১ম পর্বের লিংক: সাইকো (১ম পর্ব)
৩য় পর্বের লিংক: সাইকো (৩য় পর্ব)
শেষ পর্বের লিংক: সাইকো (শেষ পর্ব)
(২য় পর্ব)
বেশ কয়েকবার এই রকম ঘটলো।
আমার ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আমি রিক্সায় ফিরছি। আমি মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। রাস্তার জ্যামে এক জায়গায় সব ঠাঁয় দাঁড়ানো। বিরক্ত হয়ে বাইরে তাকালাম। দেখি এক লোক, মাথায় কাঁচা পাকা চুল। পাকা চুলই বেশি। একটু বয়ষ্ক। বেশ বড় একটা ভুড়ি আছে। এমন একটা লোক আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। লোকটার তাকানোতে একটা কিছু ছিল। আমার খুব অস্বস্তি হলো।
এরপর আরেকদিন, ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে ফিরে আসছি। হঠাৎ রিক্সা থামিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো, ঐ লোকটা! আশ্চর্য! আমার নাম ধরে ডাকলো, “হেলেন!”
খুব ভড়কে গিয়েছিলাম আমি। বললাম, “আপনি কে, আমি আপনাকে চিনি না!” লোকটা খুব অবাক হলো যেন, বললো, “হেলেন, তুমি আমাকে চিনতে পারছো না?” লোকটাকে কেমন উদ্ভ্রান্তের মত দেখাচ্ছল। রিক্সাওয়ালাকে একটা ঝাড়ি দিলাম, “এই! রিক্সা থামিয়ে রেখেছেন কেন? জলদি চালান।”
লোকটাকে পেছনে ফেলে দ্রুত বাসায় ফিরে আসি আমি।
তার পরদিনও প্রায় একই ঝামেলায় পড়লাম। লোকটা দূর থেকে আমাকে দেখে চিৎকার করে বলছিল, “হেলেন, আমার কথাটা একটু শোন!” রিক্সাওয়ালাকে তাগাদা দিয়ে দ্রুত বাসায় চলে এলাম। আমার বাচ্চা ছেলেটা পর্যন্ত ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল।
বাসায় এসেই প্রথমে হাসানকে ফোন দিই। হাসান আমার স্বামী। আমাদের বিয়ে হলো বছর সাতেক। এর মধ্যে দু সন্তানও এসেছে ঘর আলো করে। দুজনই ছেলে। একজন মাত্রই স্কুলে যাওয়া শুরু করলো। আরেকজনের বয়স আড়াই বছর। দাম্পত্য জীবনে আমরা বেশ সুখী।
হাসানের সাথে আমার পরিচয় অনলাইনে। এ যুগে অনলাইনে পরিচয় আর তারপর বিয়ে অনেক রিস্কি। কিন্তু আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলো।হাসানের উদ্যোগেই হলো। তখনো আমাদের দেখা হয় নি।ভার্চুয়াল আলাপ পরিচয়।হাসানই বলেছিল, একদিন বৃষ্টির দিনে আমরা দেখা করবো।আমাকে ও সাদা শাড়ি পরে যেতে বলেছিল। হাসানের ইচ্ছেমত বর্ষার এক বৃষ্টির দিনেই আমাদের দেখা হয়।আমি ওর কথা মতো সাদা শাড়ি পরেই গিয়েছিলাম। যেতে যেতে পথে অবশ্য একটু ভয় করছিল, আকাশ এত কালো হয়ে আসছে, যদি পৌঁছুতে না পারি! কিন্তু না, আমি ঠিক ঠাকই পৌঁছে যাই।
হাসানের কাছে গিয়ে যখন পৌঁছুই, তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। আমার টেনশন হয়, ‘ইস! এমন বৃষ্টি হলে ফিরবো কিভাবে?”
— হায়, বৃষ্টি, তুমি এমন জোরে এসো না, যাতে আমার প্রিয়া আসতে না পারে। আর যদি সে এসেই পরে, তবে এমন জোরে এসো যেন সে যেতে না পারে!”
সেদিন সত্যিই আমার ফেরা হয় নি। আমরা বিয়ে করে ফেলি কাজী অফিসে গিয়ে। তারপর “তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো” অবস্থা। সত্যিই আমি অনেক সুখী। হাসান আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমার দুটো ফুটফুটে ছেলে, আর কী চাই জীবনে?
কিন্তু এ কয়দিনে এই অদ্ভুত লোকটা জীবন দূর্বিসহ করে দিয়েছে। হাসানকে সব ঘটনা বলার পর বললো, এখন থেকে যেন রিক্সায় বা একা চলাফেরা না করি। অফিস থেকে ও গাড়ি পাঠিয়ে দেবে। যখন প্রয়োজন আমি গাড়িতেই যাতায়াত করবো।
এরপর গাড়িতেই যাতায়াত শুরু করি। আশ্চর্য লোকটা কিভাবে যেন আমার সব টের পেয়ে যায়। রাস্তার জ্যামে গাড়ির জানালায় এসে টোকা দিয়ে কথা বলতে চায়। ঘটনা এখানেই শেষ না।
সেদিন ছুটির দিন ছিল। আমি সব সময় আর্লি রাইজার। ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গেলাম। হঠাৎ শুনি আমার নাম ধরে কেউ ডাকছে।দেখি ঐ লোক, আমাদের বাসার সামনে রাস্তায় দাঁড়ানো। দ্রুত ঘরে ঢুকে হাসানকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে উঠাই।ছুটির দিনের সকালের ঘুম,হাসান একটু বিরক্ত, ‘কী হয়েছে?’
