আজ ১৪ই ফ্রেব্রুয়ারি, রাকার সাথে আজ আমার প্রথম দেখা হতে যাচ্ছে। রাকা বলেছে বিকাল পাঁচটায় ভার্সিটি ক্লাস শেষ করে দেখা করবে, সে রামপুরা ব্রিজে দাঁড়িয়ে থাকবে।
রাকা ইস্ট ওয়েস্টে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যায়ন করছে। লেখাপড়ার ব্যপারে রাকা একদম অন্যদের চেয়ে আলাদা। ভার্সিটিতে ক্লাসের পরে অন্যরা বসে গল্পে সময় কাটালেও, রাকাকে দেখা যায় লাইব্রেরীর টেবিলে বসে চোখ দিয়ে রেখেছে কোন বইয়ের পাতাতে।
সেই দুপুরে ঘুম থেকে উঠে আমার প্রাণচাঞ্চল্য বেড়ে গেছে। ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে মাথায় একটা গান বাজছে ” আয়ে হো মেরি জিন্দেগী মে তুম বাহার বানকে ; আমি বিকালের অপেক্ষা করতে করতে গোসল করলাম, সাধারণত দুপুরের খাবারদাবার খাই একটু বিকাল হইতে হইতে দুপুরের সূর্য্য গড়িয়ে পরে যখন। তখন প্রচন্ড গরম পরলেও দক্ষিণের বাতাসে জানালার পর্দা স্থির রাখতো না।
রাকার সাথে আমার কথা শুরু হয় ইস্ট্রাগ্রামের মাধ্যমে, রাকা একটা ছবি পোষ্ট করে। সেই ছবিটা আমার খুব পছন্দ হয়। পছন্দের পেছনের কারণটা আমি রাকাকে ব্যক্তিগতভাবে জানাই যে, ছবিটা দেখে আমার একজন প্রিয় ফিল্মমেকারকে মনে পরে। রাকা আগ্রহ করে জিজ্ঞাসা করলে, আমি রাকাকে বললাম ‘একজন ইরানি ফিল্মমেকার আব্বাস কিয়ারোস্তামি’র কথা। রাকা খুব উৎফুল্ল চিত্তে জানান দিলেন, আমি ওনাকে চিনি, খুবই চেনা। তারপর রাকা কিয়ারোস্তমির ফিল্মের গল্প করলেন। কিয়ারোস্তমি আমাদের দুইজনের পরিচয়ের শুরুতে ঐভাবে কথা বলাইয়া দিলেন।
বিকাল সারে পাঁচটায় আমার ফোন বেজে উঠলো, রাকা নওরিন। ফোন ধরতেই ওপাশের নারী কন্ঠ বলে বসলো, সরি আপনাকে অনেকক্ষন অপেক্ষা করালাম। তার পরের কথা আমিই টেনে নিয়ে ইতস্তত করতে করতে বললাম, আপনাকে সরি বলতে হবে না, আমিও যথা সময়ে পৌছাইনি। আপনি দশ মিনিট আমার জন্য দাঁড়ান আমি আসছি।
আমি রামপুরা পুলিশ বক্সের সামনে গিয়ে রাকাকে কল দিলাম, হ্যালো! রাকা, আমি এইযে আপনাদের পুলিশ বক্সের এখানে দাঁড়ানো, খয়েরি রংয়ের পোলো টিশার্ট পরা। রাকা ব্রিজের ঐদিকে অপেক্ষা করছিলো। আমি দূর থেকেই রাকাকে চিনলাম। মুখে কালো মাস্ক পরা, গোল ফ্রেমের চশমা, কপালে মাঝারি সাইজের কালো টিপ। এই এক ঝলকে দূর থেকেই দেখে নিলাম। আমার ধারণা রাকা আমাকে তখনও দেখতে পায়নি, আমি পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়ালাম। রাকা ঠিক এসে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে হাই দিলো।
