নিশিকর্ম

চিন্তাহরণ অনেক চিন্তাভাবনা করে বলল “চোরের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিৎ। পন্ডিতমশাইয়ের বাড়িতে চুরি করার মত এমন হীন কর্ম আর হতে পারেনা।” সকলেই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চৌকিদার গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলল “তা বাপু চিন্তাহরণ, তুই জানিস নাকি চোর কে?” চিন্তাহরণ প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল “না ভাই, আমি নির্বিবাদী মানুষ চোরের খবর রাখব কিভাবে ?”
-না… হোসেন আলীর পুকুরের মাছ চুরির খবর তো কারও অজানা নয়…!
-আরে চৌকিদার ভাই, মাছ চুরি করেছি বটে; পুকুর চুরি তো করিনি ! পন্ডিতমশাইয়ের পানের বাটাখানি তো পুকুর চুরিই বটে ! একাজ আমার সাধ্যে নেই ভাই।
সভায় উপস্থিত অনেকেই চিন্তাহরণের কথায় সায় দিল। চিন্তাহরণ চুরি-চামারি করে বটে তবে নিজের গ্রামে নয়। নিজের গ্রামে চুরি করা আর নিজের ঘরে চুরি করা একই বিষয়।
পন্ডিতমশাই হাহাকার করে উঠলেন। “তবে কি উদ্ধার হবেনা আমার পানের বাটাখানি ?” চিন্তাহরণ কেঁদে ফেলল। তার এই অতিভক্তি দেখে সকলেই মোটামুটি অবাক। চৌকিদার বলল “হয়েছে হয়েছে, থাম এবার। ই…পন্ডিতমশাইয়ের জন্য দেখি দরদ উথলে উঠছে!” চিন্তাহরণের কান্না হঠাৎ থেমে গেল। সে বিষ্ময়ভরা কন্ঠে বলল “ কি যে বলিস ভাই, যার নুন খাই তার জন্য তো দরদ থাকবেই।” পন্ডিতমশাই এবার নড়েচড়ে বসলেন।
-“হ্যাঁ রে চিন্তাহরণ, তোকে কোনদিন খাইয়েছি বলে তো মনে পড়ে না।”
– আপনাদের দানেই তো বেঁচে আছি পন্ডিতমশাই। নইলে না খেয়ে শুকিয়ে শুকিয়ে মরতে হতো। আপনার বয়স হয়ে গেছে বলে কিছুই মনে থাকেনা। এই তো সেদিন লক্ষীপূজায় পেট ভরে খিচুড়ি খেয়ে আসলাম।”
-অ….তাই বুঝি? আমি নির্বিবাদী মানুষ। থানা-পুলিশ করা আমার কর্ম নয়। সম্মানে বাধে। তোমরা গ্রামের দশজন আছো দেখো আমার পানের বাটাখানি উদ্ধার করতে পার কিনা। আমি এবার উঠি। ”
সভা ভেঙ্গে গেল। মুরুব্বিরা চুরির তদন্ত সংক্রান্ত আলাপচারিতা করতে করতে নিজ নিজ গন্তব্যে চলল। সভাস্থলে উপস্থিত ছিল কিছু যুবা। তারা চোর পেটানোর জন্য এসেছিল। শেষ পর্যন্ত চোর ধরা না পড়ায় বিফল মনোরথে তারা ফিরতে লাগল। শুধু চিন্তাহরণ আগের মতই মাটিতে বসে একটি বিড়ি ধরাল। পন্ডিতমশাইয়ের পানের বাটা চুরি যাবার পর তার ঘর-বাড়ি তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে। জমাদার ডেকে এনে তার বাড়ির শৌচাগারটাও পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। পন্ডিতবাড়ির দুই ধুমসি কাজের মহিলা এসে উল্টেপাল্টে দেখেছে বউয়ের দেহমন্দিরের আবরণের আধার। কিছুতেই কিছু হয়নি। তাই চিন্তাহরণ বেকসুর খালাস। কিন্তু সকল কিছু তল্লাশি হলেও চিন্তাহরণের দেহ তল্লাশি হয়নি। হয়তো কারো মনেই আসেনি সেই কথা। তাই পানের বাটাটি তার লুঙ্গির ভিতরের গোপন কুঠুরিতে বহাল তবিয়তেই আছে। রুপার জিনিস। পন্ডিতমশাইয়ের স্বর্গবাসী (গ্রামবাসীর মতে নরকবাসী) স্ত্রীর স্মৃতি। এই বিদুষী (!) মহিলার কথামৃতের ভয়ে পন্ডিতমশাইয়ের বাড়ির ধারেকাছে কেউ যাওয়ার সাহস করতো না। উনার স্বর্গ অথবা নরকপ্রাপ্তির পর এই প্রথমবার চিন্তাহরণ সেই দুঃসাহস দেখিয়েছে। সে নিজের এলাকায় চুরি করেনা কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। তবে চুরি করে ধরা পড়ার রেকর্ডও তার নেই। তার বড়ভাই হৃদয়হরণও এককালের নামকরা চোর ছিল। তবে মাসছয়েক আগে ধরা পড়ে বেদম পিটুনি খেয়ে এখন দেশান্তরী হয়েছে। এতে চিন্তাহরণের সুবিধাই হয়েছে। কারণ দাদার দাদাগিরি শিকার আর হতে হয় না। সে প্রয়োজন অনুসারে চুরি করে বউ নিয়ে আনন্দেই কেটে যাচ্ছে দিনকাল। তবে একটা বাচ্চা নেই তাদের এই যা দুঃখ। লোকে বলে সারারাত চুরি করে বেড়ালে বাচ্চা হবে কি করে ! চিন্তাহরণ বিড়িটি শেষ করে লুঙ্গিটা আবার ভাল করে গিঁট দেয়। তারপর শার্টের গুপ্তপকেট থেকে একটি দড়ি বের করে লুঙ্গির উপর খুব টাইট করে বাঁধে। তারপর কৃষ্ণনাম করতে করতে উঠে দাঁড়ায়। তার একমাত্র শিষ্য মোহন বেশ কিছুক্ষণ ধরেই লুকিয়ে ওস্তাদের কর্মকান্ড দেখছিল। এবার দৌড়ে এসে চিন্তাহরণের পা জাপটে ধরে। চিন্তাহরণ বিরক্ত হয়ে বলে
-আ..ঃ করছিস কি ?