— ঐ লোকটা আমাদের বাসার সামনে রাস্তায়!
— কোন লোক?
— ঐ যে, আমাকে বিরক্ত করে, দেখে যাও!
— দেখা লাগবে না। মনে হয় প্যারিস এসেছে।
— কে এসেছে? ( হাসানের কথা বুঝতে না পেরে আমি প্রায় চিৎকার করে উঠি)
— আরেহ, প্যারিস, প্যারিস! আরেকজনের বউ ভাগিয়ে নিয়ে যায়। চিনলে না? হেলেন অফ ট্রয়ের প্রেমিক।ঐ রকমই কেউ হয়ত তোমার!
— তুমি একটু সিরিয়াস হবে?
— হুম, এইবার আমাকে সিরিয়াস হতে হবে। সত্যিই যদি তোমাকে ভাগিয়ে নিয়ে যায়!
— অসহ্য একটা তুমি!
হাসান প্রথমে বিষয়টা হালকাভাবে নিলেও পরে সিরিয়াসলিই নেয়। কারণ, ঐ লোকের জন্য আমি এক রকম ঘরে বন্দি। উদ্ভ্রান্ত একটা লোক। তাই বাইরে আমি আর পারতপক্ষে যাই না। ছেলে স্কুলে আনা নেওয়ার দায়িত্ব হাসানই নিয়েছে।
সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে গেলো একদিন। কলিং বেলের শব্দ শুনে দরজার পিপহোলে তাকিয়ে দেখি ঐ লোক। হাসান অফিসে আর বড় বাবু স্কুলে। বাসায় তখন শুধু আমি আর ছোট বাবু। লোকটা পাগলের মত দরজা ধাক্কাচ্ছে, “হেলেন! হেলেন! তুমি আমাকে সত্যি চিনতে পারছো না! যত কিছুই হোক সব সময় তুমি তো আমার কাছেই ফিরে এসেছো।এবার এতো দেরি করছো কেন? আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি! হেলেন, দরজা খোল!!”
লোকটা আবোলতাবোল বলেই যাচ্ছে। আমি দ্রুত হাসানকে কল করে সব জানিয়ে দিই।এবার হাসান সত্যিই রেগে যায়। তারপর পুলিশ কর্মকর্তা বন্ধুকে ফোন করে আসতে বলে। হাসানের বুদ্ধিতে আশেপাশের প্রতিবেশীদেরকেও ফোনে ফোনে বিপদের খবরটা জানিয়ে দিই। তারপরের ঘটনা সামান্যই। প্রতিবেশীরা পাগল লোকটাকে ধরে মারধোর করে এবং বেঁধে রাখে। এদিকে হাসানও তার পুলিশ বন্ধুসহ বাসায় চলে আসে। পুলিশ লোকটাকে পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে যায়।
সব কিছু দ্রুতই ঘটলো। কিন্তু অদ্ভুত লোকটা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলো না। সে বারবার, “হেলেন, তুমি ফিরে এসো প্লিজ, ওদেরকে মানা করো আমার সাথে এমন বিহেভ না করতে। তোমার কোন ইচ্ছেতেই তো আমি কখনো বাধা দিই নি হেলেন! তাহলে আজ তুমি এমন করছো কেন?” এইসব আবোলতাবোল বলতেই থাকলো। আচ্ছা পাগল লোকটা!
সবাই চলে গেলে, হাসান একটু সুস্থির হয়ে ফ্যানের নিচে বসলো।
— উফ! ঝামেলাটা গেলো।
— আপদ একটা। এতদিন কি জ্বালানটাই না জ্বালালো! তুমি তো আমার কথায় পাত্তাই দিচ্ছিলে না।
— আমার কাছে নিরীহই মনে হয়েছিল।
— আর এই হলো নিরীহর নমুনা! আজ দেখলে তো!
— তোমার কোন ব্যর্থ প্রেমিক মনে হয়।
— ব্যর্থ প্রেমিক না ছাই! আস্ত পাগল একটা!
— হুম, পাগলই। তোমাকে ভালোবাসে কিনা!
— তুমিও তো আমাকে ভালোবাসো!
— হুম, ভালোবাসতে বাসতে আমিও যদি একদিন এরকম পাগল হতে পারতাম!
— এগুলো কি রকম কথার ছিরি!
— পাগলেরাই কেবল এতটা ভালোবাসতে পারে। হেলেন, তুমি কি বুঝতে পারছো, লোকটা তোমাকে কত ভালোবাসে?
— আমি এত কিছু বুঝতে চাই না, হাসান!
— ঐ লোকটাকে আমার এখন ঈর্ষা হচ্ছে।
(চলবে)
১ম পর্বের লিংক: সাইকো (১ম পর্ব)
৩য় পর্বের লিংক: সাইকো (৩য় পর্ব)
শেষ পর্বের লিংক: সাইকো (শেষ পর্ব)