইপাশে ধানক্ষেত। একপাশে ছোট্ট একটা পাগাড়। এই পাগাড়ে রমিজ চাচা ভর জাল দিয়ে মাছ ধরছেন। ফজরের আজানের পরপরই রমিজ কাকা এখানে ঘণ্টাখানেক সময় মাছ ধরে। প্রতিদিনের মতো আজও বিড়ি টানতে টানতে মাছ ধরছে সে। ডাক্তার সাহেব আর সেকান্দার রমিজ কাকার কাছে আসছে রশি ধরে টান দিল। জাল পানির নিচ থেকে উপরে উঠে গেল। আর জালের মধ্যে চার পাঁচটার মতো কাতলা মাছ লাফালাফি শুরু করল।
রাস্তার নিচে পাগাড়। পাশে একটা কালভার্ট। এখানে বসে বাদশা মিয়া বলল-শোনেন সেকান্দার ভাই, আমি যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডিউটি করি, গতকাল সেখানে একটা বাচ্চা পাওয়া গেছে। কন্যা সন্তান। ওই কন্যার ওয়ারিশ কাউকে পাওয়া যায়নি। আপনি রাজী থাকলে আমি ব্যবস্থা করতে পারি। আপনার সন্তান নেই তাতে কী। নিজের মতো করে কন্যাকে নিয়ে লালন-পালন করবেন। কথাগুলো শোনার পরই সেকান্দার আলী রাজী হয়ে যায়। ততক্ষণে সূর্য উঠেছে পূব আকাশে। একটি সোনালী দিনের প্রত্যাশায় সেকান্দার চলল মন্টু মাদবরের মাটি কাটার কাজে।
সকাল নয়টা। মাটি কাটার কাজ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু সেকান্দারের মনে আজ অন্যরকম রোমাঞ্চ। কখন বিকেল হবে, কখন মাটি কাটার কাজ শেষ হবে, কখন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাবে, কন্যাটাকে নিয়ে কখন হাপ্পুর কাছে যাবে- নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
মাগরিবের আজান হচ্ছে। ঘরে বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে হাপ্পু বেগম। ক্যারোসিন দিয়ে চলা বাতিটা যেন আজ অন্যদিনের চেয়ে বেশি আলোয় আলোকিত হয়েছে। রাতের রান্নাটাও সন্ধ্যার আগেই শেষ করে রেখেছে সে। বাইরে সন্ধ্যার আকাশটাও চমৎকার। আকাশে অনেক তারা। ঘরের পাশে অনেকগুলো সুপারি গাছ, জামগাছ, লাউগাছ। দুই তিনটা জোনাকি পোকা জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে উড়াউড়ি করছে। আর হাপ্পু অপেক্ষা করছে সেকান্দারের।
সেকান্দার আলী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে কন্যাকে নিয়ে চলে এল বাড়িতে। বয়স মাত্র একদিন। হাপসাতাল থেকেই শিশুটির পুরো এক বছরের খাবার, ওষুধপত্রসহ সবকিছু ব্যবস্থা করে দিয়েছে। রাত আটটার একটু আগে যখন বাড়িতে ফিরল সেকান্দার আলী তখন বাড়িতে নতুন চাঁদের আলোয় ঝলমল। হাপ্পুর গায়ে বেগুনী রংয়ের টাঙ্গাইলের শাড়ী। সেকান্দার আলী যে তাকে এরকম একটা উপহার দেবে কখনো কল্পনা করতে পারেনি। সকাল থেকেই হাঁটাহাঁটি, মাটিকাটা, হাসপাতাল, বাজার- অনেক ক্লান্ত সেকান্দার। এদিকে কন্যাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল হাপ্পু।