-তোমার চরণধুলি নেই গো! আর কেউ না জানুক আমি তো জানি পন্ডিতমশাইয়ের প্রসাদ তোমার ভোগেই গেছে ?
-তুই কি করে জানলি ?
-আজ্ঞে লুকিয়ে দেখেছি !
-বিদ্যে তো ভালই আয়ত্ত্ব করেছিস ! এবার তো আমার মাথায় চড়ে নাচবি দেখছি।
মোহন জিভ কেটে বলে “ছিঃ ছিঃ ছিঃ ওস্তাদের ওপরে ওস্তাদি করা মহাপাপ! আমি চোর হতে পারি কিন্তু মহাপাতক হতে পারব না।”
-হয়েছে হয়েছে। এবার মালটা পাচারের ব্যাবস্থা করতে হবে।
-ও কাজ এখন ভুলেও করতে যেও না যেন! গ্রামের লোকজন চারিদিকে নজর রেখেছে। পন্ডিতমশাইয়ের বাড়িতে চুরি বলে কথা!
-তবে উপায় কি হে মোহন ?
-লোকজনের কাছ থেকে শুনলাম গ্রামে এক সাধু এসেছে। তন্ত্রমন্ত্রও নাকি জানে। তুমি জিনিসটা যদি তাকে উপহার দাও তবে তো নিরাপদ।
চিন্তাহরণ খেপে গিয়ে বলল “ইয়ার্কি করিস গর্ভদ ! চুরি করেছি আমি আর জিনিস নেবে ঐ কোথাকার কোন সাধু!”
-আহা চটছো কেন? শোন, সাধুর তো নিশ্চয়ই এসব বৈষয়িক বিষয়ে কোন আগ্রহ নেই। আর যদি সেই সাধুর লোভ হয়েই থাকে, জিনিসটা হাতানোর মতলব করেই থাকে তবে তো উপায় আছেই। তোমার অব্যার্থ বিদ্যে প্রয়োগ করবে।
চিন্তাহরণ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মোহন বলে “আর কয়েকঘন্টারই তো মামলা, কাস্টমারকে বলে আসব; রাত্রি দ্বিপ্রহর হলেই বেঁচে দিবেন।”
শিষ্যের এই প্রস্তাব চিন্তাহরণের মনে ধরল। সে বলল “তো কোথায় পাওয়া যাবে সেই সাধুকে ?”
-আজ্ঞে আপনি আদেশ করলে আমিই ডেকে নিয়ে আসব। একটা রাত না হয় তোমার বাড়িতে থাকল।
-বলিস কি রে ! এক্কেবারে বাড়িতে এনে তুলবি ?
– ওস্তাদ তুমি সিস্টেম বোঝ না। এইরকম একজন সাধু যদি তোমার বাড়িতে আসে তবে তোমার ইজ্জত বৃদ্ধি পাবে কিনা বল ? গ্রামের দশজন সাধুসঙ্গের আশায় আসবে। তুমি তাদেরকে সাধুদর্শনের ব্যাবস্থা করে দিবে। তারপর রাত্রি দ্বিপ্রহর হলেই জিনিসটা হস্তগত করে সাধুকে কালীমন্দিরে স্থানান্তর করলেই হবে।
-তা সাধু কি এতে রাজি হবেন ?
-হবে না কেন ? সাধু তো সাধুই । সংসারত্যাগী মহাপুরুষ ! মা কালীর আশ্রয় তার কাছে অপছন্দ হবে না। ঠিক কিনা বল ?
চিন্তাহরণ আরেকটি বিড়ি ধরিয়ে বলল “তবে যা, ডেকে নিয়ে আয় সেই সাধুকে।”
মোহন দৌড়াতে দৌড়াতে চলল। চিন্তাহরণ দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বাড়ির পথ ধরল। বিকেল হয়ে এসেছে। দুপুরের খাওয়া হয়নি এখনও। বউ ভাত বেড়ে আসন বিছিয়ে বসে আছে। চিন্তাহরণ হাত-মুখ ধুয়ে গপাগপ করে খেতে লাগল। বউ পা ছড়িয়ে বসে অন্যদিকে তাকিয়ে পান চিবোচ্ছে। চিন্তাহরণ বলল “বসে না থেকে উঠোনটা একটু ঝাড়ু দাও। সাধুবাবা আসছে!” বউ টিপ্পনি কেটে বলল “চোরদের সাধু বুঝি ?” চিন্তাহরণ বিরক্ত হয়ে বলল “বাজে বকো না তো। যিনি আসছেন তিনি বিশাল তান্ত্রিক। উনার আশীর্বাদ পেলে আমরা একটা বাচ্চার মুখও দেখতে পারি!” বউ একই সুরে বলল “নিজের জোর নাই আবার সাধু আনছে! বুড়া বলদ কোথাকার!” বউ দুপদাপ করে চলে গেল। চিন্তাহরণ বিষম খেল । তার বউ যে তাকে এই প্রথমবারের মত বুড়া বলদ বলে সম্বোধন করেছে তা নয়। তবে এই খাওয়ার সময় কি না করলেই নয় ? এমন সময় মোহনের গলা শোনা গেল “ওস্তাদ, ও ওস্তাদ, সাধুজী এসেছেন ! চিন্তাহরণ তাকাল। সাধু প্রকৃতির কাউকে তার চোখে পড়ল না। মোহনের পাশে শহুরে পোষাক পড়া একটা লোক। সেটা সাধু নয় নিশ্চয়। চিন্তহরণ আরও বিরক্ত হয়ে বলল “কোথায় তোর সাধু ?”