আমি বললাম, হাই রাকা! আমরা কোথাও বসি? রাকা বললো, আপনার যেইখানে খুশি চলুন। তখনো দুপুর গড়িয়ে বিকালের শান্ত রোদ, তাপে রাস্তাঘাটে মানুশের চলাফেরা, যানবাহনের কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ গনগন করছে। আমি বললাম চলুন রাস্তা পার হয়ে হাতিরঝিলে গিয়ে বসি, ওদিকটাতে বাতাস থাকবে আর গাছে গাছে বসন্তের ফুলও থাকবে।
রাকার হাঁটাচলা খুবই শান্ত, ছোট ছোট ধীর কদমে চলেন। এই ব্যস্ত নগরের ছুটে চলার গতি তাকে খুব একটা বিচলিত করে না। তাই রাস্তা পার হতেও কোন তাড়াহুড়া নেই।
আমরা হাতিরঝিলে পানির পাশে লম্বা সিঁড়ি করা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম, খুব কাছাকাছি হয়ে। মাঝে রাকার ব্যাগটা রেখে। আমি বললাম রাকা, আমি ভ্যাক্সিন নিয়েছি, করোনা আমার থেকে ছড়াবে না। রাকা হেসে দিয়ে বললো, আপনি ভ্যাক্সিনে বিশ্বাস করেন? আমি বললাম তা করিনা। রাকা হাসতে হাসতে মুখের মাস্ক খুলে ফেললো, আমি দেখলাম রাকার চিবুকে ঘাম জমে আছে। রাকা চুল বাধা খুলে হালকা মাথা ঝাঁকা দিয়ে চুল গুলা আলাদা আলাদা করে নিলো। রাকা বললো, সেদিন চুল ছোট করে কাঁধ অব্দি করিয়েছি। আমি ডান হাতে কপাল থেকে চুল সরিয়ে কানের পেছনে আটকে দিয়ে বললাম, বাতাসে আপনার চুল উড়ছে, সুন্দর লাগতেছে। রাকা আবারও হেসে মাথা নামাইলো, মাথার মাঝ বরাবর সিঁথির দুই পাশ থেকে চুল এসে মুখ আড়াল করে দিলো।
ঝিলের চারিদিকে সাঁঝবাতিগুলো একে একে জ্বলে উঠছে, আকাশে পাখিদের নিরুদ্দেশ উড়াউড়ি দেখে আমার মনে পড়তে লাগলো একটা গানের লাইন “নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা বুঝিবা পথ ভুলে যায়” আমাদের সামনে ঝিলের পানিতে বোট চলছে, ঐ পারের রাস্তায় প্রাইভেট গাড়িগুলো তাদের হেডলাইট জ্বালিয়ে ছুটছে, পেছনের লাল বাতি জ্বালিয়ে ধীর হয়ে যাচ্ছে। আবারও ছুটছে।
সন্ধ্যা হওয়ার পর রাকাকে বললাম, চলুন কফি খাইতে যাই। তারপর হাঁটতে হাঁটতে রাকা হোচট খাইলে পরে, আমি হাত ধরতে ধরতে বললাম রাস্তায় খুব সাবধানে চলতে। আমরা রামপুরা থেকে রিকশায় উঠবো, তারপর তালতলাতে যাবো। রিকশায় আগে রাকা উঠে বসলো, তারপর আমি উঠতে গিয়ে রাকার কোমরে বসে পরতে নিয়ে, রাকাকে বললাম সরি, কোমরে লেগেছে?