আট বছর পর। মেয়েটি বড় হয়েছে। মাত্র এক দিন বয়সে যখন সেকান্দার বাড়ি নিয়ে আসে তার পরের দিনই রোকেয়া নাম রাখে হাপ্পু। গত আট বছরে এক দিনের জন্যও মেয়েকে চোখের আড়াল হতে দেয়নি হাপ্পু। কামারপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রোকেয়া দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠেছে।
সকালটা মেঘে ঢাকা। আকাশে ভারী মেঘ। মনে হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হবে। সেকান্দার বাড়িতে নেই। পাশের গ্রামে নতুন কাজ পেয়ে সে ওইগ্রামে চারদিন থাকবে। কাজ শেষে বাড়ি ফিরবে। সকালে হাপ্পু, রোকেয়া ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে। নাস্তা শেষে রোকেয়াকে বলে, স্কুলে আজ একা যেতে। যদিও রোকেয়া প্রায়ই অভিযোগ করত স্থানীয় বাসিন্দা পাগলা নান্টুর নামে। পাগলা নান্টু তাকে প্রায়ই বিরক্ত করত। রাস্তায় দেখা হলেই জোর করে সাইকেলে উঠাতে চাইত। জঙ্গলের দিকে নিয়ে যেতে চাইত জোর করে। বেশ কয়েকবার একই অভিযোগ করায় সেকান্দার আলী একবার গ্রামের চেয়ারম্যান অমিতাভ চৌধুরীর কাছে অভিযোগও করেছিল। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে রোকেয়া। পথে দেখা পাগলা নান্টুর। দেখা হতেই রোকেয়াকে জোর করে জড়িয়ে ধরে। রোকেয়ার চিৎকারে আশেপাশের লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করে।
বাড়িতে এসে মাকে খুলে বলে এ ঘটনা। এরপর থেকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয় রোকেয়া। বাবা সেকান্দার চারদিন পর বাড়ি ফিরে মেয়ের এ অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এরপর গ্রামের অনেকের কাছেই ছুটে যান এ ঘটনার একটা কিছু করতে। কিন্তু এলাকায় পাগলা নান্টু এত প্রভাবশালী যে কেউ কিছু করতে চায় না। প্রতিবাদ যেন প্রভাবশালীদের কাছে জিম্মি। কী আর করা। সেকান্দার বেছে নেয় অন্যজীবনের পথ। সত্যি সত্যি কামারপুর রেলস্টেশন এলাকায় ট্রেনের নিচে কাটা পড়েন সেকান্দার আলী ও তার মেয়ে রোকেয়া।
এ ঘটনা শোনার পর হাপ্পু বেগম পাগল প্রায়। মাত্র একদিন বয়সে রোকেয়াকে নিজেদের কাছে নিয়ে এসেছিলেন সেকান্দার আলী। এরপর থেকে একদিনের জন্যও তাকে কাছ ছাড়া করেননি। সেই মেয়েকে সুরক্ষা দিতে না পেরে আত্মঘাতী হলেন বাবা। বাড়িতে অনেক ভিড়-ভাট্টা। এলাকায় যেন শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বাকরুদ্ধ হাপ্পু। কী হবে তার সামনের দিনগুলো। কেন এমন হলো সুখের এই জীবনে।
এক সপ্তাহ পর। থানা, পুলিশ, গ্রামের মাতবর, গণমাধ্যম কর্মী- কতকিছুই তো দেখলেন হাপ্পু। কিন্তু এখন এসব দিয়ে কী হবে! সব হারিয়ে এখন শুধুই চারদিকে ঘোরাঘুরি করে হাপ্পু। কামারপুর রেলস্টেশনের পাশেই একটা গোরস্তান। এই গোরস্তানের পাশে একটা বটগাছ। এই গাছের নিচে বসে আছে। একমাত্র সন্তানসহ স্বামী হারিয়ে গেল। বেঁচে থাকার অবলম্বনটুকু হারিয়ে কেবলই কাঁদছেন হাপ্পু বেগম। এ সময় একজন মহিলা এসে তাকে নিয়ে যায় কামারপুর রেলস্টেশনে।
ছবি: ইন্টারনেট