-এই তো..ইনি.! শহুরে লোকটাকে দেখিয়ে বলল মোহন।
-এ সাধু ?
লোকটি এবার কথা বলল। “সাধু কিনা জানিনা, তবে আমি একজন সাধক। পোষাকটা একটু আধুনিক বটে, তবে কাজকম্ম সেই আদিকালের মতই শক্ত। দেখতে চাও ?
চিন্তাহরণ মাথা নাড়ল। লোকটি এবার তার দুহাত প্যান্টের পকেট থেকে বের করে মুষ্টি খুলল। সাথে সাথেই তার দুহাতে আগুন জ্বলে লাগল। চিন্তহরণের চোখ কপালে উঠে গেল। সাধুদর্শন এর আগেও তার দু-একবার হয়েছে। তাই বলে এমন আগুন জ্বালানো আধুনিক সাধু বাপের জন্মে চিন্তা করেছিল সে ? সে হাতজোর করে সাধুর দিকে ছুটতে লাগল। মোহন ইতোমধ্যেই সাধুর পা ধরে বসে পড়েছে। চিন্তাহরণ তাকে মৃদু ধমক দিয়ে সাধুর পা ছাড়িয়ে অতীব বিনয়ের সাথে সাধুকে বরন করে নিল। চিন্তাহরণের বউও সাধুর আগুন প্রজ্বলন দেখে এখন ভক্তিতে মশগুল। তার মাথা ঠান্ডা হয়েছে। সে সাধুর জন্য মিষ্টান্ন রান্নার আয়োজন করছে। বারান্দায় পাটি বিছিয়ে তার উপর চাদর পেতে দেয়া হয়েছে। কোলবালিশের অভাবে দেয়া হয়েছে মাথার বালিশ। ইতোমধ্যে আগুন জ্বালানো সাধুর কথা গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন প্রকার সমস্যা সমেত গ্রামবাসী ছুটে আসছে। যাদের কোন সমস্যা নেই তারা হাহাকার করছে। এই গ্রামে চিন্তাহরণ আজ বিশাল ওজনদার ব্যাক্তি। এতদিন যে সবার কাছে নতজানু হয়ে থাকত, চোর বলে গালি শুনতে হতো, আজ তার নির্দেশই গ্রামের সবাই উঠবস করছে। কে আগে আসবে কে পরে আসবে সেটাও চিন্তাহরণই ঠিক করে দিচ্ছে। পন্ডিতমশাই তার পানের বাটার সন্ধানের আশায় অনেক্ষণ ধরেই সাধুজীর হাটু টিপে দিচ্ছেন। চিন্তাহরণ সেই ‘অমূল্য রতন’ টি আগেই কৌশলে পাটির নিচে চালান করে দিয়েছে। মোহন ওস্তাদের অনুমতি নিয়ে মহাজনকে খবর দিতে গেছে। তবে সাধুজী কারও সমস্যাই শুনছেন না। তিনি বারান্দায় বালিশে আধাশোয়া হয়ে পান চিবুচ্ছেন এবং কিছুক্ষণ পরপর চুক চুক করে দুইবার শব্দ করছেন। এরই মাঝে একবার পকেট থেকে হাত বের করে আগুন প্রজ্জলন করেছেন। লোকজন সবাই প্রথমে ভয়ে দৌড় দিলেও ফিরে এসেছে সাধুর লীলাদর্শনের আশায়। রমনীরা কেঁদেই আকুল। কয়েকজন পুরুষলোকও গঞ্জিকা সেবনপূর্বক মাটিতে লুটোপটি হয়ে কাঁদছে।
এহেন অভূতপূর্ব ঘটনার মাঝে হঠাৎ এক দুর্ঘটনা ঘটল। চিন্তাহরণের শিষ্য মোহন ভিড় ঠেলে এসে বিকট এক চিৎকার দিয়ে সাধুর সামনে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল ! সবাই হাহাকার করে উঠল। সাধু সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে হাত তুললেন। জনতা আশ্বস্ত হল। গঞ্জিকাসেবীদের ভক্তির রোদন আরও উথলে উঠল। কিছু সময় পর সাধুজী চিন্তাহরণকে ঠোঁট নেড়ে কি যেন বললেন। চিন্তাহরণ তড়িঘড়ি করে ঘোষণা করল “সাধুজী আজ সবাইকে চলে যেতে বলেছেন। তিনি বিশ্রাম নেবেন। যদি কেউ কথা না শুনে তার ভীষণ ক্ষতি হবে।” মূহুর্তেই খালি হয়ে গেল চিন্তাহরণের ছোট্ট উঠোন। সাধু আবার চুকচুক করে শব্দ করলেন। চিন্তাহরণ ধমক দিয়ে মোহনকে বলল “হয়েছে হয়েছে এবার ওঠ। বেশি ঢং করতে হবেনা।” তার গলার স্বরে মোহন চমকে উঠে চোখ পিটপিট করতে লাগল। চিন্তাহরণ চেঁচিয়ে বউকে বললেন সাধুজীর জন্য খাবার পরিবেশন করতে। বউ মাথায় একহাত ঘোমটা টেনে বড় কাঁসার থালায় খাবার পরিবেশন করল। কাঁসার থালাটি অবশ্য চুরিকৃত নয়। বৈবাহিকসূত্রে সেটা এখন চিন্তাহরণ পরিবারের সম্পত্তি। সাধুজী ভয়াবহ ধরনের খাওয়া দিলেন। তার বনেদী ভুঁড়িখানা আরও দর্শনীয় হয়ে উঠল। মোহন ও চিন্তাহরণ বহুকষ্টে তাকে ধরে ওঠাল। গরীব চিন্তাহরনের একটি মাত্র ভাঙ্গাচোরা ঘর। সেই ঘরের ভেতরে একটিমাত্র চৌকি যত্নসহকারে সাজানো