রিকশায় রাকা আমাকে গল্প শুনাচ্ছিলো, গরমে হাত ঘামায়, হাত বের করে দেখাইলো। আমি ডান হাতে ওর বাম হাত ধরে দেখলাম, তুলার মত নরম হাতও এমন সুন্দর করে ঘামে ভেজে! আমি হাত ধরে বসে থাকলাম।
কফি শপের এই সময়টা খুব ব্যস্ত, সারাদিনের কর্মবিরতি দিয়ে একটা দিনের শেষ। রাকা কোল্ড কফি আর আমি ব্ল্যাক কফি অর্ডার করলাম। কফি শপের ছোট্ট টেবিলটায় আমরা মুখোমুখি বসে রইলাম। রাকা কিছু বলছে না, শুধু বসে দেখছে। আমি বললাম রাকা, আমি কফি নিয়ে আসি আপনি বসুন, রাকা হাসলো। কফিতে চুমুক দিয়ে, ক্যাফেইনের সাথে চিনির পরিমাণ জানতে চাইলাম, রাকা খুব সরল উত্তর করলো, এক কাপ চায়ে তিন চা চামচ চিনি মিশিয়ে পান করা অভ্যাস।
কফি শেষে বের হয়ে আমরা হাঁটছিলাম পল্লীমার ফুটপাত ধরে, পল্লীমার এই রাস্তার দুইপাশে হালকা গাছগাছালি আছে বড় সাইজের। পুরাতন পাতারা ঝড়ে পরে আছে রাস্তায়, আর নতুন জন্মানো সবুজ কচিপাতা জড়িয়ে আছে ডালপালায় গায়ে। সাদা ল্যাম্পের আলোর নিচের পাতারা বাতাসের ধাক্কায় নাচানাচি করছে। এই ছায়া পড়ার দৃশ্য অনেক সময় ধরে দেখতে থাকলে চোখে একরকম ধাঁধা তৈরী করে। কখনো স্থির, কখনো তার নিচ দিয়ে হেঁটেচলা মানুশের শরীরে, কখনোবা বাতাসের সুরে দুলতে থাকে।
রাকা হাতিরঝিলের গাছে গাছে ফুটে থাকা হলুদ-লাল-কমলা রঙয়ের ফুল এবং ঝড়ে পড়া পাতার কথা বলছিলো একটা বড় গাছের গায়ে হেলান দিয়ে। রাকার জন্ম এই শহরেই, শৈশব কৈশোরকে ঘিরে রেখেছে এই নগরের কোলাহল। যেখানে সকাল হলে দেখা যায় মানুশের হুড়মুড় করে ছুটে চলা, রাস্তায় যানবাহনের পাল্লা দিয়ে লড়াই, ধুলাবালি আর শব্দদূষণের শহর। এই শহরের নানা বৈচিত্রের শ্রেণী পেশার সাথে যুক্ত মানুশের কথা ভাবে রাকা। শাহবাগের ফুল বিক্রেতা, ফুলবাড়িয়ার ঐদিকে জীর্ণদশা ঘোড়াগুলির কথা, টিএসসিতে ফুলের মালা বিক্রি করা পথশিশুদের কথা, নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানের কথা, শাহবাগের আজীজ মার্কেটের বইবিতানগুলির কথাও। রাকা ভবিতব্য হয়ে বলছিলো, এ সবকিছু ফেলে, সে একদিন চলে যাবে সুদূর প্রবাসে পিএইচডি করতে। আমি রাকার কথা শুনছিলাম ওর হেলান দেয়া গাছের সাথে আমার বা হাতে ভর দিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
রাকা আমাকে বললো, শুনছেন! আমার ভ্রমচ্যুতি হলে আমি বললাম হ্যাঁ শুনছি, একটা পাখি ডাকছে কু কু শব্দে। এই পাখির নাম জানেন? হুম, কোকিল।
বসন্তের এই শান্ত বাতাসে আমরা আরো কিছুটা পথ একসাথে হেঁটে বেড়াইলাম। আমি আমার গল্প বললাম আর রাকা তার ভবিষ্যত দিনগুলির প্রস্তুতি নিতে থাকার কথা জানাইলো। আমরা দেখলাম একটা বাড়ির গেটে দেয়াল জুড়ে হালকা খয়েরি রঙয়ের বাগানবিলাস ফুলে ছেয়ে আছে।
আমি ভাবছিলাম, আমাদের পৃথিবীতে না থাকার সময়গুলোতেও এই একটি সন্ধ্যা আরো অজস্র ফাগুন নিয়ে ফিরে ফিরে আসবে।
ছবিঃ তানভীর মুহাম্মদ