হয়েছে। সেখানেই শয্যা হলো সাধুজীর। তারপর খাওয়া দাওয়া সেরে পাটি বিছিয়ে মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়ল চিন্তাহরণ ও তার বউ। মোহন পানের বাটাটি বিক্রির ব্যাবস্থা করেছে। সেই মহাজন দ্রুতই চলে আসবে। শিষ্য যে দরদাম করে এসেছে তাতে চিন্তাহরণ খুশি। তাই সে বস্তুখানা হস্তান্তরের দায়িত্ব নিয়ে বারন্দায় খুটিতে হেলান দিয়ে বসে ঝিমোতে লাগল। চিন্তাহরণ নিশ্চিন্ত মনে দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। গতরাত থেকে নির্ঘুম থাকায় শোয়ার সাথে সাথেই নিদ্রাদেবী আবির্ভূত হলেন। গভীর রাতে চৌকির মচরমচর শব্দে চিন্তাহরণের ঘুম ভেঙ্গে গেল। সাধুজীর বোধহয় ঘুম হচ্ছে না। চুকচুক শব্দ শোনা যাচ্ছে। পাশে বউয়ের সাড়াশব্দ নেই। হয়তো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। চিন্তাহরণ নড়াচড়া না করে ঘুমানোর চেষ্ঠা করতে লাগল। একটু পরই সাধুজী কালীনাম স্মরণ করতে করতে বলে উঠলেন “একটু প্রসাদ হলে ভাল হয়!” চিন্তাহরণ মাথা তুলল। সলতে কমিয়ে রাখা হ্যারিকেনের আলোয় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চিন্তাহরণ কান খাড়া করল। সাধুজীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বউ বলে উঠল “খেলেই হয় !” এবার চিন্তাহরণ সাধুজীর আসল লীলা ধরতে পারল। সে বিকট চিৎকার করে উঠে হ্যারিকেনের সলতে উস্কে দিলো । তারপর দরজা থেকে বাঁশের দন্ডটা খুলে সাধুর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সাধু কল্পনাও করতে পারেনি যে চিন্তাহরণ জেগে আছে। সে আগুন জ্বালানোর চেষ্ঠা করল। কিন্তু পকেটে কাঁচামাল বোধহয় ফুরিয়ে গেছে! বউ কাঁদতে শুরু করেছে। সাধুজী এবার লাঠির বাড়ি সইতে না পেরে দরজা খুলে ঝেড়ে দৌড় দিল। চিন্তাহরণ তার শিষ্যকে ডাকতে ডাকতে সাধুজীর পিছু নিল। কিন্তু মোহন সেখানে ছিল না। চিন্তাহরণ সাধুজীকে কিছুদুর তাড়া করে বাড়িতে ফিরে আসল। কপালে পিটুনি আছে ভেবে ওর বউ এখনো কেঁদেই চলছে। যদিও এযাবৎকালে কখনই সে স্বামীর নিকট হতে প্রহার উপহার পায়নি, তবে আজ বুঝি আর ক্ষমা নেই। চিন্তাহরণ অবশ্য সেরকম কিছু করল না। বরং চৌকিতে বসে রোমান্টিক দৃষ্টিতে বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকল কতক্ষণ। কে বলেছে গরীবের বউয়ের সৌন্দর্য্য নেই ? হ্যারিকেনের লাল আলোতে ঘরের মেঝেতে বউটি গুটিসুটি মেরে বসে আছে। চিন্তাহরণের মনে আজ চুরির চিন্তা আসল না। সে ধীরে ধীরে উঠল। বউ আসন্ন পিটুনির ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। মৃদুস্বরে ক্ষমাভিক্ষা করছে। চিন্তাহরণ হাসিমুখে এগিয়ে এসে বউয়ের শাড়ির আঁচল ধরল। ভাঙ্গাঘরটি ভরে উঠল ভালবাসায়।

সাধুজীর এই আকস্মিক অন্তর্ধানে গ্রামের মানুষের মাঝে তেমন কোন প্রভাব পড়ল না। চিন্তাহরণ সবাইকে বলে বেড়াতে লাগল গ্রামের সকলের মঙ্গল কামনা করেই সাধুজী প্রস্থান করেছেন। তার কথার উপরে কোন কথা চলেনা। তাকে বাঁধা দেবারও কিছু নেই। পন্ডিতমশাই জিজ্ঞেস করলো পানের বাটা সম্পর্কে সাধু কিছু বলেছে কিনা। চিন্তাহরণ গম্ভীর কন্ঠে বলল “সাধুজী বলেছেন পানের বাটা আপনার বাড়িতেই আছে, ভালভাবে খুঁজে দেখুন গিয়ে!” পন্ডিতমশাই তড়িঘড়ি করে বাড়ির পথ ধরলেন। চিন্তাহরণের প্রভাব দিনদিন বাড়তে লাগল। তার নিশিকর্মের বিষয়টি গ্রামবাসী প্রায় ভুলেই গেছে। কিন্তু প্রভাবের সাথে যদি প্রতিপত্তি না বাড়ে তবে তো চলে না। ঘরে যে খাবার নেই। বউয়ের শাড়িটিও ছিঁড়ে গেছে। তাই চিন্তাহরণ আবার চুরির সিদ্ধান্ত নিল। মোহন সেই যে ভেগেছে তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাকে পেলে চিন্তাহরণ খুন করবে বলেই মনস্থির করেছে। যদিও সাধুবাবার উপর রাগ পড়ে গেছে। কারণ সাধুবাবার কারণেই এখন সে স্ত্রীর প্রতি মনোযোগী হয়েছে। গ্রামের দশজনের কাছে মাথাটাও উঁচু হয়েছে। কয়েক মাসের মধ্যেই দুজনের সংসারে আরো একটি প্রাণের আগমন ঘটতে যাচ্ছে। এসব কারণে একাই একমাসের মধ্যে ছয় বাড়িতে হামলা করলো সে। ‘উপার্জন’ ও নেহায়েত কম হলো না। খাঁ সাহেবের বিছানার তলা থেকে পাক্কা দশহাজার টাকা উপার্জন করে চিন্তাহরণ খুশিতে আত্মহারা। এরপর কয়েকদিন সে রাতে বের হলোনা। সারাদিন গ্রামের লোকজনকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাঁ সাহেবের ক্ষেতে কাজ করলো। তারপর মজুরী নিয়ে চাল-ডাল ইত্যাদি কিনে নিজের ও বউয়ের জন্য কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরল। কি মনে করে সে অনাগত অতিথির জন্য একটি দুধ খাওয়ার বোতলও কিনে আনল। সেটি দেখে বউ তো হেসেই খুন। গ্রামের মানুষ আবার চিন্তাহরণকে সন্দেহ করতে শুরু করল। যদিও প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলত না। তার যন্ত্রণায় অস্থির গ্রামবাসী শুধু হাতেনাতে ধরার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে লাগল। মাসখানেক জমানো টাকায় খেয়ে একদিন রাতে যখন সে চুরির প্রস্তুতি হিসাবে গৌড়বর্ণ দেহে তৈলমর্দন করছে ঠিক তখনই উঠোনে এসে উপস্থিত হল হৃদয়হরণ। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তার দেহ টলছে। তার অংশের জায়গা-জমি সব গেছে নেশার পেছনেই। দাদার এই নিশিআগমনে চিন্তাহরণ খুশি হতে পারলো না। চৌর্যবৃত্তিতে এতদিন তার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। দাদা এসে তো সেখানে বাগড়া বসাবে। তার মধ্যে যদি বাড়িতে থাকতে চায় তবে তো মহা সমস্যা। তবু সে বলল “দাদা, কখন এলে গো?” দাদা জবাব না দিয়ে বারান্দায় এসে বসল। বলল “আজ কোনদিকে রে ?” চিন্তাহরণের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে মিথ্যা করে বলল “গ্রামের বাইরে। ঐ শান্তিপুরের দিকে।” হৃদয়হরণ হাই তুলে বলল “সেই ভাল। আমি যেহেতু ফিরেই এলাম সেহেতু এখন থেকে গ্রামের দিকটা আমিই দেখব।” চিন্তাহরণ পূর্বেই অনুমান করেছিল। সে বলল “আবার যদি ধরা পড় তবে তোমাকে আস্ত রাখবে ভেবেছ ? তোমাকে এবার মেরেই ফেলবে নয়তো পুলিশে দিবে। ভিটেমাটি সব বেঁচে তো শেষ করেছ। থাকবে কোথায়?” চিন্তাহরণের এহেন রুঢ় আচরণে হৃদয়হরণ মচকাল না। সে দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা করলো “নতুন জায়গা-জমি কিনছি দেখিস। কারও আশ্রয় দরকার নেই।” চিন্তাহরণ ঠোঁট উল্টে বলল “সে আমাকে শুনিয়ে কি লাভ?” তোমার কেনার সামর্থ্য থাকলে তুমি কিন গিয়ে।” হৃদয়হরণ মাটিতে কিল দিয়ে বলল “হ্যাঁ কিনব। অবশ্যই কিনব। তোর এখানে আমি থাকতে আসিনি। শুধু বলতে এসেছি যে এই গ্রামে তুই আর কিছু করতে পারবি না। আমি এই এলাকায় কাজ করব তুই অন্য এলাকায়।”
-তুমি বললেই হল নাকি ? তোমার তো এই গাঁয়ে কোন ঠাঁই নেই। সকালে লোকজন দেখলেই তোমাকে পিটুনি দিবে। তার চেয়ে ভাল যেখান থেকে এসেছিলে সেখানেই ফিরে যাও।”
-আজে বাজে কথা বলিসনি চিন্তে। কেউ আমাকে কিছু বলতে পারবে না। আমার কাছে বিশেষ শক্তি আছে।
-কিসের শক্তি ? চিন্তাহরণ অবাক হয়ে বলল।
হৃদয়হরণ বিশাল ভাব নিয়ে হাসতে হাসতে বলল “কালীমন্দিরে চল, সেখানে এক সাধুবাবা এসেছে। তিনি সবসময় শুন্যে বসে থাকেন। একটিবারও মাটিতে নামেন না। আমি তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছি। তিনি বলেছেন আমাকে আর কেউ ধরতে পারবে না। তার আদেশেই আমি এখন গ্রামে চুরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
নুতন সাধুবাবার আগমনের খবরে চিন্তাহরণের মেজাজ আরও খিচড়ে গেল। এ যে সত্যি সত্যি চোরের সাধু ! ওর বউ এতক্ষণ নিঃশব্দে ঘরের ভেতর থেকে দুই ভাইয়ের কথা শুনছিল। এবারে তার মুখ ফস্কে বেড়িয়ে পড়ল “সাধুবাবা”! বউয়ের কন্ঠে সাধুবাবার জন্য এত পুলক দেখে চিন্তাহরণ বউকে বিরাট ধমক দিয়ে দাদাকে বলল “কোথায় তোমার সাধু? চল এখনি যাব দেখতে।” হৃদয়হরণ হেসে বলল “হ্যাঁ চল তবে। রাত্রি ব্যাতিত দিনে তার দর্শন পাওয়া যায়না।” দুভাই বেরিয়ে পড়ল। দাদার পিছু পিছু চিন্তাহরণ হনহন করে হাঁটতে লাগল। কালীমন্দিরে গিয়ে তো চিন্তাহরনের আত্মারাম খাঁচাছাড়া! দেবীমূর্তির আসনের পাশে সত্যি সত্যিই কালো কাপড় পরিহিত একটি লোক শুন্যে বসে আছে। তার মুখভর্তি দাঁড়িগোঁফ। মাথায় শিবঠাকুরের মত জটা। ঘরটির দুপাশে দুটো প্রদীপ মিটিমিটি জ্বলছে। চিন্তাহরণ হা করে দেখতে লাগল। দাদা খুব গর্বের সহিত বলল “কিরে দেখেছিস ? বলেছিলাম না ?” চিন্তাহরণের কোন নড়নচড়ন নেই। সে তাকিয়েই আছে সাধুবাবার দিকে। দাদা ফিসফিস করে বলল “বাকীটুকুও যদি শুনতে চাস তবে শুনিয়ে দিই।” বলেই সাধুবাবার সামনে গিয়ে ষষ্টাঙ্গে বসে পড়ল। তারপর অতীব বিনয়ের সহিত বলল “সাধুবাবা, একটিবার তাকান। একজন অবিশ্বাসী অকালকুষ্মান্ড এসেছে আপনার দর্শনে!” সাধুবাবা চোখ খুললেন। চিন্তাহরণের বুক ধুকপুক করতে লাগল। হৃদয়হরণ পরম ভক্তিসহকারে শুধাল “সাধুবাবা, একটু বলুন না আমি এ গাঁয়েই কাজ করব নাকি গাঁয়ের বাইরে যাব ?” সাধুবাবা গম্ভীর কন্ঠে বললেন “বারবার একই কথা বলিস কেন ? বলেছি তো একবার।”
-আরেকবার বলুন না বাবা। আমার ভাইটির ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনার মুখে শুনতে চায়।
-বিশ্বাস করেনা! ও নরকবাসী হবে!
চিন্তাহরণ কেঁদে ফেলল। হৃদয়হরণ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল “এমন অভিশাপ দিবেন না বাবা। হাজার হোক ও তো আমার ছোট ভাই। মাসতুতো নয়, একেবারে আপন ভাই।” সাধুবাবা গর্জে উঠলেন “ধ্বংস হবে….! ধ্বংস হবে…!” চিন্তাহরণ এবার ভূতলে আছড়ে পড়ে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল “আমার কোন অবিশ্বাস নেই বাবা, আপনি যেটা বলেছেন সেটাই হবে। আমার কোন ক্ষতি করবেন না সাধুবাবা। আমায় ক্ষমা করুন….।’ অনেক্ষণ কান্নাকাটির পর সাধুবাবার মন গলে গেল। সে দুজনকেই ক্ষমা করে তার প্রদত্ত নির্দেশ পালন করতে বললেন। হৃদয়হরণ জমি কেনার পূর্ব পর্যন্ত মন্দিরে থেকে সাধুবাবার সেবায় নিয়োজিত হবে বলে ঘোষণা করল। এতে গ্রামের মানুষের কাছেও তার ভাবমূর্তি উজ্জল হবে। তারপর সে নামবে আসল কাজে। দাদার এসব পরিকল্পনা শুনে একা একা বাড়ির পথ ধরল চিন্তাহরণ। বউ দরজায় বসে বসে ঝিমুচ্ছে। দুহাতে ধরে বউকে তুলল চিন্তাহরণ। তারপর বিছানায় গিয়ে চাপাস্বরে সাধুবাবার গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল দুজন।

এদিকে আগের সাধুবাবার চাইতে এই সাধুবাবার নামডাক আরও বেশি ছড়িয়েছে। শুন্যে বসে থাকে বলে কথা। এই গ্রামে একের পর এক সাধুর আগমন ঘটায় আশে পাশের দশগ্রামের মধ্যে ‘পবিত্র’ হিসাবে পরিচিত হয়েছে। তবে সাধুবাবা দিনে কাউকে দেখা দেন না। মন্দিরের দরজাও বন্ধ থাকে। রাতে কালীমন্দিরে দশগ্রামের মানুষের ঢল নামে। টাকা আর খাদ্যদ্রব্যে ভরে যায় মন্দির। বিশাল আয়োজন করে দেবতার ভোগ হয়। সাধুবাবার একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে হৃদয়হরণ বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। সেই দর্শনার্থীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করে। সবাই তার কথা শুনে। চিন্তাহরণ শুধুই ভাবে এমন একটি দিন তারও এসেছিল। তবে সেটা ছিল ভন্ডসাধু। হারামজাদা বউয়ের দিকে নজর দিয়েছিল। কিন্তু ইনি তো একদম অরিজিনাল। চুরিবিদ্যা সাধনা করে সাধু হয়েছেন। কথাবার্তাও তেমন বলেন না। খাওয়ার প্রতি ও তেমন কোন আগ্রহ নেই। চিন্তাহরণ মনে মনে ভেবে রেখেছে সাধুবাবাকে বলে সেই ভন্ডসাধুর শাস্তির ব্যাবস্থা করবে। অবশেষে ধীরে ধীরে মানুষের আগ্রহও কমতে লাগল। আসলে সবাই ভাবল যে সাধুবাবা যেহেতু আছেনই সেহেতু প্রয়োজন পড়লে তার কাছে যাওয়া যাবেই। মন্দিরে খাদ্যদ্রব্যের পরিমাণ কমতে লাগল। এরই মাঝে হৃদয়হরণ জায়গা-জমি কিনে বাড়ি বানিয়েছে। সে এখন বিবাহের চিন্তা করছে। এদিকে চিন্তাহরণের বউয়ের আটমাস চলছে। সে বাইরের গ্রামে ঘুরে ঘুরে যা পায় তাতে ঠিকমত চলছে না। ওসব গ্রামে জেলে-মাঝি-মেথরেরা থাকে। তাদের ঘরে আছেই কি আর নেবেই কি! চিন্তাহরণ তাই আবার গ্রামে চুরি করার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু কার বাড়িতে হামলা করবে সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেল সে। হৃদয়হরণ এখন এই গ্রামের নিশিকর্মের হর্তাকর্তা। দুজনে যদি একই বাড়িতে ঢোকে তবে তো ধরা পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু চিন্তাহরণ কিছুতেই ধরা পড়ার ঝুঁকি নিতে চায় না। ঐ সামান্য মাছ চুরি ব্যাতিত নিজ গ্রামে কখনো সে ধরা পড়েনি। সেও তো নতুন বউ খেতে চেয়েছিল বলে। ডাক্তারের বউ হাফ ডাক্তার হলে তো চোরের বউয়ের হাফ ডাকাত হবার কথা। অতঃপর চিন্তাহরণের বউ একটা সুন্দর উপায় বের করল। এক অমাবশ্যা রাতে চিন্তাহরণ নিশ্চিন্ত মনে বড়পুকুরপড়ে দাদার বাড়িতে প্রবেশ করল। দাদা তখন অন্য কোথাও নিশিকর্মে ব্যাস্ত। চিন্তাহরণ সিঁদ কেটে ঘরে প্রবেশ করল। হৃদয়হরণের সম্পত্তির পরিমাণ দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ ! উড়ন্ত সাধুর দয়ায় সে এখন বিরাট ধনী। এত সম্পদ থাকার পরও সে চুরি করে কেন তা ভেবে পেল না চিন্তাহরণ। সে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। পুকুরপাড়ে হঠাৎ শিয়াল ডেকে উঠায় তার ঘোর কাটল। তাড়াতাড়ি হাত লাগাল কাজে। বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখা নগদ কিছু টাকা, চুরি করে আনা একজোড়া সোনার বালা আর একটি ভারী পিতলের বাটি ব্যাতীত আর কিছু নেয়ার সাহস হলো না চিন্তাহরণের। চুরিকৃত দ্রব্যগুলি নিয়ে বনের ধারে একটি গাছের নিচে পুঁতে রেখে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরল চিন্তাহরণ। তার এই সফল অভিযানের কথা শুনে বউও ভীষণ খুশি হল। ডাকাতবাড়ির মেয়ে বলে কথা। ওর বাবা চিন্তাহরণের মত একটা ছিঁচকে চোরের সাথে মেয়ের বিবাহ দিতে পুরোপুরি সম্মত ছিলেন না। কিন্তু চিন্তাহরণ দিন দিন তার যোগ্যতা প্রমাণ করে চলছে। অনাগত সন্তান ডাক্তার হবে নাকি পিতার যোগ্য উত্তসূরী হবে এটা নিয়ে চাপাস্বরে আলোচনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল দুজনে। উড়ন্ত সাধুর কথা তাদের কল্পনাতেও আসল না।

পরদিন সকালেই ছোটভাইয়ের বাড়িতে হামলা করল হৃদয়হরণ। চিন্তাহরণের উঠোনে দু-ভাইয়ের মাঝে মল্লযুদ্ধ বেঁধে গেল। প্রতিবেশীরা মজা করে দুই চোরের যুদ্ধ দেখতে লাগল। কেউ কেই মন্তব্যও করতে লাগল “গ্রামের মানুষের আর চোর ধরার দরকার নেই, দুই চোর নিজেরাই মারামারি করে মরবে !” অনেকেই এতে সায় দিল। একজন প্রস্তাব করল দুটোকে ধরেই পিটুনি দিতে। কিন্তু পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলো তারা। অতঃপর চিন্তাহরণের বউ রান্নাঘরের বটি নিয়ে রণক্ষেত্রে প্রবেশ করায় মল্লযুদ্ধের ইতি ঘটল। প্রতিবেশীদের দুয়োধ্বনি শুনতে শুনতে ঝেড়ে দৌড় দিল হৃদয়হরণ। যাবার আগে শাসিয়ে গেল যে সাধুবাবার কাছে বিচার দেবে। চিন্তাহরণ বারান্দায় বসে হাঁফাতে লাগল আর তার বউ বটি উঁচিয়ে প্রতিবেশীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব প্রদান করতে লাগল। আশঙ্কা আর আনন্দে সারা দিন কেটে গেলেও সন্ধ্যায় কালীমন্দিরে ডাক পড়ল চিন্তাহরণের। উড়ন্ত সাধুবাবা তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। দুরু দুরু বুকে চিন্তহরণ হাজির হল কালীমন্দিরে। শুন্যে বসে সাধুবাবা ধ্যান করছেন। তার সামনে হাত জোড় করে বসে আছে হৃদয়হরণ। চিন্তাহরণ দাদার থেকে একটু দুরত্ব বজায় রেখে জোড়হাত করে বসল। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে সাধুবাবার ধ্যান আর ভাঙ্গে না। চিন্তাহরণের ভয় করছে। সাধুবাবা যদি তাকে শাস্তি দেন! পায়ে ধরে, মাথা কুটে হলেও বাঁচতে হবে। চিন্তাহরণের কান্না চলে আসল। সাধুবাবা এবার ধ্যান ভঙ্গ করে গম্ভীর কন্ঠে বললেন
-তোরা দুইভাই আমার আদেশ পালন করিসনি।
হৃদয়হরণ তড়িঘড়ি করে বলল “বাবা, আমি নই আমার ভাই। সে আমার সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
-তোদের উপার্জন থেকে আমার প্রাপ্য অংশটুকুও দিসনি।
হৃদয়হরণ এবারও বলল “সাধুবাবা, আমি নিয়মিতই দিয়েছি, কিন্তু আমার ভাই হয়ত দেয়নি !”
-তোদের ব্যাবহারে আমি ক্রুদ্ধ হয়েছি। তোরা আমার ক্রোধের আগুনে পুড়ে মরবি !
দু’ভাই এবার গড়াগড়ি করে কাঁদতে লাগল। দুজনেই নিজেদের দোষ স্বীকার করে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে লাগল। সাধুবাবা তাদের কান্নাকাটিতে সন্তুষ্ট হয়ে উভয়কেই শান্ত হতে বললেন। দুই ভাই আবার হাতজোড় করে বসল। সাধুবাবা ঘোষণা করলেন
-আমি তোদের শেষ সুযোগ দিচ্ছি। আমার নির্দেশ পালন না করলে ধ্বংস হয়ে যাবি তোরা !
দুই ভাই সাধুবাবার নির্দেশ শোনার জন্য ব্যাকুল। তাদের অবাক করে সাধুবাবা বললেন “আজ থেকে যা করবি,দুজনে একসাথে করবি।” যা উপার্জন হবে তার অর্ধেক আমাকে দিয়ে বাকীটুকু দুজনে সমান ভাগ করে নিবি। নইলে আমার ক্রোধের আগুনে তোরা পুড়ে মরবি! এই আমার শেষ কথা!” দু’ভাই খুশিমনে এই প্রস্তাব গ্রহণ করল। সাধুবাবার সামনে দুজনে কোলাকুলি করে গলাগলি ধরে বাড়ির পথ ধরল। চৌকিদার এতক্ষণ ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে এই লীলাকীর্তন দেখছিল। দু’ভাই বিদেয় হবার পর সে সাহস করে সাধুবাবার সামনে এসে বসল। সাধুবাবা চোখ বুজে বসে আছেন। চৌকিদার তার সামনে হাতজোড় করে বসতেই সাধুবাবা বলে উঠল “কি বলবি বল ?” চৌকিদার হাতজোড় করে বলল “সাধুবাবা একটা মহাবিপদ হয়ে গেল যে !”
-কি মহাবিপদ ?
-আজ্ঞে এই দুইভাই অত্যন্ত ধুর্ত। অনেক চেষ্ঠা করেও এদেরে ধরতে পারিনি। এদিকে আমার চাকুরি যায় যায় অবস্থা। একটা উপায় বাতলে দিন না সাধুবাবা।
-রাতে না ঝিমিয়ে পাহারা দিবি। তবেই চোর ধরা পড়বে।
চৌকিদার একটু লজ্জা পেয়ে বলল “সে তো জানি সাধুবাবা, পুরোটা রাত একা একা ঘোরাফেরা করা কি সহজ কম্ম?” আগে একজনে চুরি করত; এখন যদি দুজনে এক হয়ে যায় তবে তো এই গ্রাম গড়ের মাঠ হয়ে যাবে!” কিছু বলুন না সাধুবাবা, চুপ করে থাকবেন না।
সাধুবাবা কিছু বললেন না। নিজের অজান্তেই তার মুখ দিয়ে ‘চুকচুক’ শব্দ বেড়িয়ে আসল !
২৪/১২/২০১৩

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত